(পূর্ব-প্রকাশিতের পর…)
…
অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ পর্ব:[০১] [*] [০৩] [০৪] [০৫] [০৬] [০৭] [০৮]
মনুসংহিতা ও ব্রাহ্মণ্যবাদ
পৃথিবীতে যতগুলো কথিত ধর্মগ্রন্থ রয়েছে তার মধ্যে মনে হয় অন্যতম বর্বর, নীতিহীন, শঠতা আর অমানবিক প্রতারণায় পরিপূর্ণ গ্রন্থটির নাম হচ্ছে ‘মনুস্মৃতি’ (Manu-smriti) বা ‘মনুসংহিতা’ (Manu-samhita)। ব্রাহ্মণ্যবাদের (Hinduism) আকর গ্রন্থ শ্রুতি বা ‘বেদ’-এর নির্যাসকে ধারণ করে যেসব স্মৃতি বা শাস্ত্র গ্রন্থ রচিত হয়েছে বলে কথিত, তার শীর্ষে অবস্থান করছে মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা। তাই মনুসংহিতা ও ব্রাহ্মণ্যবাদকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। মনুসংহিতা মানেই ব্রাহ্মণ্যবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ মানেই মনুসংহিতা। এটাকে তৎকালীন বৈদিক আর্য সমাজ ও প্রচলিত হিন্দু সমাজের অবশ্য পালনীয় পবিত্র সংবিধান বা সামগ্রিক ও সম্পূর্ণ জীবনাচরণবিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বারোটি অধ্যায়ে প্রায় দুহাজার সাতশত শ্লোক সংবলিত এ গ্রন্থটির পাতায় পাতায় ধর্মীয় বিধানের নাম দিয়ে সংস্কৃত অক্ষরে অক্ষরে যে শ্লোকগুলো উৎকীর্ণ রয়েছে, অধিকাংশ শ্লোকের ভাবার্থকে যদি মনুষ্য সমাজে পালনীয় নীতি হিসেবে বিবেচনা করতে হয়, তাহলে মানুষের সমাজে কোন মানবিক বোধ আদৌ রয়েছে বা অবশিষ্ট থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করাটাই অবিশ্বাস্য মনে হয়। এ ব্যাপারে কোন বিস্তৃত ব্যাখ্যায় না গিয়ে বরং মনুসংহিতা থেকে অনুবাদ ও ভাবার্থসহ কিছু শ্লোকের নমুনা-উদাহরণ টানলেই বিষয়গুলো আমাদের সামনে অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে।
উল্লেখ্য, মনুসংহিতাকে পরিপূর্ণ একটি ধর্ম ও শাস্ত্র গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এজন্যে যে, এই গ্রন্থে বিশ্বজগৎ বা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বস্তুনিচয়, গোটা প্রাণীকূল, উদ্ভিদ, গ্রহ-নক্ষত্র-পৃথিবী, আলো-জল-হাওয়া, দিন-রাত্রি-সময়-কাল-যুগ, জীব-জগতের উৎস, স্বভাব-চরিত্র-জীবনযাপন, গুণ ও দোষবাচক সমস্ত অনুভব-অনুভূতি, স্বর্গ-মর্ত্য-নরক, জীবলোক-মৃতলোক, সাক্ষি-বিচার-শাসন, আচার-অনুষ্ঠান, জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, খাবার-খাদ্য, ভক্ষ্য-অভক্ষ্য, শূচি-অশূচি ইত্যাদি যাবতীয় বস্তুগত ও ভাবগত বিষয়ের সৃষ্টিরহস্য ব্যবহার-বিবেচনা বর্ণিত হয়েছে কল্পনার সমৃদ্ধ শিখরে অবস্থান করে অত্যন্ত আকর্ষণীয় নিজস্ব ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে। কথিত হয় যে মহান স্রষ্টা বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন, এ সবকিছু রক্ষার জন্য তাঁর মানব সৃষ্টিও জরুরি হয়ে পড়ে। ফলে মানুষও সৃষ্টি হলো। কিন্তু মানব সৃষ্টি ও পরিপালনের ক্ষেত্রে এসে ব্রহ্মা বা ঈশ্বর বোধ করি নিজেকে আর সুমহান মর্যাদায় ধরে রাখতে পারেন নি। যে শ্রেণীবিদ্বেষপ্রসূত তীব্র অসমতাভিত্তিক বর্ণপ্রথার আশ্রয় নেয়া হয়েছে তাতেই সন্দেহ গাঢ় হয়ে ওঠে যে এটা আদৌ কোন অতিলৌকিক পবিত্র বিধিবিধান কিনা। বরং ধর্মীয় মোড়কে এক ঘৃণ্য আর্থ-সমাজ-রাজনীতির অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক হীন প্রচেষ্টা বলেই মনে হয়। তার পেছনে যে এক অতীব স্বার্থান্বেষী ভণ্ড প্রতারক গোষ্ঠির সূক্ষ্মতম কারসাজিই কার্যকর হতে পারে, তা বুঝতে খুব বেশি যুক্তিবাদী হবার প্রয়োজন পড়ে না। বিস্তৃত পরিসরে না গিয়ে আমরা প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ের নমুনা-উদাহরণ পর্যবেক্ষণ করে নিতে পারি। এক্ষেত্রে বঙ্গানুবাদসহ উদ্ধৃত শ্লোক ব্যবহারে সদেশ প্রকাশনী কলকাতা থেকে বইমেলা ১৪১২-এ প্রকাশিত মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘মনুসংহিতা’ সুলভ সংস্করণ গ্রন্থটির সহায়তা নেয়া হয়েছে।
০১
এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করে অতঃপর স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা কি আদতে মানুষ সৃষ্টি করলেন, না কি কিছু বিভেদপূর্ণ বর্ণ (varnas) (জাতি) সৃষ্টি করলেন, মনুসংহিতা পাঠ করলে তা প্রশ্ন হিসেবেই থেকে যায়। তবে গোটা গ্রন্থে যেখানে যা কিছুই বলা হয়েছে জাতি হিসেবে ব্রহ্মাসৃষ্ট বর্ণগুলোকেই বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-
সর্বস্যাস্য তু সর্গস্য গুপ্ত্যর্থং স মহাদ্যুতিঃ।
মুখবাহুরুপজ্জানাং পৃথক্ কর্মাণ্যকল্পয়ৎ।। (১/৮৭)
বঙ্গানুবাদ: এই সকল সৃষ্টির অর্থাৎ ত্রিভুবনের রক্ষার জন্য মহাতেজযুক্ত প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজের মুখ, বাহু, উরু এবং পাদ- এই চারটি অঙ্গ থেকে জাত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের পৃথক পৃথক কার্যের ব্যবস্থা করে দিলেন।অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।
দানং প্রতিগ্রহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ।। (১/৮৮)
বঙ্গানুবাদ: অধ্যাপন, স্বয়ং অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ (উপহার বা দান-সামগ্রি গ্রহণ)- এই ছয়টি কাজ ব্রহ্মা ব্রাহ্মণদের জন্য নির্দেশ করে দিলেন।প্রজানাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বিষয়েম্বপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ।। (১/৮৯)
বঙ্গানুবাদ: প্রজারণ, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, নৃত্যগীতবনিতাদি-বিষয়ভোগে অনাসক্তি, এই কয়েকটি কাজ ব্রহ্মা ক্ষত্রিয়গণের জন্য সংক্ষেপে নিরূপিত করলেন।পশূনাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বণিক্পথং কুসীদঞ্চ বৈশ্যস্য কৃষিমেব চ।। (১/৯০)
বঙ্গানুবাদ: পশুদের রক্ষা, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, বাণিজ্য (স্থলপথ ও জলপথ প্রভৃতির মাধ্যমে বস্তু আদান-প্রদান করে ধন উপার্জন), কুসীদ (বৃত্তিজীবিকা- টাকা সুদে খাটানো) এবং কৃষিকাজ- ব্রহ্মা কর্তৃক বৈশ্যদের জন্য নিরূপিত হল।অধীয়ীরংস্ত্রয়ো বর্ণাঃ স্বকর্মস্থা দ্বিজাতয়ঃ।
প্রব্রূয়াদ্ ব্রাহ্মণস্ত্বেষাং নেতরাবিতি নিশ্চয়ঃ।। (১০/১)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই তিনবর্ণের লোকেরা দ্বিজাতি; এঁরা নিজনিজ কর্তব্য কর্মে নিরত থেকে বেদ অধ্যয়ন করবেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে কেবল ব্রাহ্মণেরাই অধ্যাপনা করবেন, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই দুই বর্ণের পক্ষে অধ্যাপনা করা উচিত নয়। -এটাই শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত।এতমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ।
এতেষামেব বর্ণানাং শুশ্রূষামনসূয়য়া।। (১/৯১)
বঙ্গানুবাদ: প্রভু ব্রহ্মা শূদ্রের জন্য একটি কাজই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, -তা হলো কোনও অসূয়া অর্থাৎ নিন্দা না করে (অর্থাৎ অকপটভাবে) এই তিন বর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের শুশ্রূষা করা।
উপরোক্ত শ্লোকগুলো থেকে আমরা এটা বুঝে যাই যে, স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা গোটা বিশ্ব-জগৎ সৃষ্টি করেছেন তো বটেই। তবে এই বিশ্ব-জগৎ সুষ্ঠুভাবে রক্ষাকল্পে তিনি আসলে কোন মানুষ সৃষ্টি করেন নি। চারটি বর্ণ সৃষ্টি করলেন- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এদের আবার দুটো ভাগ- প্রথম তিনটি উচ্চ বর্ণ, আর চতুর্থটি অর্থাৎ শূদ্র হচ্ছে নিম্নবর্ণ, যে কিনা উচ্চবর্ণীয়দের সেবাদাস। আবার ব্রাহ্মণ, যে কিনা কোন শারীরিক শ্রমের সাথে কোনভাবেই জড়িত নয়, সকল বর্ণের শীর্ষে। শুধু শীর্ষেই নয়, ক্ষমতার এতোটাই কল্পনাতীত উচ্চ অবস্থানে অবস্থিত যে, জগতের সবকিছুর মালিক বা প্রভুও হচ্ছে ব্রাহ্মণ। সন্দেহ তীব্র হলে নিচের শ্লোকগুলো দেখা যেতে পারে-
উত্তমাঙ্গোদ্ভবাজ্জৈষ্ঠ্যাদ্ ব্রহ্মণশ্চৈব ধারণাৎ।
সর্বস্যৈবাস্য সর্গস্য ধর্মতো ব্রাহ্মণঃ প্রভুঃ।। (১/৯৩)
বঙ্গানুবাদ: ব্রহ্মার পবিত্রতম মুখ থেকে উৎপন্ন বলে, সকল বর্ণের আগে ব্রাহ্মণের উৎপত্তি হওয়ায়, এবং বেদসমূহ ব্রাহ্মণকর্তৃক রক্ষিত হওয়ার জন্য (বা বেদসমূহ ব্রাহ্মণেরাই পঠন-পাঠন করেন বলে)- ব্রাহ্মণই ধর্মের অনুশাসন অনুসারে এই সৃষ্ট জগতের একমাত্র প্রভু।ব্রাহ্মণো জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে।
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে।। (১/৯৯)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করা মাত্রই পৃথিবীর সকল লোকের উপরিবর্তী হন অর্থাৎ সমস্ত লোকের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন। কারণ, ব্রাহ্মণই সকলের ধর্মকোষ অর্থাৎ ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভুসম্পন্ন হয়ে থাকেন।সর্বং স্বং ব্রাহ্মণস্যেদং যৎ কিঞ্চিজ্জগতীগতম্।
শ্রৈষ্ঠ্যেনাভিজনেনেদং সর্বং বৈ ব্রাহ্মণোহর্হতি।। (১/১০০)
বঙ্গানুবাদ: জগতে যা কিছু ধনসম্পত্তি সে সমস্তই ব্রাহ্মণের নিজ ধনের তুল্য; অতএব সকল বর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে ব্রাহ্মণই সমুদয় সম্পত্তিরই প্রাপ্তির যোগ্য হয়েছেন।স্বমেব ব্রাহ্মণো ভুঙ্ক্তে স্বং বস্তে স্বং দদাতি চ।
আনৃশংস্যাদ্ ব্রাহ্মণস্য ভুঞ্জতে হীতরে জনাঃ।। (১/১০১)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ যে পরের অন্ন ভোজন করেন, পরকীয় বসন পরিধান করেন, পরের ধন গ্রহণ করে অন্যকে প্রদান করেন, সে সবকিছু ব্রাহ্মণের নিজেরই। কারণ, ব্রাহ্মণেরই আনৃশংস্য অর্থাৎ দয়া বা করুণাতেই অন্যান্য যাবতীয় লোক ভোজন-পরিধানাদি করতে পারছে।ন তং স্তেনা ন চামিত্রা হরন্তি ন চ নশ্যতি।
তস্মাদ্রাজ্ঞা নিধাতব্যো ব্রাহ্মণেষ্বক্ষয়ো নিধিঃ।। (৭/৮৩)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণকে যে ভূমি-অর্থ প্রভৃতি দান করা হয় তা এমনই নিধি (ন্যস্ত সম্পত্তি) যে, সেই নিধি চোরেরা অপহরণ করতে পারে না, শত্রুরা হরণ করতে পারে না, এবং তা নিজেও নষ্ট বা অদৃষ্ট হয় না। এই জন্য রাজার কর্তব্য হল, ব্রাহ্মণগণের কাছে এই অক্ষয় নিধি ন্যস্ত করা।সমমব্রাহ্মণে দানং দ্বিগুণং ব্রাহ্মণব্রুবে।
প্রাধীতে শতসাহস্রমনন্তং বেদপারগে।। (৭/৮৫)
বঙ্গানুবাদ: অব্রাহ্মণকে যে বস্তু দান করা হয় তার সমপরিমাণ ফল পাওয়া যায়, তার দ্বারা অতিরিক্ত ফল হয় না। ব্রাহ্মণব্রুবকে (অর্থাৎ যিনি জাতিমাত্রে ব্রাহ্মণ, কিন্তু ব্রাহ্মণোচিত গুণসম্পন্ন নন) দান করলে পূর্বাপেক্ষা দ্বিগুণ ফল লাভ হয়। যে ব্রাহ্মণ বেদাধ্যয়ন আরম্ভ করেছেন, তাঁকে দান করলে লক্ষগুণ ফল লাভ হয়; এবং যিনি সমস্ত বেদশাখাধ্যেতা বেদপারগ ব্রাহ্মণ, তাঁকে দান করলে অনন্ত ফল লাভ হয়।
বুঝাই যাচ্ছে, কথিত ব্রহ্মার পবিত্রতম মুখ হতে সৃষ্ট বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণই জগদীশ্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অতএব কাউকে কর দিয়ে ব্রাহ্মণের চলার কথা নয়। এবং তা-ই মনুসংহিতার পাতায় পাতায় খুব ভালোভাবে জানান দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
মনুশাস্ত্রে রাজার কর্তব্য হিসেবে নিরাপদে রাজ্য পরিচালনার প্রয়োজনেই প্রজাদের কাছ থেকে কর ধার্য্য ও গ্রহণের কথা বলা হচ্ছে-
নোচ্ছিন্দ্যাদাত্মনো মূলং পরেষাঞ্চাতিতৃষ্ণয়া।
উচ্ছিন্দন্ হ্যাত্মনো মূলমাত্মানং তাংশ্চ পীড়য়েৎ।। (৭/১৩৯)
বঙ্গানুবাদ: কর, শুল্ক প্রভৃতি গ্রহণ না করে রাজা নিজের মূলোচ্ছেদন করবেন না অর্থাৎ রাজকোষ শূন্য করবেন না; এবং অতিলোভবশতঃ বেশি কর নিয়ে প্রজাদেরও মূল নষ্ট করবেন না। কারণ, এইভাবে নিজের ও পরের মূলোচ্ছেদ ঘটালে নিজেকে এবং প্রজাবর্গকে উৎপীড়িত করা হয়।
অতএব কার কাছ থেকে কিভাবে কী পরিমাণ কর আদায় করা হবে তার বিস্তারিত শ্লোক-বয়ান মনুশাস্ত্রে উদ্ধৃত রয়েছে। তবে সাধারণসূত্রে বলা হচ্ছে-
যৎ কিঞ্চিদপি বর্ষস্য দাপয়েৎ করসংজ্ঞিতম্।
ব্যবহারেণ জীবন্তং রাজা রাষ্ট্রে পৃথগ্জনম্।। (৭/১৩৭)
বঙ্গানুবাদ: যে সব ‘পৃথগ্জন’ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ও শ্রোত্রিয় ছাড়া অন্য লোক কৃষি, পশুপালন প্রভৃতি কোনও একটি ব্যবহার অর্থাৎ বৃত্তি অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের কাছ থেকে রাজা বার্ষিক যৎ কিঞ্চিৎ হলেও কর গ্রহণ করবেন।
যে ব্রাহ্মণ কল্পশাস্ত্রের সাথে এক বেদ অথবা ব্যাকরণ প্রভৃতি ছয়টি বেদাঙ্গের সাথে বেদশাখা অধ্যয়ন করেন এবং বেদাধ্যয়নাদি কাজে নিরত থাকেন, তাঁকে ‘শ্রোত্রিয়’ বলা হয়। উপরোক্ত ৭/১৩৭ সংখ্যক শ্লোকে এই বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ ও শ্রোত্রিয়ের কাছ থেকে কোনরূপ কর গ্রহণকে নিরস্ত করা হয়েছে। তবে মনুসংহিতার ১০/১২৯ সংখ্যক শ্লোকের দ্বারা (পরবর্তীতে নিচে বর্ণিত হয়েছে) শূদ্রের ধন-সম্পদ অর্জনকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হলেও শূদ্রের কাছ থেকে কর আদায় নিষিদ্ধ হয়নি। যেহেতু তার অর্জিত সম্পদ থাকার কথা নয়, তাই এই কর পরিশোধ হবে বাধ্যতামূলক শ্রমদানের মাধ্যমে-
কারুকান্ শিল্পিনশ্চৈব শূদ্রাংশ্চাত্মোপজীবিনঃ।
একৈকং কারয়েৎ কর্ম মাসি মাসি মহীপতিঃ।। (৭/১৩৮)
বঙ্গানুবাদ: পাচক, মোদক প্রভৃতি কারুক এবং কাংস্যকার, লৌহকার, শঙ্খকার প্রভৃতি শিল্পী ও কায়িক পরিশ্রমের দ্বারা জীবিকানির্বাহকারী শূদ্র- এদের দ্বারা রাজা প্রতি মাসে একদিন করে নিজের কাজ করিয়ে নেবেন।
কিন্তু পরধন অর্জনে মত্ত ব্রাহ্মণের কাছে কোনক্রমেই কর নেয়া যাবে না। অর্থাভাবে রাজা মরণাপন্ন হলেও ক্ষতি নেই, তবু কোন ব্রাহ্মণ যেন রাজার রাজ্যে ক্ষুধায় মরণাপন্ন না হন, এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে-
ম্রিয়মাণোহপ্যাদদীত ন রাজা শ্রোত্রিয়াৎ করম্।
ন চ ক্ষুধাহস্য সংসীদেচ্ছ্রোত্রিয়ো বিষয়ে বসন্।। (৭/১৩৩)
বঙ্গানুবাদ: রাজা ধনাভাবে মরণাপন্ন হলেও শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের কাছ থেকে কখনও যেন কর গ্রহণ না করেন। রাজার রাজ্যে বাস করতে থেকে কোনও শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ যেন ক্ষুধায় মরণাপন্ন না হন।
মনুসংহিতার পরতে পরতে উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্ষমতা প্রদান আর নিম্নবর্ণ শূদ্রের নিচত্ব ও তাকে বঞ্চনা করার কৌশল বিভিন্নভাবে বিভিন্নরূপে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন, রাজকার্যে ও বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় ক্রিয়া-অনুষ্ঠানে সবাইকে উদ্ধারের নিমিত্তে ক্ষমতাসীন পরামর্শক ব্রাহ্মণের উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী। প্রয়োজনীয় গুণ ও যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক ব্রাহ্মণ হলেই হলো, এবং তা-ই হতে হবে। কিন্তু যত যোগ্যতা বা গুণের আধারই হোক শূদ্রকে কিছুতেই নিয়োগ মর্যাদা দেয়া যাবে না।
জাতিমাত্রোপজীবী বা কামং স্যাদ্ব্রাহ্মণব্রুবঃ।
ধর্মপ্রবক্তা নৃপতের্ন তু শূদ্রঃ কথঞ্চন।। (৮/২০)
বঙ্গানুবাদ: বিদ্যা ও গুণসম্পন্ন ব্রাহ্মণের অভাব হলে রাজা জাতিমাত্রোপজীবী অর্থাৎ জাতিসর্বস্ব ব্রাহ্মণকে অথবা ক্রিয়ানুষ্ঠানবিহীন ব্রাহ্মণব্রুবকেও (অর্থাৎ নামে মাত্র ব্রাহ্মণকেও) নিজের ধর্মপ্রবক্তার পদে (শাস্ত্রীয় আইন বিশ্লেষক) নিযুক্ত করবেন, কিন্তু শূদ্র যদি সর্বগুণসম্পন্ন, ধার্মিক এবং ব্যবহারজ্ঞও হয়, তবুও তাকে ঐ পদে নিয়োগ করতে পারবেন না।
শাস্ত্র বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ব্রাহ্মণকেই ধর্মপ্রবক্তা করার বিধান থাকায় বিদ্বান্ ব্রাহ্মণকেই ঐ কাজে নিযুক্ত করতে হয়। কাজেই ক্ষত্রিয় প্রভৃতি অন্য তিন বর্ণের লোককে ধর্ম নিরূপণের কাজে নিযুক্ত করা নিষিদ্ধ। তবুও এখানে শূদ্রকে ঐ কাজে নিয়োগ করতে নিষেধ করার তাৎপর্য হলো, ঐ কাজের জন্য উপযুক্ত বিদ্বান ব্রাহ্মণ পাওয়া না গেলে ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যকে ঐ কাজে হয়তো নিয়োগ করা যেতে পারে, কিন্তু কিছুতেই শূদ্রকে নয়। এই ব্রহ্মবিধি ভঙ্গ হলে কী পরিণতি হবে তাও মনুশাস্ত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে-
যস্য শূদ্রস্তু কুরুতে রাজ্ঞো ধর্মবিবেচনম্।
তস্য সীদতি তদ্রাষ্ট্রং পঙ্কে গৌরিব পশ্যতঃ।। (৮/২১)
বঙ্গানুবাদ: বিচারসভায় যে রাজার সাক্ষাতে শূদ্র ন্যায়-অন্যায় ধর্ম বিচার করে, সেই রাজার রাজ্য কাদায় নিমগ্ন গোরুর মতো দেখতে দেখতে নষ্ট হয়ে যায়।যদ্রাষ্ট্রং শূদ্রভূয়িষ্ঠং নাস্তিকাক্রান্তমদ্বিজম্।
বিনশ্যত্যাশু তৎ কৃৎস্নং দুর্ভিক্ষব্যাধিপীড়িতম্।। (৮/২২)
বঙ্গানুবাদ: যে রাজ্য ধর্মাধিকরণে (বিবাদ নিরূপণের ব্যাপারে-) শূদ্রের প্রাধান্য ও নাস্তিকদের প্রভুত্ব, এবং যেখানে দ্বিজগণের (ব্রাহ্মণদের) অভাব, সেই রাজ্য দুর্ভিক্ষ ও নানারকম রোগে পীড়িত হয়ে অতি শীঘ্রই বিনষ্ট হয়।
অপরাধ সংঘটন হলে রাজার বিচারে দণ্ড প্রয়োগের ক্ষেত্রে মনুসংহিতার ৮/৩৭৯ সংখ্যক শ্লোক অনুযায়ী শাস্ত্রের বিধান হলো- প্রাণদণ্ডের যোগ্য অপরাধেও ব্রাহ্মণের এই দণ্ড বা অঙ্গচ্ছেদনাদি করা যাবে না। যদিও অন্যান্য বর্ণের পক্ষে বধাদি প্রাণদণ্ডই বিধেয়। এছাড়া মনুশাস্ত্রে আরো বলা হচ্ছে-
ন জাতু ব্রাহ্মণং হন্যাৎ সর্বপাপেষ্বপি স্থিতম্।
রাষ্ট্রাদেনং বহিষ্কুর্যাৎ সমগ্রধনমক্ষতম্।। (৮/৩৮০)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ যে কোনও পাপ বা অপরাধই করুক না কেন (যত কিছু অপরাধ আছে সে সবগুলি একসাথে অনুষ্ঠান করলেও) রাজা তাকে হত্যা করবেন না; পরন্তু সমস্ত ধনের সাথে অক্ষত শরীরে তাকে রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত করবেন।
কারণ-
ন ব্রাহ্মণবধাদ্ ভূয়ানধর্মো বিদ্যতে ভুবি।
তস্মাদস্য বধং রাজা মনসাপি ন চিন্তয়েৎ।। (৮/৩৮১)
বঙ্গানুবাদ: এই পৃথিবীতে ব্রাহ্মণবধের তুলনায় গুরুতর অধর্ম (অর্থাৎ পাপ) আর কিছুই নেই। এই কারণে ব্রাহ্মণকে বধ (এবং অঙ্গচ্ছেদনাদি) করার কথা রাজা কখনও মনে মনেও চিন্তা করবেন না।
(চলবে…)
ভাই, পারলে মূল বেদ পড়ুন। মনুসংহিতা নিয়ে আছেন কেন?
আদিবাসি সমাজ থেকে কৃষিভিত্তিক সমাজে উত্তরোনের জন্যে কেন জাতিভেদ এবং অন্যান্য প্রথার সৃষ্টি হয়, সেটা অনেক দিন থেকেই সমাজ এবং নৃবিজ্ঞানে গবেষনার বিষয়।
আদিবাসী সমাজে সবাই শিকারি-তাই হায়ার্কিক্যাল স্ট্রাকচারের দরকার হয় না। সেখানে সাম্য বজায় থাকে।
কিন্ত কৃষিভিত্তিক সমাজে উত্তোরন-যা মানুষকে আরো বেশী খাদ্য নিরাপত্তা দিয়েছিল এবং খাদ্যের অধিক উৎপাদন হেতু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ও সহায়ক ছিল -সেই সমাজের প্রয়োজন মেটানোর জন্যে নানান পেশার উদ্ভব হয়। কৃষির নিরাপত্তা এবং পোলিশিং এর জন্যে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়-ফলে সামরিক শ্রেনীর উদ্ভব হয়-এবং কৃষিজাত দ্রব্য বিনপনের জন্যে ব্যাবসায়ী শ্রেণির ও সৃষ্টি হয়। যেহেতু সব পেশাতেই দক্ষতার প্রয়োজন ছিল-আস্তে আস্তে তা বংশানুক্রমিক হয়ে যায়-কারন বদ্যি থেকে কৃষক-সবাই বাবার কাছ থেকেই সিক্রেট অব ট্রেড শিখেছে। এই সব সামাজিক প্রয়োজনই জাতিভেদ প্রথার উৎস।
আর হিন্দু দেবদেবীদের সাথে রোমাণ বা গ্রীক দেবদেবী কেন, আভতারের নভিদের দেবদেবীর ও পার্থক্য নাই। কারন সব প্যাগানরাই প্রকৃতিকে দেবতা ধ্যানে পুজো করে-তাই সাপ ব্যাঙ গরু আকাশ সূর্য্য সব প্যাগান সভ্যতাতেই পূজিত। সেখানে কিছু নেই। তবে যে প্রশ্নটা করা যেতে পারে-সেটা হল ভারতে একেশ্বরবাদকে কাটিয়ে কি করে প্যাগানরা টিকে গেল যেখানে পৃথিবীর সর্বত্র খ্রীষ্ঠান এবং মুসলমানরা প্যাগানদের হারিয়ে নিজেদের ধর্মে ঢুকিয়েছে। এর একটা মূলকারন এই যে একেশ্বরবাদ ভারতে বহুদিন আগে থেকেই প্রচলিত ছিল-নিরাশ্বরবাদ বা নাস্তিকতাও ছিল। এবং গীতাতে প্যাগানিজমের নিন্দা করা হলেও , গীতার ভাষা প্যাগানদের প্রতি ইনক্লুসিভ-যেখানে কোরানে সরাসরি প্যাগানদের ধ্বংশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে মুসলমানরা যখন ভারতে আসেন-কিছু ফ্যানাটিক ইসলামিক সুলতান বা সম্রাট ছারা কেওই ভারতের এই জাতিভেদকে ডিসটার্ব করেন নি। কারন কৃষিভিত্তিক সমাজ চালানোর জন্যে তারা এটাকে ব্যাবহার করেন। প্রতিটা মুসলমান সম্রাটের রাজকর্মচারীদের অধিকাংশই ছিল ব্রাহ্মন বা বৈশ্যগ্রোত্রের। সুতরাং ভারতের মুসলমান সম্রাটরাও রাজ্য চালনার স্বার্থে সেই জাতিভেদ প্রথাকে সমর্থন জানিয়েছেন বলা চলে।
@বিপ্লব পাল,
দুর্ভাগ্যবশত আপনার কথার অর্থ উপলব্ধির কেউ এই ফোরামে নেই । এখানে অনেকেই গঠনমূলক সমালোচনার চেয়ে হিন্দুধর্মের ছিদ্রাণ্বেষণে আগ্রহী ও আমাদের দুর্ভাগ্য রণদীপম বাবু এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন যার প্রাসঙ্গিকতা অনেকদিন আগেই নষ্ট হয়েছে ।এ ধরণের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা বর্তমানে শুধুমাত্র মৌলবাদীদের হাত শক্ত করে।
ধারাবাহিকের এই পর্বটির জন্য রণো দা’কে আবারো সাধুবাদ জানাই। :yes:
যদিও বিপ্লব পাল বেশ খানিকটা বলেছেন, তবু মনুসংহতির উৎপত্তির প্রেক্ষাপট এবং এর রচয়িতাদের সর্ম্পকে আরো জানতে ইচ্ছে করছে।
সন্দেহ নেই জাতের নামে নানান বজ্জাতিকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল এই প্রচীণতম ধর্মগ্রন্থে। তবু জানতে ইচ্ছে করে, চরমতম শোষণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা দাস প্রথা যেমন সভ্যতা সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল, তেমনি প্রাচীণ ভারতে শূদ্র বা হরিজনও কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল কি না? নাকি কামার-কুমোর-মেথর-চন্ডাল-মুচি শ্রেণী দেবতার কথিক আজ্ঞাবাহক ব্রাক্ষণদের সেবাতেই জীবনপাত করেছেন। এই শ্রম বিভাজনটিই বা সে সময় কতোটুকু যৌক্তিক ছিলো? … :-/
ভাই রণদীপন
আমার ইসলামে নারীর মর্যাদা প্রবন্ধে আপনার একটা মন্তব্যের প্রেক্ষিতে নিম্ম মন্তব্য করেছিলাম কিন্তু আমার মনে হয় মন্তব্য টি আপনার দেখা হয় নি। তবে মন্ত্রব্যটি আপনার দেখা দরকার বলে আমার মনে হলো আর তাই সেটা এখানে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের নিমিত্তে ছেপে দিলাম । মুক্ত মনার এডমিনের কাছে একারনে ক্ষমা চেয়ে নিলাম।
রণদীপম বসু,
আপনার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। তবে আরবী উচ্চারন না দিলেও চলে যদি সঠিক কোরান হাদিসের নাম , নম্বর ঠিক মতো উল্লেখ থাকে, যে কেউই অনলাইন থেকে সাথে সাথে তা চেক করে নিতে পারে। আমি অন্য ধর্ম নিয়ে আপাতত কথা বলতে চাই না । উদাহরন স্বরূপ আপনি হিন্দুদের মনু সংহিতার কথা বলছেন। ওটা বেদের নির্যাস হোক আর যাই হোক, অধিকাংশ হিন্দুই কিন্তু ওটাকে ভগবানের বানী বলে এখন আর বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে – প্রাচীন কালের কিছু সুবিধাবাদী মানুষের রচিত ওটা। ফলে ঐসব মনু সংহিতা দিয়ে আজকের দিনে হিন্দু যুবাদের সন্ত্রাসী বা আত্মঘাতী বোমাবাজ বানানো সম্ভব না। পক্ষান্তরে মুসলমানদের কোরান বা হাদিস কিন্তু ঠিক ওরকম নয়। অধিকাংশ মুসলমানই মনে করে কোরান আল্লাহ প্রেরিত, হাদিস আল্লাহর নবীর কার্যাবলী যা তিনি করতেন আল্লাহর প্রতিনিয়ত নির্দেশে, ফলে এসব দিয়ে খুব সহজেই মুসলিম যুবাদের সন্ত্রাসী বা আত্মঘাতী বোমাবাজ বানানো যায় এবং তা হচ্ছেও যা আপনি দেখতে পাচ্ছেন। সুতরাং মুসলমান, ইসলাম, কোরান, হাদিস, মোহাম্মদ এসবের সাথে অন্য ধর্মের ব্যপক মাত্রাগত তফাৎ রয়েছে।আর আমি মূলত সে ব্যপারটাতেই বেশী আগ্রহী। আমি আরও বলতে পারি- আপনি যে মনু সংহিতার বিশ্লেষণ করছেন মুক্ত মনাতে , তাতে আসলে বেশী কারা লাভবান হচ্ছে জানেন? মৌলবাদী ও উগ্রবাদী মুসলমানরা , কারন তারা এসব পয়েন্ট নিয়েই পরে হিন্দুদের ও তাদের ধর্মকে জোরে সোরে কটাক্ষ করে, জাকির নায়েককেও আপনি সে ভুমিকায় দেখেছেন এবং তা করে তারা ইসলামকে আরও বেশী পারফেক্ট ও সঠিক বলে প্রমানের অপচেষ্টা চালায় ।অথচ আপনার উদ্দেশ্য হলো- মূলত হিন্দুদেরকে তাদের ধর্মীয় গোড়ামী সম্পর্কে অবগত করানো যা আমার মনে হয়। কিন্তু যাদের গোড়ামি আপনি দুর করতে চাইছেন তারা কিন্তু অনেক আগেই গোড়ামি মুক্ত। এসব মনু সংহিতার মত জিনিস স্বয়ং ভগবান বা ঈশ্বরের তৈরী তা কিন্তু খোদ ভারতেও বেশী মানুষ বিশ্বাস করে না , খুব অল্প সংখ্যক মানুষের একটি গোষ্ঠী তা বিশ্বাস করে হয়ত কিন্তু তাদের এ বিশ্বাস গোটা হিন্দু সমাজে তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। বর্ণবাদের যে কুফল আপনি সেখানে এখনও কোথাও কোথাও দেখেন তা কিন্তু সত্যিকার অর্থেই ভারতের খুব বেশী যায়গাতে কার্যকর নেই, বর্ণপ্রথা খুব দ্রুত অপসৃয়মান, তাছাড়া কেউ এখন আর ধর্মীয় ভাবে সেটাকে সত্য মনে করে না, বরং দীর্ঘদিন ধরে বর্ণপ্রথার সুযোগ সুবিধা কিছু মানুষ ভোগ দখল করে আসাতে তারা সেটা এখন ছাড়তে চায় না, বিষয়টা অনেকটাই কেউ ক্ষমতায় গেলে আর তা থেকে নামতে চায় না অনেকটা সেরকমই , এর সাথে ঐশী ব্যপার স্যপারের সম্পর্ক আর আজকে অবশিষ্ট নেই। পক্ষান্তরে মুসলিম সমাজের অবস্থা সম্পূর্ন ভিন্ন।সেখানে খৃবই অল্প সংখ্যক কিছু মানুষ মাত্রই মনে করে কোরান ঐশী কিতাব না বা মোহাম্মদ আল্লাহর নবী না। আশা করি যা বুঝাতে চেয়েছি তা বুঝতে পেরেছেন।
@ভবঘুরে,
আমি দুঃখিত যে আমার ভবঘুরেমির কারণে সাথে সাথে আপনার মন্তব্যটা চোখে পড়েনি। (হা হা হা ! কিছু মনে করবেন না আবার !)
আপনার সেই পোস্টেই প্রতিমন্তব্যটা করে এসেছি। ভালো থাকবেন। আপনার পোস্ট মন দিয়ে পড়ছি।
@ভবঘুরে,
অধিকাংশ হিন্দুই কিন্তু ওটাকে ভগবানের বানী বলে এখন আর বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে – প্রাচীন কালের কিছু সুবিধাবাদী মানুষের রচিত ওটা। ফলে ঐসব মনু সংহিতা দিয়ে আজকের দিনে হিন্দু যুবাদের সন্ত্রাসী বা আত্মঘাতী বোমাবাজ বানানো সম্ভব না।”….
আপনি কোথা থেকে এই ধারণা পেলেন যানি না যে হিন্দুরা বেদ মানে না +
প্রাচীন কালের কিছু সুবিধাবাদী মানুষের রচিত ওটা। আমি ১০০% নিশ্চিত যে আপনি বেদ পরেন নি। এর মনু সংহিতা মনু নামে মুনি দ্বারা রচিত।
আর আমার মনে হয় মনু যে ব্রাহ্মণ এর কথা বলেছেন তার কথাই কেউ বুঝতে পারছেন না। যে কেউ ব্রাহ্মণ হতে পারে তার যোগ্যতা দিয়ে। এটা কন জন্মগত ব্যাপার নয়। এর একটা কথা যে বর্তমান হিন্দুদের এই অবস্থার কারণ বেদ না পরা ও এর অর্থ না বুঝতে না পারা…… :-/
@খোলা হাওয়া,
মনুসংহিতার রচয়িতা মনু, ঋষিশ্রেষ্ঠ বৈবস্বত মনু নন।ইনি ক্ষত্রিয় রাজা ছিলেন।
আর্য্যদের বাসভূমির সমস্যা ইতিহাসের একটি বিখ্যাত আনসলভড প্রবলেম। তবে তারা যে আদি ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা গোষ্ঠির লোক -তা নিয়ে খুব বেশী বিতর্ক নেই। গ্রীক সভ্যতা বা হেলেনিক সভ্যতা এবং পার্শিয়ান সভ্যতার রুট ও সেই ইন্দো ইউরোপীয়াণ ভাষাগোষ্ঠি। তবে আর্য্য সভ্যতা যখন ভারতের বাইরে ছিল-তখন ব্রাহ্মণ্যবাদ সেই ভাবে আসে নি-যা ঋকবেদের আদি শ্লোকগুলো থেকে প্রতিভাত। পরবর্ত্তীকালে আস্তে আস্তে ব্রাহ্মণ্য অধিপত্যের সূচনা হয়। কেন এমন বিবর্তন হল-তার কোন সদুত্তর পাই না।
@বিপ্লব পাল,
যাক, এবার হয়তো তোমার সাথে ঝগড়া না করে একটা আলোচনা করা যাবে 🙂 । ঋকবেদের আদি শ্লোকগুলো কোন সময়ের আর পরের শ্লোকগুলো কোন সময়ের? কত পরে ব্রাহ্মণ্য অধিপত্যের সূচনা হয়?
গ্রীক মিথলজির সাথে হিন্দু ধর্মের দেব দেবীদের অনেক মিল আছে মনে হয় মাঝে মাঝেই। এটার কি কোন ভিত্তি আছে?
@বন্যা আহমেদ,
ঋকবেদের রচনা কাল খৃষ্টপূর্ব ৩০০০ সাল থেকে খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ সাল। এটিই পৃথিবীর আদিম তম সাহিত্য গ্রন্থ এবং দীর্ঘতম সময়ে লেখা হয়েছে-হাইম গুলো প্রায় ১৫০০ সাল ধরের উদ্ভাবিত ঋষিদের কবিতার সংকলন। মূলত দুই ভাবে স্তোত্রগুলোকে ভাঙা যায়-প্রাক মাইগ্রেশন ( ২৫০০ খৃষ্টপূর্বাব্দের আগে)-পোষ্ট মাইগ্রেশন। ভাষা বদলে যায় এই দুই যুগে। প্রথম দিকের ভাষা অনেক বেশী ইন্দোইউরোপিয়ান এবং সেখানে দাশেদের উল্লেখ নেই। পরের দিকের ভাষা অনেক বেশী বর্তমান সংস্কৃতের বা দেবনগরীর কাছাকাছি এবং দাশেদের বিরুদ্ধে রয়েছে অজস্র স্তোত্র্য।
এছাড়াও প্রি এবং পোষ্ট মাইগ্রেশন শ্লোকের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। গাছ পালা, পাখি নদী সব বদলে যায়। প্রথমের দিকের শ্লোকে কৃষির উল্লেখ নেই-শুধুই শিকারি জাতি-সেখান থেকে পরের দিকে কৃষিভিত্তিক জাতির উত্থান ও বোঝা যায়। এছারা মেয়েদের তৈরী স্তোত্র্যের সংখ্যা পরের দিকে উল্লেখযোগ্য ভাবে কম।
ব্রাহ্মনরা ছিল মিসরের পুরোহিত শ্রেনীর মতন। আদি স্তোত্র্যে ব্রাহ্মণ ছিল-কিন্ত শুদ্র বা দাশেরা ছিল না যেহেতু তখনো তারা ভারতের নেটিভ জনগনের সাথে যুদ্ধে আসে নি। তাছারা আর্য্যরা ছিল নমাডিক-নমাডিক ভা ভ্রাম্যমান আদিবাসিরা কোনকালেই জাতিবিভক্ত হয় না। জাতিভেদ প্রথার উদ্ভবের অনেক কারন আছে-আমার মনে হয়েছে মূলত ট্রাইবাল সংস্কৃতি থেকে কৃষি সংস্কৃতিতে উত্তরোনই এর মূল কারন। মেয়েদের স্বাধীনতাও কৃষিসভ্যতাতে উত্তরোনের জন্যে আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছিল-সেটাও বোঝা যায়।
খুব চমৎকার আলোচনা চলছে।
বিপ্লব সঠিকভাবেই বলেছেন যে, আর্যরা ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা গোষ্ঠির লোক। আরো সঠিকভাবে বললে, আর্য আসলে একটি ভাষাগোষ্ঠির নাম। মুলতঃ সংস্কৃত, ল্যাটিন এবং গ্রীক – এই তিনটিই হচ্ছে আর্য ভাষা। বর্তমানে ভুল প্রয়োগের ফলে 'আর্য', 'আর্য জাতি' 'আর্যভাষী' সব একাকার হয়ে গেছে। ভারতীয় ইতিহাসবিদদের মতে আর্যরা ভারতে খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ থেকে ভারতে প্রবেশ শুরু করেছিলো, যা অব্যাহত ছিলো খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সাল অবধি।
আর্যরা যখন এসেছিলো তখন ব্রাহ্মণ্যবাদ সেভাবে আসেনি, কিন্তু ওটাই ছিলো আমার মতে ব্রাহ্মণ্যবাদের সূতিকাগার এবং ভিত্তিভূমি। এখানকার আদি অধিবাসীরা কালো চামড়ার দ্রাবিড়, আর আর্যরা সাদা চামড়ার – যেন সাক্ষাৎদেবদূত। তারা নিজেদের আলাদা করতে চাইলো আদিবাসীদের থেকে। নিজেরা উঁচু জাত, তাদের রক্ত অনেক অভিজাত – এই প্রচারণা তারা জনগনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো প্রথম থেকেই। তারা মগডালে বসে বসে ছড়ি ঘোরাবে, আর নীচুতলার কালোমানুষেরা গায়ে গতরে খেটে মরবে – এটাই বোধ হয় ছিলো তাদের ব্রাহ্মণ্যবাদের আদি ভিত্তি । পরে গ্রীক দেব দেবীদের আলোকে নিজেরাও কল্পিত দেবতাদের সাথে একধরনের সম্পর্ক তৈরি করা হয়, এই নিবর্তনকে অব্যাহত রাখার প্রয়াসে। অবশ্য এগুলো সবই আমার ব্যক্তিগত ধারণা।
@অভিজিৎ,
আমার তাই মনে হয়। বৈদিক সাহিত্য পড়ে ও উচ্চবর্ণের লোকেদের (মূলতঃ ব্রাহ্মণ) ও নিম্নবর্ণের লোকেদের শারীরীক বৈশিষ্টের তুলনা করলে মনে হয় ব্রাহ্মণরাই মূলতঃ আর্য পিতৃবংশের ধারক ও বাহক আর সমস্ত সামাজিক নিয়ম কানুন রচিত হয় এদের স্বার্থ রক্ষার্থে ও সমাজে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে।casteism এর মূল সম্ভবত লুকিয়ে রয়েছে আরেক জঘণ্য প্রথা racism এর মধ্যে।
@বিপ্লব পাল,
হিটলার যে দাবী করত যে জার্মানরাই আসল এরিয়ান বা আর্য জাতি এর কি কোন ভিত্তি আছে?
@আদিল মাহমুদ,
আর্যভাষাভাষী জাতি গুলি racial antheopology অনুযায়ী বেশিরভাগ caucasoid (একমাত্র ভারতীয়দের দেহে অন্য জাতির মিশ্রণ ) দেখা যায়।আবার বর্তমানে সংস্কৃতভাষী জনগণের আদিম বাসভূমি (বেদে উল্লিখিত স্থানগুলির বাসিন্দারা মূলতঃ caucasoid(nordindid)।আবার ব্রাহ্মণাদি উচ্চবর্ণের চেহারাও nordindid তথা caucasoid মিশ্রণের সাক্ষ্য প্রদান করে।সুতরাং হিটলারের কথার কিছু সারবত্তা আছে এবং তিনি পরিকল্পিত ভাবে অর্ধসত্য প্রচার করেন। প্রকৃত সত্য হল জার্মানি আর্য জাতি তবে একমাত্র বা সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ নয়।
@রণদীপম বসু
কতগুলো আংশিক-প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করি, উত্তর জানা থাকলে বইলেন 🙂 । আর্য এবং হিন্দু ধর্মের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রায়ই ভেবেছি, কিন্তু কখনও কোন বই পড়া হয়নি, এমন কোন বই আছে কিনা তাও ঠিক জানা নেই।
আর্যরা তো পশ্চিম থেকে এসেছিল, ওরা কি পার্শিয়ান বা গ্রিক ছিল? আমরা আজকে যেভাবে ‘দেশ’ এর কথা ভাবি তখন তা ছিল না, কিন্তু ৩-৪ হাজার বছর আগে হলে তো পশ্চিমে সুমেরীয় সভ্যতা ছিল, ক্রীট ( বানানটা কি হবে নিশ্চিত না) সভ্যতা ছিল আরও পশ্চিমে ছিল মিশরীয় সভ্যতা। গ্রীক সভ্যতা মনে হয় তারও কিছু পরের। আর্যরা তো মনে হয় সে সময়ে আমাদের স্থানীয় দ্রাবিড়দের তুলনায় সাংস্কৃতিকভাবে ‘অগ্রসর’ ছিল। ওদের বিভিন্ন দেব দেবীর সাথে আমি কেমন জানি গ্রীক দেব দেবীর একটা মিল পাই। আসলে কি এদের মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে নাকি এটা নিতান্তই কাকতালীয় একটা ব্যাপার বা আমার বোঝার ভুল?
@বন্যা আহমেদ,
বন্যাপা, কোন ধারণাপ্রসূত জ্ঞান নিয়ে আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে আমি নিজেই প্রশ্নমুখীন আছি। দেখা যাক্, আগামীতে এব্যাপারে কোন ফলাফল পাই কিনা।
বিপ্লব দা’র মন্তব্য আমার অনুসন্ধানে সহায়তা করবে অবশ্যই। এ ব্যাপারে আর কারো কোন ধারণা থাকলে তা মন্তব্যের মাধ্যমে শেয়ার করতে পারেন। উত্তর পেতে সুবিধা হবে।
তবে আমার মনে হয় আপনি এবং অভিজিৎ দা এবং বিপ্লব দা যদি সূত্র খোঁজায় লেগে যান, তাহলে অনেক দ্রুত আমরা এ ব্যাপারে একটা যুক্তিসংগত ধারণা পেয়ে যাবো।
(আশা করি প্রস্তাবটা বিবেচনার অযোগ্য নয়।)