My Shangri-la beneath the summer moon,
I will return again
– Kashmir, Led Zeppelin
১৯৫১ সালে মার্কিন প্রত্নতত্ত্ববিদ রালফ সোলেকি ইরাকের বৃহত্তর রোয়ান্দুজ অঞ্চল চষে বেড়িয়েছিলেন প্রাগৈতিহাসিক গুহার খোঁজে। তখনও ইরাকের প্রাগৈতিহাসিক ঐতিহ্য সম্পর্কে আমরা খুব বেশি কিছু জানতাম না। সোলেকিই এক্ষেত্রে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর (‘ক্বাইমাকান’) এবং ইরাক ডিরেক্টোরেট জেনারেল অফ এন্টিকুইটিস এর একজন প্রতিনিধি নিয়ে জাগরোস পর্বতমালার কোল-ঘেষা রোয়ান্দুজ ও শানিদার অঞ্চলে গিয়েছিলেন। সেখানে প্রায় ৪০ টি গুহা এবং আশ্রয়স্থল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান শেষে শানিদার গুহাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এই জরিপ কাজটিই প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসে “শানিদার-রোয়ান্দুজ জরিপ” হিসেবে পরিচিত। উল্লেখ্য, এই জরিপ চলাকালেও কিন্তু জাব এবং রোয়ান্দুজ নদী অধ্যুষিত এই জনপদ সুস্থির ছিল না। গোত্রে গোত্রে সংঘর্ষ আর যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই ছিল। যুদ্ধের কারণেই ১৯৬৩ সালের পর অনেক বছর সোলেকিরা সেখানে ফিরে যেতে পারেননি। প্রত্নতত্ত্ব গবেষণার পাশাপাশি সোলেকি এই অঞ্চলের যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাসও লিপিবদ্ধ করেছিলেন তার একটি গবেষণাপত্রে। দুটি সময়ের মধ্যে ব্যবধান ৫০,০০০ বছর, সময়ের স্রোতে কতকিছুই পরিবর্তিত হয়ে গেছে, কিন্তু এক দিক দিয়ে তাদের মধ্যে সুস্পষ্ট মিল- সেটি হল যুদ্ধবিগ্রহ আর প্রতিযোগিতা।
যাহোক আমাদের গন্তব্য শানিদার গুহা। এই গুহা আবিষ্কৃত হয় ১৯৫১ সালে, অর্থাৎ জরিপ শুরুর প্রথম বছরেই। ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে ৪০০ কিলোমিটার উত্তরে কুর্দিস্তানের উত্তর-পূর্বাংশে সমুদ্রতল থেকে ৭৪৭ মিটার উচ্চতায় গুহাটির অবস্থান। কুর্দিস্তান নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে স্থানটি ইরান সীমান্তে। সুবিস্তীর্ণ জাগরোস পর্বতমালার অধিকাংশ পর্বতশ্রেণীই ইরানে, তবে ইরাকেও কিছু অংশ রয়েছে। ইরাক ও তুরস্কের মাঝের পর্বতশ্রেণীগুলো পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিন্যস্ত। কিন্তু ইরান এবং ইরাক সীমান্তের পর্বতশ্রেণী এক স্থানে এসে বিন্যাস পরিবর্তন করেছে। পূর্ব-পশ্চিম থেকে হয়ে গেছে উত্তর-পশ্চিম:দক্ষিণ-পূর্ব, এই বাঁকের কাছাকাছি একটি পাহাড়চূড়ার নাম বারাদোস্ত। বারাদোস্তের কোলেই শানিদার গুহা, আর গুহা থেকে সামনের দিকে তাকালে যে সুবিস্তীর্ণ উপত্যকা দেখা যায় তার নাম শানিদার বা স্বপ্ন উপত্যকা, উপত্যকা ধুয়ে বয়ে চলা নদীটির নাম জাব। সোলেকির দল প্রথম এই উপত্যকায় এসেছিলেন ১৯৫১ সালের ১০ই জুলাই বিকেল ৫ টায়। এই অভিযানই যে তাদের স্মরণীয় করে রাখবে এটা তারা তখনও বুঝতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু প্রথম যখন শানিদার গুহার মুখটি দেখেন তখন সোলেকির বুঝতে বাকি ছিল না যে, সামনে খুব ভাল কিছু অপেক্ষা করছে। পণ্ডিত প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এমনিভাবে স্থান দেখামাত্র অনেক কিছু বলে দিতে পারেন। প্রথম দর্শনে শানিদার গ্রামকে সোলেকির শাংগ্রি-লা (পর্বতবিভূষিত চিরশান্তির দেশ) মনে হয়েছিল। আর গুহা দর্শনের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে,
“আমরা পুলিশের লোকটিকে কেবলই জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিলাম, গরমের মধ্যে আর কতক্ষণ হাঁটতে হবে। তার উত্তর সবসময় একই ছিল, এই তো বেশি না, আর কিছুক্ষণ। অবশেষে পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি বাঁকটি ঘুরতেই পেয়ে গেলাম তাকে, ৫০০ ফুটের মত দূরে নিশ্চল দাঁড়িয়ে গুহাটি।” [শানিদার, ১৯৭১]
কোন স্থানকে উপযুক্ত মনে হল প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রথমেই যা করেন সেদিন রালফ সোলেকিও তাই করলেন- মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে কিছু খসড়া মাপ নিয়ে নিলেন, গুহার মুখটি ২৫ মিটার প্রশস্ত এবং ৮ মিটার উঁচু। এছাড়া প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে জানতে পারলেন, গুহাটি শায়িত আছে চুনপাথর স্তরের ওপর, ভেতরে অনেকবার আগুন জ্বালানোর কারণে ছাইভস্মে ছাদটা একেবারে কালো হয়ে গেছে, গুহার মেঝে পুরু এবং যত্র তত্র গবাদি পশুর মল ছড়িয়ে আছে যা থেকে বোঝা যায় এখনও এখানে মানুষের যাতায়াত আছে। পরবর্তীতে জেনেছেন শিরওয়ানি কুর্দ হিসেবে পরিচিত আদিবাসীরা শীতের সময় এখানে গবাদি পশুসহ আশ্রয় নেয়। নভেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে অন্তত ৪৫ জন তথা ৭-৮ টি পরিবার এখানে থাকে। ১৯৫১ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সোলেকি এখানে কাজ করেছেন, তবে একটানা নয়, বরং চারটি আলাদা আলাদা মৌসুমে। প্রথম মৌসুম ১৯৫১ সালে শুরু হয়ে এ বছরই শেষ হয়ে যায়, পরের মৌসুমগুলো ছিল ১৯৫৩, ১৯৫৬-৫৭ এবং ১৯৬০। চারবারের মধ্যে দুইবারই তার সাথে শিরওয়ানি কুর্দদের সাক্ষাৎ ঘটেছে। আসলে সেই আদিম নিয়ানডার্থাল থেকে শুরু করে বর্তমানের শিরওয়ানি কুর্দ- এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কখনোই বোধহয় শানিদার গুহা জনবসতিহীন থাকেনি। এজন্যই সোলেকি একে আখ্যায়িত করেছেন, “the oldest prehistoric site with the longest history of occupation in Iraq” বলে।
মৌসুমের পুরো সময়টা সোলেকি স্থানীয় পুলিশ পোস্টে থাকতেন। প্রতিদিন সকালে উঠে গুহায় যেতেন, অর্থের বিনিময়ে খনন কাজে সাহায্য করতো স্থানীয় কুর্দরা। প্রথম মৌসুমে প্রত্নবিজ্ঞানী ছিলেন সোলেকি একাই, বাকি সবাই স্থানীয় শ্রমিক। শুক্রবার সবাইকে নিয়ে ছুটি কাটাতেন। তাদের মূল কাজ ছিল গুহার ভেতরে পরিখা খনন। গুহাটি ক্রিটাশিয়াস যুগের ডলোমাইট চুনাপাথরের স্তরের উপর আছে, এমন স্থানে একটি উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করেন সোলেকি, খনন শুরু করে দেয় শ্রমিকরা। প্রতিদিন দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-গভীরতা একটু একটু বাড়তে থাকে, যতোই গভীরে যাওয়া যায় ততোই মিলতে থাকে প্রাচীনতর যুগের নিদর্শন। গুহার পৃষ্ঠতল থেকে নিচের দিকে প্রায় ৪৫ ফুট (১৪ মিটার) মত খনন করা হয়। এই অংশের মাঝে সোলেকি চারটি সংস্কৃতিক যুগের প্রতিনিধিত্বকারী চারটি পৃথক পৃথক স্তর চিহ্নিত করেন। স্তরগুলো হচ্ছে: A (বর্তমান থেকে নিওলিথিক), B (প্রাক-নিওলিথিক থেকে এপি-প্যালিওলিথিক), C (আপার প্যালিওলিথিক) এবং D (মধ্য-প্যালিওলিথিক)। এর শেষ স্তরটিতেই পাওয়া গেছে ১০ জন নিয়ানডার্থাল মানবের ফসিল। প্রথম ৯ টি পাওয়া গিয়েছিল, পরবর্তীতে উদ্ধারকৃত হাড়গোড়ের মাঝে আরো একজনের ফসিল আবিষ্কৃত হয় যার নাম দেয়া শানিদার ১০।
লক্ষ্যনীয় হচ্ছে, বি স্তরে রীতিমত সমাধিস্থল পাওয়া গেছে, নিয়ানডার্থাল নয় আধুনিক মানুষের গোরস্থান। এই প্রোটো-নিওলিথিক সমাধিস্থল নিয়ে সোলেকি আলাদা একটি বইই লিখেছেন। সেদিকে আমরা যাব না, আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে নিয়ানডার্থালদের মাঝে। তবে আগে যে বলেছিলাম প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে কখনোই শানিদার গুহা মনুষ্যশূন্য হয়নি সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় এই গোরস্থানগুলোর মাঝে। নিয়ানডার্থালদের যতগুলো ফসিল পাওয়া গেছে তার মধ্যে শানিদার ৪ এবং ৩ কে যে সজ্ঞানে সমাধিস্থ করা হয়েছে এ ব্যাপারেও প্রায় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তার মানে ৫০,০০০ বছর আগে নিয়ানডার্থালরা এই স্থানকে সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহারের পর আনুমানিক ১১,০০০ বছর পূর্বে আধুনিক মানুষেরাও একই কাজে একে ব্যবহার করেছে। এই উপাত্ত হয়ত শানিদার গুহার প্রতি মানুষের এক ধরণের নির্ভরতাকেই নির্দেশ করে, মৃত্যুর পরও হয়ত তারা এর কোল ছাড়তে চায়নি। থাক সে কথা, আমরা বরং নিয়ানডার্থালদের আবিষ্কারের মুহূর্তে চলে যাই।
প্রথমে তিনটি বয়স্ক নিয়ানডার্থালের ফসিল পাওয়া গিয়েছিল, তৃতীয় মৌসুমে, ১৯৫৭ সালে। এ বছরের ২৭ এপ্রিল শানিদার ১ আবিষ্কৃত হয়। সোলেকি খননকাজের পুরোটা সময় শ্রমিকদের সাথে সাথে থাকতেন, কারণ খনন করার সময় বিভিন্ন বস্তুর মূল্যবিচারের ক্ষমতা শ্রমিকদের ছিল না, ভুলক্রমে কোন মূল্যবান সামগ্রী নষ্ট হয়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। তবে শানিদার ১ যখন আবিষ্কৃত হয় তখন সোলেকি পরিখার পাশে ছিলেন না। কাজের তত্ত্বাবধান করছিলেন তার সহকর্মী ফিলিপ স্মিথ। ফিলিপ স্মিথের ডায়রিতে এ নিয়ে নিচের লেখাটুকু পাওয়া গেছে:
“বিকেলে B-7 এর একটু উপরে পূর্ব দিককার প্রোফাইল পরিষ্কার করার সময় পাথরের নিচে চাপা পড়ে থাকা একটি মানুষের খুলি পাওয়া গেল, পৃষ্ঠ থেকে ১৪ ফুট ৩ ইঞ্চি নিচে। খুলির পশ্চিম পাশে মাটিতে গভীর একটি দাগ ছাড়া আশপাশে সমাধির আর কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। খুলিটি সামান্য ডান দিকে হেলে দক্ষিণ দিকে মুখ করে আছে। যখন পাওয়া গেছে তখন খুলির উপর একটি বিশাল পাথর থিতু হয়ে ছিল। আশপাশের মাটি হলদে বাদামী, ধূলো কর্দমাক্ত। উপরে ছাড়া আশপাশেও ভারী ভারী পাথর- সম্ভবত পাথরে চাপা পড়ে এই ব্যক্তি মারা গিয়েছিল, অথবা হয়ত তার সমাধির উপর পরে উপর থেকে পাথর পড়েছিল। খুলির সবগুলো হাড় থাকলেও ক্ষত-বিক্ষত। ভ্রুর স্থানটি খুব পুরু।”
স্মিথ অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবে এর গুরুত্ব বুঝতে পারেননি। মনে করেছিলেন আপার প্যালিওলিথিক যুগের কোন হোমো স্যাপিয়েন্স এর ফসিল হবে, এ আর এমন কি! তাই সবাইকে দ্রুত জানানোর প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেননি। সোলেকি ঘটনা শুনেন বিকেলে চা খাবার সময়। পরদিন তার সহধর্মী ও সহকর্মী রোজ সোলেকি সহ সবাই গুহায় যান খুলিটি পরীক্ষা করে দেখতে। এবার আর ভ্রান্তি থাকে না। সোলেকি একে একটি নিয়ানডার্থাল হিসেবে চিহ্নিত করেন, সাথে সাথে স্থানটির গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়, পরিষ্কার করার কাজে সবাইকে আরও সতর্ক হতে নির্দেশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে এই খুলির নামই হয় শানিদার ১, শানিদার গুহায় আবিষ্কৃত প্রথম নিয়ানডার্থাল, পরবর্তীতে যার ডাক নাম রাখা হয় ন্যান্ডি। মজার ব্যাপার হচ্ছে ১৯৫৩ সালের মৌসুমে সোলেকি মাত্র ১০ ইঞ্চির জন্য এই খুলিটি উদ্ধার করতে পারেননি, আর ১০ ইঞ্চি খনন করলে সে সময়ই খুলির দেখা মিলত।
খুলির নিচের চোয়াল ছিল না, পরে স্থানটি আরো পরিষ্কার করার পর দাঁতসহ নিচের চোয়াল পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে যে আঘাতে তার খুলি ক্ষত বিক্ষত হয়েছে সে আঘাতেই চোয়াল বিচ্ছিন্ন হয়েছে। অনেকের মনে এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, কোন একটা অংশ পাওয়ার পরপরই কি সেটা মাটি থেকে উঠিয়ে আনা হয়? উত্তর হচ্ছে, না। আবিষ্কারের পরেও অনেকক্ষণ খুলিটি যথাস্থানেই রাখা হয়েছিল, কারণ শুধু খুলি আলাদা করলে তো বাকি অংশ থেকে তা বিচ্ছিন্নও হয়ে যেতে পারে। নিচে আরও পরিষ্কার করলে যে কঙ্কালের বাকি অংশ পাওয়া যাবে না তার নিশ্চয়তা কি? অবশ্য পুরো কঙ্কাল একসাথেই উদ্ধার করতে হবে এমন কোন কথা নেই, সবই নির্ভর করে প্রত্নবিজ্ঞানীর উপস্থিত বুদ্ধির উপর। অনেক চিন্তাভাবনা করে ২৮শে এপ্রিল সোলেকি খুলিটি উঠিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। বহু যত্নে খুলি এবং বিচ্ছিন্ন চোয়ালকে একই সাথে প্যারিস প্লাস্টার দিয়ে প্লাস্টারিং করা হয়, তারপর একটি ভারী কাঠের বাক্সে করে শানিদার পুলিশ পোস্টে নিয়ে যাওয়া হয়।
শানিদার ১ আবিষ্কারের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলাম কেবল প্রত্নবিজ্ঞানীদের একাগ্রতা এবং প্রত্নতাত্ত্বিক খননে কি পরিমাণ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় তা বোঝানোর জন্য। আরেকটা লক্ষ্য করার মত বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি ফসিল আবিষ্কারই একটি অনন্য ঘটনা, প্রতিটি ঘটনাতেই অনেক আকস্মিকতা, বিস্ময়, তথাকথিত ভাগ্যের উপাদান রয়েছে। তথাকথিত ভাগ্য বললাম এই কারণে যে, পরিসাংখ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ভাগ্য সম্পর্কে আমাদের স্বভাবসিদ্ধ ধারণা অর্থহীন হয়ে যায়। যাহোক, এভাবেই আরও ৮ জন নিয়ানডার্থালের দেহের বিভিন্ন অংশের ফসিল পাওয়া গেছে এই গুহার কোলে। শানিদার ৩ আবিষ্কারের ঘটনাও হয়ত অনেকটা এমনই ছিল। তবে শানিদার ১০ আবিষ্কৃত হয়েছে একেবারে অন্যরকমভাবে, সেটা আরও মজার। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি, এখন আসুন সোলেকির মানচিত্রে দেখে নেয়া যাক- কোন স্থানে কোন নিয়ানডার্থাল এর ফসিল পাওয়া গেছে:
উপরের মানচিত্রটির প্রস্থ বরাবর বামে পশ্চিম এবং ডানে পূর্বদিক। নিচের দিকে হচ্ছে গভীরতা, চারটি স্তরই আলাদা আলাদাভাবে রেখা টেনে দেখানো হয়েছে। দেখা যাচ্ছে বি স্তরকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে- বি১ এবং বি২। সেদিকেও আমরা যাব না, সোজা চলে যাই ডি স্তরে। শানিদার ১ প্রাপ্তির স্থান দেখুন- ডি স্তরের একেবারে উপরে। গভীরতার সাথে এখানে সময়ও দেখানো হয়েছে। ভূতত্ত্বের ভেল্কি- যতোই গভীর, ততোই প্রাচীন। শানিদার ১ পাওয়া গেছে ১৪ ফুট ৩ ইঞ্চি গভীরে যা আনুমানিক ৩৫,০০০ বছর পূর্বের সময়কে নির্দেশ করে। এবার চোখ রাখুন শানিদার ৩ এর দিকে, রোমান হরফে লেখা Shanidar III, তার পাশেই একটি কালো বৃত্ত দিয়ে স্থান নির্দেশ করা- দেখুন তো আমাদের গল্পের কাহিনীর সাথে মিলল কি না। মিলেছে, শানিদার ৩ এর সময়কাল আনুমানিক ৫০,০০০ বছর পূর্বে। বাকিগুলো নিশ্চয়ই আর লিখে দেয়ার দরকার নেই, মনোযোগ দিয়ে চোখ বুলালেই এই ৪৫ ফুট পরিখার মানচিত্রে সকল নিয়ানডার্থালের হদিস পাবেন। আমরা বরং শানিদার ৩ এর কথায় ফিরে যাই। এখন আমি দেখানোর চেষ্টা করব, যে গল্প দিয়ে ফসিলকথন শুরু করেছি তা একেবারেই অলীক নয়। গল্পে কোন তথ্যগুলো প্রমাণের দাবী রাখে? মোটামোটি এগুলো: শানিদার ৩ এর পায়ে অনেক ব্যথা ছিল, বাম দিকের ৯ নম্বর পাঁজরে গভীর ক্ষত ছিল, এই ক্ষত দৈহিকভাবে আধুনিক মানুষের বর্শার আঘাতে হয়েছে, এই ক্ষতের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে, মৃত্যুর আগে আগে সে নিরামিষ ভক্ষণ করেছে, তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছে। দেখি তো শানিদার ৩ এর ফসিল থেকে এত তথ্য পাওয়া যায় কি না…
শানিদার ৩ এর পায়ে ব্যথার কারণ ছিল আর্থ্রাইটিস তথা সন্ধিপ্রদাহ। তার ডান পায়ের গোঁড়ালি এবং আশপাশে পায়ের পাতার বেশ কয়েকটি হাড়ের সন্ধিতে এই রোগ ছিল, ফসিল সে কথাই বলছে। তবে শানিদার ১ এর তুলনায় তার আর্থ্রাইটিসের প্রকোপ বেশ কমই ছিল বলা যায়। গল্পের একটা তথ্যের সত্যতা পেয়ে গেলাম আমরা, শানিদার নিয়ানডার্থালদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ নিয়ে আরো বলব অন্যান্য ফসিলগুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচনার সময়। এবারে গল্পের আরো কিছু তথ্য যাচাই করে নেয়া যাক।
বাম পাশের ৯ নম্বর পাঁজরে এমন সূক্ষ্ণ ক্ষত পাওয়া গেছে যা কোন দুর্ঘটনার মাধ্যমে ঘটা সম্ভব না। জীবাশ্মবিজ্ঞানীরা দেখেই বুঝেছিলেন যে মধ্য-প্যালিওলিথিক যুগের কোন সূক্ষ্ণ অস্ত্রের আঘাতে এমনটি হয়েছে। এই ক্ষতের মধ্যে আবার সেড়ে ওঠার চিহ্নও ছিল। এ থেকেই ধারণা করা হয়েছে যে, আঘাত পাওয়ার দুই সপ্তাহ খানেক পরে শানিদার ৩ মারা গেছে, ততদিনে তার ক্ষত সাড়তে শুরু করেছিল। তবে অস্ত্রের আঘাতে হাড় ভাঙার পাশাপাশি তার বাম ফুসফুসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যার কারণে তার মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়েছে। কিন্তু এই অস্ত্র যে সে সময়কার দৈহিকভাবে আধুনিক মানুষেরই তার প্রমাণ কি? বিবর্তনীয় নৃবিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতি এবং আবিষ্কারগুলো কতোটা চমকপ্রদ এই প্রমাণের মধ্যেই তা ফুটে উঠবে।
এ যেন একটি প্রাগৈতিহাসিক ক্রাইম সিন ইনভেস্টিগেশন তথা সিএসআই। সিএসআই এর সাথে মেলাতে আমরা ধরে নেই শানিদার উপত্যকার এই ঘটনাটি একটি অপরাধ ছিল এবং সেই অপরাধের ৫০,০০০ বছর পরে গোয়েন্দারা চেষ্টা করছেন অপরাধী সনাক্ত করতে। বাস্তবিকই কিন্তু ব্যাপারটা এমন। কেবল পার্থক্য হচ্ছে এফবিআই এর গোয়েন্দা না হয়ে এখানে অনুসন্ধান করেন একজন ফরেনসিক নৃবিজ্ঞানী। এই পার্থক্য আরও কমিয়ে আনা যায়, কারণ ফরেনসিক নৃবিজ্ঞানীদের অনেকে কিন্তু তদন্ত কাজে পেশাদার গোয়েন্দাদেরও সহায়তা করেন। শানিদার গুহা থেকে উদ্ধারকৃত নিয়ানডার্থালদের ফসিল নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা করেছেন এরিক ট্রিনকাউস এবং টমাস ডেল স্টুয়ার্ট। ডেল স্টুয়ার্ট একজন ফরেনসিক নৃবিজ্ঞানী যিনি এফবিআই এর তদন্ত কাজে সহযোগিতা করতেন, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তাকে আদালতে গিয়েও হাজিরা দিতে হতো। যাহোক আমরা শনিদার সিএসআই এ ফিরে আসি।
এক্ষেত্রে মূল তদন্তের কাজ করেছেন যুক্তরাজ্যের ডিউক ইউনিভার্সিটির বিবর্তনীয় নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক স্টিভেন চার্চিল। অন্যদের মত তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন, এই ক্ষত ইচ্ছাকৃত আঘাতের কারণে হয়েছে এবং এ ধরণের আঘাত কেবল দুটি প্রজাতির পক্ষেই করা সম্ভব ছিল সে সময়- নিয়ানডার্থাল এবং দৈহিকভাবে আধুনিক মানুষ। হতে পারে শানিদার ৩ নিয়ানডার্থালদের অন্তঃকলহে মৃত্যুবরণ করেছিল, অথবা হতে পারে প্রতিপক্ষ আধুনিক মানুষেরা তাকে হত্যা করেছিল। অপরাধী সনাক্ত করার একটি উপায় পেয়ে গেলেন চার্চিল, সে সময় নিয়ানডার্থাল এবং আধুনিক মানুষদের ব্যবহৃত অস্ত্র এক রকম ছিল না। এটা বড়ই আশার কথা। কোন ধরণের অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে এবং সেই অস্ত্র কে ব্যবহার করে- এটুকু জানলেই কিন্তু তদন্তের কাজে অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া যায়। কোন ধরণের অস্ত্র কারা ব্যবহার করে সেটা চার্চিল জানেন, তার কেবল জানা দরকার ছিল কোন ধরণের অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতটি হয়েছে, তাহলেই অপরাধী চেনা যাবে। এটা জনার জন্য চার্চিল পুরো অপরাধের ঘটনাটি পুনরায় মঞ্চস্থ করলেন।
প্রথমে দুই ধরণের অস্ত্র বানালেন: নিয়ানডার্থালরা শিকারের জন্য অনেক ভারী বর্শা ব্যবহার করতো, বর্শা নিক্ষেপ না করে তারা কাছ থেকে সজোরে শিকারের দেহে ঢুকিয়ে দিতো, এমন ভারী বর্শা দিয়ে কাছ থেকে শিকারের মত দৈহিক শক্তি তাদের ছিল; অন্য দিকে মানুষেরা অপেক্ষাকৃত হালকা অস্ত্র তৈরি করতে শিখেছিল, কাঠের আগায় ধারালো পাথর বেঁধে সেটা নিক্ষেপকের মাধ্যমে ২০-৪০ মিটার দূরত্বে ছুড়তে পারত। নিয়ানডার্থালদের অস্ত্রগুলোকে মুস্টিয়ারিয়ান (Mousterian) এবং আধুনিক মানুষদের অস্ত্রগুলোকে Levallois বলা হয়। এরপর চার্চিল শানিদার ৩ এর বক্ষপিঞ্জরের রেপ্লিকা খুঁজতে শুরু করলেন। প্রথমে তার সহকর্মী জন শিয়া ছাগলের বক্ষপিঞ্জরে দুই ধরণের অস্ত্র দিয়েই বেশ কয়েকবার আঘাত করে হাড়ের ক্ষতগুলো পরীক্ষার জন্য তার কাছে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ছাগলের পাঁজরগুলো আঘাতে এতোই বিধ্বস্ত হয়েছিল যে সেগুলো পরীক্ষার কোন উপায় ছিল না। তাই চার্চিল নিজেই নতুনভাবে পরীক্ষা করেন। পার্শ্ববর্তী কসাইখানা থেকে শূকরের বেশ কয়েকটি বক্ষপিঞ্জর জোগাড় করে সেগুলোর একেকটিতে একেক ধরণের অস্ত্র দিয়ে অনেকবার আঘাত করেন। আঘাতের সময় নিয়ানডার্থাল ও আধুনিক মানুষের নিক্ষেপণ পদ্ধতি পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়।
এরপর ছাত্রদের সাথে মিলে হাড়গুলোকে গরম পানি ও ডিটারজেন্ট দিয়ে পরিষ্কার করেন। এতেই চাঞ্চল্যকর ফলাফলটি বেরিয়ে আসে। শানিদার ৩ এর পাঁজরের ক্ষতের সাথে আধুনিক মানুষের অস্ত্রের ক্ষত বেশ ভালভাবেই মিলে যায়। গবেষণাপত্রে চার্চিল উল্লেখ করেছিলেন যে, অন্যান্য উপায়ে আঘাত প্রাপ্তির সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যায় না, কিন্তু তারপরও এই ক্ষতের সাথে আধুনিক মানুষের হাত থেকে নিক্ষিপ্ত হালকা বর্শার আঘাতের সামঞ্জস্য সবচেয়ে বেশি। বর্শা সাধারণত ৪৫ ডিগ্রি কোণে উপরের দিকে নিক্ষেপ করতে হয় যা সেকালের আদিম-আধুনিক মানুষেরা আয়ত্ত করেছিল। এ ধরণের বর্শা লক্ষ্যবস্তুতে ৪৫ ডিগ্রি কোণে বিঁধে। শানিদার ৩ এর উচ্চতা ছিল আনুমানিক ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। সে দাঁড়িয়ে থাকলে ৪৫ ডিগ্রি কোণে আসা বর্শার আঘাতেই এ ধরণের ক্ষত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। অন্য চারজন গবেষকের সাথে মিলে লেখা চার্চিলের “Shanidar 3 Neandertal rib puncture wound and paleolithic weaponry” নামক গবেষণাপত্রটি Journal of Human Evolution এ ২০০৯ সালের ২৫শে মে গৃহীত হয়েছে। এর অ্যাবস্ট্রাক্টে কি লেখা আছে তাই দেখি চলুন:
“দুর্ঘটনা, নিয়ানডার্থালদের ব্যবহৃত ভারী বর্শা বা ছুরি কোনটিকেই পুরোপুরি বাতিল করে দেয়া যায় না। তথাপি অবস্থান, কোণ এবং অঙ্গসংস্থান দেখে মনে হয় স্বল্প গতি শক্তিতে নিক্ষিপ্ত কোন হালকা বর্শার আঘাতেই ক্ষতটি হয়েছে। যেহেতু সে সময় পশ্চিম এশিয়াতে আদিম-আধুনিক মানুষের সাথে শানিদার ৩ এর যোগাযোগ ঘটেছিল এবং আদিম-আধুনিক মানুষেরা যেহেতু নিক্ষেপণযোগ্য বর্শা তৈরিতে সক্ষম ছিল বলে ধারণা করা হয় সেহেতু ফরেনসিক জীবাশ্মবিজ্ঞানের গণ্ডির বাইরেও এই ঘটনাটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।”
এই বিশেষ গুরুত্বটার দিকেই চার্চিলসহ অনেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এমন কি হতে পারে না যে, আফ্রিকা থেকে আসা দৈহিকভাবে আধুনিক তথা আদিম-আধুনিক মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠতে না পেরেই আনুমানিক ৩০,০০০ বছর পূর্বে নিয়ানডার্থালরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল? এমনও হতে পারে যে, আদিম-আধুনিক মানুষ ক্ষেত্রবিশেষে নিয়ানডার্থালদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধও করেছে, তাদের বিলুপ্তিতে সরাসরি ভূমিকা রেখেছে। তবে শুধু এই একটি কারণের দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া অনুচিত, সেটা বিজ্ঞানসম্মতও হবে না। নিয়ানডার্থালদের বিলুপ্তির কারণ বলার সময় আমরা এগুলো বিস্তারিত আলোচনা করব। আপাতত গল্পের বাকি তথ্যগুলো যাচাই করে নেয়া যাক।
আহত হওয়ার পর শানিদার ৩ নিরামিষ খেয়েছিল। হতে পারে, আগে থেকেই নিরামিষ ভোজনের সামান্য অভ্যাস ছিল তার, নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। তবে এটা নিশ্চিত যে, জীবনের কোন এক পর্যায়ে সে নিরামিষ ভোজনে বাধ্য হয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় শানিদার ৩ এর দাঁতের plaque এ পাওয়া অণুজীবের ফসিলে।
শানিদার ৩ এর কথা ফুরোল, আমাদের গল্পের প্রাগৈতিহাসিকতাও যাচাই করে নেয়া গেল। কিন্তু শানিদার গুহার অন্যান্য নিয়ানডার্থালদের বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। আদতে শানিদার ৩ এর চেয়ে কিন্তু শানিদার ১ এবং শানিদার ৪ এর গুরুত্ব অনেক দিক দিয়েই বেশি। যার ফসিল থেকে যত বেশি নতুন তথ্য পাওয়া যায় তার গুরুত্ব ততোই বেশি। আমাদের ফসিল বিষয়ক আলোচনা এই গুরুত্ব বিচার করেই এগোবে। আমাদের পূর্বপুরুষদের এতো বেশি ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে যে তার সবগুলো নিয়ে সংক্ষেপে লিখতে গেলেও ঢাউস সাইজের বিশ্বকোষ হয়ে যাবে। তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফসিলগুলো থেকে পাওয়া সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্যগুলোই কেবল তুলে ধরব। আগেই বলেছি, শানিদার গুহা থেকে মোট ১০ জন নিয়ানডার্থালের ফসিল উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে শানিদার ৩ নিয়ে আমরা বিস্তর কথা বলেছি, এরপর গুরুত্ব বিচারে আসবে শানিদার ১, শানিদার ৪ এবং শানিদার ১০ এর কথা। শুরু করা যাক তবে…
শানিদার ১ এর ফসিলটি দেখামাত্রই সোলেকি বুঝে গিয়েছিলেন, গুহার ভেতরে পাথর ধ্বসে তার মৃত্যু হয়েছে। সোলেকি তার বইয়ে এই মৃত্যুর ঘটনাটি খুব স্পষ্টভাবে চিত্রায়িত করেছেন। গুহার ছাদের সামনের দিকের একটি অংশ থেকে যখন পাথর ধ্বসে পড়ে তখন শানিদার ১ মেঝের একটু হেলানো অংশে দাঁড়িয়ে ছিল। পাথর ধ্বসটা বড় রকমের হলেও তার হাড়গোড় একেবারে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়নি, কারণ সে নরম মেঝেতে দাঁড়িয়ে ছিল। শক্ত পাথরের ওপর থাকলে সবগুলো হাড়ই একেবারে চূর্ণ হয়ে যেতো এবং সেক্ষেত্রে বর্তমানে জীবাশ্মবিজ্ঞানীদের গবেষণার জন্য একটি পাতলা ফসফেট স্তর ছাড়া আর কিছুই থাকতো না। তার হাড়গুলো স্থানে স্থানে ভাঙা ছিল, অনেক হাড়ের সাথে পাথর লেগে ছিল। আমরা ধারণা করতে পারি শানিদার গুহা তাকে আশ্রয় দিতে গিয়ে একটু বেশিই দিয়ে ফেলেছে, গুহার কোলে তার আশ্রয় জুটেছে ৫০,০০০ বছর, তারপর গিয়ে পড়েছে জাদুঘর আর গবেষণাগারে। তবে মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করার সময় সোলেকিরা শানিদার ১ এর ডান হাত সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানতে পারেনি। পরে টি ডেল স্টুয়ার্টের গবেষণায় দেখা গেছে তার ডান হাত কনুইয়ের নিচ থেকে কাটা এবং ধারণা করা হচ্ছে তার জীবদ্দশাতেই এটি কাটা হয়েছিল। হয়তো ছোটকাল থেকেই তার ডান হাতটি অক্ষম ছিল যার ফলে এক সময় তা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে।
শানিদার ১ নিয়ে পরে বিস্তর অনুসন্ধান চলেছে। খুলির হাড় থেকে জানা গেছে, খুব ছোট বয়সেই সে মাথায় বড় ধরণের আঘাত পেয়েছিল। এই আঘাতে তার বাম চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, হয়ত অন্ধও হয়ে গিয়েছিল, আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মস্তিষ্কের যে অংশ দেহের ডান পাশ নিয়ন্ত্রণ করে সে অংশটা। এ কারণেই তার ডান হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল, হয়ত ডান পাও অবশ ছিল। বলা যায় তার পুরো ডান পাশটাই প্যারালাইসিসে আক্রান্ত ছিল। কিন্তু লক্ষ্য করার মত ব্যাপার হচ্ছে, এ ধরণের কোন আঘাত বা অসুস্থতার কারণেই তার মৃত্যু হয়নি, মৃত্যু হয়েছে পাথরে চাপা পড়ে। এমনকি অনেকগুলো আঘাত এবং অসুস্থতাই তার জীবদ্দশায় সাড়তে শুরু করেছিল। বেঁচে ছিল প্রায় ৩৫-৪৫ বছর। অথচ একেবারে ছোটবেলায়ই প্যারালাইসিসের কবলে পড়েছিল। এ থেকে কি বোঝা যায়? বোঝা যায় আত্মীয়-স্বজনেরা তার সেবা শুশ্রুষা করেছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, নইলে এতোদিন তার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না। শানিদার ১ এভাবেই নিয়ানডার্থাল সমাজ সম্পর্কে আমাদের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়েছে। এতো কিছু যে জানালো তার একটা ডাক নাম না দিলে কি চলে? অনেকেই তাই শানিদার ১ কে ন্যান্ডি নামে ডাকতে শুরু করেছে।
[চলবে… শানিদার ৪ ও ১০ এর কথা পরে অন্য এক সময় হবে]
এই পর্বটা পড়ে মনে হল গোয়েন্দা কাহিনী পড়ছি। কোয়ান্টিটিতে না হলেও কোয়ালিটিতে বাংলার জনপ্রিয় বিজ্ঞান সাহিত্য ইংরেজিরটার কাছাকাছি চলে যাচ্ছে।
@পৃথিবী,
:yes: হ্যা তিনবার পড়লাম, একদম সাবলীল ভঙ্গীতে লেখা। নিঃসন্দেহে চমৎকার। ছবিগুলো যুক্ত করায় আরো ভালো লাগছে।
হুম ছবিটা আসলেই কার্যকরী। ধন্যবাদ সৈকতদা…
ধন্যবাদ। উৎসাহ পাচ্ছি সবার কাছ থেকে।
তোর লেখার স্পিড কমে গেছে।
কাজটা ঠিকনা।
লাস্ট দুইটা লেখা যা নিশ্চিত স্পিড কমলেও মান যে বাড়ছে সেইটা বুঝাই যাইতেছে। সুতরাং একটু মন দিলে তুই যে দুইমাসেই কোপাই দিতে পারিস এইটুকু বিশ্বাস আছে [স্পিড প্লাস কোয়ালিট]।
সুতরাং দয়া করে লিখাটা শেষ কর। না দিলে বন্যাপা, এখন যতই ভালো ভালো কথা বলুক, তখন কিন্তু একেবারে ছারখার করে দিবে 😀
তোর কথায় উৎসাহ পাইলাম। তিন মাসে হবে আশাকরি…
আমিও এক নিঃশ্বাসেই শেষ করলাম। ফরেন্সিক ইনভেষ্টিগেশন প্রিয় বিষয় বলেই মনে হয়, সাথে দারুন বর্ননা।
একতু বেকুবের মত প্রশ্ন করি; নিয়ানডার্থাল আর আধুনিক মানুষেরা একই সময়ে ছিল? মানে নিয়ানডার্থালেরা বিবর্তিত হয়ে আধুনিক মানুষ হয়নি? নাকি প্রজাতির হিসেবে এদের একই ধরা হয়?
না, নিয়ানডার্থালরা বিবর্তিত হয়ে আধুনিক মানুষ হয়নি। এরা দুইটা আলাদা প্রজাতি, এদের সাধারণ পূর্বপুরুষ আছে। এরা থাকতো ইউরোপে। আধুনিক মানুষেরা যখন আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আসে তখন তাদের সাথে প্রায় ২০-৩০ হাজার বছর নিয়ানডার্থালরা সহাবস্থান করেছে, মারামারি করেছে।
@শিক্ষানবিস, সম্প্রতি পড়লাম নিয়ানডারথালরা মানুষের সাথে ইন্টারব্রিড করেছে। এ নিয়েও কিছু লেখা চাই, বাংলায় লেখা হয়নি তেমন একটা এ নিয়ে।
দারুণ। তবে আগের পর্বে যে গল্পের কাঠামো ছিলো, ওটাই ভালো লাগছিলো। এটাও দুর্দান্ত মচৎকার।
শুভেচ্ছা।
বাইরে পড়তে যাওয়ার সময় কখন হচ্ছে?
@ বন্যা আহমেদ:
একজন ক্রেতা নিশ্চিত করলাম। 😉
পুরোটা আসলে গল্পের কাঠামোতে লেখা সম্ভব না। ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগল।
সময় হচ্ছে সেপ্টেম্বরে 🙂
@ব্লাডি সিভিলিয়ান, ভালো কথা বলেছেন, কিন্তু একটা প্রশ্ন করি আপনাকে। মানব বিবর্তনের মত বিষয়ের উপর লেখা বিজ্ঞানের একটা বইএর সবটাই যদি গল্পের মত স্টাইলে লেখা হয় তাহলে কি তার ক্রেডিবিলিটি থাকবে? বিষয়টা বেশ জটিল এবংবাংলায় শুধু মানব বিবর্তনের উপর একেবারে আধুনিক গবেষণার উপর ভিত্তি করে লেখা তেমন কোন বই নেই বললেই চলে। বইটা বিজ্ঞানের সাহিত্য হিসেবে লেখা হলেও মূল লক্ষ্য কিন্তু বৈজ্ঞানিক তথ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরা। তাই আমরা বিভিন্ন অধ্যায়ের শুরুতে বা মাঝে কিছুটা হাল্কা করার জন্য মজার কিছু গল্প বা কথোপকথন টাইপের কথাবার্তা রাখলেও বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপরই জোর দেওয়ার চেষ্টা করছি। এই ধরণের আলোচনাগুলো করার জন্যই আসলে আমি এবং শিক্ষানবিস লেখাগুলো মুক্তমনা ব্লগে দিচ্ছি। আপনি যেহেতু প্রথম ক্রেতাদের মধ্যে একজন তাই এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছি 🙂 । ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
শিক্ষানবিস, তোমার এত বড় লেখাটা পড়তে শুরু করতে না করতেই মনে হলো শেষ হয়ে গেল। এর কৃতিত্বটা পুরোটাই লেখকের, পাঠকের নয়। ফসিলের মত এত খটমটা একটা বিষয় নিয়ে এত চমৎকারভাবে লিখতে পারাটা আসলেই খুব কষ্টকর। এভাবে আগাতে থাকলে মানব বিবর্তনের বইটা এ বছরে নিশ্চিতভাবে বের করে ফেলা যাবে।
দু’একটা জায়গায় সামান্য কিছু ‘সাজেশন’ দেই, এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, তবে ভেবে দেখতে পারোঃ
পারিসাংখ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কি দেখা যেতো সে সম্পর্কে আরেকটু বললে ভালো হতো মনে হয়।
‘দৈহিকভাবে’ … এ কথাটা কি টাইপো?
আচ্ছা, এই খুলির হাড় থেকে যে আঘাতের কথা বলা হয়েছে সেটা কি মরে যাওয়ার পর কঙ্কালের উপর কোন আঘাতও হতে পারে না? বিজ্ঞানীয়া কিভাবে বোঝেন যে, এই আঘাতটা তার জীব্দদশায়ই ঘটেছিল? আর এই নিয়ান্ডারথালরা যে অসুস্থদের সেবা করতো এটা কি শুধু এই উদাহরণ থেকেই জানা গেছে নাকি আরও এমন ফসিলের উদাহরণ পাওয়া গেছে। আমি বেশ অনেক জায়গায়ই এ প্রসঙ্গে পড়েছি।
আরেকটা কথা, তুমি কি নিয়ান্ডারথাল প্রজাতির উদ্ভব এবং আফ্রিকা থেকে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া নিয়ে আলোচনা করবে আগামী কোন অধ্যায়ে? তুমি যেহেতু আ্যন্সেষ্টরস টেল এর আদলে সামনে থেকে পিছনে যাচ্ছো ( ভূতত্ত্বের ভেল্কির মতই) সেই হিসেবে তো বিলুপ্তির পরে এদের উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা আসার কথা। আমি আসলে জানতে চাচ্ছিলাম তোমার ‘আউট অফ আফ্রিকা ২’ নিয়ে আলোচনা করার কোন প্ল্যান আছে কিনা।
আরেকটা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলি, হিউম্যান নেচারস বলে যে বইটার কথা বলেছিলাম সেটাতে নিয়ান্ডারথালদের নিয়ে একটা ছোট্ট অংশ আছে। সেখানে একটা মজার তুলনা করেছেন লেখক। আজকের আধুনিক homo sapiens দের মধ্যে উত্তর মেরুতে বসবাসকারী ইনুয়িট সম্প্রদায়ের মস্তিষ্কের আকার সবচেয়ে বড়। অত্যন্ত ঠান্ডা জলবায়ুতে বাসবাসকারীদের মধ্যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিপাকক্রিয়ার জন্য নাকি বড় মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয়। অনেকে ধারণা করেন যে, একইভাবে নিয়ান্ডারথালরা ইউরোপ মহাদেশের ঠান্ডা আবহাওয়াতে অভিযোজিত হয়েছিল বলেই তাদের মস্তিষ্ক আমাদের প্রজাতির চেয়ে বড় ছিল।
আমি তো খুব ভয়ে ছিলাম, সুপাঠ্য হবে কিনা এটা নিয়ে। আপনের কমেন্ট পড়ে আশ্বস্ত হইছি।
পরিসাংখ্যিক দৃষ্টিকোণটা সংক্ষেপে কিভাবে লেখা সম্ভব তাই বুচ্ছিলাম না। এটা নিয়া আপনের সাথে কথা বলতে হবে আরো।
anatomically modern human এর বাংলা করছি দৈহিকভাবে আধুনিক মানুষ- বেখাপ্পা লাগতেছে?
হ্যা, মরার আগে নাকি পরে সেটা নিয়ে এরিক ট্রিনকাউসের hard time among the neanderthals লেখায় কিছুটা আছে। মরার আগে হলে আঘাতটা সেড়ে ওঠার চিহ্ন থাকবে আর পরে হলে সেড়ে ওঠার কোন চিহ্ন থাকবে না। এটা দিয়েই সম্ভবত বুঝে। তবে ব্যাপারটা অনেক কঠিন, অনেক সময়ই নিশ্চিত হওয়া যায় না। আরো পরে লেখায় অ্যাড করলে ভাল হবে।
হ্যা প্রথমে নিয়ানডার্থালদের বিলুপ্তি এবং পরে উদ্ভব নিয়ে আলোচনা থাকবে। আচ্ছা উৎপত্তির আগে বিলুপ্তি লেখাটা কি বেখাপ্পা হই যাবে? অতীতের দিকে যাচ্ছি বলে যে সবই অতীতের দিকে হতে হবে এমন কিন্তু না। এক প্রজাতি থেকে তার চেয়ে প্রাচীনতর প্রজাতিতে যাওয়া যায়, কিন্তু একই প্রজাতির মধ্যে উৎপত্তি আর বিলুপ্তির ক্ষেত্রেও এটা মানতে হবে এমন কিন্তু না? তবে আগে দেই আর পরে দেই বিলুপ্তিটাই আমি আগে লিখতেছি।
ইনুইট দের এটা থাকতেই হবে। এ নিয়ে আপনাকে মেইল করছি একটা দেইখেন।
@শিক্ষানবিস,
এটার বাংলা ‘শরীরতত্ত্বীয়ভাবে আধুনিক মানব’-কেমন হয়?
কেমন জানি ভারিক্কি লাগে। তাও ভেবে দেখছি আরও…
চমৎকার লাগলো শিক্ষানবিস। অনেক দিন পর একটা ভাল লেখা পড়ার সুযোগ হলো। এ লেখাগুলো থেকে সবসময়ই শিক্ষনীয় কিছু থাকে।
চার্চিলের গবেষণার ফলাফল সত্য হলে তাহলে আমরা আধুনিক মানুষেরাই আসলে নিয়ান্ডার্থালদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবার প্রকৃত কারণ। আমাদের হাতেই আসলে লেগে আছে আমাদের পূর্বসূরীদের হত্যার রক্তিম দাগ! আমি তো আরেকটা গবেষণায় পড়ে ছিলাম কিছু কিছু জায়গায় নাকি এমন আলামতও পাওয়া গেছে যে, যুদ্ধের পরে আধুনিক মানুষেরা কেটে কুটে নিয়ান্ডার্থালদের ভক্ষণ করতো। সেটা নিয়ে একটু লিখবে নাকি পরে?
ধন্যবাদ অভিজিৎদা।
এই ক্যানিবালিজম নিয়ে লিখতে হবে। ইচ্ছা আছে…
ভাল লাগল!
আচ্ছা নৃবিজ্ঞানীরা শানিদারদের সামাজিক জীবন সম্বন্ধে কিছু বলতে পারেন কি?
তারা যে বৃদ্ধদের সেবা করতো এবং ফুল লাতা-পাতা দিয়ে মৃতদের সমাধিস্থ করতো এটা শানিদারদের থেকে জানা গেছে। এছাড়া অস্ত্র কেমন ছিল সেটাও জানা গেছে, খাদ্যাভ্যাসও জানা গেছে। সমাধিস্থ করার বিষয়টা শানিদার ৪ এর বর্ণনা দেয়ার সময় আসবে। পরে ইচ্ছা আছে…
এক নি:শ্বাসে পড়ে নিলাম। আর পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
দারুন প্রানবন্ত বর্ননা , মনে হচ্ছিল কোন উপন্যাসের কাহিনী পড়ছি। সাবাস, চালিয়ে যান ভাই, আপনার হবে – আমি নিশ্চিত।