আমার কিছু জানার ছিল

আকাশ মালিক

‘ধর্মীয় মৌলবাদ নির্মূল করার বাস্তব উপায়’ বাতলায়ে বিপ্লব পাল মুক্তমনায় পরপর যে দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন তার অনেক কিছুই আমি বুঝি নাই। প্রথম লেখাটি ছিল ধর্মীয় মৌলবাদ নির্মূল করার বাস্তব উপায় আর দ্বিতীয়টি মৌলবাদ বিরোধি জন সংগঠন। পাঠকদের কাছ থেকে প্রচুর সাড়া পাওয়া গেল। খুব দ্রুতই সংবিধান লিখা, একাউন্ট খোলা, মেম্বার সংগ্রহ করা, চাঁদা কালেকশন করা, লেনিনের পথ ধরে জন সংগঠন করা, এমন কি নাম রাখারও প্রস্তাব এসে গেলো। মনেমনে বললাম, আমার সবকিছু জানার দরকার নাই, আমি না বুঝলেও চলবে। পরে দেখলাম, না বুঝার দলে আমি শুধু একা নই আমার মত আরো দু একজন আছেন। তাদের একজন বললেন-
‘একজন ধর্মবিশ্বাসী কীভাবে বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারে, আমি বুঝি না’।

অপরজন বললেন-
‘পরিষ্কারভাবে কুসংস্কারমুক্ত এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সংগঠন করতে হলে ধর্মে বিশ্বাসীদের সাথে নিয়ে কিভাবে করা যায় এটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না’।

যাকে নির্মূল করা হবে আগে তাকে তো চিনতে হবে। এত কিছু কথা, এত মন্তব্য শোনার পর আমি যদি বলি, ‘মৌলবাদ জিনিষটা কী আর মৌলবাদী কারা’ আমি সেটাই বুঝি নাই, লোকে বলবে সাতখন্ড রামায়ন পড়ে জিজ্ঞেস করছি সীতা কার বাপ। ১৪ কোটি মুসলমানের দেশ বাংলাদেশের কয়জন মুসলমান মৌলবাদী? পৃথিবীতে মৌলবাদ সমর্থন করে এমন মুসলমান কয়জন আছে? বাংলাদেশে ১৫০টা ইসলামী দলগুলোর কোন্ দলটি মৌলবাদী? কোন্ মুসলমান কোন না কোন ভাবে একটি ইসলামী দলের সমর্থক বা সদস্য নয়? ব্যক্তি জীবনে বিজ্ঞান ব্যবহার করেনা, বিজ্ঞানের খায়না, বিজ্ঞানের পরেনা, বিজ্ঞানের সুফল গ্রহন করেনা এমন ব্যক্তি জগতে কি একজনও আছে?

ভয়ে ভয়ে এতদিন জিজ্ঞেস করি নাই, এবার একটু সাহস পেলাম। সত্য কথা গোপন করায় কোন মহত্ব নেই। সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে আমি নিজেকে ধোঁকা দিতে পারিনা, তাই শুনতে যতই অবুঝ, অজ্ঞ বা বোকার মত শোনাক না কেন, আমার সত্য কথা বলাটা যদি কারো অপছন্দ বা বিরক্তির কারণ হয়, আমি আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

প্রথম প্রবন্ধটি (ধর্মীয় মৌলবাদ নির্মূল করার বাস্তব উপায়) পড়ে আমার মনে হলো, এই আলোচনা, এই প্রজেক্টের প্রায়োগিক পরিবেশ চাঁদের দেশে থাকতে পারে, দুনিয়ায় নেই। দুনিয়ায় কৃষ্ণ, যীশু, মুহাম্মদ হাজার হাজার বছর রাজত্ব করেছেন, তাদের অনুসারীগণ এমন অবুঝ শিশু নন যে তাদেরকে কলার ভেতর ট্যাবলেট ঢুকিয়ে খাওয়ানো যাবে। বিজ্ঞানের কল্যাণে কৃত্রিম উপায়ে ফসল ফলাতে পারলে মানুষ ধর্ম থেকে দূরে সরে যাবে কেন? আমি তো বরং উল্টোটাই দেখি। আমন, বুরো ধানের ফসল ধ্বংস হওয়ার পরে বিজ্ঞানের কল্যাণে ইড়ি ধানের উৎপাদন যত বেড়েছে, মানুষের আল্লাহ বিশ্বাস ততই বেড়েছে। ধানের মধ্যে মানুষ আল্লাহর মহিমা আবিষ্কার করেছে আর সেই আল্লাহর নৈকট্য পেতে তার সংবিধান কোরান খুলে পড়েছে এবং সেই অনুযায়ী কৃতজ্ঞতার নিদর্শণ স্বরূপ বিজ্ঞান নিয়ে টুইন টাওয়ারে ঢুকেছে, একসাথে আঘাত করেছে বাংলাদেশের ৫ শো টি যায়গায়। আগেই বলেছি আমার অনুমান, আমার বিশ্লেষণ ভুল হতে পারে, তাই সংশ্লিস্ট প্রবন্ধ থেকে কিছু কথা আর পাঠকের কিছু মন্তব্য তুলে ধরবো। দুজন পাঠকের মন্তব্য দিয়ে শুরু করা যাক-

‘আমার মনে হয় বাংলাদেশে এমন কিছু করতে গেলে ধর্মের কথা ভূলেও
সামনে আনা যাবেনা। মানুষের সেন্টিমেন্টে সামান্যতম আঘাত করলে কোন কাজই এগুবেনা’।

লেখক উত্তর দিলেন- ‘বিজ্ঞানে ত ধর্ম লাগে না। তাহলে ধর্মের কথা আসবেই বা কেন? আমি সেটাই ত বুঝি না’।

‘নিশ্চয়ই নাস্তিকতা নামের কোন ধর্ম প্রচারে এই সংগঠন নামবে না। বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ক সংগঠন আমাদের দেশে কম হলেও আছে, নুতন কিছু নয়। সংগঠন করতে হবে, সদস্য বানাতে হবে সবই বুঝলাম। তবে তার আগে কি ইস্যু নিয়ে কার্যক্রম ঠিক করবেন সেটার একটা শক্ত ভিত্তী দরকার নয় কি’?

লেখক উত্তর দিলেন- ‘নাস্তিকতা নিয়ে ভাবি না-কারন আসলেই নাস্তিকতা কোন ধর্ম না দর্শন না আমার কাছে। নাস্তিকতার প্রচারের ও আমি খুব একটা পক্ষপাতি না। প্রচার চালাতে হবে বিজ্ঞান মুখী চিন্তার’।

বুঝা গেল আমার মত আরো অনেকেই লেখার বিষয়বস্তু পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হন নাই।

এবার দেখা যাক লেখক কী কী বলেছেন-

যুক্তি তর্ক আবেগ দিয়ে কেও জিতে থাকে বা টিকে থাকে বলে জানি না।
যুক্তি দিয়ে মহম্মদকে নীচ এবং মহান-বিড়াল এবং বানর-মহৎ ও ক্ষুদ্র সবকিছুই প্রমান করা যায়। লাভ খুব বেশী হবে না।
(বাংলাদেশে টিভি চ্যানেলে) বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করলে কেন দেবে না। বিজ্ঞানের চোখ দিয়েই ধর্মকে দেখাতে হবে। মহম্মদ বা কৃষ্ণকে গালিগালাজ করাটা কোন পথ বা সমাধান না।
হিন্দুধর্ম দিয়ে মুসলমানদের সাথে দাঙ্গা বাধানো যায়, কিন্ত ইসলামিক মৌলবাদের সাথে যুদ্ধ করা যায় না। বিজ্ঞানের প্রসার ছারা আরত কোন গতি নেই।
সেই মুসলমান মোটেও সভ্যতার জন্যে ভয়ংকর নয়, যে ইসলামের নেগেটিভ দিকগুলি নিয়ে অবগত-এটা অন্য ধর্মের জন্যেও সত্য।
কারা মেম্বার হবার যোগ্য? যারা বিজ্ঞানের গবেষনা লদ্ধ জ্ঞানকে, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্যে একমাত্র পথ বলে মনে করেন। তিনি আস্তিক, নাস্তিক, কমিনিউস্ট যে কেওই হতে পারেন।
একজন ধার্মিকের বিজ্ঞান চেতনায় বিশ্বাসী হওয়া আটকায় না যদি তার ধর্ম বলতে সে মানবিকতাকে বেছে নেয়।
ধার্মিক মানে বিবর্তন বিরোধি তাও না।
সব ধার্মিক মানেই বিজ্ঞানের সাথে সংঘাত, সেটা আমি মানি না।
একজন ধার্মিকের বিজ্ঞান চেতনায় বিশ্বাসী হওয়া আটকায় না যদি তার ধর্ম বলতে সে মানবিকতাকে বেছে নেয়। নিজের ধর্মের প্রতি ক্রিটিকাল দৃষ্টিভংগী বজায় রাখে।
বিজ্ঞান চেতনার উন্মেষে প্রতিটা প্রগতিশীল মানুষেরই আমাদের সাহায্য চাই। আস্তিক নাস্তিক সেখানে সকলেই স্বাগতম। আজকে যদি আমি দাবী করে বসি সকলকে নাস্তিক হতে হবে, কারন আমি মনে করি তাহাই ইহজগতের জন্যে উত্তম বা ঠিক সেই কারনে আমি জোর করে নাস্তি্কতার প্রচার করি, সেটাও মৌলবাদের রূপ নেবে। এবং তার সাথে ইসলাম বা হিন্দুত্ববাদের কোন পার্থক্য থাকবে না।
শুধু ধর্মের কারনে কেও সন্ত্রাসী হয় না। এর পেছনে থাকে অনেক রাজনীতি অর্থনীতি শ্রেণীদ্বন্দ।
নাস্তিকতার প্রচারের ও আমি খুব একটা পক্ষপাতি না। প্রচার চালাতে হবে বিজ্ঞান মুখী চিন্তার।

বেশ ভাল ভাল কথা। আবেগ নেই, যুক্তি নেই, তর্ক নেই, ধর্ম নেই, ধর্মগ্রন্থের সমালোচনা নেই, কৃষ্ণ-মুহাম্মদকে গালাগালি নেই, হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা নেই,‌ নাস্তিকতার প্রচার নেই। এমন একটি সংগঠনে জগতের তাবত বিশ্বাসীরা সদস্য হতে আগ্রহী না হওয়ার কোন কারণ দেখিনা। লেখকের উপরোল্লেখিত এ সমস্ত বক্তব্য শুনে, খুশী মনে মডারেইট মুসলিম, উদারপন্থি, বিজ্ঞান সমর্থক, মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রযাত্রী আবিদ সাহেব লিখলেন-

বিপ্লব, এই কথাগুলোই কিন্তু আমি বহুদিন ধরে বলে আসছি। ভিন্নমত, সদালাপে এসব নিয়ে অনেক লিখেছি। বরং এই কথাটাই ইসলামের বিরুদ্ধাচারী অনেক লেখক মানেননা। আপনি এটা বিশ্বাস করেন দেখে ভাল লাগলো। – ধর্মীয় সন্ত্রাসের কারন প্রসঙ্গে আপনার মৌলিক অবস্থানের সাথে আমার মৌলিক অবস্থানের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে কিছুটা হলেও সামঞ্জস্যতা আছে, তা আশা করি আপনার চোখে পড়বে।

আমি ভাবলাম, এইতো ধর্মগ্রন্থ আর বিজ্ঞানের অপূর্ব সহাবস্থান, একই মোহনায় এসে ভাববাদ আর বস্তুবাদের কি মধুর মিলন। এবার মৌলবাদ পৃথিবী থেকে নির্মূল না হয়ে যায় কোথায়?

তারপর-
মেইন স্ট্রিম মিডিয়াতে নাস্তিকতাকে টানাঃ
ধার্মিক ব্যাবসায়ীরা অতিরিক্ত অর্থ মন্দির মসজিদে ব্যায় করে-আমরা লাইব্রেরী তৈরী করতে ব্যায় করব। মোদ্দাকথা এই নেটওয়ার্কিং টা দরকার। মুসলমানরা মুসলমানদের পাশে দাঁড়ায়-হিন্দুরাও দাঁড়াচ্ছে-নাস্তিকদের মধ্যেও এই সাপোর্ট সিস্টেমটা বানাতে হবে।
নাস্তিকদের ও ব্যাবসাতে নামতে হবে, যাতে এই সাপোর্টগুলো আনা যায়। অধিকাংশ বাঙালী নাস্তিকই সুখী পড়াশোনা করা চাকুরীজীবি লোক-এটা একটা বিশাল সমস্যা নাস্তিক মিডিয়া করার ক্ষেত্রে। কারন মিডিয়া চলে ব্যাবসা প্রমোট করতে-সেখানে নাস্তিকদের ব্যাবসা না থাকলে এই ধরনের মিডিয়া করা খুব কঠিন। আমি এই জন্যে প্রতিটা নাস্তিককে ব্যাবসায় নামার জন্যে উৎসাহিত করব।
কালচারাল আইডেন্ডিটি বাজে জিনিস। হিন্দু বা মুসলিম বলে পরিচয় দিলে সমাজ গ্রহন করে বেশী-কিন্ত সেটার বিকল্প হিসাবেই নাস্তিক সমাজ গড়তে হবে-যেখানে নাস্তিকরা তাদের প্রয়োজনে সাহায্য পাবে। নাস্তিক হওয়ার এই মুহুর্তে সামাজিক ইউটিলিটি শুন্য, বা নেগেটিভ-সেটাই নাস্তিকতার পথে বড় বাধা।
সব ধরনের ধর্মীয় আইন রাষ্ট্র থেকে বাতিল করে, সমাজ বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে সামাজিক গবেষনার মাধ্যমে নতুন আইন আনার দাবী জানাতে হবে।
ধর্মটা বিবর্তনের ফলে উঠে আসা একটা সামাজিক প্রোডাক্ট-যার প্রয়োজন ছিল। আজ তা নেই। তাই আস্তে আস্তে উঠে যাবে।
আমি আজ পর্যন্ত শুধু অসম্প্রদায়িক তাদেরই দেখেছি, যারা নাস্তিক-এবং বিজ্ঞানমুখী ও যুক্তিবাদি।
অভিজ্ঞতাই আমাকে শিখিয়েছে ধর্মীয় সহনশীলতার অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ।
সর্ব ধর্ম সত্য এবং সমান-এই কথাটা কিন্ত কোরান বলে না।
মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব বেশী কারন কোরান ভীষন ভাবেই একটি সাম্প্রদায়িক গ্রন্থ।

আমার শেষ জিজ্ঞাসা- মুসলমান আর মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরানের এই যে পরিচয় দিলেন, এর পর এই সংগঠনে আবিদ সাহেবের মত অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদ বিরোধী উদারপন্থি, কোরানে বিশ্বাসী মুসলমানদের অংশ গ্রহন এখনও কি আশা করেন?