(গল্পের আগের নোট : আমি ভাই পুরা আস্তিক মানুষ। আস্তিক মানুষের ভাবনায় শ্রমণ শব্দটি প্রিয়। আস্তিকের গল্প পড়ছেন ধরে নিয়েই পড়বেন। না পড়লে সমস্যা নাই। আস্তিক মানুষের জয় হোক। )
………………………………………………………………………………………………………………………………

গারবেজ ক্যানের উপর বসে থাকি। পা ঝুলিয়ে। শির শির করে বাতাস আসে। চুলের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
হাঁটুর উপরে কাগজ রেখে আঁকিবুকি করি।একটা লম্বা আঁকাবাঁকা রেখা আঁকি। কী একটা পাতা। গোল গোল সুতোর মতো মেঘ আঁকি। আর ফুট ফুট তারা। ঝিকমিক করে ওঠে। কী হাওয়ায় দোলে।

দুএকজন লোক একটু দাঁড়িয়ে যায়। ভ্রু কুচকে দেখে। আবার চলে যায়।

এ সময় চেলসি নামের একটি মেয়ে এসে দাড়িয়েছে। হাসি হাসি মুখ। ছবির মতো। কিন্তু হাসি নেই। নিঃশব্দ।
অনেক ক্ষণ পরে গাল ফুলিয়ে বলে, আমাকে এঁকেছ? এঁকেছ আমাকে? আমার ছবিটা?

আমি আঁকছি এলানো ঢেউয়ের রেখা। তার উপরে অনেক উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখি। পাখিটার একটা লেজ দেই। এতো বড়ো লেজ- আকাশ আর জল ভাইবোন গলাগলি করে হাঁটে। একটা মাছও লাফিয়ে উঠেছে।

চেলসি চলে যায়। পিছনে ফিরে দেখেনি- মাছটির চোখে একটি চাঁদের চাদের পাহাড়। আর কখনো চেলসিকে দেখিনি। পাহাড়ের গায়ে বুনো ফুল। চেলসি চলে গেছে অন্য কোথাও। অন্য কোন কারো কাছে। কোনো গাছের কাছে। অথবা নদীর কাছে। সত্যিকারের পাহাড়ের ধারে।

কে একজন ডাকাবুকো মেয়ে কি মহিলা কোমরে হাত দিয়ে দাড়াল। সোজা করে বলল, তুমি চেলসির ছবিটা আঁকনি? আঁকনি?
-কে চেলসি?
-আমার মেয়ে। তুমি আঁকনি ওর ছবি? লাল হয়ে উঠেছে মুখটি। রাতজাগা চোখ। চুলে ধুলোর কাগজ।
আমি আঁকছি- পাহাড় থেকে একটি পাথর ছিটকে পড়ছে নিচে। আলোর রোশনাই উছলে উঠেছে চারিদিকে। আর কে যেন গান গাইছে, আমি এমনি এসে ভেসে যাই..

আমার কাগজটি থাবা দিয়ে নিয়ে চলে গেল। যে যায় – সে আর ফেরে না।
অনেকদিন পরে এক বুড়ি এসে বসল আমার গারবেজ ক্যানটির পাশে। আমি লিখছি-

ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি
চাম কাটে জমিদার
ধেয়ে এলো দামোদর-

বুড়িটা বসে রইল অনেক দুরে তাকিয়ে। চুলগুলো সাদা। চামড়া কুঁচকে গেছে।
বলল, ওগো ভালমানুষের ছেলে। চেলসি খুব হেসেছিল তোমার ছবিটা পেয়ে। খুব হেসেছিল।
-হেসেছিল কেন?
-ওর ছবিটা তুমি একেঁছ ঠিক ঠিক। কিভাবে জানলে ওকে?
-হেসেছিল কেন?
– হেসেছিল একদিন। সেই একবারই হেসেছিল। চাঁদের আলোর মতো। হাওয়ার গানের মতো। নদীর স্রোতের মতো। প্রাণের স্রোতের মতো হেসেছিল। তুমি ঠিকই চিনতে পেরেছ ওকে, হে ভালমানুষের ছেলে।

বুড়ি কথা বলে পাতা ঝরার মতো করে। কথার মধ্যে বেদনা লুকিয়ে বোনে। ফিসফিস দীর্ঘশ্বাস। বলে, এলসাকে দেখতে চেয়েছিল হাসি শেষ করে। এলসাকে পাবে কোথায়। ও দিনমানে ঘোরে পার্কে পার্কে। রাতে শেকড় ছড়িয়ে দাড়িয়ে থাকে দীর্ঘ ওক গাছের মত। শিশির ঝরে টুপটাপ। পাতা থেকে ডালে। ডাল থেকে হাওয়ায়। হাওয়া থেকে ঘাসে। ঘাস থেকে মাটিতে। ঠিক সকালে গাছটি তো আর গাছ থাকে। পাতা। ঝরা পাতা হে।

বুড়ি বলে, ওর বাবাতো মাতাল। ওটা আসল বাবা কিনা কে জানে। হা হা করে হাসে। হু হু করে কাঁদে । ফোস ফোস করে ঘুমায়। একটি পোকার মতো। খোলস পাল্টানো শুয়োপোকার মতো। চেলসি হাসতে হাসতে এলসাকে দেখতে চেয়েছিল। বলতে চেয়েছিল, মা। বাবা। নাকি বলতে চেয়েছিল, ভালবাসি। বলতে চেয়েছিল, আহ্? তুমি জান ও কাঁদতে কাঁদকে কী বলতে চেয়েছিল? কী বলার ছিল ওর?

আমি পার্কের পুরনো জুবুথুবু গার্বেজ ক্যানের উপরের বসে থাকি। একা একা। মাথা নিচু করে লিখি। লিখি-

ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি
চাম কাটে জমিদার
ধেয়ে এলো দামোদর

বুড়িটা নেই। চলে গেছে। অথবা বুড়িটা ছিল না। একটা হুসহুসে হাওয়া ছিল। অথবা পাতা ঝরার শব্দ। মাটির শব্দ। জলের শব্দ। নৈঃশব্দের শব্দ।