জীবন সচেতন

[মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বই পড়েছি। বিশেষ করে আহমদ শরীফ ও হুমায়ুন আজাদের বই। পড়তে পড়তে যে সমস্ত বাক্য ভালো লেগেছে সেগুলো আমার একটি নোট খাতায় লিখে রেখে মুখস্ত করতে চেষ্টা করেছি। আজ মুক্তমনা পাঠকদের উদ্দেশ্যে সেগুলো নিবেদন করলাম, পাঠকদের ভালো লাগলে এবং কেউ যদি মুক্তিবুদ্ধি চর্চায় অনুপ্রাণিত হন তাহলে আমার এই শ্রম সার্থক মনে করবো]

(1) দেখতে শুনতে বলতে করতে যা কুৎসিত, তা পরিহার করে চলা, নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিশ্বাসের মাপে যা অসত্য, অন্যায়, অসততা, অসঙ্গত, অবাঞ্ছিত, চিন্তা-কর্ম আচরণে তা এড়িয়ে চলা, সমাজ-সদস্য হিসেবে যথাস্থানে যথাসময়ে যথাপ্রয়োজনে যথাযোগ্য ও যথাসাধ্য নৈতিক-সামাজিক-মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করাই আমার ধর্ম।
(2) জন্ম-মৃত্যুতেই জীবনের আদি-অন্ত সীমিত। জাগ্রত মুহুর্তগুলোতে অনুভূত চেতনার সমষ্টিই জীবন। মানুষের দেহে মনে সুপ্ত থাকে অপরিমেয় শক্তি ও সম্ভাবনা। সচেতন অনুশীলনের মাধ্যমে তার বিকাশসাধন না করলে জীবনের পূর্ণ রূপ প্রকট হয় না। বৃথা ও ব্যর্থ হয় সম্ভাবনাময় জীবন।
(3) মানুষের ভালত্ব ও মন্দত্ব আপেক্ষিক। যে-খুনী ডাকাত নরহত্যায় অর্থ সম্পদ সংগ্রহ করে, সে-ও প্রেমময় স্বামী, স্নেহময় পিতা, পিতামাতার অনুগত সেবক। তার এ দুটো রূপই তো সত্য।
(4) ব্যক্তির চেতনায় তার জগতের, জীবনের ও সমাজের বাঞ্ছিত রূপ স্বরূপই তার জীবনদর্শন।
(5) শাস্ত্র নয়, আত্মবোধ ও আত্মমর্যাদা চেতনাই মানুষকে বিবেকী বিবেচক তথা নীতিনিষ্ঠ রাখে। এ মানুষই হয় চরিত্রবান।
(6) জ্ঞানকে প্রজ্ঞায় উন্নীত করাই শিক্ষার লক্ষ্য, অন্য কথায় মানসোৎকর্ষসাধনই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
(7) নির্লোভতা ও প্রয়োজনে ক্ষতি স্বীকারের শক্তিই ব্যক্তিজীবনে অপরাজেয় শক্তি।
(8) কৌতুলহীনতা ও আকাঙ্খাশূন্যতা থেকেই আধির (মানসিক পীড়া) উৎপত্তি।
(9) অনুকরণে নয়, জীবনের প্রয়োজনে সজ্ঞান সৃষ্টিই উন্নতির লক্ষণ।
(10) প্রাকৃতিক নিয়মেই দেহ-মনের স্বাস্থ্য নির্ভর করে নিয়মিত ও পরিমিত কায়িক ও মানসিক শ্রমের উপর।
(11) যে যত বেশি সাফল্যকামী বা লোভী সে তত বেশি তদবীরে তকদির বদলের তত্ত্বে আস্থা রাখে এবং দ্বিগুণ উৎসাহে মতলব হাসিল লক্ষ্যে আত্মমর্যাদা পরিহার করে সর্বপ্রকার জঘন্য পন্থায় ও দুর্নীতির আশ্রয়ে কাঙ্খ্য ফল পেতে চায়।
(12) পাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ না হয়ে না-চাওয়ার ও না-পাওয়ার ক্ষতি স্বীকারের জেদ ও শক্তি অর্জন করতে পারলেই কেবল বিদ্যাসাগরের মতো শির সমুন্নত রেখে অটুট আত্মমর্যাদা নিয়ে নীতিনিষ্ঠ শ্রদ্ধেয় জীবন যাপন সম্ভব। এমন মানুষ সম্পদে রিক্ত হলেও অন্তরে থাকে ঋদ্ধ।
(13) অনুতপ্তের অপরাধবোধ থেকেই সহজেই দ্রুত জাগ্রত হয় বিবেক এবং জাগ্রতবিবেক সদ্বুদ্ধি ও সদিচ্ছা যোগায়।
(14) বিদ্যায়-বিত্তে-মানে-মর্যাদায় যারা বড়ো, মানুষ তাদের অনুকরণে আত্মোন্নয়ন করে ধন্য হতে চায়। সেজন্যে প্রায় নির্বিচারে বড়ো ব্যক্তির ও জাতির অনুকরণে-অনুসরণে আগ্রহী হয় হীনমন্য ব্যক্তি ও জাতি।
(15) গোঁজামিলে গোল মেটে না, সমাধান মেলে না কোনো সমস্যার। শুকায় না কোনো মর্মমূলের ক্ষত। পরিহার করে না শ্রেয়চেতনাবশেও কোনো ঐতিহ্য।
(16) তুচ্ছ একটা কণা জড়িত আগুন যেমন গোটা পাড়া পোড়াতে পারে, দাবানল যেমন পারে গোটা অরণ্য ভস্ম করতে, তেমনি মানস-সংস্কারও রাষ্ট্রিক জীবনে বিপর্যয় ঘটাতে পারে।
(17) আমরা যদি স্বীকার করি যে পৃথিবীতে বিভিন্ন রুচির মানুষ রয়েছে, তাহলে নিন্দার কিংবা আশঙ্কার কারণ থাকে না।
(18) সমাজে বাস করে বলেই নিরক্ষর মানুষও জীবনযাত্রার প্রয়োজনে দেখে ও শুনে অনেক কিছুই শেখে, জানে ও বোঝে। কিন্তু তাতে নিতান্ত ঘরোয়া ও সামাজিক নিয়ম-নীতির মধ্যে রীতিপদ্ধতি মেনে প্রাণী হিসেবে দেহে বাঁচাই মাত্র সম্ভব হয়, মনে বাঁচার অপূর্ণতা ও স্থূলতা থেকেই যায়।
(19) মানুষ হিসেবে বিপুল জগতে বিচিত্র অনুভবের মধ্যে মনে বাঁচার জন্যে মানুষকে প্রাত্যহিক জীবনে চাহিদার অতিরিক্ত অনেক কিছুই শিখতে, জানতে ও বুঝতে হয়।
(20) জ্ঞান অনুভবের ও উপলব্ধির জগৎ প্রসারিত করে। অপরের থেকে যা জানা যায়, তাই জ্ঞান, আর ব্যক্তিগত ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণের মধ্যে দিয়ে যা জানা হয় তার নাম অভিজ্ঞতা। এক হিসেবে অভিজ্ঞতাই পূর্ণ জ্ঞান- যা বোধিতে বা প্রজ্ঞায় পরিণতি পায়।
(21) কোন্‌ প্রয়োজনে কোন্‌ অবস্থায় ও অবস্থানে আমাদের কি কর্তব্য, কোন্‌ বিপদ এড়ানোর জন্যে কোন্‌ উপায় বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, কার সঙ্গে কোন্‌ পরিস্থিতিতে কিরূপ ব্যবহার করা সমীচীন, তা আমরা অতীতের অপরের অভিজ্ঞতা থেকে তথা আমাদের অর্জিত জ্ঞান থেকে বুঝতে পারি।
(22) প্রকৃতির জগতে কিছুই বৃথা পড়ে থাকে না। শূন্য থাকে না কোনো স্থান। কেউ না কেউ, কিছু না কিছু তা ভোগ করে, কারো না কারো ব্যবহারে লাগে। লঘু-গুরু-উপযোগ থাকে সব কিছুর।
(23) এ জগতে প্রকৃতি ও মানুষ কেউ অজ্ঞের অক্ষমের, নিষ্কর্মার নির্বোধের বন্ধু নয়।
(24) কল্পনার, বিশ্বাসের, শাস্ত্রের, ন্যায়-অন্যায়ের ও পাপ-পূণ্যের ধারনার পৃথিবীব্যাপী এই কালিক ও স্থানিক পরিবর্তনই নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে যে ভূত-প্রেত-পিশাচ, জীন-পরী, দেবতা-দানব আসমানী দিন-ক্ষণ-তিথি নক্ষত্র-রাশিচক্র, ভাগ্য, নিয়তি প্রভৃতি দৃশ্য-অদৃশ্য পূজ্য-উপাস্য, অরি-মিত্র শক্তি নিতান্তই আত্মপ্রত্যয়হীন অজ্ঞ অসহায় ভীরু মানুষের কল্পনাপ্রসূত।
(25) গণমুক্তির লক্ষ্যে সমাজ পরিবর্তন করতে হলে পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার ও নিয়ম-নীতি মুক্ত, যুক্তি ও বিজ্ঞানমনস্ক বাঞ্ছিত সংখ্যক আদর্শবান কর্মনিষ্ঠ মানুষপ্রেমীন নাগরিক প্রয়োজন।
(26) সবার মধ্যে নৈতিকচেতনা, আত্মবিশ্বাস ও শ্রেয়োবোধ সমান থাকে না, কারো কারো মধ্যে এসব গুণ সুপ্তই থেকে যায়। তাই কোনো সমাজেই কোনোকালেই বৌদ্ধিক, নৈতিক, শৈক্ষিক, আর্থিক ও চারিত্রিক বিকাশ সমভাবে হয় না।
(27) গরু মেরে জুতাদান নীতিপন্থী নানা ছদ্ম পরার্থপর তথাকথিত দুস্থমানবদরদী সেবা সমিতি, ক্লাব, ও এন জি ও গুলো দেশের মানুষকে আত্মসম্মানহীন কৃপাকরুণা, দান-দাক্ষিণ্য-কামী-জীবি চরিত্রভ্রষ্ট পরনির্ভর পঙ্গুমনের মানুষে পরিণত করেছে।
(28) ভালোবাসা, বিশ্বাস, ভরসা ও নির্ভরতাই ব্যক্তি জীবনের পুঁজি ও পাথেয়। কাউকে ভালোবেসে, কারো উপর বিশ্বাস, ভরসা ও নির্ভরতা রেখে চলা সম্ভব বলেই জীবন এতো প্রিয়, পৃথিবী এমন আকর্ষণীয়। এ সবের অভাব ঘটলে জীবন হয় অসহ্য যন্ত্রণার আধার, তখন মানুষ আত্মহননে মুক্তি খোঁজে।
(29) যে মানববাদী নয়, মানবতার অনুশীলন যার নেই, যে মানুষের প্রতি প্রীতিমান নয়, সে মানুষের হিতকামী হতে পারে না, মানবসেবী হওয়ার যোগ্যতা তার থাকে না।
(30) কোনো কিছুরই একটি শব্দে, একটি বাক্যে সংজ্ঞা, টীকা, ভাষ্য, বিশ্লেষণ সম্পন্ন করা যায় না। রূপে, রঙে, গুণে, মানে, মাত্রায় রকমফের নির্দেশ করতে হলে ‘এবং, আরো, ইত্যাদি’ যোগে অনেক কথায় বলতে হয়। তার পরেও পূর্ণাঙ্গ চিত্র দেয়া যায় না। সমস্যার আলোচনায়ও দোষ ত্রুটি থাকে। তবু আলোচনা করতেই হয়।
(31) কোনো কাজ আদায়ে বাবা-মামা-শ্বশুরের তদ্বীর চাই। ক্ষমতাবান আত্মীয়-বন্ধু-স্বজনের সুপারিশ চাই। তদ্বীর ও সুপারিশের বিকল্প হচ্ছে অনাত্মীয় অপরিচিতের দেয় ঘুষ।
(32) প্রায় সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বাধিকারে যে কোনো রকমের দুর্নীতির নীতি-নিয়ম লঙ্ঘনের, পক্ষপাতিত্বের দায়ে দায়ী। সবাই পাপী-অপরাধী, সবাই কাঁচের ঘরে বাস করে। তাই কেউ কাউকে সাহস করে উচ্চ কণ্ঠে স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারে না- আমার কাজ করে দেয়া, আমার চাহিদা পূরণই তো নিযুক্তিসূত্রে আপনার দায়িত্ব, কর্তব্য ও বাধ্যতা।
(33) ব্যক্তিভেদে মানুষের স্বভাবে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রবণতা। কেউ ত্যাগে, কেউ ভোগে, কেউ রাগে, কেউ বিরাগে, কেউ ক্ষমায়, কেউ প্রতিহিংসায় আসক্তি রাখে। কেউ কোমল, কেউ কঠোর, কেউ আবেগপ্রবণ, কেউ ধীর শান্ত, কেউ আনুগত্যপ্রবণ, কেউ বা দ্রোহী।
(34) ব্যক্তি-সত্ত্বার অস্তিত্ব অনুভূত ও প্রকাশিত হয় কথায়, কাজে ও আচরণে তার মনোভাবের অভিব্যক্তির মাধ্যমে। যার ব্যক্তিত্ব যত প্রবল, তার কথার, কাজের ও আচরণের গুরুত্ব তত বেশি।
(35) ভুল বা ত্রুটিজড়িত তথ্য-বা তত্ত্ব-জাত ধরণা ভিত্তিক সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা, কর্ম ও আচরণ পরিণামে ক্ষতির কারণ হয়।
(36) যে-কারণেই বা যে-প্রয়োজনেই হোক, যে জুলম করে সে মনে রাখে না, কিন্তু যে মজলুম সে তা কখনো ভুলে না।
(37) সব ক্রিয়ারই কারণ থাকে, এবং একক কারণে কিছু ঘটে না; আপাত-আকস্মিক ঘটনার পেছনেও থাকে একাধিক দৃশ্য অদৃশ্য, প্রত্যক্ষ পরোক্ষ কারণপরম্পরা।
(38) জাগ্রত সময়ের পরিসরে অনুভূত চেতনার সমষ্টিই জীবন, নিদ্রিত ও মুর্ছিত মানুষে জীবন অনুপস্থিত। নব নব খণ্ড আকাঙ্খাপূর্তির প্রণোদনাই হচ্ছে জীবনের চালিকাশক্তি। তাই অতৃপ্তিই জীবন-প্রেরণা। মানুষের কর্মে আচরণে কাঙ্খাজাত জীবনানুভূতিরই প্রকাশ ও বিকাশ ঘটে। এ তাৎপর্যে কাঙ্খার পূর্তি-অপূর্তির সামষ্টিক অনুভূতিই সুখ-দুঃখময় জীবন।
(39) মানুষের শোনা-জানা থাকে অনেক কিছুই, কিন্তু জ্ঞান প্রজ্ঞায় পরিণতি না পেলে, বোধ-বুদ্ধি হৃদয়গত না হলে তা বিবেক প্রণোদিত কর্মে আচরণে অভিব্যক্ত হয় না।
(40) মানুষ সম্বন্ধে আমার ধারণা- দৈশিক, কালিক, শাস্ত্রিক, বার্ণিক, আবয়বিক, আর্থিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক অবস্থানভেদ সত্ত্বেও প্রাণিজগতে প্রজাতি হিসেবে সারা দুনিয়ার মানুষেরই বৃত্তি-প্রবৃত্তি অভিন্ন। মানুষ ভালোও নয়, মন্দও নয়। মানুষ কখনো ভালো, কখনো মন্দ, কারুর প্রতি ভালো, কারুর প্রতি মন্দ, কারুর কাছে ভালো, কারুর কাছে মন্দ, কারুর জন্যে ভালো, কারুর জন্যে মন্দ। মানুষে মানুষে সব সম্পর্কই আপেক্ষিক।
(41) কারণ-কার্যের অজ্ঞতা থেকেই উদ্ভব বিস্ময়ের ও কল্পনার। কল্পনা স্থূলযুক্তি ও ব্যাখ্যা জড়িত হয়ে বিশ্বাসরূপে চিত্তলোকে দৃঢ়মূল হয়। এ দৃঢ় বিশ্বাসই সামাজিক প্রতিষ্ঠা পায় শাস্ত্রীয় প্রত্যয়রূপে। সবচেয়ে ক্ষতিকর হচ্ছে, ওই কল্পনাজাত প্রত্যয়কেই শাস্ত্র-ব্যাখ্যাতারা যুক্তিযোগে সত্য বলে প্রমাণ করতে চায়।
(42) আস্তিক মানুষমাত্রেরই রয়েছে পরধর্মে অবজ্ঞা ও বিধর্মীর প্রতি সুপ্ত বিদ্বেষ।
(43) আস্তিকরা দেড়-দুই-আড়াই-তিন-সাড়ে তিন হাজার বছর আগের স্বল্পজ্ঞানের ও সংকীর্ণ চেতনার জগতে মানসবিহার করে। আস্তিক মানুষের চিন্তা-চেতনা, যুক্তি-বুদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে সেই অজ্ঞতার, অন্ধকার অতীতের কল্পনাজাত তত্ত্ব ও তথ্য।
(44) আস্তিক মানুষ মাত্রই গোষ্ঠী বা দলচেতনা বশে বিধর্মী-বিজাতি-বিভাষী-বিদেশী-বিদ্বেশী। তারা ভিন্ন দলের, মতের, দেশের ও ভাষার মানুষ মাত্রকেই পর ও সম্ভাব্য শত্রু বলে জানে ও মানে। আস্তিক মানুষ শাস্ত্র-সমাজ মানে বলেই তার উদারতাও নিতান্ত সংকীর্ণ পরিসরেই আবর্তিত হয় মাত্র।
(45) আস্তিক মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে হাটুরে লোকের মতো ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে একত্রিত হয় বটে, কিন্তু মিলিত কিংবা সমন্বিত হয় না।
(46) আস্তিকের সবচেয়ে বড়ো দোষ দলছুট বলে তারা নাস্তিকের প্রতি সক্রিয় কিংবা নিষ্ক্রিয়ভাবে অসহিষ্ণু। তারা সমাজে চোর-ডাকাত-গুণ্ডা-লম্পট-মাতাল-জালিয়াত-প্রতারক প্রভৃতি যে কোনো আস্তিক দুষ্ট-দুর্জন-দুর্বৃত্ত-দুষ্কর্মাকে সহ্য করতে এমনকি কৃপা-করুণা বশে ক্ষমা করতেও রাজি, কিন্তু নাস্তিকের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ পরিহার করতে অক্ষম। যদিও নাস্তিক এমন কোনো নুতন পাপ বা অপরাধ করে না যা আস্তিকে দুর্লভ। বাস্তবে নাস্তিকের ন্যায়-নীতি-আদর্শনিষ্ঠা ও বিবেকানুগত্য বেশিই থাকে।
(47) আস্তিক মানুষের বিশ্বাসের স্থান যুক্তির উপরে। তাই তারা বিশ্বাস-নির্ভর, তাদের কাছে বিশ্বাসের বিপ্রতীপ কোনো যুক্তির মূল্য-মর্যাদা আদর-কদর নেই। এ জন্যেই আস্তিক কখনো নিঃশর্ত উদার ও গ্রহণশীল হতে পারে না।
(48) আস্তিক মানুষের স্রষ্টায় বিশ্বাস এবং শাস্ত্রে আস্থা থাকা সত্বেও এসব মানুষ শাস্ত্রের বিধি নিষেধের, নৈতিক ন্যায়-নিয়মের, রষ্ট্রিক আইন কানুনের ও সামাজি প্রথা-পদ্ধতির অনুগত থাকতে চায় না, প্রয়োজনবোধে সুযোগ পেলেই বেড়া ভাঙে।
(49) আস্তিক মানুষই অর্থ-সম্পদ লোভে ও রাজনীতির স্বার্থে সারা পৃথিবীর সর্বত্র দেশ জাত-গোত্র-বর্ণ-ধর্ম-ভাষা-মত-পথভেদের অজুহাতে দাঙ্গা বাধায়, দেশ ছাড়ায়- হত্যা করে। এমন মানুষ যে কেবল বিধর্মী বিদেশী বিভাষীকেই পর ও শত্রু ভাবে, তা নয়, পর প্রতিবেশীকেও আপন করতে অক্ষম, কুটুম্বকেও আত্মীয় মানতে অসমর্থ।
(50) আচারনিষ্ঠ আস্তিকের চেয়ে নীতিনিষ্ঠ নাস্তিকই হয় বাঞ্ছিত চরিত্রের মানুষ। প্রলোভন প্রবল হলে সাধারণ আস্তিক হেন পাপ নেই যা করে না।
(51) প্রলোভন প্রবল হলে লুব্ধ মানুষ করে না হেন অপকর্ম নেই- সে-মুহূর্তে ভূত-ভগবান-সমাজ-শাসক, নিন্দা-শাস্তি প্রভৃতির অস্তিত্ব ওই লোভ তরঙ্গের তোড়ে ভেসে যায়।
(52) আস্তিকের আশা-আকাঙ্খা সংকল্প-সিদ্ধান্ত সবটাই দৈব-ইচ্ছা নির্ভর। ‘ইনশাল্লাহ, মাশাল্লাহ, ঈশ্বরেচ্ছায়’- প্রভৃতি উচ্চারণেই তাই তাদের বাঞ্ছা-বাসনা পরিব্যক্ত হয়। কাজেই এমন দুর্বলচিত্ত সদাশঙ্কিত মানুষ নাস্তিক হতেই পারে না।
(53) ধার্মিকমাত্রই স্বাতন্ত্রকামী হয় এবং অন্তরে পোষে বিধর্মে অবজ্ঞা ও বিধর্মী-বিদ্বেষ। ফলে বিভিন্ন ধর্মের আস্তিক মানুষ জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই কখনো মানুষের জন্যে অকৃত্রিম মিলন-ময়দান তৈরি করতে পারে না।
(54) অভাব স্বভাব নষ্ট করেই, অভাব ঘুচলেই অভ্যাস পরিহার করে স্বভাবে কেউ আর ফিরে আসে না। অভাবে স্বভাব নষ্ট। অভাব মিটে গেলেও, সম্পদে প্রাচুর্য এলেও হৃতস্বভাব আর ফিরে আসে না, তখন মানুষ হয় অভ্যাসের দাস। কাজেই বাইরে কাঙালী ঘুচলেও মনের কাঙালপনা, দুর্নীতি ও অপরাধপ্রবণতা কয়লার মতোই অবিমোচ্য হয়ে থেকেই যায়।
(55) বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও জীবিকাক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা মানুষকে করে আত্মপ্রত্যয়রিক্ত ও আত্মশক্তিতে আস্থাহীন। তাই তারা ভাগ্যনির্ভর, নিয়তিবাদী এবং তদবীরে তকদির বদলানোর তত্ত্বে আস্থাবান। এমন মানুষ, তুক-তাকে, দারু-টোনায়, ঝাড়-ফুঁকে, তাবিজ-কবচে, মন্ত্র-মাদুলীর শক্তিতে, লোহা-তামা-নিকেল-রূপা-সোনা-হীরা-প্ল্যাটিনাম প্রভৃতি ধাতুগুণে ও নানা মূল্যবান রত্নের-পাথরের প্রভাবে আস্থা রাখে, ভরসা রাখে সাধু-সন্ন্যাসী-ফকির-দরবেশের দোয়ায়। ফলে এসব লোকের আঙুলের নানা রঙের ও আকারের অঙ্গুরী, কণ্ঠের, কোমরের, বাহুর তাগা-তাবিজ, আর ভাগ্যগণকের কাছে তাদের অসহায় আত্মসমর্পনই প্রমাণ করে যে তারা স্বস্থ ও সুস্থ নয়।
(56) ঘুষ, বকসিস, কমিশন ছাড়া আজকাল নাকি কোথাও কোনো চাকুরেই তার দায়িত্ব পালন করে না তার কর্তব্য স্মরণে। সর্বত্র অকারণে ও অন্যায়ভাবেই ‘ফেল কড়ি মাখো তেল’ নীতি কার্যকর।
(57) ঘুষেরও প্রকারভেদে নামভেদ রয়েছে। যেমন পরোক্ষ ঘুষ ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রীতি প্রতীক উপহার, প্রত্যক্ষ ঘুষ নজর, উপঢৌকন, সম্মানী, আবওয়াব, সালামী এবং কাজে সাহায্য পেয়ে এবং কাজ করে দেয়াতে মক্কেল খুশি হয়ে অর্থ-সামগ্রী দিয়ে কর্মকর্তাকে খুশী করার নাম ‘বকশিশ’।
(58) অপরকে অযাচিত উপদেশ-পরামর্শ দেয়ার ধৃষ্টতা যে অপরিশীলিত বর্বর রুচি-বুদ্ধিরই পরিচায়ক, তা তথাকথিত শিক্ষিত-সংস্কৃতিবানেরাও উপলব্ধি করে না।
(59) অতীত স্মৃতির বন্ধন ও প্রীতির আকর্ষণই মানুষকে শাস্ত্রে ও ঐতিহ্যে আস্থাবান ও নির্ভরশীল রাখে।
(60) বিদ্বানমাত্রই সুশিক্ষিত সংস্কৃতিবান সজ্জন নয়। জ্ঞান বোধশক্তির বিকাশ ঘটায়, বৃদ্ধি বাড়ায়, চরিত্র গড়ে না। শাস্ত্রানুগত্যও মানুষকে যান্ত্রিক রোবট করে, মনুষ্যত্ব দান করে না।
(61) বাস্তবে পাপভীতি বা শাস্তির আশঙ্কা নয়, তীক্ষ্ণ আত্মবোধ তথা আত্মমর্যাদা চেতনাই মানুষকে ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণে ভালোমন্দ সম্বন্ধে বিবেকী-বিবেচক করে তোলে।
(62) আত্মসম্মান সচেতন আত্মপ্রত্যয়ী স্বশিক্ষিত নাস্তিকরা জীবনে যতটা ন্যায় ও নীতিনিষ্ঠ হয় ও থাকে, ততটা তেমনি যান্ত্রিকতায় অভ্যস্ত শাস্ত্র-মানা নীতিবিদদের ও নীতিবানদের মধ্যে দুর্লক্ষ্য।
(63) সমাজস্বাস্থ্য রক্ষার জন্যে শাস্ত্র-মানা মানুষ নয়- নীতিনিষ্ঠ মানুষই কাম্য। নীতিনিষ্ঠ মানুষমাত্রই দেশ-কাল-জাত-বর্ণ-ধর্মের উর্ধে স্বসৃষ্ট নিঃসঙ্গ একক মানুষ- অনন্য ব্যক্তিত্ব।
(64) যেখানে অজ্ঞতা, সেখানেই কল্পনার আশ্রয়, কল্পিত ধারণা প্রশ্রয় পেয়ে পরিণত হয় সংস্কারে, আর সংস্কার দৃঢ়মূল হলে তা বিশ্বাস রূপে পায় স্থিতি।
(65) নেহাত শাস্ত্রানুগত্য থেকে নৈতিক চেতনার উদ্ভব ঘটে না কখনো।
(66) কেবল রাজনীতি নয়, যে কোনো ক্ষেত্রে নেতা ও নেতৃত্ব সম্বন্ধে আমার ধারণা নেতার মনীষা ও চত্রিবল থাকা আবশ্যিক। একজন নেতার সত্যপ্রীতি, ন্যায়নিষ্ঠা, সংযম, সাহস, সততা, ক্ষতি স্বীকারের শক্তি, ধৈর্য এবং লক্ষ্য নিষ্ঠা, অবিচল আত্মবিশ্বাস ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি থাকা জরুরী। সে নেতাই আদর্শ নেতা যিনি যে-যন্ত্রণা, যে-ক্ষতি, যে-ঝুঁকি নিজের জন্যে কামনা করেন না, তা তাঁর অনুগত জনের জন্যেও বাঞ্ছিত মনে করেন না। যিনি এগিয়ে দিয়ে লেলিয়ে দিয়ে নিজে সরে দাঁড়ান না। যে মানুষের উপর বিশ্বাস-ভরসা-নির্ভর রাখা যায়, যে-মানুষ স্বস্বার্থে ছল-চাতুরী-প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অনুগত-অনুরাগীর আস্থা নষ্ট করবেন না, আগে নিজের ক্ষতি না করে অনুগত জনের ক্ষতির কারণ হবেন না, সে-মানুষই যথার্থ নেতা।
(67) চক্ষুগ্রাহ্য নয় বলেই নতুন চিন্তার, চেতনার, যুক্তির, সত্যের, শ্রেয়সের, তথ্যের ও তত্ত্বের উপযোগ আমাদের বোধগত হয় না।
(68) বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা যায় বেড়ে, জ্ঞান পায় বৃদ্ধি, অনুভূতি হয় গভীর, আকাঙ্খা জাগে এ জগতকে ও জীবনকে সাধ্যানুসারে মনোগত করে জানতে, বুঝতে ও আয়ত্বে আনতে।
(69) সবকিছুই জ্ঞান-বুদ্ধি-সাহস-আত্মপ্রত্যয়-প্রজ্ঞাযোগে মনোবল বাহুবল ও ধনবল প্রয়োগে অর্জন করতে হয়।
(70) যেহেতু প্রকৃষ্ট জ্ঞান কখনো কাউকে প্রতারিত করে না, যুক্তির আশ্রয় মানুষকে আত্মপ্রত্যয়ী করে এবং বুদ্ধি মানুষকে সতর্ক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে, সেহেতু জ্ঞান-যুক্তি-বুদ্ধির সার্বক্ষণিক অনুশীলনই মানুষের জীবনযাত্রার নির্ভরযোগ্য পুঁজি ও পাথেয়।
(71) শেখা, জানা আর বোঝা সমার্থক নয়। যা শেখা হয় তা-ই শিক্ষা, যা জানা যায়, তা-ই বিদ্যা বা জ্ঞান। আর যা বোঝা যায় তা-ই বোধি বা প্রজ্ঞা। হাতেখড়ির পরে যে-শিশু ‘কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল’ শেখে, সে কিন্তু ‘কানন’, ‘কুসুম’, ‘কলি’, কি জানে না। সে কেবল মুখস্থ করে, এ-ই তার কাজ। যে-শিক্ষার্থী ‘বরিশালে ধান ও পাট জন্মে’ বলে জানে, সেও বোঝে না ধান ও পাঠ উৎপন্ন না হলে বরিশালের কি ক্ষতি হত। বুঝবার জন্যে শেখার, জানার বয়সের প্রয়োজন- সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বোঝার আগ্রহের।
(72) রাজনীতিবিদদের মুখে ইসলামের ও আল্লাহর নাম, কিন্তু ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণে এরা শয়তানের চেলা।
(73) যে বাঙালীসত্তা-চেতনা ১৯৭১ সনে তাদেরকে জীবন-পণ-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা দিয়েছিলো, তা আজ দুর্লক্ষ্য।
(74) সব ধর্মের নৈতিকতার ভিত্তি ভয়। বহু ধর্মে বিধাতা ক্রদ্ধ ও হিংস্র; ক্রদ্ধ ও হিংস্র হয়ে থাকা ছাড়া তাঁর আর কোনো কাজ নেই; অবিশ্বাসীকে শাস্তি দেয়ার জন্যে তিনি ব্যগ্র, এবং বিশ্বাসীকেও সব সময় রাখেন সে ভীতির মধ্যে।
(75) ধর্মের নৈতিকতার সাথে মানবিক নৈতিকতার তুলনা করলে ধরা পড়ে যে ধর্মীয় নৈতিকতার মূলে নৈতিকতা নেই, রয়েছে সেচ্ছাচারী নির্দেশ; আর মানবিক নৈতিকতার ভিত্তি হচ্ছে কল্যাণ।
(76) নাস্তিক চায় মানুষের চেতনাকে বদলে দিতে, মানুষকে বিকশিত করতে; আর ধার্মিক চায় মানুষের চেতনাকে নষ্ট করতে, মানুষকে রুদ্ধ করতে। ধার্মিকদের নৈতিকতাবোধ খুবই শোচনীয়।
(77) যে-কোনো নির্বোধের পক্ষে ধার্মিক হওয়া সহজ, কিন্তু শুধু জ্ঞানী ও মানবিক ব্যক্তিই হ’তে পারে নাস্তিক। নাস্তিক হত্যা আর ধ্বংস করে না; কিন্তু ধার্মিক সব সময় হত্যা ও ধ্বংসের জন্যে ব্যগ্র থাকে; তারা ইতিহাসের পাতাকে যুগে যুগে রক্তাক্ত করেছে। প্রত্যেক ধর্মে রয়েছে অসংখ্য সন্ত, যারা মস্তিষ্কের হত্যাকারী।
(78) মৃত্যুর পর মানুষের পরিণতি বর্ণনা ধর্মের এক প্রিয় বিষয়; এ এলাকায় ধর্মগুলো মানুষকে লোভের পর লোভ আর ভয়ের পর ভয় দেখায়। মৃত্যুর পর মানুষের পরিণতি সম্পর্কে ধর্মগুলো যা বলে, তা হাস্যকর, যাতে বিশ্বাস করতে পারে শুধু লোভী ও ভীত মানুষ।
(79) মৃত্যু হচ্ছে জীবনপ্রক্রিয়ার উল্টোনো অসম্ভব পরিসমাপ্তি। আর ফেরা নেই, আর অগ্রগতি নেই; চিরকালের জন্য থেমে যাওয়া। যে ছিলো সে আর সেই; আর সে নিশ্বাস নেয় না, তার শিরা আর কাঁপে না, আলো তাকে আর চকিত করে না, আঘাত তাকে আর ব্যথা দেয় না। আমি জানি, ভালো করেই জানি, কিছু অপেক্ষা করে নেই আমার জন্যে; কোনো বিস্মৃতির বিষণ্ন জলধারা, কোনো প্রেতলোক, কোনো পুনরুত্থান, কোনো বিচারক, কোনো স্বর্গ, কোনো নরক; আমি আছি, একদিন থাকবো না, মিশে যাবো, অপরিচিত হয়ে যাবো, জানবো না আমি ছিলাম। নিরর্থক সব পুণ্যশ্লোক, তাৎপর্যহীন প্রার্থনা, হাস্যকর উদ্ধত সমাধি; মৃত্যুর পর যে-কোনো জায়গাই আমি পড়ে থাকতে পারি,- জঙ্গলে, জলাভূমিতে, পথের পাশে, পাহাড়ের চূড়োয়, নদীতে।