পূর্ববর্তী পর্বের পর …
এই লেখাগুলো হয়তো ব্লগে দেওয়ার উপযুক্ত লেখা নয়, এগুলো আসলে আগামী বছর প্রকাশিতব্য মানব বিবর্তনের বইটাকে লক্ষ্য করে লেখার বিভিন্ন অংশ। আগের দু’টো পর্বে খুব হাল্কাভাবে এভুলেশনারী ডেভলপমেন্টাল বায়োলজী বা এভু ডেভু র বিষয়টা নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এখন এর ভিতরে ঢোকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। মানব বিবর্তনের ভিতরে ঢুকতে হলে অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা এবং আবিষ্কারের কথা বলতেই হবে, আর এ বিষয়ে বই লিখতে হলে টেকনিকাল কিছু বিশ্লেষণ করতেই হবে। মুক্তমনায় বিজ্ঞানের লেখা দিলে একটা লাভ হয়, আগ্রহী পাঠকের চিন্তা উদ্দীপক আলোচনা-সমালোচনা, প্রশ্নগুলো থেকে অনেক কিছু সংশোধন করে নেওয়া যায়। আশা করি এই পর্বগুলো ব্লগের জন্য একটু কঠিন হলেও পাঠকেরা তাদের মূল্যবান মতামত দিয়ে আগের মতই সহযোগিতা করবেন।
:line:
মাছের পাখনা থেকে মাটিতে চড়ে বেড়ানো প্রাণীদের পায়ের বিবর্তন নিয়ে আগের পর্বে আলোচনা করেছিলাম। এতদিন একে এক বিশাল ‘উল্লম্ফণ’ বা ‘বিশাল কোন ব্যাপার’ হিসেবে মনে করা হলেও এভু ডেভুর গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে আসলে এর মধ্যে তেমন কোন বড় ‘কারসাজি’র দরকার পড়েনি। এবারে চলুন আরেক ধাপ এগিয়ে যাই, দেখা যাক চোখের বিবর্তনের ধাঁধাটির সমাধানে এভু ডেভুর কোন ‘মারফতি ক্ষমতা’ কাজে লাগানো যায় কিনা। চোখ বিবর্তনবিরোধীদের কাছে খুব প্রিয় একটা অংগ – তারা প্রায়ই বলে থাকে ‘এত জটিল’ অঙ্গের উৎপত্তি ঘটতে হলে ‘‘সুপরিকল্পিত ডিজাইন’’ ছাড়া নাকি কোন গতি নেই! আসেলেই কি তাই? চলুন এভু ডেভুর জগতে ঘুরে আসি আরেকবার।
প্রাণী জগতে এত বিচিত্র রকমের চোখের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায় যে জীববিজ্ঞানীরা এর উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে বহুদিন ধরেই যেন হিমশিম খাচ্ছিলেন। ধরুন, মাছির পুঞ্জাক্ষির সাথে কি আমাদের চোখের তুলনা করা চলে? পোকামাকড়ের চোখ ৮০০ পার্শ্ববিশিষ্ট আর সেখানে মানুষের চোখ অনেক সরল এবং ক্যামেরার মত সম্পূর্ণ ভিন্ন দর্শনাভূতিতে কাজ করে[২]। যেখানে মাছির পুঞ্জাক্ষি মানুষের চোখের তুলনায় সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন পদ্ধতিতে কাজ করে, সেখানে তাদের সাথে আমাদের চোখের মিল না থাকাটাই তো যুক্তিযুক্ত, এবং তাইই মনে করে এসেছিলেন বিজ্ঞানীরা এতদিন! প্রকৃতিতে কত রকমের চোখই না দেখা যায় – মানুষসহ বিভিন্ন মেরুদন্ডী প্রাণীর চোখকে বলে ক্যমেরা চোখ, অক্টোপাসেরও ক্যামেরার চোখ আছে যা আবার বেশ ভিন্নভাবে কাজ করে! ওদিকে আবার কাঁকড়া বা বিভিন্ন আর্থ্রপডের আছে জটিল পুঞ্জাক্ষি, যেখানে ১০ থেকে ৮০ টা পর্যন্ত একক চোখের সমাবেশ দেখা যেতে পারে -এছাড়াও আছে একক লেন্সের ক্যামেরার মত চোখ, একক লেন্স সম্বলিত আয়নার মত চোখসহ আরও বিভিন্ন ধরণের চোখ।
ছবি১(ক): মাছির পুঞ্জাক্ষির গঠন [১২]
ছবি১(খ): মানুষের চোখের গঠন [১৩]
প্রাণীর চোখকে বলে ক্যমেরা চোখ, অক্টোপাসেরও ক্যামেরার মত চোখ আছে যা আবার বেশ ভিন্নভাবে কাজ করে! ওদিকে আবার কাঁকড়া বা বিভিন্ন আর্থ্রপডের আছে জটিল পুঞ্জাক্ষি, যেখানে ১০ থেকে ৮০ টা পর্যন্ত একক চোখের সমাবেশ দেখা যেতে পারে -এছাড়াও আছে একক এবং দ্বৈত লেন্সের ক্যামেরার মত চোখ, একক লেন্স সম্বলিত আয়নার মত চোখসহ আরও বিভিন্ন ধরণের চোখ। বৈচিত্রের যেন শেষ নেই, মানুষের চোখ এবং স্কুইড বা অক্টোপাসের চোখ জটিল ক্যামেরার মত চোখ হলেও তারা কাজ করে এক্কেবারে উলটো পদ্ধতিতে। আমাদের চোখকে ক্যামেরার সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে যে, ফিল্মের বদলে আমাদের চোখের পিছনে রয়েছে রেটিনা আর ফটোরিসেপ্টর কোষ এবং এরা আলোর বিপরীতে কাজ করে। আর অন্যদিকে স্কুইড বা অক্টোপাসের চোখের ফটোরিসেপ্টরগুলো থাকে সামনের দিকে আর তারা আলোর দিকে লক্ষ্যস্থির করে। এখান থেকে পরিষ্কারভাবে দেখা যায় যে, প্রকৃতিতে বিবর্তনের ধারায় চোখ তৈরির জন্য বিভিন্ন রকমের পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। বিখ্যাত বিবর্তনবিদ আর্নেষ্ট মায়ার প্রকৃতিতে চোখের গঠনে এত বৈচিত্র দেখেই প্রস্তাব করেছিলেন যে, প্রকৃতিতে হয়তো ৪০-৬৫ বার সম্পূর্ণ পৃথক পদ্ধতিতে চোখের বিবর্তন ঘটেছে [১১]!
কিন্তু আরও অনেক চমকের মতই এভু ডেভুর গবেষণা এবারও চমকে দিল সবাইকে। এই তো সেদিনের ঘটনা, ১৯৯৪ সালের দিকে সুইজারল্যন্ডের বিজ্ঞানী ওয়াল্টার গেরিং এবং তার সাথীরা আকস্মিকভাবেই আবিষ্কার করলেন যে জিনটি ফলের মাছিতে চোখ তৈরির জন্য দায়ী তার সাথে মানুষ বা ইঁদুরের চোখের জিনগুলোর অদ্ভুত এক সাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে। এই জিনটির নাম প্যাক্স-৬ জিন (Paired Box6, বা Pax6)। মানব শিশুর জন্মের কয়েক মাস আগে ভ্রূণাবস্থায় এই জিনটি ‘অন’ বা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং চোখ তৈরির কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা আগে থেকেই জানতেন যে ইঁদুর বা মানুষের ভ্রূণতে এই জিনটির মিউটেশন ঘটলে তাদের চোখ ছোট হয়ে জন্মায়, এমনকি বিশেষ কিছু মিউটেশন ঘটলে চোখ বলে কোন অংগই তৈরি হয় না। বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে দেখলেন যে ফলের মাছির মধ্যেও একই ব্যাপার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা কি করে সম্ভব? ফলের মাছির চোখতো জটিল পুঞ্জাক্ষি, তার সাথে আমাদের চোখের তো কোন মিলই থাকার কথা নয়। এখানেই শেষ নয়, ডঃ গেরিং এর সামনে আরও কিছু বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল। তারা ধীরে ধীরে আবিষ্কার করলেন, মাছির পুঞ্জাক্ষিই শুধু নয়, কৃমি, পাখি, ব্যাঙ থেকে শুরু করে ইঁদুর, কিংবা মানুষ, গরু, ঘোড়ার মত সব মেরুদন্ডী প্রাণীর চোখের বিবর্তনের পিছনেও এই একই প্যাক্স-৬ জিনটিই ‘কাজ করে চলেছে [১৫]।
ছবি ২. প্যাক্স৬ জিন থেকে তৈরি প্রোটিনের তুলনাঃ এখানে ফলের মাছি, ইদুঁর এবং মানুষের আ্যমাইনো এসিডের সিকোয়েন্সের তুওলনা দেখানো হচ্ছে। খেয়াল করুন, মানুষ এবং ইদুঁরের প্রোটিনের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্যই দেখা যাচ্ছে না, আর ফলের মাছির সাথে এদের পার্থক্যটাও খুবই সামান্য [১১]।
ফলের মাছিতে চোখ তৈরির জন্য প্রায় ২০০০ জিন কাজ করে, মানুষের চোখের উৎপত্তির পিছনেও সমসংখ্যক জিনেরই ভূমিকা থাকার কথা। এতগুলো জিন যেখানে চোখ তৈরির কাজে নিয়োজিত সেখানে একটি মাত্র জিন কি করে সম্পূর্ণভাবে চোখ তৈরির প্রক্রিয়াটা বন্ধ করে দিতে পারে? তাহলে কি এরা নিয়ন্ত্রক জিন, এদের হাতে কোন মহাক্ষমতাধর সুইচ আছে? যাকে ‘অন’ বা ‘অফ’ করে তারা একটা অংগ তৈরির পুরো কাজটারই সলিল সমাধি ঘটিয়ে দিতে পারে?
এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার আগে বরং চলুন বিভিন্ন ধরণের জিনের কাজেগুলো সম্পর্কে একটা খুব প্রাথমিক ধারণা নিয়ে নেই। কী কী ধরণের জিন আছে এবং তারা কিভাবে কাজ করে না জানলে এদের কাজকর্ম বুঝে ওঠা মনে হয় খুব সহজ হবে না। আমরা এখন পর্যন্ত বহুবারই হক্স জিন বা প্যাক্স৬ জিনের মত বাহারি সব নামের জিনগুলো কথা বলেছি। এদেরকে নিয়ন্ত্রক জিন হিসেবেও উল্লেখ করেছি। কিন্তু এদের সাথে আমাদের বহু পরিচিত প্রোটিন তৈরি-করা জিনগুলোর পার্থক্যটা কি? ‘সুইচের ‘অন অফ’ এর কথাও এসেছে মাঝে মাঝে। জিনের ‘সুইচ’ বলতেই বা কি বোঝায়?
সাধারণ জিনগুলো অপসিন, গ্লোবিন, রাইবোনিউক্লিসিস জাতীয় বিভিন্ন ধরণের প্রোটিন তৈরি করে, যারা আমাদের দেহের দর্শন, শ্বাস-প্রশ্বাস, ঘ্রাণ বা পরিপাকের মত বিভিন্ন শারীরতত্ত্বীয় কাজের গুরু-দ্বায়িত্বগুলো পালন করে। আর এই হক্স জিন বা প্যাক্স জিনের মত জিনগুলোকে কেউ কেউ ‘মাস্টার কন্ট্রোল জিন’, ‘টুল কিট জিন’ বা নিয়ন্ত্রক জিন বলেন কারণ এরা মূলত শরীরের আকার এবং গঠনের মূল কাজটা নিয়ন্ত্রণ করে।
এরা জীবের শরীরের বিভিন্ন অংগ প্রত্যঙ্গের অবস্থান, আকৃতি, সংখ্যা এবং বিভিন্ন ধরণের কোষের পরিচয় নিয়ন্ত্রণ করে। এদের বেশীরভাগই প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে কখন এবং কোথায় অন্যান্য জিনগুলো সক্রিয় হবে বা কাজ করবে তা নিয়ন্ত্রণ করে। এই জন্যই প্যাক্স৬ জিনের মিউটেশন হলে আমরা প্রাণীর দেহে চোখের বিলুপ্তি ঘটে যাওয়ার মত নাটকীয় ঘটনাও দেখতে পাই আমরা। আবার, এরা যে শুধু একটা বিশেষ কাজই করে থাকে তা ভাবলেও কিন্তু ভুল হবে, এদের অনেকেই দেহের একাধিক অংগ প্রত্যংগ গঠনে ভূমিকা পালন করে। যেমন, এই প্যাক্স৬ জিনটি স্তন্যপায়ী প্রাণীতে মস্তিষ্কের একটি অংশ এবং নাক তৈরির কাজেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে [১১]। উপরের ছবিটা লক্ষ্য করুন, নিয়ন্ত্রক জিনগুলোর কাজ অনেকটা ‘চেইন রিয়্যাকশান’ এর মত। এরা বিভিন্ন জিনকে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেয়, যার ফল গিয়ে পরে অন্য আরেক জিনের উপর, এর ফলশ্রুতিতে আবার দেখা যায় আরেক সেট জিনের কর্মকান্ড শুরু হয়…এভাবে চলতেই থাকে।
এবার আসি সুইচের প্রসঙ্গে। এভু ডেভু নিয়ে লেখার প্রথমেই বলেছিলাম যে আমাদের ডিএনএর মাত্র শতকরা দেড়ভাগ প্রোটিন তৈরিকারি জিন হিসেবে কাজ করে। বাকি ডিএনএর শতকরা তিনভাগ কাজ করে রেগুলেটর হিসেবে। প্রত্যেক জিনের মধ্যেই এই প্রোটিন তৈরি না-করা অংশ থাকে। আর এই অংশটার মধ্যেই সুইচের মত কিছু জিনিস থাকে যারা অন্য জিনগুলো কখন সক্রিয় হবে, কখন হবে না, সেটা নিয়ন্ত্রণ করার কাজে ব্যস্ত থাকে। একটা নিয়ন্ত্রক জিনের মধ্যে কিন্তু এ ধরণের বহু সুইচ থাকতে পারে। আর এরাই নিয়ন্ত্রণ করে শরীরে কখন কোথায়, কোন অংশে এই নিয়ন্ত্রক জিনটা কিভাবে কাজ করবে, কাকে কি নির্দেশ দিবে অথবা কিভাবে তার গঠনকে প্রভাবিত করবে। কোন সুইচটা কখন অন বা অফ হচ্ছে তার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে নিয়ন্ত্রক জিনের কর্মকান্ড।
যাক, এ তো গেল জিনের অ আ ক খ। এবার চলুন ফেরা যাক আমাদের প্যাক্স জিনের গল্পে। বিজ্ঞানীরা নিয়ন্ত্রক জিন হিসেবে প্যাক্স জিনের কার্যকারিতা বোঝার জন্য হাতে কলমে পরীক্ষাও করে দেখেছেন। গবেষণাগারে ভ্রূণাবস্থায় ইঁদুরের জিনের প্রতিলিপি (মানুষের চোখের গঠনেও এই একই জিন কাজ করে) নিয়ে যখন মাছির মধ্যে স্থাপন করা হয় এর ফলাফল হয়েছিল অভূতপূর্ব। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাছির ভ্রূণতে ইঁদুরের নয়, মাছির চোখের টিস্যুই তৈরি হয়েছিল! এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিভিন্ন প্রাণীতে প্যাক্স৬ জিনের গঠনই যে শুধু এক তাইই নয়, কার্যকারিতার দিক থেকেও এরা অভিন্ন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এখানে কিন্তু মাছির চোখ তৈরি হয়েছে, ইদুঁরের নয়। কারণ ইদুঁর থেকে আমরা শুধু নিয়ন্ত্রক জিনটাই প্রতিস্থাপন করেছি মাছিতে যে চোখ তৈরির জন্য নির্দেশ প্রদান করছে অন্যান্য জিনকে। আর এই অন্যান্য জিনগুলো যেহেতু মাছির জিনোমের অংশ তারা তাদের নিজস্ব নিয়মানুযায়ী সেখানে মাছির চোখই তৈরি করছে।
কেমন যেনো ‘দেজা ভু’র মত শোনাচ্ছে না? হ্যা ঠিকই ধরেছেন, আমরা প্রায় একই রকমের কাহিনী শুনেছিলাম টিকট্যালিকের পা এবং মাছের পাখনা তৈরির জন্য দায়ী হক্স জিন সম্পর্কেও। বিজ্ঞানীরা এখানেই থেমে থাকেননি, তারা উল্টোভাবে মাছির জিন উভচর প্রাণী ব্যাঙ এ প্রতিস্থাপন করে দেখেছেন। সেখানেও মাছির প্যাক্স৬ জিন থেকে ব্যাঙ এর শরীরে ব্যাঙ এর চোখই তৈরি হয়েছে। এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে মেরদন্ডী প্রাণী এবং পতঙ্গের মধ্যে এই আদি জিনটির অস্তিত্ব এবং কার্যকারিতা নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
বিজ্ঞানীরা আরও পরীক্ষা করে দেখেছেন, বিশেষ কায়দায় যদি এই জিনটিকে ফলের মাছির পায়ে, হাতে, বা শুড়ের মত অদ্ভুত সব জায়গায় সক্রিয় করে তোলা যায়, তাহলে সেখানে পুঞ্জাক্ষি গড়ে ওঠে। অর্থাৎ এগুলো হচ্ছে হক্স জিনের মতই আরেকটি মহাশক্তিধর নিয়ন্ত্রক জিন, যারা অন্যান্য জিনকে নির্দেশ দেয় ভ্রূণাবস্থায় কোথায় কখন কি ধরণের চোখ তৈরি করতে হবে। পরবর্তীতে এও দেখা গেছে যে যে ‘অদ্ভুত’ সব জায়গায় প্রতিস্থাপিত এই চোখগুলো দিয়ে মাছিরা সতিসত্যিই দেখতেও পায়। অর্থাৎ, এই একটি নিয়ন্ত্রক জিনকে যেখানেই নিয়ে বসান না কেন চোখ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ২০০০ জনের কর্মকান্ডকে সে অনায়াসেই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে।
এত রকমের প্রাণীর চোখ তৈরির পিছনে যেহেতু এই একই প্যাক্স-৬ জিনের হাত রয়েছে, এটাকে আর কাকতালীয় ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ, এই বিচিত্র সব প্রাণীদের সাধারণ পূর্বপুরুষের মধ্যে এই জিনটির অস্তিত্ব ছিল এবং তাদের মধ্যে খুব সরল এবং আদিম কোন চোখ বা চোখ জাতীয় কোন কিছুর তৈরির জন্য এই প্যাক্স-৬ জিনই দায়ী ছিল। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে, এত রকমের চোখের বিকাশের জন্য মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন নতুন নিয়ন্ত্রক জিনের আবিষ্কার বা তৈরির দরকার পড়েনি। বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় চোখের ভিত্তি বারবার নয়, একবারই আবিষ্কৃত হয়েছে। তারপর প্রায় ৫০ কোটি বছর ধরে বিভিন্ন শ্রেণীর প্রাণীগুলো ভিন্ন ভিন্ন পথে বিবর্তিত হতে হতে বিভিন্ন ধরণের চোখের উৎপত্তি ঘটিয়েছে। এই আদি নিয়ন্ত্রক জিনটি কখন কোন সময়ে, কার সাথে অন্য কোন জিনের উপর বা সাথে কাজ করছে বা কোন জেনেটিক সুইচ কোন সময়ে সক্রিয় হয়েছে – এই সব বিভিন্ন ফ্যক্টরের উপর ভিত্তি করেই উদ্ভব ঘটেছে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্সম্পন্ন চোখের!
তাহলে এর পরের যৌক্তিক প্রশ্নটাই হচ্ছে, এই সব ধরণের চোখের বিবর্তনের পিছনে ভিত্তিটা কি ছিল? অর্থাৎ, আমাদের আদি পূর্বপুরুষদের মধ্যে তাহলে কোন কোন উপাদানের অস্তিত্ব ছিল যেখান থেকে আজকের এই জটিল চোখগুলোর উদ্ভব ঘটলো?
ডঃ শ্যন ক্যারল এ প্রশ্নটার খুব চমৎকার উত্তর দিয়েছেন তার ‘মেকিং অফ দ্যা ফিটেষ্ট’ বইতে। চোখ কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের কিন্তু খুব বিস্তারিত ধারণা রয়েছে। দু’ধরণের কোষ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; ফটোরিসেপ্টর নামের আলোক সংবেদনশীল কোষ আর অদিকে পিগমেন্ট বা রঞ্জক কোষ যারা এই ফটোরিসেপ্টরের উপর আলোর কোণিক পতনকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাহলে যৌক্তিকভাবেই ধারণা করা যায় যে, আদি চোখগুলোতে খুব আদিমভাবে হলেও এই দু’টি কার্যক্ষমতাই বিদ্যমান ছিল । ডারউইনও কিন্তু এরকম কোন সরল এবং আদি চোখের কথাই বলেছিলেন।
আর সামুদ্রিক প্রাণী রাগওয়ার্মের শুককীটের মধ্যে প্রথমে ঠিক এরকমের দুটি আদিম কোষবিশিষ্ট্য চোখেরই অস্তিত্ব দেখা যায়। কিন্তু তাই বলে এদের এই সরল চোখকে অবজ্ঞা করা মোটেও ঠিক হবে না, আমাদের মত জটিল চোখগুলোর উপাদানের সাথে এই সরল চোখের উপাদানগুলোর কিন্তু খুব একটা পার্থক্য নেই। আলোর সংবেদনশীলতার জন্য আমাদের চোখে অপসিন নামক যে প্রোটিনটি ব্যবহার করা হয় ঠিক সেটারই অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় রাগওয়ার্মের শুককীটের আদি চোখেও। আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে পূর্ণবয়স্ক রাগওয়ার্মের মধ্যে জটিল চোখ তৈরি হয় -বহু সংখ্যক একই রকমের কোষের সমন্বয়ে নতুন করে ত্রিমাত্রিক সজ্জায় সাজানোর মাধ্যমে জটিল চোখের উৎপত্তি ঘটে (১১)।
একই ধরণের কোষ এবং একই ধরণের জিনের সমন্বয়ে ধীরে ধীরে সরল চোখ থেকে জটিল চোখের উৎপত্তির উদাহরণ আমাদের সামনে যেন বিবর্তনের ধারায় জটিল অংগ তৈরির এক জলজ্যান্ত প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এখান থেকে দেখা যাইয় যে, বিভিন্ন প্রাণীতে একই ‘বিল্ডিং ব্লক’ এবং একই বংশগতীয় সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে সময়ের সাথে সাথে বহু রকমের চোখের উৎপত্তি ঘটা কোন অসম্ভব ব্যাপার নয়। শুরুটা বড্ড সাধারণ, দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষিতে একটার উপরে আরেকটা ছোট ছোট পরিবর্তন, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ‘যোগ্যতর’ এর টিকে থাকার বাড়তি সুবিধা পাওয়া অর্থাৎ, ক্রমান্বয়ে দেখার জন্য অপেক্ষাকৃত ‘উন্নততর’ চোখের নির্বাচন – এ সব কিছু থেকেই জটিল অংগপ্রত্যঙ্গের উদ্ভব সম্ভব। সুইডেনের বিজ্ঞানী ড্যান নিলসন এবং সুসান পেলগার কম্পিউটার মডেলিং করে দেখিয়েছেন যে, ছোট ছোট প্রকারণগুলোর নির্বাচনের মাধ্যমে ৫ লাখ বছরের মধ্যে প্রায় দুই হাজার ধাপেই সাধারণ চোখ থেকে জটিল ক্যামেরা চোখের বিবর্তন সম্ভব।
ছবি ৩. ছবি: অধ্যাপক ড্যান নিলসন এবং পেলগারের সিমুলেশনের ফলাফল, তারা দেখিয়েছেন আদি সমতল আলোক সংবেদনশীল সেল থেকে শুরু করে ৪০০ ধাপ পরে তা রেটিনাল পিটের আকার ধারণ করে, ১০০০ ধাপ পরে তা আকার নেয় অপেক্ষাকৃত সরল পিন-হোল ক্যামেরার মত আকৃতির, আর প্রায় ২০০০ ধাপ পরে চতুষ্পদী জীব এবং অক্টোপাসের মত জটিল চোখের উদ্ভব ঘটানো সম্ভব।
এভু ডেভুর এই আবিষ্কারগুলো সৃষ্টিবাদী বা আইডিওয়ালাদের উপর বেশ বড় আঘাত হয়ে দেখা দিয়েছে। মানুষের চোখের মত এত জটিল একটি অংগ নাকি বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় তৈরি তে পারে না, এর জন্য ‘ডিজাইনার’ ছাড়া নাকি গতি নেই। কিন্তু প্যাক্স-৬ বা হক্স এর মত জিনগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সময়ের সাথে সাথে আদি এই জিনগুলোর বিবর্তনের ফলে এই ধরণের জটিল অঙ্গগুলোর উৎপত্তি এবং বিবর্তন মোটেও কোন অসম্ভব ব্যাপার নয়। আর এখন, প্রথমবারের মত, আমরা গবেষণাগারেই পরীক্ষা করে বিবর্তনের এই ধাপগুলো দেখাতে পারছি।
এই নিয়ন্ত্রক জিনগুলোর কার্যকারিতার আরেকটা উদাহরণ দেখা যাক। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যার অধ্যাপক ডঃ ক্লিফ ট্যাবিন গ্যালাপেগাস দ্বীপের ডারউইনের দেখা সেই বিখ্যাত ফিঙ্গেগুলোর উপর গবেষণা চালান। উনিও ডঃ শন ক্যারলের মতই বিবর্তনীয় বিকাশমান জীববিদ্যার সাথে খুব ঘনিষ্টভাবে জড়িত একজন গবেষক। উনি এই বিভিন্ন প্রজাতির ফিঙ্গেগুলোর বিভিন্ন রকমের ঠোটের পিছনে কোন জিনগুলো কাজ করছে তা খুঁজে বের করেন। ডঃ সুবিন যে কারণে তার গবেষণার জন্য মাছ এবং মানুষ বা ইঁদুরের মত খুব ভিন্ন ভিন্ন দু’টি শ্রেণীর প্রজাতির প্রাণী বেছে নিয়েছিলেন ( আগের পর্বে এ নিয়ে লিখছিলাম) ডঃ ট্যাবিন ঠিক তার উলটো কারণেই খুব কাছাকাছি প্রজাতির ফিঙ্গেগুলোকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বেশি দূরের প্রজাতিগুলোর মধ্যে বংশগতিক পার্থক্য ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকাটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে ঠিক কোন একটা বৈশিষ্ট্যের জন্য নির্দিষ্ট কোন বংশগতীয় পরিবর্তন ঘটছে তা বের করা অপেক্ষাকৃত কঠিন হয়ে উঠতে পারে। ওনারা তাই এই ফিঙ্গেদেরই বেছে নেন, যাদের মধ্যে এই ঠোঁটের গঠন ছাড়া অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের তেমন কোন বড় পার্থক্য নেই।
ছবি ৪. বিভিন্ন প্রজাতির ফিঙ্গের ঠোঁটের গঠনের ছবি [৯]
কি পেলেন তারা তাদের গবেষণা থেকে? এতক্ষণে, এভু ডেভুর গবেষণা থেকে প্রাপ্ত উপরের উদাহরণগুলো থেকে আপনারা নিশ্চয়ই তা অনুমান করে ফেলেছেন। হ্যা, ধারালো চোখা ঠোঁটের কথাই বলেন, ভোতা ঠোঁটের কথাই বলেন বা বড় চওড়া বাদাম ভাঙ্গা ঠোঁটের কথাই বলেন – এদের সবার গঠনের পিছনেই কিন্তু একই জিনের অবদান রয়েছে। আবারও একই চিত্র ফুটে উঠছে এই গবেষণা থেকেও, বিভিন্ন ফিঙ্গের ঠোঁটের গঠনে পার্থক্যগুলোর জন্য দায়ী বিভিন্ন জিন নয়, বরং একই জিন কখন কিভাবে কোন প্রজাতির মধ্যে কতখানি সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হচ্ছে তার উপর নির্ভর করেই এই পার্থক্যগুলোর উৎপত্তি ঘটেছে।
ছবি ৫. ধারালো চোখা ঠোঁট, অপেক্ষাকৃত ভোতা ঠোঁটের উৎপত্তির জন্য নতুন জিনের প্রয়োজন নেই বরং ভ্রূণবস্থায় একই জিন থেকে তৈরি প্রোটিনের ঘনত্বের পরিবর্তন করেই বিভিন্ন ঠোঁট তৈরি করা সম্ভব [৯]।
তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই যে, সেই পুরোনো প্রবাদ ‘many roads lead to Rome’ (বহু রাস্তা ধরে রোমে পৌঁছানো যায়’) এখন আর খাটছে না নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য উদ্ভবের ক্ষেত্রে। বিজ্ঞানীরা এখন অবাক হয়ে দেখছেন মোটেও ‘বহু পথের’ প্রয়োজন হয়নি, বরং বহুবারই বিভিন্ন ধরণের প্রাণী একই পথ দিয়ে হেটে গেছে বিবর্তনের পথ ধরে। বিবর্তনের আধুনিক সংশ্লেষণ মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা আর্নেষ্ট মায়ার প্রায়ই এ কথাটা বলতেন,খুব কাছের প্রজাতিগুলো ছাড়া দূরের কোন প্রজাতির মধ্যে একই ধরণের জিন খোঁজার নাকি কোন অর্থ হয় না, অর্থাৎ, নিকটাত্মীয় কোন প্রজাতি না হলে তাদের মধ্যে তেমন বংশগতীয় মিল থাকার কথা নয় । আসলে শুধু আর্নেষ্ট মায়ারকেই বা দোষ দিয়ে লাভ কি, কিছুদিন আগে পর্যন্ত সব জীববিজ্ঞানীই তো এভাবেই ভাবতেন। কিন্তু এই পুরো ধারণাটিই আজ ভুল প্রমাণ হতে চলেছে।
গত কয়েক দশকের নতুন নতুন আবিষ্কারগুলো বিজ্ঞানীদের প্রাণীজগতের বিবর্তন, বিভিন্ন অংগপ্রত্যংগের উদ্ভব এবং গঠন এবং সেই সাথে এই পৃথিবীর অকল্পনীয় জৈববৈচিত্র নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। ডঃ স্টিফেন যে গুল্ড প্রথম আশির দশকে তার ‘দ্য স্ট্রাকচার অফ এভ্যুলেশনরী থিওরী’ শরীর গঠনকারী জিন এবং হক্স জিনগুচ্ছ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তার ভবিষদ্বাণীকে সঠিক প্রমাণ করে দিয়ে আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি যে, নতুন নতুন সব অজানা জিনের আবিষ্কারের মাধ্যমে নয় বরং এই আবিষ্কারগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা অপ্রত্যাশিত সব বিষয়গুলোই আমাদের বিবর্তন নিয়ে প্রচলিত চিন্তার পদ্ধতিতে বিপ্লব ঘটিয়ে দিচ্ছে (১)।
অদ্ভুত ব্যাপার হল এই হক্স জিন বা প্যাক্স জিনের মত এই নিয়ন্ত্রক জিনগুলো কোটি কোটি বছরেও ‘আউট অফ ফ্যাশন’ হয়ে যায়নি। ঘুরে ফিরে, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বিভিন্ন অংগ-প্রত্যংগ গঠনে এই দলের জিনগুলো ছাড়া গতি নেই। মেরুদন্ডী প্রাণী, পাখী, সরীসৃপ থেকে শুরু করে পোকামাকড় পর্যন্ত সবার দেহ গঠনে তাদের অপরিহার্যতা প্রমাণিত হচ্ছে বারবার। তারা প্রাণীর মৌলিক গঠন তৈরিতে এতখানি গুরুত্ব বহন করে বলেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় তাদেরকে এভাবে কোটি কোটি বছর ধরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই জিনগুলোর সংরক্ষণ আবারও প্রমাণ করে যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন শুধু ধ্বংসই করে না, যে বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকৃতিতে অত্যন্ত যোগ্যভাবে টিকে থাকতে সক্ষম তাদের বংশগতীয় উপাদানকে সংরক্ষণও করে। এভু ডেভুর বিভিন্ন আবিষ্কার থেকে এখন দেখা যাচ্ছে যে, শুধু, হাত, পা বা চোখই নয় বরং বিভিন্ন ধরণের প্রাণীতে হৃৎপিন্ড, পরিপাকযন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্রের মত অংগগুলোর গঠনের নেপথ্যেও বিভিন্ন ধরণের আদিম সাধারণ জিনের ভূমিকা রয়েছে।
এ প্রসংগে ডঃ ক্লিফ ট্যাবিনের দেওয়া একটি সাক্ষাৎকার উল্লেখযোগ্য। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, প্রাথমিক অবস্থায় মোটামুটি সব প্রাণীর ভ্রূণই অনেকটা যে একইরকম দেখায় তার পিছনে কি এই সাধারণ জিনেরগুলো অস্তিত্বই দায়ী? তিনি উত্তরে বলেছিলেন,
‘হ্যা। সেই ১৮০০ সাল থেকেই একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়ে আসছে, আমরা যদি বিভিন্ন মেরুদন্ডী প্রাণীর ভ্রূণ পর্যবেক্ষণ করি – তা সে মাছ, স্যালামান্ডারই হোক বা ব্যাঙই হোক অথবা মুরগী, ইঁদুর বা মানুষই হোক – তাহলে দেখতে পাবো যে তারা প্রাথমিক অবস্থায় দেখতে প্রায় একইরকম বলে মনে হয়। সত্যি কথা বলতে কি তারা এমন কিছু পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যায় যখন তাদেরকে একে অপরের থেকে বলতে গেলে পার্থক্যই করা যায় না। যদিও, পেশাদার কোন ব্যক্তি অণুবীক্ষণযন্ত্রের নীচে দেখলে প্রথম থেকে, নিশ্চিতভাবেই, তাদের পার্থক্য করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু, যাই বলেন না কেন, ভ্রূণের প্রাথমিক অবস্থায় এই সাদৃশ্যগুলো কিন্তু অসাধারণ। আমি মনে করি, এর পিছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, সব ভ্রূণের মধ্যেই এই অত্যন্ত প্রাথমিক অবস্থায় পা-গুলোকে ঠিক জায়গায় স্থাপণ করা, বাকি শরীর থেকে মাথাকে আলাদা করতে পারার মত কিছু খুব সাধারণ মৌলিক ব্যপার ঘটতে থাকে যাতে করে মূখ্য আনবিক ক্রিয়াগুলো ঘটতে পারে। অর্থাৎ, এই প্রাথমিক স্তরে আমরা শুশুকই হই আর মানুষ বা বানরই হই না কেন, আমাদের মধ্যে কিন্তু একই প্রক্রিয়াগুলো ঘটতে থাকে। এর পরের স্তরে গিয়ে ধীরে ধীরে পার্থক্যগুলো বিকশিত হতে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় একজন অনভিজ্ঞ মানুষের কাছে যে এদের সবাইকে একই রকম মনে হয় তাইই শুধু নয়, আসলে মৌলিকভাবে চিন্তা করলে এরা কিন্তু আসলেই এক [৯]।’’
আমি এভু ডেভুর লেখাটা (প্রথম পর্ব) শুরু করেছিলাম কতগুলো প্রশ্ন দিয়ে, এখন যেহেতু নটে গাছটি মুড়ানোর সময় হয়ে আসছে তাই বরং এক এক করে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে শুরু করি। দু’টি প্রশ্ন ছিল এরকম – এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতি তৈরি হতে যদি এত কাড়িকাড়ি নতুন জিনের প্রয়োজন হয় তাহলে তাইই বা তৈরি হচ্ছিল কোথা থেকে? এই কোটি কোটি নতুন প্রজাতির বিবর্তনের পিছনে তাহলে কত নতুন জিনের দরকার হল? এভু ডেভুর গবেষণা থেকে আমরা প্রথমবারের মত এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে আরম্ভ করেছি।
একই আদি জিনের উৎস থেকে টিকট্যালিকের মধ্যে পাখনা হতে পা’য়ের বিবর্তন, বিভিন্ন প্রাণীতে বিভিন্ন রকমের চোখের বিবর্তন, কিংবা ডারউইনের ফিঙ্গেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন আকারের ঠোঁটের উদ্ভব থেকেই আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাচ্ছি। আমরা দেখছি যে, শুধু ছোট ছোট পরিবর্তনই (মাইক্রো লেভেলে)নয়, অনেক বড় বড় পরিবর্তন বা বিবর্তনের (ম্যাক্রো লেভেল) জন্যও সবসময় আনকোড়া নতুন জিনের উদ্ভব ঘটার দরকার পড়েনি। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই পুরোনো বা আদি নিয়ন্ত্রক জিনগুলো বারবার নতুন সজ্জায় সজ্জিত হয়ে হাজির হয়েছে, বিবর্তন ঘটিয়েছে অভূতপূর্ব নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যের। অর্থাৎ, জীবজগতের বড় বড় রূপান্তরের জন্য বা নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভবের জন্য সবসময় অভিনব সব জিনের প্রয়োজন পড়েনি। এভাবেই পুরনো জিন থেকেই বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটেছে। একে কোন পরিবেশে কিভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেখান থেকে কোন বৈশিষ্ট্যগুলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়েছে সেটা উপরই নির্ভর করেছে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য এবং বৈচিত্রের বিকাশ।
যাক, প্রথম সেটের প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া গেল এভু ডেভু থেকে। কিন্তু এখন কান টানলে মাথা আসার মত করে পরের যে যৌক্তিক প্রশ্নগুলো চলে আসে তাদের উত্তর দেওয়া হবে কিভাবে? ‘এ তো রীতিমত শাখের করাতের মত অবস্থা – একদিকে দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন প্রজাতি তৈরিতে নিত্যনতুন জিনের দরকার পড়ছে না, শিয়ালের একই কুমীরের ছানা দেখানোর মত করে পুরোনো সেই নিয়ন্ত্রক জিনগুলোই বারবার হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে। আবার, আরেকদিকে প্রকৃতিতে অকল্পনীয় রকমের সব জটিল এবং বৈচিত্রময় বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটেছে। একই নিয়ন্ত্রক জিন থেকে কি করে এত রকমের বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটা সম্ভব? এত ধরণের জীব-বৈচিত্র্যই বা তৈরি হল কিভাবে? এভু ডেভু কি সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে? এর পরের পর্বে (শেষ পর্ব) এর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো।
তথ্যসূত্রঃ
১) Carroll S, 2005, Endless Forms most Beuaitful. W.W. Norton & Company.
২) http://discovermagazine.com/2009/mar/19-dna-agrees-with-all-the-other-science-darwin-was-right
৩) যুক্তি, সংখ্যা ৩, জানুয়ারি ২০১০, শন ক্যারলের সাথে সাক্ষাকারঃ ডি এন এ এবং অন্যান্য বিজ্ঞান প্রমাণ করছে যে ডারউইন সঠিক ছিল।
৪) Shubin N, 2008, 2009,Your Inner Fish. Vintage Books. ৫) http://www.nytimes.com/2007/06/26/science/26devo.html
৬) http://www.pbs.org/wgbh/nova/beta/evolution/darwin-never-knew.html এই ভিডিওটা এখান থেকে ডাউনলোড করা যেতে পারে ( ধন্যবাদ পথিক কে ডাউনলোড এর এই উপায়টা খুঁজে বের করার জন্য)
veoh2://veoh.com/?cmd=DA782A7C-3538-4dd9-B28B-90F927E31BF1
৭) ইনুয়িটরা (Nunavut) কানাডার উত্তর মেরুতে নুনাভেট টেরিটরী অফ আর্কটিক এ বসবাসকারী আদি আমেরিকান গোষ্ঠী। তাদের এই এলাকাতেই টিকট্যালিকের ফসিলের সন্ধান পান ডঃ সুবিন এবং তার গবেষণা দল। ইনুয়িট গোষ্ঠীর প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যই ডঃ সুবিন নুনাভেট কাউন্সিল অফ এল্ডারস দের কাছে তাদের সদ্য আবিষ্কৃত ফসিলটির জন্য নাম চেয়ে পাঠান। ডঃ সুবিন তার ‘ইয়োর ইনার ফিস’ বইটিতে মজা করে বলেছেন যে, যে কমিটির নাম ছিল Inuit Qaujimajatuquangit Katimajiit তারা সে ফসিলের জন্য কি নাম ধরণের দুর্বোধ্য নাম প্রস্তাব করবেন কে জানে। তাদের কাউন্সিল দু’টি নাম পাঠান, Siksagiaq এবং Tiktalik। নামটির সহজবোধ্যতা এবং অর্থের (large fresh water fish) কথা বিবেচনা করে তারা টিকট্যালিক নামটি রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
৮) মিসিং লিঙ্কঃ কথাটা জনপ্রিয় বিজ্ঞানের সাহিত্যে অনেকে ব্যবহার করেন, বিজ্ঞানীরা একে খুব একটা পছন্দ করেন না। কারণ এটা বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে – এতে মনে হতে পারে যে মাছ আর উভচরের মধ্যে একটাই লিঙ্ক ছিল, যা হচ্ছে এই টিকট্যালিক। অনেকেই, বিশেষ করে সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা এই ‘মিসিং লিঙ্ক’ কথাটা থেকে মনে করে যে, কোথাও একটা অর্ধেক মাছ আর অর্ধেক উভচরের মত প্রাণী থাকবে! আসলে তো ব্যাপারটা তা না, মাছ আর উভচরের মধ্যবর্তী বিভিন্ন রকমের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গাদি গাদি ফসিল পাওয়া গেছে।
৯) পিবিএস এর নোভায় প্রচারিত ডঃ ক্লিফ ট্যাবিনের সাক্ষাৎকারঃ http://www.pbs.org/wgbh/nova/beta/evolution/what-evo-devo.html
১০) http://evolution.berkeley.edu/evolibrary/article/0_0_0/homology_04
১১) Carroll S, 2006, Making of the Fittest. W.W. Norton & Company. Pg. 194
১২)http://www.udel.edu/biology/Wags/histopage/wagnerart/coloredempage/coloredems.html
১৩) http://www.phys.ufl.edu/~avery/course/3400/vision/eye_photo.jpg
সব বিশ্লেষণ ভাল লাগল কিন্তু বইটার নাম চেঞ্জ করে সরল বাংলা শব্দের মিশ্রনে দিলে আরো আকরসিত হত।
sorry for interference
ফরিদ ভাই, নিজে লিখেন বিজ্ঞানের বই আর ওইদিকে বিজ্ঞানের লেখা পড়েন না বলে গলা ফাটায় বেড়ান। ভন্ডামী ছাড়েন 🙂 । আর বাংলা কলেজে মাষ্টারির কথা বলে কোন দিক থেকে যে বাঁশটা দিলেন ঠিক ধরতে পারতেসিনা। অনেকভাবে এটাকে ব্যাখ্যা করা যায়, আমি বৃদ্ধ চশমাওয়ালা ওল্ড ফ্যাশান্ড একটা মানুষ অথবা টিচারদের মত খটমটা বাংলা লিখি… :-/
অনেকদিন ধইরাই ভাবতেসিলাম কেউ এইডা নিয়া কিসু কয়না ক্যান। শুনেন এটারও অনেক রকম উত্তর হয়,
– আমার বাপে ময়মনসিংহের, ‘ও’ রে সবসময় ওরা ‘উ’ কয়, হয়তো সেখান থেকে পাইসি।
– অথবা ধরেন আমার ভালো লাগসে তাই কইসি, তা তে কার কি?
– অথবা, আমি যেহেতু বাংলায় প্রথম লিখলাম এই টার্মটা আমি প্যাটেন্টেড করলাম এভাবে তা তে কারও কিছু বলার নাই… 🙂
নাহ আসলে এবার আসল কথাটা বলি, ক্যামনে জানি ‘এভু ডেভু’ হয়ে গেসে প্রথম থেকেই, পরে আর আলসেমি করে ঠিক করা হয় নাই। আমার মতে এভো-ডেভো বলা উচিত। কারণ ইংরেজিতে এভুলেশনারী ডেভলেপমেন্টাল বায়োলজী থেকে ছোট করে বলে Evo Devo। কি কন?
আপনার আর ইরতিশাদ ভাইয়ের কঠিন প্রশ্নগুলার উত্তর পরে দিমু, এখন মুড নাই…
বহুকালবাদে বহু কষ্ট করে বিজ্ঞানের উপর একটা লেখা পড়লাম এবং যথারীতি বুদ্ধু বনলাম কিছু বুঝতে না পেরে। একেবারে যে কিছু বুঝি নাই সেটা অবশ্য ঠিক না। এইটুকু খালি বুঝলাম যে লেখকের মত এই রকম বাংলা জানলে বিজ্ঞান লেখা বাদ দিয়ে আমি কোন বাংলা কলেজে বাংলার মাস্টারি করতাম।
আচ্ছা এই এভু-ডেভু লোক দুইটা কে? যমজ ভাই নাকি এরা?
তেড়ে আসার আগে ফাজলেমি বাদ দিয়ে সিরিয়াস আলোচনা করিঃ
আচ্ছা তুমি এভু-ডেভু লিখছো ক্যান? Evo-Devo-র সঠিক উচ্চারণতো ইভো-ডিভো বা ইভো-ডেভো হবার কথা? এই বিকৃতিটা কী ইচ্ছা করে করছো নাকি? আমরা যেমন ইংলিশরে বলি ইংরেজি, সেই রকম?
Fruit fly- কে ফলের মাছি বলার কী কোন দরকার আছে। পড়তে গিয়ে বার বার ধাক্কা খেলাম। শুধু মাছি বললে সমস্যা কী?
এইবার একটা বোকার মত প্রশ্ন করি। পেট ফাইট্যা হাসি পাইলেও ভদ্রতা কইরা হাইসো না।
এই যে কিছু জিন নিয়ন্ত্রকের স্থায়ী ভূমিকা নিলো এর পিছনে কী কোন সুনির্দিষ্ট কারণ আছে নাকি দৈবক্রমে এরা এই ব্যাপক ক্ষমতা অর্জন করেছিল? এরা বিবর্তনের যাত্রাপথে এতো দ্রুতই বা নিয়ন্ত্রকের ভুমিকায় চলে এলো কী করে?
@ফরিদ আহমেদ,
সিরিয়াস প্রশ্নই তো।
উত্তর কই?
কখন যে মুড ঠিক হবে আর আমরা এর উত্তর পাবো আল্লায়ই জানে।
বন্যাকে ধন্যবাদ। অত্যন্ত সহজবোধ্য ভাষায় এভু ডেভুর মতো বেশ জটিল একটা বিষয় নিয়ে লিখেছেন – এতো সাবলীল আর প্রাঞ্জল লেখা খুব একটা দেখা যায় না। যেহেতু লেখাটা বিষয়ের ওপরে সীমিত জ্ঞান নিয়ে আমিও বুঝতে বুঝতে পেরেছি, আমি নিশ্চিত এই লেখাটা কারো বুঝতে অসুবিধা হবে না। বরং আমার মনে হয়েছে, এই সিরিজের লেখা পড়ে আমার মতো আরো অনেকেই এ ব্যাপারে আরো জানতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন।
সেই আগ্রহ থেকে আমার মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে…
ভালো কথা, নিয়ন্ত্রক জিনের কর্মকান্ড নির্ভর করছে কোন সুইচটা কখন অন বা অফ হচ্ছে তার উপর, কিন্তু সুইচের অন/অফ হওয়াটা নির্ভর করছে কিসের ওপরে? এটা কি একধরনের প্রিপ্রোগ্রামিং। তার মানে কোন জিন কখন কি করবে তা আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে? প্রশ্নটা অজ্ঞতাপ্রসূত কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু উত্তরটা হয়তো আমার মতো আরো অনেকের উপকারে আসতে পারে।
আর একটা ব্যাপারে বন্যার কাছে একটু বিস্তারিত জানতে চাইবো, হয়তো পরবর্তী পর্বে প্রসঙ্গটা আসবে…
প্রজাতি-গঠনে (স্পিসিয়েশন) নিয়ন্ত্রক জিনের কোন ভূমিকা আছে কিনা।
এটাতো একটা বিরাট ব্যাপার। অন্ধ মানুষের জন্য কি তাহলে এভাবে অন্য প্রানীর নিয়ন্ত্রক জিন নিয়ে চোখ বানানো সম্ভব?
বিবর্তন যে বাস্তব, এভু ডেভু তা আবারো প্রমাণ করলো।
জীব জগতের বিবর্তনবাদ নিয়ে আমরা অনেক কিছু জেনেছি, বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষন ও গবেষণা তা প্রমান করেছে সর্বতোভাবে। এ বিষয়ে আমাদের কোন দ্বিমত নেই, তেমনি দ্বিমত নেই মৌলবাদীদেরও। কারন তাদের ঐশি গ্রন্থের মধ্যে বিবর্তন সম্পর্কিত বক্তব্য আবিষ্কারের প্রানান্তকর প্রচেষ্টা তারই বহিঃপ্রকাশ। এখন আমার মনে হয় জড় জগতের রাসায়নিক বিবর্তনবাদ নিয়ে বিস্তারিত জানা দরকার নইলে কিন্তু জীব জগতের বিবর্তনবাদ সম্পর্কিত জ্ঞানের মধ্যে ত্র“টি থেকে যাবে। কারন রাসায়নিক বিবর্তন না ঘটলে জীবকনার আবির্ভাব ঘটত না। তাই সেটা জানা বিশেষ জরুরী মনে করি। এ বিষয়ে যার সম্যক জ্ঞান বা ধারনা আছে তাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করব অতি সত্ত্বর তিনি যেন বিষয়টির প্রতি মনযোগ দেন। পরিশেষে, খুব দ্রুত এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ মুক্ত-মনা সাইটে আশা করছি।
@ভবঘুরে,
মুক্তমনার দুই মডারেটর অভিজিৎ রায় এবং ফরিদ আহমেদ এ নিয়ে একটা পুরো বইই লিখেছিলেন, সেটার অনলাইন ভার্সনটা মুক্তমনার ই-বুক সেকশানে রাখা আছে। অভিজিৎ মনে হয় আপনাকে আগেই অন্য একটা পোষ্টে সেটা জানিয়েছিল। এছাড়া আমাদের নতুন করা বিবর্তনের আর্কাইভেও এই বিষয়টা নিয়ে একটা শাখাই করা আছে, আপনি সেগুলোও পড়ে দেখতে পারেন। জীবের বিবর্তন এবং প্রাণের উৎপত্তির ব্যাপারগুলো একটা আরেকটার সাথে যুক্ত হলেও এখনো এই দুই গবেষণাকে আলাদা করেই দেখা হয়। এবায়োজেনেসিসের গবেষণাগুলো খুব যৌক্তিক কারণেই জটিল এবং এর সাথে প্রাণের বিবর্তনের গবেষণার ফিল্ডগুলোর যথেষ্টই পার্থক্য আছে। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে বলবো, জীবজগতের বিবর্তনের সাথে রাসায়নিক বিবর্তনকে মিলানোর কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। এটা সৃষ্টিবাদীরা প্রায়ই করে থাকে যা শেষ পর্যন্ত কূতর্ক ছাড়া আর কিছুতে গড়ায় না। ‘একটা না হলে আরেকটা মিথ্যা প্রমাণিত হবে বা জৈব বিবর্তনের ত্রুটি থেকে যাবে’ এই কথাটা আসলে সঠিক নয়। ধরুন, একটা উদাহরণ দেই, যদি শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে, রাসায়নিক বিবর্তন আসলে ঘটেই নি ( যেটা আমরা জানি সঠিক নয়), কোন এলিয়েন বা স্রষ্টা ফু দিয়ে আদিজীবে প্রেণের উন্মেষ ঘটিয়েছিল ( 🙂 ) তাহলেও কিন্তু এই পৃথিবীতে প্রাণের বিবর্তন যে ঘটেছে তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিতই থেকে যাবে, তা কোনভাবেই ভুল প্রমাণিত হয়ে যাবে না।
এপ্রসঙ্গেও কিছু বলা প্রয়োজন মনে করছি। প্রথমতঃ আপনার দ্বিমত না থাকতে পারে, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষেরই কিন্তু আছে। আমেরিকায় অর্ধেক মানুষ এখনও জীবের বিবর্তনকে সঠিক মনে করে না, আমাদের দেশে তো সেই সংখ্যাটা ৯০% ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে জাকির নায়েক এবং হারুন ইয়াহারাই এখনও রাজত্ব করে আমাদের দর্শন এবং বিজ্ঞানের জগতে। আর বিবর্তনবাদ একটা বিশাল সাব্জেক্ট এরিয়াতে বিরাজ করে, আমরা আসলে এখনও এর অনেক কিছুই জানি না। জীববিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটা শাখায়ই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ নিয়ে গবেষণা চলছে। যেমন ধরুন, এই এভু ডেভুর ব্যাপারগুলো এক্কেবারে কাটিং এজ বিজ্ঞান, এখনও বাংলা তো দুরের কথা ইংলিশ এও এ নিয়ে খুব বেশী বই বা লেখা খুঁজে পাবেন না। আমি আসলে মনে করি, বাংলায় বিজ্ঞানমনস্কতার বিকাশ ঘটাতে হলে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রচুর বই লিখে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, আগ্রহী পাঠকের সংখ্যা কিন্তু খুব কম নয়, আমাদের লেখক নেই সঠিকভাবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ বিজ্ঞানকে তুলে ধরার জন্য। দ্বিতীয়তঃ আমি ( এবং আমার মতে বেশীরভাগ বিজ্ঞান লেখক) মৌলবাদীরা কি বললো, বা কোন চুলায় বিজ্ঞান খুঁজে পেল তার জন্য বিজ্ঞানের লেখা লিখিনা। তারা যতক্ষণ পর্যন্ত না গায়ের উপর এসে বলছে যে, বিজ্ঞান যা বলছে তা ভুল, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তাদের সাথে বিতর্কে যাওয়ারও প্রয়োজন বোধ করি না। তাই এই একবিংশ শতাব্দীতে বসে বিজ্ঞান নিয়ে তাদের কোন কথাই শোনাটাওকে নিতান্তই অপ্রোজনীয়ই মনে করি।
এইখানে দুটো প্রশ্ন রাখি। বন্যাদি আপনি কোথাও উত্তরগুলো পেলে জানাবেন।
প্রথম প্রশ্ন – একই জিন বিভিন্ন প্রাণীর ক্ষেত্রে একই অঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন রূপ তৈরী করেছে। কিন্তু, একই জিন কি বিভিন্ন অঙ্গে প্রভাব রাখতে পারে? যদি জিন সুইচ তত্ত্ব সঠিক হয় তবে সেটাও সঠিক হতে পারে – তাই না? যে সুইচ শুধু প্রোটিনের ঘনত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে সে চোখের সাথে কানের প্রোটিনের ঘনত্বও বাড়িয়ে দিতে পারে – এমন কি দেখা গেছে?
দ্বিতীয় প্রশ্ন – ধরা যাক পাশাপাশি (মানে বেস-পেয়ার শৃঙ্খলায় পাশাপাশি অবস্থিত) দুটি জিন আছে এক জীবে। এক জিনের কার্যকলাপ কি অন্যটিকে প্রভাবিত করতে পারে? এভু-ডেভু অনুসারে যদি জিনের কার্যকলাপ স্বতন্ত্র (Isolated) না হয় তাহলে সেটা ঘটার সম্ভাবনাও থেকে যায়, তাই না?
@দিগন্ত, মিঠুনের প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়ে মনে হল আরেকটু বিস্তারিত করে ব্যাপারগুলো ব্যখ্যা করা দরকার। তাই, প্রথম অংশটাতে অনেক কিছু যোগ করে দিলাম। তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তরটাও মনে হয় সেখানে এসেছে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তরটা মনে হয় কিছুটা আপেক্ষিক। যদি ধর কোন জীবের ডেভেলপমেন্টাল প্ল্যানএ পাশাপাশি দু’টি জিনের একসাথে কাজ করার নির্দেশনা থাকে তাহলে তো তারা একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত হতেই পারে। উপরে, লেখায় একটা ছবি দিয়েছি, যেখানে দেখানো হয়েছে যে নিয়ন্ত্রক জিনগুলো ‘কাস্কেডিং ইফেক্ট’ বা ‘চেইন রিয়্যাকশান’ তৈরি করতে পারে।
@বন্যা আহমেদ, অর্থাৎ ব্যাপারটা যতটা জটিল ভাবা হয়েছিল তার থেকেও বেশী জটিল।
ইশ্ ! জগতের এতো জটিল জটিল বিষয়গুলো এতো সহজ হয়ে যাচ্ছে ! নাকি আমরা জটিল হয়ে যাচ্ছি, বুঝতে পারছি না।
জিনের আচরণ তো দেখি একেবারে অপমানজনক তরল পদার্থের (যে পাত্রে রাখা হয় সে আকার ধারণ) মতো ব্যক্তিত্বহীন বহুরূপী স্বভাবের ! পরিবেশ ফ্যাক্টর ? হা হা হা !
প্রাঞ্জল বর্ণনা। লেখা ভালো লাগলো বন্যাপা।
@রণদীপম বসু,
আসলে ব্যাপারটা তেমন কিন্তু সরল নয়, বেশ জটিলই বলতে হবে। আমরা ইতোমধ্যেই আবিষ্কারটা করে ফেলেছি দেখে হয়তো আমাদের কাছে এখন এত সোজা মনে হচ্ছে। অনেকটা ‘আহহাহা’ মুহূর্তের মত, তাই তো, ব্যাপারটা এরকম তাহলে! ধরেন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে জিনিসটা খুব সোজা একটা কন্সেপ্ট। কিন্তু তা জানার আগে আমরা কত কিছুই না কল্পনা করেছি। ধন্যবাদ আপনাকে লেখাটা পড়ার জন্য, পড়ে সোজা লাগলো বলাতেও একটু স্বস্তি পেলাম, কারণ মনে হচ্ছিল লেখাটা ক্রমান্বয়ে কঠিন হয়ে উঠছে।
দারুন লাগল বন্যাপু। ছোটবেলা থেকেই বায়োলজি তে আমার চরম অনীহা ছিল। তারই ফলস্বরুপ বিবর্তনও অনেক কম বুঝি। তবে বিবর্তনের উপর আপনার লেখাগুলো পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছে, যতটা রসকষহীন মনে করি ততটা আসলে নয়। ধন্যবাদ আপনাকে।
একটা বিষয়ে একটু প্রশ্ন ছিল। মাছি আর ইদুরদের চোখের গঠনের জন্য একই জিন দায়ী। মাছির জিন ইদুরে প্রবেশ করালে মাছির চোখ উৎপন্ন হয়না। এর কারন কি জিন গুলোর অফ অন হবার সময়কালের ভিন্নতা শুধু না আরও কোন ফ্যাক্টর আছে? ধরুন, আমার প্যাক্স-৬ জিন টি ইদুরে প্রবেশ করালে ইদুরের দেহে মানুষের চোখ উৎপন্ন হয়না। কারন আমার ক্ষেত্রে জিনটি যখন অন হচ্ছে ইদুরের দেহে গিয়ে তখন আর অন হচ্ছে না। তাহলে এই কখন অন হতে হবে এই বিষয়টি কিভাবে নির্দিষ্ট হচ্ছে?
জানিনা প্রশ্নটা ঠিক হল কিনা? বায়োলজীতে সীমিত জ্ঞানের জন্য আপনার বিবর্তনের উপর মূল্যবান লেখাগুলো নিশ্চুপে পড়ে যাই। কিন্তু কখনও প্রশ্ন করার সাহস পাইনা। আজ সাহস করে করেই ফেললাম।
@ মিঠুন,
একটা লাখ টাকা দামের প্রশ্ন করলেন, আমি এই বিষয়টা নিয়ে বিস্তারিত লেখার প্ল্যান করেছিলাম এর পরের পর্বে। এই ধরণের প্রশ্নগুলোই আসলে লেখাকে সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করে। নিয়ন্ত্রক জিন কি করে, সুইচের কাজ কি, আর আমাদের চির চেনা প্রোটিন তৈরিকারি জিনগুলোর কাজ কি। এক কাজ করি, আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে বেশ কিছু কথা বলতে হবে, কিছুক্ষণের মধ্যে লেখাটাই আপডেট করে দেই, তাহলে হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধা হবে।
অনুরোধ করবো ভবিষ্যতেও এধরণের প্রশ্ন করবেন, তাহলে বুঝতে সুবিধা হয় পাঠকের কোথায় খটকা লাগছে – এ জন্যই ব্লগে দেওয়া লেখাগুলো।
আর ছোটবেলা থেকে জীববিজ্ঞানে অনীহা থাকায় কিছু মিস করেননি। আমাদের দেশের জীববিজ্ঞানের কারিকুলামে আর বিবর্তন পড়ানো হয় না, আর যখন পড়ানো হত তখনো তা থেকে তেমন কিছু শিখতে পারতেন না। খুব বেশী হলে যেটা করতে পারতেন সেখান থেকে হয়তো বিবর্তনের উপর একটা ভালো বই খুঁজে পড়ার অনুপ্রেরণা পেতে পারতেন । কিন্তু এখন যেহেতু সিলেবাস থেকেই বিবর্তন উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তাই সে সম্ভাবনাটুকুও আর নেই। জীববিজ্ঞান কি করে বিবর্তনের কন্সেপ্ট ছাড়া পড়ানো যায় সেটা ভাবলেই অবাক লাগে।
@বন্যা আহমেদ,
বন্যাপু, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, আর আমাকে তুমি করে বলবেন, আমি আপনার অনেক ছোট, তাই আপনি করে বললে অস্বস্তি হয়।
@মিঠুন, তোমাকে আরেকটু কষ্ট করতে অনুরোধ করবো, মন্তব্যে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে অনেক বড় হয়ে যেতো। তাই লেখার প্রথমাংশটাতে( প্রায় অর্ধেকটাতেই) বেশ কিছু নতুন তথ্য যোগ করলাম। পড়ে জানায়ও এখন তোমার প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে কিনা। না হলে আবারও পরিষ্কার করার চেষ্টা করে দেখবো।
@বন্যাপু,
ধন্যবাদ আপনাকে। আমি বোধহয় বুঝতে পেরেছি। আমি আমার কনসেপশন টা নিচে তুলে ধরছি। কোথাও কোন ভুল থাকলে ধরিয়ে দিবেন-
চোখ তৈরীর জন্য ২০০০ জিন কাজ করে; আবার যেহেতু প্যাক্স ৬ জিনটির কারনেই চোখের উদ্ভব হবে কি হবেনা, বা হলে কোথায় হবে এইসব বিষয় নির্ধারিত হচ্ছে, তাই এটিকে বলা হচ্ছে নিয়ন্ত্রক জিন। আমাদের ডিএনএর মাত্র শতকরা দেড়ভাগ প্রোটিন তৈরিকারি জিন হিসেবে কাজ করে আর বাকি ডিএনএর শতকরা তিনভাগ কাজ করে রেগুলেটর হিসেবে; তাই বলতে পারি প্যাক্স জিনটি ঐ শতকরা তিন ভাগের ভিতরে পরে আর বাকি যে ১৯৯৯ টি (প্রায়)জিন রয়েছে তারা পরে শতকরা দেড়ভাগ ক্যাটাগরীতে। তার মানে প্যাক্স জিনটি প্রথমে নির্ধারন করে চোখ উত্পন্ন হবে কি হবে না, হলে কোথায় হবে; এরপর এটি বাকি ১৯৯৯ টি জিনের উপর (প্রোটিন তৈরীকারী জিন) নিয়ন্ত্রন আরোপ শুরু করে এবং তাদেরকে যখন যেসময়ে প্রয়োজন সে সময়ে অন বা অফ হবার নির্দেশ দেয়। ভিন্ন ভিন্ন প্রনীতে এই নির্দেশাবলীও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। একারনেই মাছির চোখ আর মানুষের চোখে এত পার্থক্য।
প্যাক্স-৬ জিনের কথা বলেছেন যে এরা শুধু চোখ ই নয়, বরং আরও কিছু অংগ যেমন নাক বা মস্তিষ্কের একটা অংশ তৈরীতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। এটা কি সব প্রানীদের বেলায়ই প্রযোজ্য? মানে সব প্রানীদের তো আর মানুষের মত নাক নেই, যেসব প্রানীদের এই মানুষের মত নাক আছে বা ধরেন হাতির শূর, এগুলোর পেছনেও কি প্যাক্স জিন কাজ করে? যদি না করে, তাহলে কি আমি বলতে পারিনা যে, আসলে কাজ করার কথা ছিল কারন যদি সকল প্রাণীর চোখের পেছনে একই জিন কলকাঠী নাড়ে, তবে সকল প্রানীর নাক বা একই ধরনের অংগপ্রত্যঙ্গের পেছনেও একই ধরনের নিয়ন্ত্রক জিনের কলকাঠী নাড়া উচিৎ?
আমার কিন্তু বেশ সাবলীল এবং উপাদেয় লাগলো। কেন মিছিমিছি ভাবছেন?
চালিয়ে যান।
@ব্লাডি সিভিলিয়ান, ধন্যবাদ।
দারুন একটা লেখা।
ব্লগে একবার পরিচিত এক বড় ভাই বলেছিলেন, তিনি মেসিন ভিশন নিয়ে কাজ করেন। এখন মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন, এই চোখ এমনি এমনি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হতে পারেনা।
তারপর ওয়াজ ডারউইন রং ডকুতে সুইডিস বিজ্ঞানী ড্যান নিলসনের আলোক সংবেদনশীল পর্দা থেকে মানুষের চোখের গঠন পর্যন্ত বিবর্তনের ডেমনেস্ট্রেশন দেখে প্রথম বিবর্তনের উপর ব্লগ লিখি। সেখানে অবশ্য এতো ডিটেইল এবং প্যাক্স-৬ জিনের কথা ছিলোনা।
আগেও যৌক্তিক মনে হতো, তবুও কাউকে বোঝাতে গেলে, এক স্টেপ থেকে আরেক স্টেপ এ কীভাবে গেলো এইটা সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হতোনা। এখন তো দেখা যাচ্ছে আদতে কিছুই না ব্যাপারটা। লাফালাফির কোনো আদতে নেই। এভু ডেভু পুরাই রক করে।
আমাকে দুইটা প্যাক্স- ৬ দিয়েন। দুই হাতে দুইটা চোখ বানামু 🙂
বানানঃ
কোষবিশিষ্ট্য= বিশিষ্ট হবেনা?
@রায়হান আবীর,
ক্রেগ ভেন্টর রে একটা ফোন দাও, দেখো ব্যবস্থা করতে পারে কিনা। তয়, আপনের ট্যাকের অবস্থাটা কিরকম জানা দরকার তার আগে। একটা বেহুদ্দা ব্যাক্টেরিয়াল কোষ বানাইতে ওদের নাকি ৪০ মিলিয়ন ডলার লাগসে, প্যাক্স৬ দিয়া চোখ বানাইতে বিলিয়ন ডলারও লাগতে পারে। খুব বেশী কিছহু না অবশ্য 🙂 ।