(পূর্ব-প্রকাশিতের পর…)
…
অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ পর্ব:[০১] [০২] [০৩] [০৪] [*] [০৬] [০৭] [০৮]
০৬
ব্রাহ্মণদের প্রভূত্বকামী শাসনব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রধান অস্ত্রই হলো চতুবর্ণ প্রথা। অর্থাৎ সমাজে চারটি বর্ণের উপস্থিতি- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। এই প্রথার মাধ্যমে গোটা জনগোষ্ঠিকে এক অদ্ভুত বর্ণবৈষম্যের মধ্য দিয়ে বিভাজিত করে যে ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতি কায়েম করা হয়েছে, সেখানে স্বঘোষিত বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের আধিপত্য প্রশ্নহীন করে রাখা হয়েছে। বর্ণ-মর্যাদার দিক থেকে এর পরই রাজদণ্ডধারী ক্ষত্রিয়ের অবস্থান। তার নিচে বৈশ্য এবং সর্বনিকৃষ্ট বর্ণ শূদ্র। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, সেখানে কোন মানুষের উল্লেখ নাই বললেই চলে। অর্থাৎ মানুষ সম্পর্কিত ধারণা বা মানব সমাজটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে আগ্রাসনবাদী বৈদিক সমাজের সর্বগ্রাসী বর্ণ-বিভেদের ছায়ায়। গোটা মনুসংহিতার কোথাও কোন ভাবে মানুষ নামের কোন স্বতন্ত্র সত্ত্বার বা মানব জাতির অস্তিত্ব প্রায় খুঁজেই পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে- চারটি বর্ণভিত্তিক ব্রাহ্মণ জাতি, ক্ষত্রিয় জাতি, বৈশ্য জাতি ও শূদ্র জাতি। তবে চতুর্বর্ণের বাইরে আরেকটি গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রয়েছে- অন্ত্যজ বা অস্পৃশ্য। অর্থাৎ অস্তিত্ব থাকলেও সমাজ যাকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করে না।
যেহেতু চারটি বর্ণ নিয়ে সমাজ, তাই এই অস্পৃশ্যরা বর্ণ-বিভাগেরও বাইরে। মনুসংহিতায় এদেরকে ‘সঙ্করজাতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে এরা কি এই বৈদিক সমাজ বা সনাতন হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত নয় ? একটা অস্পষ্ট বিভ্রান্তি থেকে যায়-
ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ো বৈশ্যস্ত্রয়ো বর্ণা দ্বিজাতয়ঃ।
চতুর্থ একজাতিস্তু শূদ্রো নাস্তি তু পঞ্চমঃ।। (১০/৪)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণের পক্ষে উপনয়ন সংস্কারের বিধান থাকায় এরা ‘দ্বিজাতি’ নামে অভিহিত হয়। আর চতুর্থ বর্ণ শূদ্র উপনয়নসংস্কার বিহীন হওয়ায় দ্বিজাতি নয়, তারা হলো ‘একজাতি’। এছাড়া পঞ্চম কোনও বর্ণ নেই অর্থাৎ ঐ চারটি বর্ণের অতিরিক্ত যারা আছে তারা সকলেই সঙ্করজাতি।
প্রাসঙ্গিকভাবেই বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্র পর্যন্ত চারজাতীয় মানুষই হলো চারটি বর্ণ। এ ছাড়া বর্বর, কৈবর্ত প্রভৃতি অন্যান্য যে সব মানুষ আছে তারা সঙ্কীর্ণযোনি বা বর্ণসঙ্কর। চারটি বর্ণের মধ্যে তিনটি বর্ণ ‘দ্বিজাতি’ অর্থাৎ এদের দুবার জন্ম হয়; কারণ দ্বিতীয়-জন্ম উৎপাদক উপনয়ন-সংস্কার কেবল ঐ তিনটি বর্ণের পক্ষেই শাস্ত্রমধ্যে বিহিত আছে। শূদ্র হলো একজাতি অর্থাৎ ওদের একবার মাত্র জাতি বা জন্ম হয়, কারণ শূদ্রের পক্ষে উপনয়ন-সংস্কারের বিধান নেই। অতএব অনিবার্যভাবে শূদ্ররা হলো নিম্নবর্ণ। ফলে এরা ব্রত যজ্ঞ অনুষ্ঠানাদি পালনের যোগ্য হতে পারে না।
এবার বর্ণসঙ্কর বিষয়ে মনুর বৈদিক অভিজ্ঞানশ্রুতি থেকে কিঞ্চিৎ ধারণা নিতে পারি।
সর্ববর্ণেষু তুল্যাসু পত্নীষ্বক্ষতযোনিষু।
আনুলোম্যেন সম্ভূতা জাত্যা জ্ঞেয়াস্ত এব তে।। (১০/৫)
বঙ্গানুবাদ: সকল বর্ণের পক্ষেই স্বপরিণীতা ও অক্ষতযোনি (অর্থাৎ প্রথমবিবাহিতা এবং যার সাথে আগে কোনও পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক হয় নি) সবর্ণ বা সমান জাতির নারীর গর্ভে সবর্ণ পতিকর্তৃক উৎপাদিত সন্তান পিতামাতার জাতি থেকে অভিন্ন। অর্থাৎ ব্রাহ্মণীতে ব্রাহ্মণকর্তৃক উৎপাদিত সন্তান ‘ব্রাহ্মণ’হবে; ক্ষত্রিয়কর্তৃক এই রকম ক্ষত্রিয়া পত্নীর গর্ভে উৎপাদিত সন্তান ‘ক্ষত্রিয়’ হবে; বৈশ্যকর্তৃক স্বপরিণীতা ও অক্ষতযোনি বৈশ্যার গর্ভে উৎপাদিত সন্তান ‘বৈশ্য’ এবং শূদ্রকর্তৃক ঐ রকম শূদ্রার গর্ভে উৎপাদিত সন্তান ‘শূদ্র’ হবে। এসব ছাড়া অসবর্ণা স্ত্রীর গর্ভে উৎপন্ন সন্তান জনকের সাথে সবর্ণ হয় না, নিশ্চয়ই জাত্যন্তর হবে।স্ত্রীষ্বনন্তরজাতাসু দ্বিজৈরুৎপাদিতান্ সুতান্।
সদৃশানেব তানাহুর্মাতৃদোষবিগর্হিতান্।। (১০/৬)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ প্রভৃতি দ্বিজ বর্ণ-ত্রয়ের দ্বারা অনুলোমক্রমে অনন্তর অর্থাৎ অব্যবহিত পরবর্তী জাতীয়া নারীর গর্ভে জাত সন্তানেরা অর্থাৎ ব্রাহ্মণকর্তৃক ক্ষত্রিয়াতে উৎপন্ন সন্তান এবং ক্ষত্রিয় কর্তৃক বৈশ্যানারীতে উৎপন্ন সন্তান এবং বৈশ্যকর্তৃক শূদ্রা নারীতে উৎপন্ন সন্তানগণ হীনজাতীয়া মাতার গর্ভে উৎপন্ন বলে পিতৃজাতি প্রাপ্ত হয় না, কিন্তু উৎপাদকের (পিতার) জাতির সদৃশ হয়। এই সন্তানেরাই মূর্ধাবসিক্ত, মাহিষ্য ও করণ নামে অভিহিত হয়। এরা মাতৃজাতির তুলনায় উৎকৃষ্ট কিন্তু পিতৃজাতির তুলনায় নিকৃষ্ট।বিপ্রস্য ত্রিষু বর্ণেষু নৃপতের্বর্ণয়োর্দ্বয়োঃ।
বৈশ্যস্য বর্ণে চৈকস্মিন্ ষড়েতেহপসদাঃ স্মৃতাঃ।। (১০/১০)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণের পক্ষে তিনটি বর্ণের নারীতে (অর্থাৎ পরিণীতা ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা ও শূদ্রা স্ত্রীতে) উৎপন্ন (মূর্দ্ধাবসিক্ত, অম্বষ্ঠ বা ভৃজ্যকণ্ঠ ও নিষাদ বা পারশব), ক্ষত্রিয় পুরুষের পক্ষে দুইটি বর্ণের নারীতে (অর্থাৎ বৈশ্যা ও শূদ্রা স্ত্রীতে) জাত (মাহিষ্য ও উগ্র), এবং বৈশ্য পুরুষের পক্ষে একটি বর্ণের নারীতে (অর্থাৎ শূদ্রা স্ত্রীতে) জাত (করণ)- এই ছয় জাতীয় অনুলোমজ সন্তান অপসদ নামে অভিহিত হয় (অপসদ মানে পুত্রের যে প্রয়োজন তা থেকে এরা অপসারিত; সমান জাতীয় পুত্রের তুলনায় এরা অপসদ অর্থাৎ অপকৃষ্ট); এই অনুলোম-সঙ্করজাতির কথা স্মৃতিমধ্যে বর্ণিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, শাস্ত্রানুযায়ী পুত্রের প্রয়োজন হয় পিতৃপুরুষের আত্মার মুক্তি বা সদগতির লক্ষে (স্বর্গারোহণ) শ্রাদ্ধাদিতে পিণ্ডদান করার জন্য। পিণ্ডদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে মূলত অন্যান্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়ে যায়। বৈদিক শাস্ত্রে পুত্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যায় নিম্নোক্ত শ্লোকটি থেকে-
সংস্থিতস্যানপত্যস্য সগোত্রাৎ পুত্রমাহরেৎ।
তত্র যদ্ রিক্থজাতং স্যাত্তত্তস্মিন্ প্রতিপাদয়েৎ।। (৯/১৯০)
বঙ্গানুবাদ: কোনও ব্যক্তি যদি অপুত্র অবস্থায় মারা যায়, তাহলে তার স্ত্রী গুরুজনদের দ্বারা নিযুক্ত হয়ে সগোত্র পুরুষের দ্বারা পুত্র উৎপাদন করবে এবং মৃত ব্যক্তির যা কিছু ধনসম্পত্তি তা ঐ পুত্রকে অর্পণ করবে।
বৈদিক বিধান এমনই অলৌকিক শাস্ত্র যে সম্পদরক্ষায় পুত্রের প্রয়োজনে মনুসংহিতার ৫/১৫৭ সংখ্যক শ্লোকে (ইতঃপূর্বে উদ্ধৃত) বর্ণিত বিধবার কর্তব্যও সাময়িক রদ হয়ে যায়।
শাস্ত্র অনুযায়ী উপরোক্ত অনুলোমজ (উচ্চবর্ণ পিতার ঔরসে অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্ণ মাতার গর্ভজাত) সন্তানেরা সবর্ণ পুত্রের সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত হলেও এরা বর্ণবহির্ভূত নয়। এরা মাতৃজাতির তুল্য অর্থাৎ মাতৃজাতির সংস্কারের যোগ্য হয়। কিন্তু প্রতিলোম-সঙ্করের (নিম্নবর্ণ পিতার ঔরসে অপেক্ষাকৃত উচ্চবর্ণ মাতার গর্ভজাত সন্তানের) ক্ষেত্রেই যতসব শাস্ত্রীয় সমস্যা ও জটিলতার সূত্রপাত। এক্ষেত্রে সর্বজ্ঞ মনু একের পর এক প্রতিলোমজ সঙ্করের উৎপত্তি ও পর্যায়ক্রমিক যে বহুবিধ জাতি-তালিকা তৈরি করতে থাকেন, রীতিমতো বিভ্রান্ত হবার মতো। এবং একটা পর্যায়ে এসে হঠাৎ করে আমরা কতকগুলো স্পর্শাদি-অযোগ্য অছ্যুৎ বা অস্পৃশ্য জাতির সন্ধান পেতে থাকি। যেমন প্রাথমিকভাবে সূত, মাগধ, বৈদেহ, আয়োগব, ক্ষত্তা, চণ্ডাল নামের যে প্রতিলোমজ-সঙ্কর জাতি পাই, তাদের মধ্যে চণ্ডাল হলো অস্পৃশ্য। তবে আয়োগব ও ক্ষত্তা অস্পৃশ্য না হলেও এরা অপসদ বা নরাধম, অর্থাৎ পুত্রকাজ করার অযোগ্য। কারণ এরা শূদ্র পিতার ঔরসে প্রতিলোমজ-সঙ্কর। এক্ষেত্রে মনুসংহিতায় সুকৌশলে তৈরি বিধিবদ্ধ সূত্রগুলো কিঞ্চিৎ অধ্যয়ন করে নেয়া যায়-
একান্তরে ত্বানুলোম্যাদম্বষ্ঠোগ্রৌ যথা স্মৃতৌ।
ক্ষত্ত্ববৈদেহকৌ তদ্বৎ প্রাতিলোম্যেহপি জন্মনি।। (১০/১৩)
বঙ্গানুবাদ: একান্তরে অর্থাৎ একটি মাত্র বর্ণের ব্যবধানে অর্থাৎ ব্রাহ্মণপুরুষের ঔরসে বৈশ্যজাতীয় নারীর গর্ভে জাত অম্বষ্ঠ এবং ক্ষত্রিয়পুরুষের ঔরসে শূদ্রানারীর গর্ভে জাত উগ্র- এইসব অনুলোমজ সন্তান যেমন স্পর্শাদিযোগ্য হয়, সেইরকম প্রতিলোমক্রমে একান্তরিত অর্থাৎ একজাতি-ব্যবধানে উচ্চবর্ণের স্ত্রীতে জাত (যেমন, শূদ্রপুরুষ থেকে ক্ষত্রিয়া স্ত্রীতে উৎপন্ন ক্ষত্তা এবং বৈশ্য পুরুষ থেকে ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রীতে উৎপন্ন বৈদেহ) দুই জাতি স্পর্শাদিযোগ্য হবে। (তবে যজনাদিক্রিয়াতে এদের তুল্যতা নেই।)
এই সূত্রানুযায়ী প্রতিলোমজগণের মধ্যে দুই বর্ণ-ব্যবধানে (অর্থাৎ শূদ্র পুরুষ কর্তৃক ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রীতে) উৎপন্ন চণ্ডাল এই সূত্রে পড়ে না বলে শাস্ত্রানুযায়ী চণ্ডালই একমাত্র অস্পৃশ্য হয়ে যায়।
এখানে একটা সাধারণ সূত্র খেয়াল রাখতে হবে। চতুর্বর্ণ প্রথার মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এরা বর্ণক্রমে দ্বিজজাতি। অর্থাৎ তাদের জন্য উপনয়ন-সংস্কারের বিধান থাকায় এরা উৎকৃষ্ট জাতি। তাই এই তিন বর্ণের নারীতে অনুলোমক্রমে উৎপাদিত সন্তানও দ্বিজ হয়। অর্থাৎ ব্রাহ্মণপুরুষ কর্তৃক ব্রাহ্মণজাতীয়া, ক্ষত্রিয়জাতীয়া ও বৈশ্যজাতীয়া স্ত্রীতে এবং ক্ষত্রিয়পুরুষ কর্তৃক ক্ষত্রিয়া ও বৈশ্যা স্ত্রীতে এবং বৈশ্যপুরুষ কর্তৃক বৈশ্যনারীতে উৎপাদিত সন্তান দ্বিজ হবে। আর বাহ্যক্ষেত্রে অর্থাৎ প্রতিলোমক্রমে অনন্তরবর্তী উচ্চবর্ণের স্ত্রীতে যেমন বৈশ্যপুরুষ কর্তৃক ক্ষত্রিয়া স্ত্রীতে এবং ক্ষত্রিয়পুরুষ কর্তৃক ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রীতে যে সন্তান উৎপাদিত হয় সেও তাদের আত্মা অর্থাৎ দ্বিজ হয়। এককথায় দ্বিজদের মধ্যে আন্তসম্পর্কক্রমে উৎপাদিত বর্ণসঙ্কররা দ্বিজজাতিই হবে।
কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কোথাও শূদ্র নারী বা পুরুষের আবির্ভাব ঘটলে। শাস্ত্রীয় বিধানে দাসজাতি শূদ্রবর্ণের জন্য উপনয়ন-সংস্কারের বিধান নাই বলে এরা একজাতি। তাই তাদের মাধ্যমে সৃষ্ট বর্ণসঙ্করাও দ্বিজ হয় না। এক্ষেত্রে অনুলোম প্রক্রিয়ায় শূদ্রা স্ত্রী উচ্চবর্ণভোগ্যা হওয়া তার জন্য ভাগ্যের ব্যাপার বলে উৎপাদিত সন্তান দ্বিজ হয় না বটে, তবে মাতৃজাতি শূদ্র থেকে কিঞ্চিৎ উৎকৃষ্ট হয়। কিন্তু শূদ্রবর্ণের পুরুষের জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ প্রতিলোম প্রক্রিয়ায় উচ্চবর্ণের স্ত্রীভোগ গুরুতর সামাজিক অপরাধ বা দূষণ হিসেবেই চিহ্নিত। তাই এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত বর্ণসঙ্কর সন্তান তাদের পুত্র-অধিকার হারিয়ে নরাধম হয়ে যায়। আর এই অপরাধের মাত্রা বা দূষণপ্রক্রিয়া তীব্রতম হলে অর্থাৎ শূদ্রপুরুষ কর্তৃক ব্রাহ্মণা স্ত্রী দূষিত হলে উৎপাদিত বর্ণসঙ্কর অস্পৃশ্য চণ্ডাল হয়ে যায়।
অতএব, শূদ্র পুরুষ যেখানে বর্ণসঙ্করে জড়িত সেখানে কি সমস্যা না হয়ে পারে ?
আয়োগবশ্চ ক্ষত্তা চ চাণ্ডালশ্চাধমো নৃণাম্।
প্রাতিলোম্যেন জায়ন্তে শূদ্রাদপসদাস্ত্রয়ঃ।। (১০/১৬)
বঙ্গানুবাদ: শূদ্র পুরুষ থেকে প্রতিলোমক্রমে জাত অর্থাৎ শূদ্র পুরুষের ঔরসে বৈশ্যা স্ত্রীতে জাত আয়োগব, ক্ষত্রিয়া স্ত্রীতে জাত ক্ষত্তা এবং ব্রাহ্মণী স্ত্রীতে জাত চণ্ডাল- এই তিন জাতি পুত্রকাজ করার অযোগ্য। এই জন্য এরা অপসদ অর্থাৎ নরাধম বলে পরিগণিত হয়। এদের মধ্যে চণ্ডাল হলো অস্পৃশ্য।চণ্ডালশ্বপচানাং তু বহির্গ্রামাৎ প্রতিশ্রয়ঃ।
অপপাত্রাশ্চ কর্তব্যা ধনমেষাং শ্বগর্দভম্।। (১০/৫১)
বঙ্গানুবাদ: চণ্ডাল, শ্বপচ প্রভৃতি জাতির বাসস্থান হবে গ্রামের বাইরে। এইসব জাতিকে ‘অপপাত্র’ করে দিতে হয়; কুকুর এবং গাধা হবে তাদের ধনস্বরূপ। (অপপাত্র হলো যে পাত্রে ভোজন করলে তা আর সংস্কার দ্বারা শুদ্ধ করা চলবে না, তা পরিত্যাগই করতে হবে। অথবা তারা যে পাত্র স্পর্শ করে থাকবে তাতে অন্ন-শক্তু প্রভৃতি দেয়া চলবে না; কিন্তু পাত্রটি মাটির উপর রেখে দিলে কিংবা অন্য কোনও লোক তা হাতে করে ধরে থাকলে তার উপর ভাত-ছাতু প্রভৃতি দিয়ে মাটির উপর রেখে দিলে তারা ঐ খাদ্য গ্রহণ করবে। অন্য অর্থে ভাঙা পাত্রকে অপপাত্র বলে।)বাসাংসি মৃতচেলানি ভিন্নভাণ্ডেষু ভোজনম্।
কার্ষ্ণায়সমলঙ্কারঃ পরিব্রজ্যা চ নিত্যশঃ।। (১০/৫২)
বঙ্গানুবাদ: মৃত লোকের কাপড় এদের আচ্ছাদন (পোষাক) হবে; এরা ভাঙা পাত্রে ভোজন করবে; এদের অলঙ্কার হবে লৌহনির্মিত; এবং এরা সকল সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াবে। অর্থাৎ একই স্থানে বাস করবে না।
খুব সাধারণভাবে সঙ্কর জাতি থেকে সঙ্কর জাতিরই জন্ম হয়। আর শাস্ত্রানুযায়ী জন্মদোষ যেহেতু প্রজন্মক্রমেই স্থায়ী দোষ, যা থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই, তাই যেখানে নরাধম ও অস্পৃশ্যের ছোঁয়া পড়ে সেখানে পরবর্তী বংশ পরম্পরায় অস্পৃশ্য-সঙ্কর জাতিরই উৎপত্তি হতে থাকে। এভাবে ডাল-পালা বিস্তৃত করতে করতে সর্বজ্ঞ মনু তাঁর শঙ্করায়ন-শাস্ত্রকে এতোটাই জটিল পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে শেষপর্যন্ত শত শত অন্ত্যজ-অছ্যুৎ সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠির বিশাল এক জনগোষ্ঠিই সেখানে বাঁধা পড়ে যায়, যারা মূলত শ্রমজীবী। সমাজের গতিচক্রটিকে এরাই ধারণ করে অথচ এরাই হয়ে যায় বৈদিক সমাজের ব্রাত্য জনগোষ্টি- অছ্যুৎ, অস্পৃশ্য, দলিত বা নির্যাতিতও। মনুসংহিতায় এই ব্রাত্যজনগোষ্ঠির উৎপত্তি নির্ধারণক্রমে সৃষ্ট যে জালিকাবিন্যাস, এর সুদীর্ঘ তালিকা দেখলে রীতিমতো আঁৎকে ওঠতে হয় ! প্রাসঙ্গিক হিসেবে দুয়েকটি উদাহরণ প্রণিধানযোগ্য, যেমন-
যথৈব শূদ্রো ব্রাহ্মণ্যাং বাহ্যং জন্তুং প্রসূয়তে।
তথা বাহ্যতরং বাহ্যশ্চাতু র্বর্ণ্যে প্রসূয়তে।। (১০/৩০)
বঙ্গানুবাদ: শূদ্র যেমন ব্রাহ্মণী স্ত্রীতে বাহ্য অর্থাৎ নিকৃষ্ট চণ্ডাল নামক সন্তানের জন্ম দেয়, সেইরকম সূত (ক্ষত্রিয় পুরুষ থেকে ব্রাহ্মণী স্ত্রীতে জাত সন্তান সূত) প্রভতি অন্যান্য বাহ্যজাতি (বৈদেহক, চণ্ডাল, মাগধ, ক্ষত্তা এবং আয়োগব) অর্থাৎ নিকৃষ্টজাতীয় পুরুষ চারবর্ণের নারীতে আরও বেশি বাহ্য অর্থাৎ নিকৃষ্টজাতীয় সন্তান উৎপাদন করে।নিষাদো মার্গবৎ সূতে দাশং নৌকর্মজীবিনম্।
কৈবর্তমিতি যং প্রাহুরার্য্যাবর্তনিবাসিনঃ।। (১০/৩৪)
বঙ্গানুবাদ: আয়োগবজাতীয় (শূদ্র পুরুষ থেকে বৈশ্যনারীর গর্ভজাত সন্তান হলো আয়োগব) নারীতে নিষাদজাতীয় পুরুষ (ব্রাহ্মণ কর্তৃক শূদ্রা নারীতে জাত সন্তানকে নিষাদ বলে) ‘মার্গব’ নামক সঙ্কর সৃষ্টি করে থাকে। তাদের দাস বলা হয়; আর্যাবর্তনিবাসিগণ তাদের কৈবর্ত নামে অভিহিত করেন। তারা নৌকর্মের দ্বারা জীবিকার্জন করে। (নৌকর্ম হলো নৌকা চালান, তার দ্বারা জীবন ধারণ করা।)কারাবরো নিষাদাত্তু চর্মকারঃ প্রসূয়তে।
বৈদেহিকাদন্ধ্রমেদৌ বহির্গ্রামপ্রতিশ্রয়ৌ।। (১০/৩৬)
বঙ্গানুবাদ: নিষাদ পুরুষ থেকে ‘বৈদেহী’ নারীতে (বৈশ্য পুরুষ থেকে ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রীতে উৎপন্ন সন্তানকে বৈদেহ বলে) ‘কারাবর’ জাতি জন্মে; এরা চামড়ার কাজ করে। কারাবর এবং নিষাদজাতীয়া নারীতে ‘বৈদেহিক’ পুরুষ থেকে ‘অন্ধ্র’ এবং ‘মেদ’ এই দুই বর্ণসঙ্কর সৃষ্ট হয়; গ্রামের বাইরে এদের বাসস্থান।চাণ্ডালৎ পাণ্ডুসোপাকন্ত্বক্সারব্যবহারবান্।
আহিণ্ডিকো নিষাদেন বৈদেহ্যামেব জায়তে।। (১০/৩৭)
বঙ্গানুবাদ: চণ্ডালজাতীয় পুরুষ থেকে বৈদেহজাতীয় নারীতে ‘পাণ্ডুসোপাক’ নামক বণসঙ্করের উৎপত্তি; এরা বাঁশ থেকে ঝোড়া-চুব্ড়ী প্রভৃতি তৈয়ার করে জীবিকা নির্বাহ করে। নিষাদ পুরুষের ঔরসে ঐ ‘বৈদেহী’ নারীতেই ‘আহিণ্ডিক’ জাতির উৎপত্তি। (তাদেরও ঐ একই বৃত্তি।)নিষাদস্ত্রী তু চাণ্ডালাৎ পুত্রমন্ত্যাবসায়িনম্।
শ্মশানগোচরং সূতে বাহ্যানামপি গর্হিতম্।। (১০/৩৯)
বঙ্গানুবাদ: নিষাদজাতীয়া নারী চণ্ডালজাতীয় পুরুষ থেকে ‘অন্ত্যাবসায়ী’ নামক সন্তান প্রসব করে; সে শ্মশানের কাজে নিযুক্ত হয়; সে নিকৃষ্টজাতিরও নিন্দিত।
অন্ত্যজ জাতিগোষ্ঠির উৎপাদনরহস্য নিয়ে এরকম ভুরিভুরি দৃষ্টান্ত-শ্লোক মনুসংহিতায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে। এই সঙ্করায়ন-প্রক্রিয়ায় অনন্তপ্রকার বর্ণসঙ্কর উৎপন্ন হতে পারে বলে খোদ শাস্ত্রকারই এ অভিমত ব্যক্ত করেন। তাই বাস্তবে এই অছ্যুৎ বর্ণসঙ্কর চেনার উপায় বা প্রক্রিয়া কী হবে, এ প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই আসতে পারে। হয়তো এসেছেও। নইলে পবিত্র মনুসংহিতায় এরকম শ্লোক আসতো কি?
সঙ্করে জাতয়স্ত্বেতাঃ পিতৃমাতৃপ্রদর্শিতাঃ।
প্রচ্ছন্না বা প্রকাশা বা বেদিতব্যাঃ স্বকর্মভিঃ।। (১০/৪০)
বঙ্গানুবাদ: পিতা-মাতার নাম নির্দেশপূর্বক এইসব হীন সঙ্করজাতির কথা বলা হলো; এছাড়া যাদের পিতা-মাতার নাম জানা যায় না, এমন যারা গুপ্তভাবে বা প্রকাশ্যভাবে বর্ণসঙ্কররূপে উৎপাদিত হয়, তাদের জাতিপরিচয় তাদের ক্রিয়াকলাপ থেকে জানতে হবে।
কারণ-
পিত্র্যং বা ভজতে শীলং মাতুর্ব্বোভয়মেব বা।
ন কথঞ্চন দুর্যোনিঃ প্রকৃতিং স্বাং নিযচ্ছতি।। (১০/৫৯)
বঙ্গানুবাদ: জন্মগত দোষযুক্ত ব্যক্তি পিতার দুষ্ট স্বভাব অথবা মাতার নিন্দিত স্বভাব অথবা উভয়েরই স্বভাবের অনুবর্তী হয়। যে লোক দুর্যোনি অর্থাৎ বর্ণসঙ্করজাত নিন্দিত ব্যক্তি, সে কখনো নিজ জন্মের কারণ অর্থাৎ পিতামাতার স্বভাবকে গোপন করতে পারে না।
স্বার্থগৃধ্নুতায় ক্ষমতাদর্পী বৈদিক ব্রাহ্মণ তথা স্বঘোষিত উচ্চবর্ণধারী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠিটা কী জঘণ্য বর্ণবিদ্বেষী হতে পারে মনুসংহিতায় উদ্ধৃত উপরোক্ত অবশ্য-পালনীয় শ্লোকগুলো এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। এরকম শত-সহস্র বর্ণবিদ্বেষী শ্লোক গোটা মনুসংহিতা জুড়ে পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। মজার ব্যাপার হলো, বৈদিক বা আর্য-সভ্যতার বাইরে আর কোন দেশে বা সভ্যতায় বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের অস্তিত্ব মনুসংহিতায় স্বীকার করা হয়নি। হয়তো এটাই মনুকৃত একমাত্র সত্যবাদিতা বা বাস্তবতা স্বীকার। তবে আর্য-সভ্যতার বাইরেও পৃথিবীতে যে আরো বহু দেশ রয়েছে বা থাকতে পারে তা হয়তো অস্বীকার করার উপায় ছিলো না। ফলে সেসব দেশেও শাসক সম্প্রদায় থাকবে এটাই স্বাভাবিক এবং তাদের অস্তিত্বকেও স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার দম্ভে এরা এতোই একদেশদর্শী ছিলো যে, মনুসংহিতা অনুযায়ী শাসকশ্রেণী ক্ষত্রিয় হলেও সেসব দেশের শাসককে উচ্চবর্ণের ক্ষত্রিয় বলে গ্রহণ করা সংগত বিবেচিত হয়নি। কারণ উপনয়নাদি-সংস্কার পালন না করা এবং ‘ব্রাহ্মণ’ নামক বেদাংশে বিহিত বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে ওরা শূদ্র হয়ে গেছে। মনুশাস্ত্র অনুযায়ী-
পৌণ্ড্রকাশ্চৌড্রদ্রবিড়াঃ কাম্বোজা যবনাঃ শকাঃ।
পারদা পহ্নবাশ্চীনাঃ কিরাতা দরদাঃ খশাঃ।। (১০/৪৪)
বঙ্গানুবাদ: পৌণ্ড্রক, উড্র, দ্রাবিড়, কাম্বোজ, যবন, শাক, পারদ, পহব, চীন, কিরাত, দরদ ও খশ- এই সব দেশোদ্ভব ক্ষত্রিয়গণ তাদের কর্মদোষে শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছে।
কী তাদের কর্মদোষ ?
শনকৈস্তু ক্রিয়ালোপাদিমাঃ ক্ষত্রিয়জাতয়ঃ।
বৃষলত্বং গতা লোকে ব্রাহ্মণাদর্শনেন চ।। (১০/৪৩)
বঙ্গানুবাদ: ওই সমস্ত ক্ষত্রিয়জাতিগণ পুরুষানুক্রমে উপনয়নাদি, নিত্যাগ্নিহোত্র ও সন্ধ্যাবন্দনা প্রভৃতি ক্রিয়ার অনুষ্ঠান না করায় এবং ‘ব্রাহ্মণ’ নামক বেদাংশে বিহিত বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করায় ক্রমে ক্রমে বৃষলত্ব অর্থাৎ শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছে।
(চলবে…)
@ রণদীপম বসু, বাবা সাহেবের কথা শিরোনাম এ আছে কিন্তু লেখায় নেই কেন সেটা জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেটার উত্তরতো আপনি দিয়েই দিয়েছেন উপরের মন্তব্যে। আগেই ধন্যবাদ দিয়েছি এই সিরিজটা লেখার জন্য, তাই আবার ধন্যবাদ দিচ্ছি না। অনেক কিছু জানতে পারছি এটা থেকে।
এবার পাঠক হিসেবে আমার দুই একটা মতামত বা পর্যবেক্ষণের কথা বলি। আমার কাছে সবসময়েই মনে হয় যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো ব্যাখ্যা না করলে তা পরিপূর্ণ হয় না। যেমন ধরুন, বিপ্লব যেমন বলেছিল যে বেদ ১৫০০ বছর ধরে বেদ লেখা হয়েছিল এবং প্রথম পর্যায়ের লেখাগুলোর সাথে পরের গুলোর বিশাল পার্থক্য দেখা যায়। এ সময় যদি তারা নোমাড সমাজব্যবস্থা থেকে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় উত্তোরিত হয়ে থাকে তাহলে সেটা ঐতিহাসিক/সামাজিক, নৃতাত্বিক, বৈজ্ঞানিক সব দিক থেকেই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়, এর ফলে তাদের চিন্তা, চেতনা, মূল্যবোধ, সমাজব্যবস্থায় বিশাল পরিবর্তন ঘটার কথা। আর সেটা বেদ এর মধ্যে প্রতিফলিত হতে বাধ্য। জানি সেটা করতে হলে বিশাল গবেষণার প্রয়োজন, কিন্তু মাঝে মাঝে এই আলোচনাগুলো আসলে পাঠকের পক্ষেও কন্টেক্সট বোঝা সম্ভব হবে, এবং তাতে করে ধর্মের আলোচনা শুধু একতরফা সমালোচনায় পরিণত হয় না।
@বন্যা আহমেদ,
বন্যাপা, আপনার মন্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করেও বলি-
আমার এ লেখাটা কিন্তু ধর্মতত্ত্ব বিশ্লষণ করা নয়। শুধু মনুসংহিতার বর্ণবাদী দৃষ্টীভঙ্গিটা উপস্থাপন। এই বর্ণবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে আম্বেদকরের জীবন ও কর্মকাণ্ডকে উপলব্ধির প্রয়োজনে এই কাজটুকু করতে হয়েছে আমাকে, যেহেতু কেউ করেন নি, অন্তত আমার চোখে পড়েনি। ফলে আম্বেদকরকে জানতে বুঝতে হয়তো আমাদের সুবিধা হবে। যা আমি উপরে বিপ্লব দা’র মন্তব্যের জবাবে বলেছি।
মনুসংহিতার বিশাল ব্যাপ্ত মানব জীবনের সামগ্রিক আচরণ বিধি থেকে ছেকে ছেকে গুটিকয় শ্লোক উদ্ধৃত করে এর মৌলিক অবস্থানটাকেও বুঝানোর দরকার ছিলো। আমি যা করেছি, তা হলো, বিষয়গুলো মধ্যে একটা সূত্র ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা। কোন বিশ্লেষণ নয়। আর এ পোস্টের চরিত্র বিচারে এ ক্ষেত্রে হয়তো এর ঐতিহাসিক, সামাজিক বা নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণেরও দরকার ছিলো বলে আমার কাছে মনে হয় নি। হয়তো সময়ের ব্যবধান নিয়ে পর্ব আকারে যাচ্ছে বলে এবং প্রথম পর্বের পরে মাঝখানে চারটি পোস্ট কেবল মনুসংহিতা সংশ্লিষ্ট হয়ে গেছে বলে এখানে ভুল বোঝার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়ে গেছে, যা গোটা লেখাটাকে একটানে পড়লে এরকম সমস্যা হতো না বা হবে না বলে আমার ধারণা।
আর বিশ্লেষণে গেলে এতগুলো বিষয়ের অবতারণা হবে যে, শেষ পর্যন্ত হয়তো পরিসরের অভাবে খেই হারিয়ে ফেলতে হবে, মূল বিষয়টাতে আর আলোকপাত করা হবে না।
বেদ যে দীর্ঘসময় নিয়ে লেখা হয়েছে তার নমুনা কিন্তু আমরা মনুসংহিতা থেকেও পেয়ে যাই একটু সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে, যা আমি পরের পর্বটিতে কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছি।
আসলে আগের পর্ব পরের পর্ব বলছি এখানে পোস্ট দেয়ার ক্রমিক অবস্থা বুঝাতে। প্রকৃতপক্ষে আমি গোটা লেখাটা একটানে তৈরি করেছিলাম। এখন কেবল টুকরো টুকরো করে তা তুলে দিচ্ছি এখানে। হা হা হা! অবশ্য আমি সব লেখার ক্ষেত্রেই তা করে থাকি।
আপনার পর্যবেক্ষণটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং তা আমার মাথায় থাকলো। নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করতে পারলে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে হয়তো আলোচনা হতেও পারে।
ভালো থাকবেন। অনেকদিন আপনার পোস্ট পাচ্ছি না, না কি ফাঁকিবাজ আমার চোখেই পড়েনি বুঝতে পারছি না।
@রণদীপম বসু,
একদম ঠিক কথা, দোষটা আপনারই, মুক্তমনার এক্কেবারে উপরেই তো আমার লেখা দেখা যাচ্ছে, দেখেন না ক্যাম্নে বুঝি না 🙂
না আসলে বেশ কয়েকদিন ধরে লেখাটা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। মানব বিবর্তনের বইএ এগুলো না দিলে কাআবার টিং এজ ব্যাপারগুলো আসবেও না। এত্ত কঠিন বিষয়গুলো কিভাবে বিজ্ঞানের সাহিত্যের অংশ হিসেবে সোজা করে লেখা যায় সেটা বের করার বৃথা চেষ্টা করলাম। অনেকদিন আসলেই লেখা হয় নাই।
@বন্যা আহমেদ,
সম্ভবত উদার, বর্ণভেদহীন বৌদ্ধধর্মের চ্যালেঞ্জের প্রতিক্রিয়াশীল জবাব হল মনু স্মৃতি।
চমৎকার হচ্ছে। চলুক। :rose:
—
তবে উদ্ধৃতির সংখ্যা আরেকটু কমিয়ে বিশ্লেষণ কী আরো বাড়িয়ে দেওয়া যায়? 😕
@বিপ্লব রহমান,
বিপ্লব দা, আমার এ পর্ব পর্যন্ত সম্ভবত বুঝা যায় নি যে লেখাটা মূলত বাবাসাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকরকে নিয়ে। আম্মেদকরের জীবন, যুদ্ধ, রাজনীতি ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডগুলো সম্পর্কে আমরা কম-বেশি সবাই হয়তো জানি। কিন্তু তিনি কিরকম ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিজেকে পরিচালিত করেছিলেন তা কখনোই উপলব্ধিতে আসা সম্ভব নয় যদিনা পেছনের দর্শনটা সম্পর্কে আমরা কিছুটা অবগত না হই। মূলত সে লক্ষ্য থেকেই মনুসংহিতার হাজার হাজার বর্ণবিদ্বেষী শ্লোক থেকে প্রাসঙ্গিক কিছু শ্লোককে নমুনা হিসেবে উপস্থাপন করার প্রয়াস। কেননা আম্বেদকরের বিভিন্ন বক্তব্যে হিন্দু সমাজ, অস্পৃশ্য বা দলিত ও মনুসংহিতার পুনঃ পুণঃ উল্লেখ থাকবে। এ বক্তব্যের গভীর শিকড় কোথায় প্রোথিত তা সম্যক উপলব্ধির জন্যই আমার নিজের বিশ্লেষণ কম করে নমুনা উপস্থাপনে গুরুত্ব দিয়েছি। অবশ্য আগামী পর্ব থেকে খুব সম্ভবত মনু-উদ্ধৃতি বিশেষ থাকবে না।
এখানে বলে রাখি, আমি আম্বেদকরকে নিয়ে লেখা শুরুর পর মনুসংহিতার বোধগম্য শ্লোকের খোঁজে গুগল সার্চ করেছি পাক্কা দুদিন। উল্লেখযোগ্য কিছু না পাওয়ায় শেষে নিজেই উদ্যোগী হলাম অন্তর্জাল-স্মৃতিতে কিছু নমুনা যুক্ত করে দিতে। শ্লোকের আধিক্যও এ কারণেই। আর অতি-ধৈর্যসহকারে কষ্ট স্বীকার করে এগুলো ডিঙিয়ে এসেছেন বলে আম্বেদকরের কষ্টটা এবার হয়তো আগের চেয়ে আরেকটু বেশি উপলব্ধি করতে পারবেন। পাশাপাশি তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতীয় নেতাদের চরিত্রও এবার অন্যরকম উপলব্ধিতে জারিত করে নিতে সুবিধা হবে হয়তো।
এই দাঁতভাঙা সংস্কৃত ও সম্ভ্রান্ত অনুবাদের টিলা-টক্কর ডিঙাতে আপনাদের কষ্ট আমি ঠিকই অনুধাবন করতে পারি, কেননা আমি নিজেই বিরক্ত এসব খটমটে বচনে। হা হা হা !
আগামী পর্ব থেকে আশা করা যায় দাঁত ভাঙার ঝুঁকি আর থাকবে না।