গত ২১ জুন দৈনিক ‘প্রথম আলো’তে প্রকাশিত একটি খবর হল–
‘এনি ওয়ান বাট ইংল্যান্ড’—ইংল্যান্ড বাদে আর যে কেউ। এ কথার অর্থ যাই হোক, স্কটল্যান্ড পুলিশের দৃষ্টিতে তা সাম্প্রদায়িকতা। স্কটল্যান্ডের এইচএমভি চেইন স্টোরের মুখপাত্রের দাবি, ‘স্কটল্যান্ডের ফুটবলভক্তরা চাইছে ইংল্যান্ড বাদে আর যে কেউ এবারের বিশ্বকাপ জিতুক। তাই আমরা আমাদের টি-শার্টে ও জানালায় এই কথা লিখেছিলাম। এতে মোটেও সাম্প্রদায়িকতার কিছু দেখি না!’ কিন্তু পুলিশ এ দাবি মানবে কেন? সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ পেয়ে তারা দোকান থেকে পোস্টার ও টি-শার্ট সরিয়ে নিতে মিউজিক ভিডিওর দোকান এইচএমভিকে বাধ্য করেছে। স্কটল্যান্ড এবার মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেনি। এএফপি।
ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে স্কটল্যান্ডের ফুটবলভক্তদের এমন ভাবনাকে যদি সাম্প্রদায়িকতা আখ্যা দেয়া হয় তবে আমরা —- আমিসহ আমার আশেপাশের লোকজন যে সাম্প্রদায়িক তাতে সন্দেহ পোষণ করারও অবকাশ নেই। কারণ বিভিন্ন বিষয়েই তো আমরা এমন মনোভাব লালন করে থাকি।

আমার এক পরিচিতজন বই পড়েন বলে নিজেকে পাঠক বলে প্রচার করেন। বাংলাদেশের অনেক জনপ্রিয় উপন্যাসিকদের এ বই সে বইয়ের নাম বলে আমার সাথে কথোপকথন চালাতে চান। আমি তখন নিজের অপারগতা প্রকাশ করি। কারণ তার মতে অত্যন্ত জনপ্রিয় বই দেখছি আমার পড়া হয়নি। তাছাড়া, সব পাঠকের যে একই ধরণের বইয়ে প্রতি আগ্রহ থাকার কথা নয় তা ও তাকে বুঝানোর অপচেষ্টা করে ফল পাওয়া যায়নি।
একদিন আমার হাতে পূরবী বসুর ‘নারী, সৃষ্টি ও বিজ্ঞান’ নামক বইটি। ঐ পাঠক আমাকে প্রশ্ন করলেন, উনি কি ভারতীয় লেখক?
আমি পালটা প্রশ্ন করলাম, কেন? কীভাবে বুঝলেন?
মানে এ লেখকের নাম শুনিনি , নারী এবং হিন্দু নাম।
হিন্দু নারী কোন লেখকের বাস ভারতেই হবে এ সরলীকরণকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করব?

আমি নিজে কি সাম্প্রদায়িক? এর উত্তর নিজের কাছে নিজেই খুঁজছি। ড্রাইভারের নামাজ পড়া নিয়ে কি আমার মধ্যে কোন রকম সাম্প্রদায়িক মনোভাবের উদয় হয়? আমি জানিনা। সচেতনভাবে না হলেও অবচেতনভাবে হয় কিনা তা পাঠক হয়ত ভাল ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। ঘটনাটি খুলেই বলি। অফিসের কাজে জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন অফিসে আমাকে সভায় অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন কাজে যেতে হয়। যেমন, জেলা প্রশাসক,সিভিল সার্জন, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা, জন স্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসে কাজ শেষ করে প্রায়শঃই গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকি, দেখি ড্রাইভার নাই। তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ। এভাবে ১০-১২ মিনিট অপেক্ষা করা নৈমিত্তিক ব্যাপার। কখনো ওই অফিসের সিঁড়ির কোনায় দাঁড়িয়ে আছি। ড্রাইভারও নেই, গাড়িও নেই। মিনিট দশেক পরে এসে বলে, দিদি, নামাজটা একটু পড়েই নিলাম। তখন আমার যে বিরক্তি তা কি সাম্প্রদায়িকতা প্রসূত?

সরকারী কর্মকর্তাদের অনুরোধে অনেক সময়ই আমার অফিসের গাড়িতে যথারীতি অফিসের নিয়মানুযায়ী ওয়েভার ফরম পূরণ করিয়ে তাদের মফঃস্বল থেকে ঢাকায় নিয়ে আসি। একদিন এক সরকারী কর্মকর্তা গাড়ী থামিয়ে আমার ড্রাইভারসহ আছরের নামাজ পড়ল। আবার যানজটের কারণে রাস্তায় দেরী হওয়ায় এশার নামাজের সময় হয়ে গেলে তাও পড়ল আমাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে। পূণ্যার্থী ড্রাইভার নামাজ পড়া নিয়ে সরকারী কর্মকর্তার সাথে বেশ অতিৎসাহী হয়ে উঠে। সে সরকারী ঐ কর্মকর্তার সাথে এতই আত্মিক টান, ভ্রাতৃত্ব অনুভব করে যে আমার অস্তিত্ব রীতিমত ভুলেই যায়। একে তো এসব নামাজীদের নামাজ কাজা না করার জন্যে দেরি করতে গিয়ে আমার ফেরার সময় কাজা হয়ে গেছে। আবার দ্বিতীয়ত ঢাকায় সন্ধ্যার পর রাত যত বাড়ে যানজট তত দীর্ঘ হয়। উপরন্তু গাড়িতে একজন হিন্দু নারীর পক্ষে মুসুল্লিদের সামনে এভাবে বসে থাকা, তাদের চোখের ভাষাকে উপেক্ষা করা যে কি দূরহ তা একমাত্র ভূক্তভোগীই জানে।
এমবতস্থায় অফিস তাকেসহ (ড্রাইভার) গাড়িটি যে আমার জন্যে বরাদ্দ করেছে তা স্মরণ ঐ ড্রাইভারকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া কি সাম্প্রদায়িকতার লক্ষণ?
আমি তো মানবিকবোধে আচ্ছন্ন একজন মানুষ হতে চাই, থাকতে চাই। আমি সংবেদনশীল মননের চর্চা করতে চাই, কিন্তু আমার পরিচিত পরিবেশ আমাকে এ থেকে বঞ্চিত করে। সংখ্যাগুরুর অনেক প্রতিনিধি আমাকে –আমার বোধকে বুঝে হোক না বুঝে হোক ঠকায়, তাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে হয়তো হীনমন্যতায় ভোগী। আর এ হীনমন্যতা থেকেই সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হয়।

বিভিন্ন অফিসে নারী পুরুষের সমতার আনার জন্যে নীতি রয়েছে। জেন্ডার পলিসি থাকা তো যে কোন সংগঠনের জন্যে সুস্থতার লক্ষণ। যদিও এর বাস্তবায়নে শুভংকরের ফাঁকি। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা নিরসনের কোন কাগুজে প্রচেষ্টাও নেই।