শ্রুতি মাধুর্য নির্মাণে শব্দের পরিশিলিত ও পরিমার্জিত ব্যবহার বাক্য বিন্যাসে যে দোলা বা ঢেউয়ের সৃষ্টি করে তার নাম ছন্দ। বুনন ও উচ্চারণের তারতম্যে নির্মিত শব্দ-স্রোত আবার নানা রকম আবহ তৈরী করে, বাংলায় যাদের বলা হয় স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত। পয়ার, অমিত্রাক্ষর, মন্দাক্রান্তা, মহাপয়ার ইত্যাদিও এই তিন ছন্দের সম্প্রসারিত ফলাফল। বাংলা ছন্দ, যার উৎপত্তি ভাষার জন্মলগ্ন থেকে এবং প্রথম লেখ্য রূপের নিদর্শন চর্যাপদে, তার ক্রম-বর্ধমান বিকাশ ঘটে পাঁচালী, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলী, মৈমনসিংহ-গীতিকা তথা মধ্যযুগের হাত ধরে ক্লাসিক্যাল বা মহাকাব্যিক ও রোমান্টিক পর্যায় পেরিয়ে আধুনিক ও উত্তরাধুনিক কালে।
মনে রাখা দরকার যে একেক ভাষার ছন্দ একেক রকম। কারণ প্রত্যেক ভাষারই স্বতন্ত্র উচ্চারণ রীতি আছে। এই রীতি মেনেই ছন্দ বিকশিত হয়। তবে ঐতিহাসিক ভাবে সত্য যে স্বরবৃত্ত ছন্দ বা এই ধরণের উচ্চারণ মাধুর্য, ইংরেজীতে যা অনেকটা আয়াম্বিক ছন্দের মতো, সব ভাষায়ই তার উৎপত্তির সাথে সাথে বেড়ে ওঠে। কথা বলা, ছড়া কাটা, শ্লোক তৈরী ও স্বগত উচ্চারিত গান ইত্যাদির ভেতর দিয়ে এটি অনেকটাই অনায়াস লব্ধ।
ক্রমোন্নতি এবং বিকাশের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যালোচনা করার লক্ষ্যে বাংলা ছন্দের বিকাশকে নিন্মোক্ত পাঁচটি পর্বে ভাগ করা যায়:

১। অদি পর্ব
২। মধ্যযুগীয় পর্ব
৩। ক্লাসিক্যাল পর্ব
৪। রোমান্টিক পর্ব
৫। আধুনিক ও উত্তরাধুনিক পর্ব

আদি পর্ব:
এই পর্বের ছন্দ নিয়ে আলোচার আগে যাঁর কথাটি উঠে আসে তিনি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। কারণ তিনিই চর্যাপদের আবিষ্কারক। এশিয়াটিক সোসাইটির পুঁথি উদ্ধার প্রকল্পের আওতায় ১৯০৭ সালে তৃতীয় বারের মতো তিনি নেপাল যান। এ পর্যায়ে যে কয়খানা পুঁথি তিনি খুঁজে পান তার একটির নাম “চর্যাগীতিকোষ”। তিনি বলেন, “উহাতে কতকগুলি কীর্তনের গান আছে ও তাহার সংস্কৃত টীকা আছে। গানগুলি বৈষ্ণবদের কীর্তনের মত, গানের নাম চর্যাপদ।” ১৯১৬ সালে এইসব খুঁজে পাওয়া পুঁথি দিয়ে তিনি যে গ্রন্থটি প্রকাশ করেন তার নাম “হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা”। এই গ্রন্থেই “যর্চাগীতিকোষ”-এর কবিতাগুলো সংযোজিত হয় “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়” নামে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য পদগুলির নামেই এইসব কবিতা পরিচিতি পায়। অর্থাৎ চর্যাপদই হয়ে ওঠে এযাবত পাওয়া বাংলা ভাষার প্রথম গ্রন্থবদ্ধ নিদর্শন। রচিত প্রতিটি পদের উপরে ছিলো নির্দিষ্ট রাগের উল্লেখ। ধারনা করা হয়, এগুলো মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাধনার গান। কথিত আছে বৌদ্ধ আচার্যরা সাধারণ মানুষের জন্য ধর্ম প্রচার করতেন। অতএব তাঁদের ভাষা অর্থাৎ চর্যাপদের ভাষা অনেকাংশেই সাধারণ লোকের মুখের ভাষা বলে প্রতিষ্ঠা পায়। এগুলি যে বাংলায় রচিত তার যথেষ্ট প্রমাণাদী থাকা সত্ত্বেও অসমীয়া উড়িয়া ও মৈথিলী ভাষার বিশ্লেষকেরা মনে করেন যে এই পদগুলি তাদের ভাষারই আদি রূপ। তবে সুখের কথা হলো চর্যাপদের রচনাকাল, আনুমানিক অষ্টম থেকে দ্বাদশ অব্দে বাংলা ছাড়া উল্লিখিত অন্যান্য ভাষা বিকাশের তেমন নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর “সমস্তই বাংলা বলিয়া বোধ হয়”কে শিরোধার্য করে চর্যাপদকে বাংলায় রচিত কবিতার লিখিত প্রথম নিদর্শন হিসেবে মেনে নিতে আমাদের কোনো অসুবিধা থাকার কথা নয়।
চর্যাপদের ছন্দ বিশ্লেষণ বেশ দুরূহ কাজ। কারণ তখনো বাংলা ছন্দের আঁটোসাঁটো রূপ ফুটে ওঠেনি। তবে, বাংলা ভাষার উপর সংস্কৃত ও প্রাকৃতের প্রভাব থাকার ফলে ধারণা করা হয় যে ওই ভাষাদ্বয়ের তখনকার প্রচলিত ছন্দ, প্রাচীন মাত্রাবৃত্ত, প্রাথমিক ভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এ-ও অসম্ভবত নয় যে বহুকাল কবিতার কথ্যরীতির প্রচলন থাকায়, বাংলা কথ্য ভাষার সাথে ওইসব ভাষার প্রভাব একত্রিত হয়ে শব্দবন্ধের স্রোত বা দোলা আলাদা রূপ ধারণ করে। অন্যদিকে এই পর্বের কবিরা সাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসায়, ওইসব মানুষের সাহচর্যে লৌকিক ছন্দ স্বরবৃত্তের সাথে প্রাচীন মাত্রাবৃত্তের মিশ্রণে দানাকৃত হয় এক নতুন ছন্দ, যার নাম মিশ্রবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্ত। ফলতঃ চর্যাপদে যেমন স্বরবৃত্তের আভাস মেলে, প্রাচীন মাত্রাবৃত্তের চাল পাওয়া যায়, তেমনি অক্ষরবৃত্তের পয়ারও দেখা যায়। অন্যদিকে ধর্মীয় আচার যাপন যদিও চর্যার বিশেষ প্রতিপাদ্য বলে ধারনা করা হয়, তথাপি সাহিত্যের প্রাণ চঞ্চলতায় পদগুলি পরিপূর্ণ।
সাতটি দীর্ঘধ্বনি যেমন, আ ঈ ঊ এ ও ঐ ঔ প্রাচীন মাত্রাবৃত্ত ছন্দে মাত্রা সম্প্রসারণের কাজ করতো। অর্থাৎ এদের প্রত্যেককে দুই মাত্রার মূল্য দেয়া হতো। সাথে সাথে যুক্তাক্ষর জনিত বদ্ধস্বরকেও দুই মাত্রা দেয়ার প্রচলন ছিলো। প্রাকৃত ও অপভ্রংশে যেমন এই নীতিমালা আস্তে আস্তে লোপ পেতে থাকে, তেমনি বাংলায় এই নিয়ম ভেঙে বেরিয়ে আসার প্রবণতা চর্যাপদের কালেই শুরু হয়।

১.
আলে গুরু উএসই সীস।
বাকপথাতীত কহিব কীস।।
(কাহ্নুপাদ)

আধুনিক উচ্চারণকে অনুসরণ করলে দেখা যায় যে এই পঙ্ক্তি দু’টি রচিত হয়েছে স্বরবৃত্তের দু’টি করে নির্ভুল পর্ব দিয়ে। ‘সীস’ এর সাথে ‘কীস’ এর নিখুঁত অন্ত্যমিলও রাখা হয়েছে।

পর্ববিন্যাস:

আলে গুরু/ উএসই সীস।/
বাকপথাতীত/ কহিব কীস।।/

কাঠামো:
৪ + ৪
৪ + ৪

এমন নিখুঁত ছন্দ রীতি অবশ্য এই কবিতাটির সর্বত্র বিরাজিত নয়। তবে ছন্দটিকে এর ভেতর দিয়ে দানাকৃত হতে দেখা যায়। পুরো কবিতাটি পড়া যাক।

জো মনগোএর আলাজাল।
আগম পোথী ইষ্টামালা।।
ভণ কইসেঁ সহজ বোলবা জাঅ।
কায় বাক চিঅ জসু ণ সমাঅ।।
আলে গুরু উএসই সীস।
বাকপথাতীত কহিব কীস।।
জেতবি বোলী তেতবি ঢাল।
গুরু বোক সে সীসা কাল।।
ভণই কাহ্নু জিণরঅন বি কইসা।
কালেঁ বোব সংবোহিঅ জইসা।।

পর্ববিন্যাস:

জো মনগোএর/ আলাজাল।/
আগম পোথী/ ইষ্টামালা।।/
ভণ কইসেঁ সহজ/ বোলবা জাঅ।
কায় বাক চিঅ/ জসু ণ সমাঅ।।
আলে গুরু/ উএসই সীস।/
বাকপথাতীত/ কহিব কীস।।/
জেতবি বোলী/ তেতবি ঢাল।
গুরু বোক সে/ সীসা কাল।।
ভণই কাহ্নু জিণ/ রঅন বি কইসা।
কালেঁ বোব সংবো/ হিঅ জইসা।।

দ্বিতীয়, তৃতীয়, সপ্তম ও অষ্টম লাইনগুলি স্বরবৃত্তের মতো মনে হয় না। আলোচনার সুবিধার্থে এদের আলাদা করে নেয়া যাক।

ভণ কইসেঁ সহজ/ বোলবা জাঅ।
কায় বাক চিঅ জসু/ ণ সমাঅ।।
ভণই কাহ্নু জিণ/রঅন বি কইসা।
কালেঁ বোব সংবো/হিঅ জইসা।।

এদের অনেকটা অক্ষরবৃত্তের (পয়ার) আট-ছয় মাত্রার বুনন বলে ধরা যায়, যদিও প্রত্যেক পঙ্ক্তির শেষ পর্বটিতে ছয় মাত্রা সংযোজত হয়নি। তবে বহুদিন ধরে ছন্দবিসারদগণ যে চিন্তাটি করে আসছেন তার ভিত্তিতে তৃতীয় লাইনটি বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।

ভণই কাহ্নু জিণ/রঅন বি কইসা।

আমরা যদি ধরে নেই যে “কাহ্নু” শব্দটি তিনমাত্রা এবং “রঅন” শব্দটি দুই মাত্রা ধারণ করেছে, তাহলে এই পঙ্ক্তিটি অনায়াসে আট-ছয় পর্বের পয়ার তৈরী করে। আদতে ঘটনাটিও তাই ঘটেছে। দীর্ঘধ্বনি ও যুক্তাক্ষর জনিত বদ্ধস্বর-এর (যাকে দীর্ঘধ্বনির আওতায় আনা হয়) প্রসারণ ও হ্রস্বধ্বনির সংকোচন। যেহেতু “কাহ্ন” শব্দের “কান” যুক্তাক্ষর জনিত দীর্ঘধ্বনি, একে দেয়া হয় দুই মাত্রা; (তবে চর্যাপদের সময় “কান” বা এই জাতীয় বদ্ধস্বরকে আলাদা করার প্রচলন শুরু না হওয়ায় “হ্ন”কে-ই দু’মাত্রা দেয়া হতো।) অন্যদিকে “রঅন” শব্দের মাঝে “অ” হ্রস্বধ্বনি, একে সম্পূর্ণ ভাবে সংকোচন করে “রঅন”কে দেয়া হয়েছে দুই মাত্রা। অর্থাৎ “ভণই কাহ্নু জিন”=আট; এবং “রঅন বি কইসা”=ছয়। যদিও এই চার পঙ্ক্তির সর্বত্র এই নিয়ম সমান ভাবে ব্যবহৃত হয়নি, তথাপিও চর্যাপদের পয়ার তৈরীতে দীর্ঘধ্বনির প্রসারণ ও হ্রস্বধ্বনির সংকোচন ছিলো একটি গ্রহণযোগ্য উপায়।

২.
উঁচা উঁচা পাবত তহিঁ বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গিবত গুঞ্জরী মালী।।
উমত সবরো পাগল সবরো না কর গুলী গুহাডা তোহৌরি।
(শবরপাদ)

পর্ববিন্যাস:

উঁচা উঁচা/ পাবত তহিঁ/ বসই সবরী/ বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ/ সবরী গিবত গুঞ্জরী/ মালী।।
উমত সবরো/ পাগল সবরো/ না কর গুলী/ গুহাডা তো/হৌরি।

প্রথম ও তৃতীয় পঙ্ক্তি স্বরবৃত্তের মতো, কিন্তু দ্বিতীয় পঙ্ক্তিকে মনে হয় অক্ষরবৃত্তে (পয়ারে) রচিত। সেক্ষেত্রে আট-আট-দুই কিম্বা আধুনিক কালের আট-দশ এর বুনন হিসেবে ধরে নিলে সমস্যা এই যে প্রথম পর্বে নয় মাত্রা ও দ্বিতীয় পর্বে এগার মাত্রা পাওয়া যায়। কিন্তু সংকোচন ও প্রসারণের নিয়মে দেখলে “পরহিণ” শব্দের হ্রস্বধ্বনি “হি”কে সংকুচিত এবং “গুঞ্জরী” শব্দের দীর্ঘধ্বনি “গুণ”-এর মাত্রা বাড়িয়ে শব্দ দু’টিকে যথাক্রমে তিন ও চার মাত্রা ধারণের ক্ষমতা দেয়া হলে উত্থিত সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। “মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ”=আট; এবং “সবরী গিবত গুঞ্জরী মালী”=দশ।

অন্যদিকে সবগুলো দীর্ঘধ্বনির প্রসারণ ও হ্রস্বধ্বনি সংকোচন হলে দাঁড়ায়: ( ‘-’ দিয়ে প্রসারণ ও ‘[ ]’ দিয়ে সংকোচন দেখানো হলো।)

উঁচা- উঁচা- পা-বত তহিঁ/ বসই সবরী- বা-লী-। ১২+১১
মোরঙ্গি- পী-চ্ছ- পর[হি]ণ/ সবরী- গিবত গুঞ্জ-রী- মা-লী-।। ১২+১৬
উমত সবরো- পা-গল সবরো-/ না কর গুলী- গুহা-ডা- তো-হৌ-রি। ১৫+১৬

পঙ্ক্তি শেষে মাত্রা সংখ্যা দেখানো হয়েছে, যা কোনো অবস্থাতেই যুক্তিপূর্ণ মনে হয় না। অতএব এই কবিতাটি প্রাচীন মাত্রাবৃত্তে রচিত নয়। চলতি বাংলার সাথে সংস্কৃত ছন্দের মিল রেখে, কখনো মেনে, কখনো উচ্চারণকে প্রধান্য দিয়ে যে কবিতা রচনা করা হয়েছে সেখানে সংকোচন প্রসারণের নিয়ম সর্বদা মানা হয়নি। তাছাড়া একই কবিতার সব পঙ্ক্তিতে একই ছন্দ প্রয়োগের চেষ্টাটিও হয়তো অনেকটা শিথিল ছিলো। তবে পরপর দুই পঙ্ক্তির ছন্দ একই রাখার চেষ্টা দেখা যায়।

৩.
তিঅড্ডা চাপী জৌইণি দে অঙ্কবালী।
কমলকুশিল ঘাণ্টি বরহু বিআলী।।
জোইনি তঁই বিনু খনহিঁ ন জীবমি।
তো হুম চুম্বী কমলরস পীবমি।।
(গুণ্ডরীপাদ)

পর্ববিন্যাস:

তিঅড্ডা চাপী জৌইণি/ দে অঙ্কবালী।
কমলকুশিল ঘাণ্টি/ বরহু বিআলী।।
জোইনি তঁই বিনু খ/ নহিঁ ন জীবমি।
তো হুম চুম্বী কম/ লরস পীবমি।।

পঙ্ক্তিগুলিতে দীর্ঘধ্বনির প্রসারণ ও হ্রস্বধ্বনির সংকোচন ক্রিয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে আট-ছয় এর চমৎকার পয়ার নির্মিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে

সংকুচিত হয়েছে:
তিঅড্ডা শব্দে অ ১ম পঙক্তি
জৌইনি শব্দে ই ১ম পঙক্তি
জোইনি শব্দে ই ৩য় পঙক্তি

প্রসারিত হয়েছে:
তিঅড্ডা শব্দে ড্ড ১ম পঙক্তি
জৌইনি শব্দে জৌ ১ম পঙক্তি
অঙ্কবালী শব্দে ঙ্ক ১ম পঙক্তি
চুম্বী শব্দ ম্বী ৪র্থ পঙক্তি

লক্ষণীয়, ‘তিঅড্ডা’ ও জৌইনি’ শব্দের সংকোচন ও প্রসারণের পরেও প্রত্যেকেই তিন মাত্রা বহন করার ক্ষমতা পেয়েছে; কিন্তু এই প্রক্রিয়া ব্যতিরেকে প্রত্যেক অক্ষরকে একমাত্রা করে দিলেও এই ফল পাওয়া যায়। সম্ভবত এই চিন্তা থেকেই পরবর্তী কালে অক্ষরবৃত্তের মাত্রা গণনার রীতি পরিবর্তীত হয়। তাছাড়া সব দীর্ঘধ্বনির প্রসারণ না ঘটিয়ে শুধু যুক্তাক্ষর জনিত দীর্ঘধ্বনির প্রসারণ বোধ করি এখান থেকেই শুরু হয়।

৪.
ধামার্থে চাটিল/ সাঙ্কম গঢ়ই।
পারগামিলোঅ/ নিভর তরই।।

পুচ্ছতু চাটিল/ অনুত্তরসামী।।
(চাটিল্যপাদ)

পয়ারে ছয়-ছয় এর চাল। ধরণা করা অসঙ্গত নয় যে ছয় মাত্রার এই প্রথম পর্বগুলি কালক্রমে অক্ষরবৃত্তের আটমাত্রা এবং অবস্থা বিশেষে মাত্রাবৃত্তের ছয় মাত্রায় পরিণত হয়েছে।

৫.
এক সো পদমা চৌসঠঠী পাখুড়ী।
তহিঁ চড়ি নাচ অ ডোম্বী বাপুড়ী।।
(চর্যাপদ-১০)

প্রাচীন মাত্রাবৃত্তে বিন্যাস:

এ-ক সো পদমা-/ চৌসঠঠী- পাখুড়ী-।
তহিঁ চড়ি না-চ অ/ ডো-ম্বী- বাপুড়ী-।।

প্রচীন মাত্রাবৃত্তে আট-আট এর চাল। ‘-’ দিয়ে মাত্রা প্রসারণ বুঝানো হয়েছে। আট-আট এর এই বুননকে প্রাকৃত ছন্দে পাদকুলক বলা হতো। তবে এই পঙ্ক্তিদ্বয়ে চলতি বাংলার মিশ্রণ জনিত উচ্চারণের প্রভাব পাওয়া যায়। প্রাচীন মাত্রাবৃত্তের সাথে কথ্যভাষার (স্বরবৃত্তের) মিলন মিশ্রবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্তের পথ খুলে দিতে থাকে।

৬.
অধরাতি ভর/ বিকসিউ।
বতস জোইণী তসু/ অঙ্গ উহ্নসিউঃ।।
(ভুসুকুপাদ)

সংকোচন প্রসারণের ধারা না মেনে দ্বিতীয় পঙ্ক্তিটি অক্ষরবৃত্তের আট-ছয় হলেও প্রথম পঙ্ক্তি রচিত ছয়-চার মাত্রার পর্বে। অবশ্য প্রথম পঙ্ক্তিটি স্বরবৃত্তের চার-চার এবং মাত্রাবৃত্তের ছয়-চার ধরে নিলেও অসুবিধে হয় না, যদিও মাত্রাবৃত্তের নতুন চাল পরিপূর্ণ হতে অনেকগুলো শতাব্দী লেগে যায়।

৭.
আলিএঁ কালিএঁ/ বাট রুন্ধেলা।
তা দেখি কাহ্ন/ বিমলা ভইলা।।
(কাহ্নপাদ)

‘রুন্ধেলা’কে ‘রুনধেলা’ এবং ‘কাহ্ন’কে ’কানথো’ হিসেবে প্রসারিত করে প্রতি পর্বে ছয় মাত্রার চাল আনা হয়েছে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে লৌকিক স্বরবৃত্ত ও প্রাকৃত প্রভাব যুক্ত প্রাচীন মাত্রাবৃত্তের মিশ্রণে অক্ষরবৃত্তের পয়ারগুলো চর্যাপদে দানাকৃত হয়ে উঠছিলো। মাত্রার সংকোচন ও প্রসারণের মতো কৌশলী চিন্তাও ধারণ করেছিলেন ওই সময়ের কবিরা। যদিও বেশ কিছু ত্র“টিপূর্ণ বুনন চোখে পড়ে, তথাপি অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে এই পর্বের কবিরা ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক। ‘জালা-মালা’, ‘সীস-কীস’, ‘বালী-মালী’, ‘গয়ই-তরই’, ‘কইসা-জইসা’, ‘ মোহে-বোহে’ ও ‘জুঝঅ-বুঝঅ’ ইত্যাদি মিল তৈরীর মাধ্যমে তাঁদের মেধাসম্পত চর্চার উৎকৃষ্ট প্রমাণ রেখেছেন। সাথে সাথে সমৃদ্ধতর করে তুলেছেন বাংলা কবিতার শুরুর প্রহরটিকে।
(চলবে)