(পূর্ব-প্রকাশিতের পর…)
…
অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ পর্ব:[০১] [০২] [০৩] [*] [০৫] [০৬] [০৭] [০৮]
০৪
সম্পদ অর্জন এবং তা নিজের অধিকারে রাখার প্রচেষ্টা ও নিরাপত্তার প্রয়োজনেই এককালে ব্যক্তির উত্তরাধিকার তৈরি জরুরি হয়ে পড়ে। এবং এ কারণেই মানব সমাজে বিবাহপ্রথার সৃষ্টি হয় বলে সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত। বৈদিক সমাজে বিবাহকে অন্যতম ধর্মানুষ্টানের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানেও বৈষম্যবাদী বর্ণপ্রথার তীব্র উপস্থিতি। বিশেষ করে নিম্নবর্গীয় শূদ্রনারীকে উচ্চবর্ণীয়দের দ্বারা ভোগ করার ব্যবস্থা পাকা করা হলেও শূদ্রদের জন্য কোন মর্যাদা বা সুযোগ না রেখে সর্বতোভাবে বঞ্চিত করার কূটকৌশলী প্রয়াস মনুসংহিতার বিবাহ ব্যবস্থায় তীব্রভাবে লক্ষ্যণীয়।
সবর্ণাহগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মণি।
কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ।। (৩/১২)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই দ্বিজাতিগণের দারপরিগ্রহব্যাপারে সর্বপ্রথমে (অর্থাৎ অন্য নারীকে বিবাহ করার আগে) সমানজাতীয়া কন্যাকেই বিবাহ করা প্রশস্ত। কিন্তু কামনাপরায়ণ হয়ে পুনরায় বিবাহে প্রবৃত্ত হলে (অর্থাৎ সবর্ণাকে বিবাহ করা হয়ে গেলে তার উপর যদি কোনও কারণে প্রীতি না জন্মে অথবা পুত্রের উৎপাদনের জন্য ব্যাপার নিষ্পন্ন না হলে যদি কাম-প্রযুক্ত অন্যস্ত্রী-অভিলাষ জন্মায় তাহলে) দ্বিজাতির পক্ষে বক্ষ্যমাণ নারীরা প্রশস্ত হবে। (পরবর্তী শ্লোকে তা বর্ণিত হয়েছে)শূদ্রৈব ভার্যা শূদ্রস্য সা চ স্বা চ বিশঃ স্মৃতে।
তে চ স্বা চৈব রাজ্ঞশ্চ তাশ্চ স্বা চাগ্রজম্মনঃ।। (৩/১৩)
বঙ্গানুবাদ: একমাত্র শূদ্রকন্যাই শূদ্রের ভার্যা হবে; বৈশ্য সজাতীয়া বৈশ্যকন্যা ও শূদ্রাকে বিবাহ করতে পারে; ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সবর্ণা ক্ষত্রিয়কন্যা এবং বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে; আর ব্রাহ্মণের পক্ষে সবর্ণা ব্রাহ্মণকন্যা এবং ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে।
অর্থাৎ এখানে ‘অনুলোম’ বিবাহের বিষয়টিকেই অনুমোদন করা হয়েছে। উচ্চবর্ণের পুরুষের সাথে অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্ণের কন্যার বিবাহকে অনুলোম বিবাহ বলে। এর বিপরীত বিবাহের নাম প্রতিলোম বিবাহ। প্রতিলোম বিবাহ সকল স্মৃতিকারদের দ্বারাই নিন্দিত। মনু মনে করেন, প্রথমে সজাতীয়া কন্যার সাথে বিবাহই প্রশস্ত। পুনর্বিবাহের ইচ্ছা হলে অনুলোম-বিবাহের সমর্থন দেয়া হয়েছে।
কিন্তু এখানেও অন্য ভার্যায় সমস্যা নেই, শূদ্রা ভার্যার ক্ষেত্রেই যত বিপত্তি।
দৈবপিত্র্যাতিথেয়ানি তৎপ্রধানানি যস্য তু।
নাশ্লন্তি পিতৃদেবাস্তং ন চ স্বর্গং স গচ্ছতি।। (৩/১৮)
বঙ্গানুবাদ: শূদ্রা ভার্যা গ্রহণের পর যদি ব্রাহ্মণের দৈবকর্ম (দেবতার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ বা যে ব্রাহ্মণভোজনাদি হয়, তা), পিত্র্যকর্ম (পিতৃপুরুষের প্রতি করণীয় কর্ম যেমন শ্রাদ্ধ, উদক-তর্পণ প্রভৃতি) এবং আতিথেয় কর্ম (যেমন অতিথির পরিচর্যা, অতিথিকে ভোজন দান প্রভৃতি) প্রভৃতিতে শূদ্রা ভার্যার প্রাধান্য থাকে অর্থাৎ ঐ কর্মগুলি যদি শূদ্রা স্ত্রীকর্তৃক বিশেষরূপে সম্পন্ন হয়, তাহলে সেই দ্রব্য পিতৃপুরুষগণ এবং দেবতাগণ ভক্ষণ করেন না এবং সেই গৃহস্থ ঐ সব দেবকর্মাদির ফলে স্বর্গেও যান না (অর্থাৎ সেই সব কর্মানুষ্ঠান নিষ্ফল হয়।)
অর্থাৎ শূদ্রা নারী ব্রাহ্মণের প্রথম পরবর্তী ভার্যা হয়ে ব্রহ্মভোগের বস্তু হলো ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্ত্রীর কোনো মর্যাদাই তার প্রাপ্য হয় না। আর যদি সে প্রথম বিয়ে করা স্ত্রী হয় ?
শূদ্রাং শয়নমারোপ্য ব্রাহ্মণো যাত্যধোগতিম্।
জনয়িত্বা সুতং তস্যাং ব্রাহ্মণ্যাদেব হীয়তে।। (৩/১৭)
বঙ্গানুবাদ: সবর্ণা স্ত্রী বিবাহ না করে শূদ্রা নারীকে প্রথমে বিবাহ করে নিজ শয্যায় গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণ অধোগতি (নরক) প্রাপ্ত হন; আবার সেই স্ত্রীতে সন্তানোৎপাদন করলে তিনি ব্রাহ্মণত্ব থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েন (অর্থাৎ সমানজাতীয়া নারী বিবাহ না করে দৈবাৎ শূদ্রা বিবাহ করলেও তাতে সন্তান উৎপাদন করা ব্রাহ্মণের উচিত নয়)।
এছাড়া ব্যভিচারের দণ্ডের ক্ষেত্রেও বৈষম্যবাদী বর্ণপ্রথা চোখে পড়ার মতো-
শূদ্রো গুপ্তমগুপ্তং বা দ্বৈজাতং বর্ণমাবসন্।
অগুপ্তমঙ্গসর্বস্বৈর্গুপ্তং সর্বেণ হীয়তে।। (৮/৩৭৪)
বঙ্গানুবাদ: কোনও দ্বিজাতি-নারী (অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ত্রিয় ও বৈশ্য নারী) স্বামীর দ্বারা রক্ষিত হোক্ বা না-ই হোক্, কোনও শূদ্র যদি তার সাথে মৈথুন ক্রিয়ার দ্বারা উপগত হয়, তাহলে অরক্ষিতা নারীর সাথে সঙ্গমের শাস্তিস্বরূপ তার সর্বস্ব হরণ এবং লিঙ্গচ্ছেদনরূপ দণ্ড হবে, আর যদি স্বামীর দ্বারা রক্ষিতা নারীর সাথে সম্ভোগ করে তাহলে ঐ শূদ্রের সর্বস্বহরণ এবং মারণদণ্ড হবে।
অথচ উচ্চবর্ণিয়দের ক্ষেত্রে একই অপরাধের জন্য বিবিধ বিধানের মাধ্যমে মনুশাস্ত্রে বর্ণক্রমানুসারে বিভিন্ন মাত্রার কিছু অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে মাত্র।
০৫
বৈদিক শাস্ত্র মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে যে, ব্রহ্মা তাঁর পা থেকে শূদ্রের সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ শূদ্রের জন্ম নিজে নিজে বা তার ইচ্ছায় হয়নি বা এ প্রক্রিয়ায় তার কোন কর্মদোষও জড়িত নেই। জড়িত কেবল স্রষ্টা ব্রহ্মার তীব্র বৈষম্যমূলক দৃষ্টি। অথচ মনুসংহিতায় শূদ্রের প্রতি অন্য বর্ণকে যে অমানবিক আচরণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা এককথায় ন্যাক্কারজনক।
ন শূদ্রায় মতিং দদ্যান্নোচ্ছিষ্টং ন হবিষ্কৃতম্।
ন চাস্যোপদিশেদ্ ধর্মং ন চাস্য ব্রতমাদিশেৎ।। (৪/৮০)
বঙ্গানুবাদ: শূদ্রকে কোন মন্ত্রণা-পরামর্শ দেবে না। শূদ্রকে উচ্ছিষ্ট দান করবে না। যজ্ঞের হবির জন্য যা ‘কৃত’ অর্থাৎ সঙ্কল্পিত এমন দ্রব্য শূদ্রকে দেবে না; শূদ্রকে কোনও ধর্মোপদেশ করবে না এবং কোনও ব্রত বা প্রায়শ্চিত্ত করতেও উপদেশ দেবে না।
কেউ এ বিধান অমান্য করলে তার পরিণতি বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
যো হ্যস্য ধর্মমাচষ্টে যশ্চৈবাদিশতি ব্রতম্।
সোহসংবৃতং নাম তমঃ সহ তেনৈব মজ্জতি।। (৪/৮১)
বঙ্গানুবাদ: যে ব্যক্তি (কোন ব্রাহ্মণকে ব্যবধানে না রেখে) নিজে শূদ্রকে ধর্মোপদেশ দেন, বা প্রায়শ্চিত্তাদি ব্রতের অনুষ্ঠান করতে আদেশ দেন, তিনি সেই শূদ্রের সাথে অসংবৃত নামক গহন নরকে নিমগ্ন হন।
উল্লেখ্য যে, মনুশাস্ত্রে শূদ্রের কোনরূপ সম্পদ অর্জনকেও নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।
শক্তেনাপি হি শূদ্রেণ ন কার্যো ধনসঞ্চয়ঃ।
শূদ্রো হি ধনমাসাদ্য ব্রাহ্মণানেব বাধতে।। (১০/১২৯)
বঙ্গানুবাদ: ‘ধন অর্জনে সমর্থ হলেও শূদ্রকে কিছুতেই ধন সঞ্চয় করতে দেওয়া চলবে না, কেননা ধন সঞ্চয় করলে ব্রাহ্মণদের কষ্ট হয়৷ শাস্ত্রজ্ঞানহীন শূদ্র ধনমদে মত্ত হয়ে ব্রাহ্মণদের পরিচর্যা না করে অবমাননা করতে পারে ৷’
এই যখন অবস্থা- সম্পদ অর্জন নয়, কোনরূপ খাবার সরবরাহও নয়, তাহলে শূদ্রদের বেঁচে থাকার উপায় ? উপায় একটা রয়েছে বৈ কি। এক্ষেত্রে যেসব জন্মদাস শূদ্র ব্রাহ্মণ বা অন্য উচ্চবর্ণীয়দের সেবা শুশ্রূষায় কৃতপরায়ণ হবে তাদের প্রতি অবশ্য কিছুটা করুণা দেখানো হয়েছে। যেমন-
শূদ্রাণাং মাসিকং কার্যং বপনং ন্যায়বর্তিনাম্।
বৈশ্যবচ্ছৌচকল্পশ্চ দ্বিজোচ্ছিষ্টঞ্চ ভোজনম্।। (৫/১৪০)
বঙ্গানুবাদ: ন্যায়চরণকারী শূদ্রগণ (অর্থাৎ সে সব শূদ্র ব্রাহ্মণ-শুশ্রূষা পরায়ণ) মাসে মাসে কেশ বপন (অর্থাৎ কেশমুণ্ডন) করবে এবং জননশৌচে ও মরণাশৌচে বৈশ্যের মত অশৌচ পালনের পর শুদ্ধ হবে এবং ব্রাহ্মণের উচ্ছিষ্ট ভোজন করবে।উচ্ছিষ্টমন্নং দাতব্যং জীর্ণানি বসনানি চ।
পুলাকাশ্চৈব ধান্যানাং জীর্ণাশ্চৈব পরিচ্ছদাঃ।। (১০/১২৫)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ উচ্ছিষ্ট অন্ন, জীর্ণ-পরিত্যক্ত বস্ত্র, ধানের পুলাক অর্থাৎ আগড়া (অসার ধান) এবং জীর্ণ পুরাতন ‘পরিচ্ছদ’ অর্থাৎ শয্যা-আসন প্রভৃতি আশ্রিত শূদ্রকে দেবেন।
মনুসংহিতায় বর্ণিত সামাজিক বিচার ব্যবস্থায় দণ্ড প্রয়োগের ক্ষেত্রেও বর্ণবৈষম্যের তীব্রতা লক্ষ করা যায়। অধমর্ণদের প্রতি উত্তমর্ণের খারাপ আচরণের দণ্ডের সাথে উত্তমর্ণের প্রতি অধমণের্র খারাপ আচরণের দণ্ডে যথেষ্ট ভেদ রয়েছে। কিন্তু নিম্নবর্ণ শূদ্র ও অন্ত্যজদের প্রতি দণ্ড প্রয়োগের বিধি একেবারেই অমানবিকতায় পর্যবসিত হতে দেখা যায়।
পঞ্চাশদ্ ব্রাহ্মণো দণ্ড্যঃ ত্রিয়স্যাভিশংসনে।
বৈশ্যে স্যাদর্দ্ধপঞ্চাশৎ শূদ্রে দ্বাদশকো দমঃ।। (৮/২৬৮)
বঙ্গানুবাদ: (উত্তমর্ণ) ব্রাহ্মণ যদি (অধমর্ণ অনুসারে) ক্ষত্রিয়ের প্রতি আক্রোশন বা গালিগালাজ করে তা হলে তার পঞ্চাশ দণ্ড হবে, বৈশ্যের প্রতি করলে পঁচিশ পণ এবং শূদ্রের প্রতি করলে বারো পণ দণ্ড হবে।শতং ব্রাহ্মণমাক্রুশ্য ক্ষত্রিয়ো দণ্ডমর্হতি।
বৈশ্যোহ প্যর্দ্ধশতং দ্বে বা শূদ্রস্তু বধমর্হতি।। (৮/২৬৭)
বঙ্গানুবাদ: ক্ষত্রিয় যদি ব্রাহ্মণকে গালাগালি দেয় তা হলে তার এক শ পণ দণ্ড হবে। এই একই অপরাধে বৈশ্যের দণ্ড হবে দেড় শ কিংবা দুই শ পণ; আর শূদ্র শারীরিক দণ্ড প্রাপ্ত হবে (এই দণ্ড অপরাধের তীব্রতা অনুযায়ী বধ পর্যন্ত হতে পারে)।
এই শারীরিক দণ্ড কেমন হবে তাও বিশদ ব্যাখ্যাকারে বর্ণিত হয়েছে-
যেন কেনচিদঙ্গেন হিংস্যাচ্চেৎ শ্রেষ্ঠমন্ত্যজঃ।
ছেত্তব্যং তত্তদেবাস্য তন্মনোরনুশাসনম্।। (৮/২৭৯)
বঙ্গানুবাদ: শূদ্র কিংবা অন্ত্যজ ব্যক্তি (শূদ্র থেকে চণ্ডাল পর্যন্ত নিকৃষ্ট জাতি) দ্বিজাতিগণকে (ব্রাহ্মণ, ত্রিয়, বৈশ্য) যে অঙ্গের দ্বারা পীড়ন করবে তার সেই অঙ্গ ছেদন করে দেবে, এটি মনুর নির্দেশ।
মনুশাস্ত্র অনুযায়ী একজাতি শূদ্র যদি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এইসব দ্বিজাতিকে দারুণ কথা বলে গালি দেয় তা হলে তার জিহ্বাছেদন কর্তব্য (৮/২৭০), যদি নাম ও জাতি তুলে আক্রোশন করে তবে তার মুখের মধ্যে দশ-আঙুল পরিমাণ জ্বলন্ত লৌহময় কীলক প্রবেশ করিয়ে দেবে (৮/২৭১), যদি ঔদ্ধত্যবশতঃ ব্রাহ্মণকে “তোমার এই ধর্ম অনুষ্ঠেয়, এখানে ধর্মানুষ্ঠানে তোমাকে এই সব কাজ করতে হবে” এইসব বলে ধর্মোপদেশ করে তা হলে রাজা তার মুখে ও কানে উত্তপ্ত তেল ঢেলে দেবেন (৮/২৭২), যদি হাত উঁচিয়ে কিংবা লাঠি উঁচিয়ে ক্রোধের সাথে উচ্চ জাতিকে প্রহার করে তবে তার হাত কেটে দেবে এবং পায়ের দ্বারা যদি ক্রোধের সাথে প্রহার করে তা হলে পা কেটে দেবে (৮/২৮০), ঔদ্ধত্যবশতঃ ব্রাহ্মণের গায়ে থুতু-গয়ের প্রভৃতি দিলে রাজা অপরাধীর ওষ্ঠদ্বয় কেটে দেবেন, মূত্রাদি ত্যাগ করলে পুরুষাঙ্গ এবং পায়ুবায়ু ত্যাগ করলে মলদ্বার কেটে দেবেন (৮/২৮২)। (অপমান করার অভিপ্রায়ে কোনও শূদ্র যদি ঔদ্ধত্যবশতঃ) ব্রাহ্মণের চুল ধরে টানে, কিংবা পা, দাড়ি, গ্রীবা (গলা) কিংবা বৃষণ (অণ্ডকোষ) ধরে টানে তাহলে রাজা কোন রকম বিচার না করেই ঐ শূদ্রের দুটি হাতই কেটে দেবেন (৮/২৮৩)। শুধু তা-ই নয়-
ব্রাহ্মণান্ বাধমানন্তু কামাদবরবর্ণজম্।
হন্যাচ্চিত্রৈর্বধোপায়ৈরুদ্বেজনকরৈর্নৃপঃ।। (৯/২৪৮)
বঙ্গানুবাদ: যদি কোনও শূদ্র ইচ্ছাপূর্বক ব্রাহ্মণকে শারীরিক বা আর্থিক পীড়া দেয়, তাহলে অতি কষ্টপ্রদ নানা উদ্বেগজনক-উপায়ে (যেমন শূলে চড়িয়ে, মস্তক ছেদন করে দীর্ঘকাল যন্ত্রণা ভোগ করিয়ে) সেই শূদ্রকে বধ করা উচিত।
তাছাড়া-
সহাসনমভিপ্রেপ্সু রুৎকৃষ্টস্যাপকৃষ্টজঃ।
কট্যাং কৃতাঙ্কো নির্বাস্যঃ স্ফিচং বাহস্যাবকর্তয়েৎ।। (৮/২৮১)
বঙ্গানুবাদ: যদি কোন শূদ্রজাতীয় ব্যক্তি ব্রাহ্মণের সঙ্গে এই আসনে বসে তা হলে তার কোমরে ছেঁকা লাগিয়ে দাগ দিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে কিংবা তার পাছা খানিকটা কেটে দেবে।
শূদ্রজন্ম যে প্রকৃত অর্থেই দাসজন্ম, এ বিষয়টা যাতে কারো কাছে অস্পষ্ট না থাকে সেজন্যে মনুশাস্ত্রে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে-
শূদ্রং তু কারয়েদ্ দাস্যং ক্রীতমক্রীতমেব বা।
দাস্যায়ৈব হি সৃষ্টোহসৌ ব্রাহ্মণস্য স্বয়ম্ভুবা।। (৮/৪১৩)
বঙ্গানুবাদ: ক্রীত অর্থাৎ অন্নাদির দ্বারা প্রতিপালিত হোক্ বা অক্রীতই হোক্ শূদ্রের দ্বারা ব্রাহ্মণ দাসত্বের কাজ করিয়ে নেবেন। যেহেতু, বিধাতা শূদ্রকে ব্রাহ্মণের দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।ন স্বামিনা নিসৃষ্টোহপি শূদ্রো দাস্যাদ্বিমুচ্যতে।
নিসর্গজং হি তত্তস্য কস্তস্মাত্তদপোহতি।। (৮/৪১৪)
বঙ্গানুবাদ: প্রভু শূদ্রকে দাসত্ব থেকে অব্যাহতি দিলেও শূদ্র দাসত্ব কর্ম থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। দাসত্বকর্ম তার স্বভাবসিদ্ধ কর্ম (অর্থাৎ জন্মের সাথে আগত)। তাই ঐ শূদ্রের কাছ থেকে কে দাসত্ব কর্ম সরিয়ে নিতে পারে ?বৈশ্যশূদ্রৌ প্রযত্নেন স্বানি কর্মাণি কারয়েৎ।
তৌ হি চ্যুতৌ স্বকর্মভ্যঃ ক্ষোভয়েতামিদং জগৎ।। (৮/৪১৮)
বঙ্গানুবাদ: রাজা বিশেষ যত্ন সহকারে বৈশ্য এবং শূদ্রকে দিয়ে তাদের কাজ অর্থাৎ কৃষিবাণিজ্যাদি করিয়ে নেবেন। কারণ, তারা নিজ নিজ কাজ ত্যাগ করলে এই পৃথিবীকে বিক্ষুব্ধ করে তুলবে।
অর্থাৎ শূদ্রকে তার নিজ কর্মের বাইরে বিকল্প জীবিকা গ্রহণের কোন সুযোগও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথচ উচ্চবর্ণিয়দের জন্য প্রতিকুল সময়ে ভিন্ন জীবিকা গ্রহণের পর্যাপ্ত সুযোগ এই মনুসংহিতায় বিশদভাবেই দেয়া হয়েছে।
(চলবে…)
নিজের অজান্তেই এই ধারাবাহিকের ভক্ত হয়ে উঠেছি। ভাবতেই শিউরে উঠছে, মধ্যযুগে কি বর্বর কায়দাতেই না ব্রাহ্মণ্যবাদ টিকিয়ে রাখা হয়েছিল।
রণো দা’র কাছে বিনীত অনুরোধ, সম্ভব হলে লেখার পরের পর্বগুলোতে উদ্ধৃতি আরো কমিয়ে বিশ্লেষণের পরিমান যেনো আরো বাড়িয়ে দেওয়া হয়। :rose:
@বিপ্লব রহমান,
বিপ্লব দা, নিশ্চয়ই পরের পর্বেও শ্লোক-উদ্ধৃতি চড়াই-উৎড়াই পেরোতে দাঁত ভেঙে ফেলেছেন এরই মধ্যে ! সেখানে আপনার মন্তব্য দেখেই বুঝতে পেরেছি। তবে এ-র পরের পর্ব থেকে মলম দেয়ার চেষ্টা থাকবে। হা হা হা ! এ-কথাটাও ওখানে বলেছি।
ভালো থাকবেন।
(অনেকদিন দেখাদেখি হচ্ছে না, ব্যাপার কী ?)
লেখাটা দারুণ। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
একটি প্রশ্ন। আপনি মনুসংহিতাকে “বৈদিক শাস্ত্র” বলছেন, এটা একটু ব্যাখ্যা করবেন কি? আমি যতদূর জানি মনুসংহিতা (মোটামুটি ভাবে) গুপ্ত-সাম্রাজ্যের প্রথম দিকে লিখিত। এর সাথে বেদ-এর সম্পর্ক কি? নাকি আপনি “ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র” অর্থে “বৈদিক শাস্ত্র” ব্যবহার করছেন?
@রৌরব,
মনুসংহিতার ভাষ্যমতেই এটা হচ্ছে বেদ-এর নির্যাস। বেদের জটিল চক্কর থেকে সাধারণ্যের বোধগম্য করে বৈদিক নিয়মের মধ্যে থেকে একটা পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্রীয় আচরণবিধি তৈরির প্রয়োজনেই মনুসংহিতার সৃষ্টি। অতীত ও বর্তমানে প্রচলিত যে হিন্দু আইন বা অন্যান্য যেকোন কার্যের ভিত্তি, তা সবই সরাসরি মনুসংহিতা থেকে আহরিত। অর্থাৎ মনুসংহিতার আইনই আসলে বৈদিক আইন। সে অর্থেই আমার বক্তব্যগুলো দেয়া। এটাকে বৈদিক আমল নামের খ্রীস্টপূর্ব আনুমানিক দেড় হাজার বছর সময়কালকে গুপ্তযুগের আনুমানিক দু-তিনশ বা চারশ বছর সময়কালের সাথে এক করে ফেলার যৌক্তিকতা থাকবে না। এতে জটিলতা বেড়ে যাবে।
যদিও মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে, ব্রহ্মা নিজেই বিশ্বজগত সৃষ্টির শুরুতেই লক্ষাধিক শ্লোকের বিশাল সংহিতা সৃষ্টি করে মনুকে পড়তে দেন। মনু আবার তাকে অতি সংক্ষিপ্ত ও সহজ সরল আকার দিয়ে মহর্ষি ভৃগুকে ভালোভাবে অধ্যয়ন ও শিক্ষাদান করান। এই ভৃগু কর্তৃক মনুর উক্তি হিসেবে এই সংহিতা অন্যান্য মহর্ষিদিগের মাধ্যমে তা প্রচারিত হয়।
এখানে যুক্তি খোঁজে ফায়দা নেই। বিষয়টাই মূল।
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
@রণদীপম বসু,
“এটাকে বৈদিক আমল নামের খ্রীস্টপূর্ব আনুমানিক দেড় হাজার বছর সময়কালকে গুপ্তযুগের আনুমানিক দু-তিনশ বা চারশ বছর সময়কালের সাথে এক করে ফেলার যৌক্তিকতা থাকবে না। ”
একমত, কিন্তু সেকারণেই “হিন্দুশাস্ত্র” বলাটাই সমীচীন। অবশ্যই এটা আমার ব্যক্তিগত মত।
আমার মনে হয় এভাবে যুগে যুগে ব্রাহ্মণরা শোষন করেছে শূদ্রদের।
পীর আর ইমামরা সাধারন মুসলমানদের।
মনে পরে আব্বা একবার এক জৈনপুরী পীরকে বাসায় এনেছিলেন।
আমরা মেয়েরা পর্দার ওপারে তার পাগড়ীর এক কোনা ধরে মুরীদ হয়েছিলাম।
যাওয়ার সময় যথারীতি নজরানা নিয়ে ফিরেছিলেন!
রণদীপম বসু;
আপনার এই সিরিজটা আমি মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। আমি এখন ইসলামীস্টদের ভাষা ব্যবহার করব।
বলুনঃ
আপনি কি সংস্কৃত ভাষা জানেন?
আপনি কেমন করে জানলেন যে অনুবাদ সঠিক?
আপনি কি এই সব শ্লোকগুলির প্রসঙ্গ (context) জানেন? না জেনে আপনি কেমন করে পবিত্র গ্রন্থের সমালোচনা করেন?
আপনি কি কোন হিন্দু ইমামের সাথে এই সব শ্লোকের ব্যাপারে আলাপ করেছেন?
আপনি কি কোনদিন হিন্দু মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন?
হিন্দু ধর্ম সমন্ধে আপনার জ্ঞান খুবই সীমিত। আপনার কি হিন্দু ধর্মের উপর কোন ডিগ্রি অথবা আলেমী সনদ আছে?
উপরের প্রশ্নগুলোকে আপনি হেঁসে উড়িয়ে দিবেন না।
সত্য কথা–পবিত্র হিন্দু ধর্মের উপরে একবিন্দু মন্তব্য করার উপযোগীতা আপনার নেই, যেমন নেই ঐ সব মুরতাদদের পবিত্র ইসলামের উপর বিরুপ মন্তব্য করার।
হে হে হে।
@আবুল কাশেম,
বছরের সেরা কমেন্ট 🙂 ।
তবে ছোট একটা কারেকশন আছে।
“হিন্দু মাদ্রাসায়” না হয়ে মনে হয় “হিন্দু টোলে” হবে।
@আবুল কাশেম,
মহা সঙ্কটে ফেললেন তো ভাই !
এমনিতেই শাস্ত্র অধ্যয়নে শূদ্রের কোন অধিকারই নেই, তার উপরে পবিত্র দেবনাগরি অক্ষর ও ভাষা অপবিত্র চোখ দিয়ে দেখে ফেলা !
সংস্কৃত জানি না বলেই তো বাংস্কৃত করে উঠিয়ে দিলাম যাতে মহান শাস্ত্র বিশেষজ্ঞজন অনুবাদের যথার্থতা যাচাই করে দেখতে পারেন। হেন কর্মের জন্য শাস্ত্র-নির্দেশিত কারণ ও প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই শূদ্র থেকে অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে গেছি !
আর মনুশাস্ত্র অনুযায়ী কোন্ দ্বিজাতি শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ অচ্ছ্যুৎ শূদ্রের সাথে শাস্ত্রীয় আলোচনা করে নিজে প্রায়শ্চিত্তেরও অযোগ্য অবস্থায় পতিত হবেন ? আমার যে সব কুলই বন্ধ ভাই !
এখন আমার কী উপায় হবে !!
@রণদীপম বসু,
আপনার ভন্ডামীতে মুগ্ধ আমি 😛
@মিঠুন,
আপনার মন্তব্যে জবাবে একটা কবিতা শুনাই-
মুখোশ, মুখোশ শুধু / পবিত্র মুখোপাধ্যায়
…
মুখোশ, মুখোশ শুধু, চারিদিকে মুখোশের ভিড়;
আমাকে অস্থির
ক’রে তোলে, নিরুপায় হয়ে তুলি হাত
আকাশে,… খটখটে মেঘ-রোদ্দুরের অনির্বচনীয়
সুন্দর নির্মাণ করে চিরায়ত
আর এক পৃথিবী;
আমি চেয়ে থাকি নির্নিমেষ।
এখন মুখোশ যুদ্ধে কেউই পরে না ছদ্মবেশ,
স্বাভাবিক দেখে ভাবি- আড়ালে
নেকড়ের চোখ জ্বলে;
ধারালো নখের লক্ষ্য ঢেকেছে আস্তিনে।
আমি অক্ষরের যাদুবলে
মুখোশের আড়ালে যে মুখ, তাকে চিনে
নিতে গিয়ে দেখি, তাও
প্লাস্টিক সার্জারী করা, অন্য আগন্তুক।
ছেলেবেলাকার সেই চোখ-নাক-মসৃণ চিবুক
কিশোর, যুবক আজ নেই,
পণ্যভার বহনের ভারে ক্লিষ্ট প্রাণ
মানুষ হয়ে ছদ্মবেশী
যুগের অস্থির অভিনেতা
আজ সকলেই।
মুখ ও মুখোশে আজ ভেদ নেই, কোন ভেদ নেই।
…