ল্যাবেরেটরি রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের লেখা। ল্যাবেরেটরীর রবীন্দ্রনাথ একটু অচেনা-গল্পটিতেও একাধিক দ্বন্দের উপস্থিতিতে মূল বক্তব্য বেশ জটিল। এ গল্পটাই এমন যে দশজন পরিচালক দশটি ল্যাবেরেটরি বানালে দশটিই আলাদা সিনেমা হবে। নির্ভর করবে পরিচালক কোন রবীন্দ্রনাথকে গ্রহন করেছেন।
রাজা সেন যে এই দুর্বোধ্য অথচ চিত্তাকর্ষক গল্পটিকে চিত্রায়নের দ্বায়িত্ব নিয়েছেন, তাতে তাকে প্রথমেই সাধুবাদ জানাই। সিনেমাটির সংগীত পরিচালনা এবং চিত্রায়ন ও খুব ভাল। বাংলা সিনেমাতে এত উন্নত টেকনিক্যাল কাজ আগে হয় নি। রঞ্চিত মল্লিক, সব্যসাচী চ্যাটার্জী, অর্পিতা, রবীনা ট্যান্ডন চরিত্রগুলির সাথে মিশে গেছেন-সাহেব চ্যাটার্জি চরিত্রটি বুঝেছেন কি না, সেই নিয়ে একটু সমস্যা আছে। তবে খুব খারাপ কিছু না-রেবতীভূষন হিসাবে তাকে পাশ মার্কই দেব।
এবার সিনেমার প্রসঙ্গে আসি। প্রতিটি সাহিত্য সৃষ্টির একটি ঐতিহাসিক পটভূমিকা আছে। ল্যাবেরেটরির পটভূমিকা বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকের কোলকাতা-যখন সেখানে বিজ্ঞান চর্চার জোয়ার এসেছিল। মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বোস, স্যার রামনদের মতন বিজ্ঞানীরা কোলকাতার ওয়ার্কশপ থেকে যন্ত্র বানিয়ে বিশ্বের বিজ্ঞানে সেরা স্থান দখল করেছিলেন। সেই বিজ্ঞান চর্চার মধ্যে পরাধীনতার গ্লানি দূর করার এক বিশাল জাতিয়তাবাদি মনোভাব কাজ করেছে। নন্দকিশোর সেই বিজ্ঞান সমাজের উজ্জ্বল প্রতিনিধি। রাজাসেনের নন্দকিশোরের সাথে রবীন্দ্রনাথের নন্দকিশোরের পার্থক্য নেই। কিন্ত সমস্যা আছে গল্পের নায়িকা সোহিনীর চিত্রায়নে।
এই সোহিনী চরিত্রটি রবীন্দ্রনাথের ইন্টেলেকচুয়াল মানস কন্যা। সে জানে ধর্ম পুরুষতান্ত্রিক-সে আমাদের লোকায়েত সংস্কৃতির পুরুষতান্ত্রিকতা নিয়ে সজাগ-অথচ তার বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ করবে না। বরং দরকার হলে সেও ধর্মকে কাজে লাগিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধি করবে। এই বিধবাটির দায়বদ্ধতা তার প্রয়াত স্বামীর জীবনাদর্শের প্রতি-তার সৃষ্ট ল্যাবেরেটরী যার মূর্ত প্রতীক।
সোহিনীর চরিত্রের শেষের দিকটি রাজাসেন ঠিকই ধরেছেন-কিন্ত সমাজ সংস্কার এবং ধর্ম নিয়ে যে রবীন্দ্র সোহিনী,
তা আরো বেশী জটিল। রাজাসেন সেই জটিলতা কাটিয়ে চরিত্রটিকে কিছুটা সরল করেছেন হয়ত মার্কেটের কথা ভেবেই। বিশেষত গল্পটিতে আস্তিকতা বনাম নাস্তিকতা , ধর্মের নানান রূপ নিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য ডায়ালোগ আছে-পরিচালক সেসব বিতর্ক এরিয়ে গেছেন। গিয়ে সোজা ফোকাস টেনেছেন মা বনাম মেয়ের দ্বন্দে-সেই দ্বন্দটার ভিত্তি কিন্ত একটা অযৌত্বিকতা-তা হচ্ছে সোহিনীর কাছে ঐ ল্যাবেরটরীটাই তার জীবনের একমাত্র খুঁটি। কবির কাছে এটি অস্তিত্ববাদি বনাম যুক্তিবাদি দ্বন্দ। রাজা সেন এটি সোহিনীর মাধ্যমে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। যদিও গল্পটিতে এই ব্যাপারে অধ্যাপক মম্মথ চৌধুরীর ভূমিকা ছিল সর্বাধিক।
রবীন্দ্রনাথের গল্পে দুটো ফ্লো আছে-একটি অধ্যাপক চৌধুরী বনাম সোহিনী, অন্যটি সোহিনী বনাম নীলা। রাজাসেন দ্বিতীয়টি নিয়ে যত্নবান -প্রথমটিতে গল্পের অনেক ডায়ালোগ কেটেছেন। হয়ত সময়ের জন্যে। তবে এই জন্যে রবীন্দ্রানুরাগীরা অসন্তুষ্ট হতে পারেন।
তবে বলিউড শরৎচন্দ্রের উপন্যাস গুলোর যে ভর্ত্তা বানায় রাজা সেন তা করেন নি। এটা যথেষ্ট সিরিয়াস সিনেমা।
আমি সস্ত্রীক ভালোই উপভোগ করেছি। সিনেমাটিক লিবার্টি রাজাসেন যে খুব একটা বেশী নিয়েছেন তাও না। আসলেই গল্পটা এত জটিল অতগুলো ডাইমেনশন একটা সিনেমাতে নিলে অনেকের ভাল নাও লাগতে পারত। সেই অর্থে বাজার এবং রবীন্দ্রনাথ এই দুই ব্যালান্সিং বিমের ওপর টিপে টপে পা রেখে রাজা সেন উৎরেছেন। এবং আমার বেশ ভালোই লেগেছে।
সিনেমাটি গোটা বিশ্বের দর্শক ডিঙ্গোরাতে ( www.dingora.com) দেখতে পারেন। অনলাইন নেটফ্লিক্সের চেয়েও ভাল ভিডিও কোয়ালিটি ডিঙ্গোরাতে। বাংলা সিনেমার এত ভাল অনলাইন ভিডীও ডিঙ্গোরা দেখাচ্ছে-আমি বাঙালী হিসাবে কৃতজ্ঞ।
আপনার সরস লেখার প্রশংসা না করে পারছিনা। একটা ব্যাতিক্রমধর্মী লেখা দিলেন পাঠককে।
এই জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। :rose2: