আমার বড় মেয়ে ইয়েন ভূমিষ্ঠ হয়েই দুনিয়ার তাবৎ জিনিষ শিখে ফেলে।

ওকে চিত করে শুইয়ে দিলাম। চোখে মেলে তাকাল। বলল – আমার নাম ইয়েন, তুমি আমার বাবুনি। ওর মাকে বলল – তুমি আমার মামনি।

তারপর আকাশের দিকে তাকাল। বলল – ওটা আকাশ। আকাশের রং নীল। একটা চড়ুই পাখী বসল বারন্দায়। বলল – ওটা চড়ুই পাখী। বৃষ্টি পড়ল। বলল – বৃষ্টি পড়ছে। এখনই বিদ্যুৎ চমকাবে। আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ে। মাঠে ফসল হয়। পাহাড় দেখল, পর্বত দেখল। ব্রহ্মপুত্র নদ দেখল। বলল – এটা ব্রহ্মপুত্র নদ। বর্ষায় জল দক্ষিনে বইতে শুরু করল। বলল – জলের গতি দক্ষিনে।

একদিন মন্দিরে গেল। দূর্গার অনেক গুলো হাত দেখল। তার দুটো। বলল – দূর্গার অতগুলোই হাত থাকতে হয়। গনেশের গলার উপরে হাতীর মাথা। একটুও বিচলিত না হয়ে বলল – দেবতাতো! ঠিক আছে। বলল – ওইযে ছোট্ট একটি ইঁদুর, ওটাতে চড়েই গনেশ সারা বিশ্বব্রহ্মান্ড ঘুরে বেড়ায়। লক্ষ্মীর বাহক পেঁচা, সরস্বতীর হাঁস, কার্ত্তিকের ময়ূর। সব কিছু দেখল। জানল। আমাদেরকে কোন দিন একটি প্রশ্নও করল না।

কিন্তু অসুবিধায় পড়লাম আমাদের ছোট মেয়েটাকে নিয়ে। ওর নাম ছ্যাড়া। জন্ম থেকে সে কিছুই শিখেনি। বড় হয়েছে। ওর বয়স এখন বাইশ। কিন্তু কিছু দেখেনি। একদিন চোখ খুলল। চিনল না আমরা কে। আকাশের দিকে তাকাল। চিনল না ওটা আকাশ।
– দিনের বেলা সূর্য্য উঠে কেন?
– আকাশ ওখানে কেন?
– রংটা নীল কেন?
– গাছ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে কেন?
– গাছে পাতা-ফুল কেন হয়?
– পাখী কেন উড়ে বেড়ায়?

চারিদিকে হঠাৎ করে অজস্র নতুন জিনিষ। হাজারটা প্রশ্ন।
untitled

আমার দীর্ঘায়িত ছাত্রজীবনের বন্ধু সুমিত এসেছে Boulder, Colorado থেকে। স্ত্রী মল্লিকা, ছোট ছেলে রিক। এখন তেরতে। নয় বছর পর কলেজ স্টেশন। রিকের হোম টাউন। হিউস্টনে কী কী নতুন হয়েছে তাও দেখবে। শুনেছে স্বামী নারায়ণের মার্বেলের মন্দির হয়েছে। রাজস্থান থেকে হাজার হাজার পাথরের মূর্তি এসেছে। ওগুলোকে পর পর বসিয়ে বিরাট মন্দির তৈরী করেছে। তাজমহলের ঝিকিমিকি এখানে দেখা যায়।

হিউস্টন হিমালয় রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ। ইয়েন এল। সাথে অহিন্দু(?) স্বামী। জে কুমার। রাজপুত। শৈবাল এল ছ্যাড়াকে নিয়ে। তারপর স্বামী নারায়ণ মন্দির ভ্রমণ। মন্দির প্রাংগনে জুতো খুলে বেদীতে উঠে গেছি। শৈবালরা পেছনে। কোথায় পার্ক করছে কে জানে। আমি সেলফোনে হ্যালো বলছি। সুমিত আর রিকের পড়নে সিল্কের সোনালী রঙ্গের লুঙ্গি উঠে গেছে। আমার পেছনে ঘাড়ে একটা হাত পড়ল। স্বেচ্ছাসেবীর। অনেক কিছু এক সাথে। আমি হতভম্ব। কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকেও বুঝি লুংগি দিচ্ছে পড়তে। ঘুরে দাঁড়িয়েছি। বলল – No cellphone. ভারি বিরক্ত হলাম। – কেন?
– এটাই নিয়ম।

বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না – নিয়মের খ্যাঁতা পুড়ি।
swaminarayanপূন্যার্থীরা জুতা-স্যান্ডেল সামাল দিচ্ছেন। ছবিঃ রিক

ছ্যাড়া-শৈবাল বেদীতে প্রবেশ করেছে। যথারীতি জুতো-স্যান্ডেল নীচে। এক মহিলা নাকি রক্তদান করে মন্দিরে এসেছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। ইমার্জেন্সী সার্ভিস এসে গেছে।
emergencyইমার্জেন্সী ভেহিকল দাঁড়িয়ে। ছবিঃ রিক

ইমার্জেন্সী ভেহিকল দুরে দাঁড়িয়ে। ক্রু ছুটে আসছে। মূমূর্ষূ রোগিণী। হাতে ইমার্জেন্সী গীয়ার। ওদেরও জুতা খুলতে হবে নাকি? কোনটা বেশী জরুরী? রুগিনীর জীবন? নাকি জুতো খুলা? আমার ভুল ভাংগল। সবার উপরে (মানুষ নয়) দেবতা সত্য। তাহার উপরে কেহ নাই। তুচ্ছ মানব জীবন। দেবতার সাথে মানুষের তুলনা? হাজার পূণ্যার্থী এখানে আসে। জন্ম-মৃত্যু দেবতার হাতে, দু-একটা মরলে কী যায় আসে তাতে! হায়রে মূর্খ ব্যাটা নৃপেন সরকার!

হাতে walki-talki. ওগুলোও ওরা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। আমি বাংলাদেশ-ভারত থেকে এসেছি। সেলফোন বন্ধ করতে বলাতে বিরক্তি প্রকাশ করেছি। হায়রে সাদা চামড়া! তোরা মানুষ হলি না। যা কিছু বিদেশী তাকেই তোরা সন্মান দেখাস। গ্রহণ করিস। ট্রেনিং মোতাবেক তোদের কাজ করার কথা। এক চুলও এদিক-ওদিক করার নিয়ম নেই। কিন্তু ধর্মের কাছে তোরা নতজানো। তোদের নিয়ম অচল, ট্রেনিং বাতিল। তোদের ছাড় দেওয়ার সীমা নেই। ধৈর্য্যেরও সীমা নেই।

ছ্যাড়া্র প্রশ্ন – সুমিত, রিকের পড়নে লুংগি। অনেক মেয়েদেরও। বললাম – ওরা শর্ট পড়ে এসেছে। হাফ ন্যাকেড। দেবতার অবমাননা হয়। দেবতাদের লজ্জাবোধ আছে, মানুষের নাই। তাই স্বেচ্ছাসেবীরা দেবতাদের লজ্জা নিবারণ করেছে।

ছিলিংএর তলা থেকে একটি ঘন্টা ঝুলানো। আমি লক্ষ্য করিনি। কিন্তু ছ্যাড়া করেছে। প্রশ্ন – ওটা বাজিয়ে দিচ্ছে কেন? আমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলাম – দেবতারা ঘুমিয়ে থাকে। এদের প্রনাম এবং প্রার্থনা বৃথা নষ্ট হয়ে যাবে যে!

ছ্যাড়ার বুদ্ধি আছে। বলল – তাই বুঝি শব্দ করে জাগিয়ে দিচ্ছে?

আমি বললাম – ঠিক তাই।

কিন্তু এভাবে প্রশ্ন করতে থাকলে আমি ভয়ানক বিপদে পড়ব ভেবে আমার গায়ে জ্বর এসে গেল।

হিউস্টন দূর্গাবাড়ী – বাঙ্গালীদের বিরাট মন্দির। সামনে বিশাল লেক। আর এক পাশে স্পোর্টস complex. মন্দিরের ভিতরে আছে শিবলিংগ। আমাকে নিশ্চয় প্রশ্ন করবে – ইহা কী জিনিষ?
untitled1ছবিঃ ডঃ আলী আজাদ চৌধূরী

আমি কী উত্তর দেব এই প্রশ্নের? মাঝখানে দন্ডায়মান জিনিষটি শিব নামক এক দেবতার বিশেষ একটি অংগ। ইহাকেই হিন্দুরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। চেয়ে দেখ, ইহার উপর পুষ্পস্তবক এবং চন্দন শোভা পাচ্ছে। আবার দেখ জিনিষটি স্থাপিত দেবী পার্বতীর বিশেষ আর একটি অঙ্গের উপর।

তার পাশেই আছে কালীর ভয়াল মূর্তি। পড়নে একটি সূতাও নেই। মাথার চুল থেকে নখ পর্য্যন্ত নগ্ন। কী বাহারী দৃশ্য! গায়ে কাপড় নেই কিন্তু মাথায় সোনার মুকুট, নাকে নথ, কানে সোনার দুল, কব্জিতে সোনার অলংকার। এক হাতে খড়্গ, এক হাতে মানুষের মাথা, এক হাতে চক্র আর এক হাতে অভয় বাণী। মানুষ মেরে কেটে মাথা দিয়ে মালা পড়েছেন গলায়। কাটা হাত দিয়ে কোমড়ে পড়েছেন কোমড়বন্ধ। মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে এক বিঘত লম্বা জিহবা। ইনি হলেন দেবী! যার হাতে অভয় বাণী। মাটিতে লুটায়ে ভক্তরা করিছে প্রণাম।

kaliছবিঃ আকাশ মালিক

এই ছবিটা ভিন্ন। অভয়ের বাণী নেই। ইন্টারনেটে খুজলে হাজার রকমের ছবি পাওয়া যাবে।

সুমিতের সাথে স্বামীনারায়ণ মন্দির ভ্রমণ আমার মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। হিউস্টন মন্দির প্রতিপালকেরা আমার ভয় কিছুটা লাঘব করেছেন। চিত্র দেখুন। নীল শাড়ী দিয়ে লজ্জাহীনা কালীর সব কিছু ঢেকে দিয়েছে। তবে কি প্রতিপালকেরা নিজেরাও লজ্জিত? তাহলে শিবলিংগটিকেও কেন ঢেকে রাখে না?
2010-07-25-kalipratima

টেক্সাস। ২৬ জুলাই ২০১০।