প্রথম পর্ব এখানে পড়ুন

ঠিক একই রকমের গোলকধাঁধায় পড়ে যাই যখন বিচার করতে যাই কোনটা পাপ আর কোনটা নয়। যখন পশুক্লেশ নিবারণী সমিতি পোপের কাছে সাহায্যের আবেদন জানায়, তিনি এই মর্মে তা প্রত্যাখ্যান করেন যে ইতর প্রাণীদের প্রতি মানবজাতির কোন দায়িত্ব নেই, আর পশুদের সাথে দুর্ব্যবহার করাও পাপ নয়। এর কারণ হলো জানোয়ারের কোন আত্মা থাকে না। অন্যদিকে, তোমার প্রয়াত স্ত্রীর বোনকে বিয়ে-করা পাপ-অন্তত চার্চ তো তাই শিক্ষা দেয়-সে তোমার আর তার যতোই বিয়ের আকাঙ্ক্ষা থাকুক না কেন। এর কারণ এই নয় যে এ-ঘটনার ফলাফল দুঃখময় হবে, বরং এর কারণ হচ্ছে বাইবেলের কিছু লাইন।

দেহের পুনরুত্থান, এ্যাপোসলের ক্রিডের একটা অনুচ্ছেদ, এমন এক মতবাদ যার নানান রকম কৌতূহলজাগানিয়া ফলাফল আছে। খুব বেশি দিন আগের কথা না, এমন এক লেখক ছিলেন যিনি দুনিয়ার শেষদিন গুনে বের করার এক অনন্যমেধাবী উপায় উদ্ভাবন করেন। তাঁর যুক্তি ছিলো এরকম, শেষ দিনটা আসার আগে অব্দি প্রতিটা মানবদেহের পুনরুত্থানের জন্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ উপাদানের একটা নির্দিষ্ট অবশেষ থাকতেই হবে। খুব সতর্কতার সাথে দরকারি কাঁচামালের হিসেবটা কষে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে কোন একটা নির্দিষ্ট তারিখের পর ওসব উপাদানগুলো নিশ্চিতভাবে আর টিকে থাকবে না। সেদিনটা যখন আসবে, দুনিয়া ধ্বংস হবেই হবে, নইলে দেহের পুনরুত্থান অসম্ভব হয়ে পড়বে। দুর্ভাগ্য এমন, তারিখটাই ভুলে গেছি, কিন্তু এটা নিশ্চিত, খুব বেশি দূরের কথা না।

ক্যাথলিক চার্চের ঘোষিত দার্শনিক সেন্ট টমাস এ্যাকুইনাস একটা সমস্যা নিয়ে বিশদে এবং গভীরে আলোচনা করেছেন যেটা আমার আশঙ্কা, আধুনিক ধর্মতত্ত্ববিদেরা অন্যায়ভাবে উপেক্ষা করে গেছেন। তিনি এমন এক নরখাদকের কল্পনা করেন যে নরমাংস ছাড়া আর কিছুই খায় নি কখনো আর তার মা-বাবারও ছিলো একই প্রবণতা। তার শরীরের প্রতিটি কণাই যুক্তিসঙ্গতভাবে অন্যের। আমরা নিশ্চয় মেনে নেবো না যে যারা তার ভক্ষ্যে পরিণত হয়েছিলো তারা শরীরের কোন অংশ হারিয়ে যাত্রা করবে অনন্তে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সেই নরমাংসাদটির কী হচ্ছে? তার পুরো শরীরটাই যদি মূল অধিকারীদের দেহে ফেরৎ যায় তবে তাকে নরকে ঠিকভাবে পুড়িয়ে সেদ্ধই বা করা হবে কিভাবে? ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো আছে, সেন্ট বুঝেছিলেন ঠিকই।

এপ্রসঙ্গে অর্থোডক্সপন্থীদের শবদাহ নিয়ে একটা অদ্ভুত রকমের আপত্তি আছে, যাতে ঈশ্বরের সর্বশক্তিমানত্বের ব্যাপারে একটা অপ্রতুল চেতনা চোখে পড়ে। চিন্তাটা এই যে, কোন দেহ যখন পোড়ানো হয় তখন সেটা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে ঈশ্বরের যে-পরিমাণ ঝামেলা পোহাতে হয়, তার চেয়ে অনেক কম ঝামেলায় তিনি কবর-দেওয়া আর পোকায়-খাওয়া একটা লাশ ফের জিন্দা করে তুলতে পারেন। সন্দেহ নাই যে বাতাস থেকে কণাগুলো আবার জড়ো-করা আর দহনের রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোর চাকা উল্টোদিকে ঘোরানোর কাজটা বেশ ঝামেলাযুক্ত বটে, কিন্তু মহাশক্তিধরের এরকম কাজে অসমর্থ হওয়ার চিন্তা করাটাই তো রীতিমত ঈশ্বরদ্রোহিতা। শেষমেষ বলতে চাই যে দাহকার্যের বিরোধিতা করাটাই ঘোরতর ধর্মদ্রোহিতা। কিন্তু মনে হয় না অর্থোডক্সপন্থীরা আমার মতামতের কোন গুরুত্ব দেবে।

চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রয়োজনে শবব্যবচ্ছেদের অনুমোদন চার্চ দেয় নিতান্ত ধীরগতিতে এবং যথেষ্ট অনিচ্ছার সাথে। এই ব্যবচ্ছেদের পুরোধা ছিলেন ভ্যাসালিয়াস, সম্রাট পঞ্চম চার্লসের রাজবৈদ্য। তাঁর চিকিৎসায় দক্ষতার কারণে সম্রাট ছিলেন তাঁর সহায়। কিন্তু, সম্রাটের মৃত্যুর পরে বিষম গোলে পড়ে যান তিনি। অভিযোগ আনা হয় তাঁর ব্যবচ্ছেদকৃত এক শবে প্রাণের লক্ষণ পাওয়া গেছে এবং তাঁকে অভিযুক্ত করা হয় নরহত্যার দায়ে। রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের পৌরহিত্যে পরিচালিত ইনকুইজিশন অবশ্য তাঁর ব্যাপারে নমনীয়তা দেখায় এবং তাঁর শাস্তি নির্ধারিত হয় পবিত্র ভূমিতে তীর্থযাত্রা। ফেরার পথে তাঁর জাহাজডুবি হয় এবং ক্লান্তিতে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। এরপর কয়েক শতাব্দী ধরে রোমের পোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা শুধু মৃতদেহের ওপর সামান্য কাটাছেঁড়ার সুযোগ পেতো, তা-ও ওগুলোর জননাঙ্গ সরিয়ে ফেলা হতো আগেভাগেই।

মৃতদেহের পবিত্রতা একটা বহুলপ্রচলিত ধারণা। এর বাহক মিশরীয়েরা, ফলাফল মমিকরণ। চিনে এখনো পুরোদমে এই ধারা বহমান। চিনেরা এক ফরাসি সার্জনকে পাশ্চাত্য চিকিৎসা শেখানোর কাজে নিয়োগ দেয়। কাটাছেঁড়া করার জন্যে তাঁর লাশের দাবিতে তারা আঁৎকে ওঠে। অবশ্য তাঁকে আশ্বাস দেওয়া হয় যে জীবন্ত অপরাধী তিনি প্রচুর পাবেন। এই বিকল্পের প্রতি তাঁর অনাস্থা তাঁর চৈনিক নিয়োগকর্তাদের বোধগম্য হয় নি।

যদিও পাপ আছে নানান কিসিমের, সাতটা তার মধ্যে মারাত্মক। শয়তানের ওয়াসঅসার সবচাইতে সাফল্যের ক্ষেত্র হচ্ছে যৌনতা। এসংক্রান্ত গোঁড়া ক্যাথলিক নীতিমালা খুঁজে পাওয়া যাবে সেন্ট পল, সেন্ট অগাস্টিন আর সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাস-এ। ব্রহ্মচর্যই শ্রেষ্ঠ, কিন্তু আত্মশমদদমের ক্ষমতা না থাকলে বিয়ে চলতে পারে। বিবাহোত্তর যৌনতা পাপ নয়, তবে শর্ত হচ্ছে এর মূলে থাকতে হবে সন্তানকামনা। বিবাহবহির্ভূত সব যৌনতাই পাপ এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা নিলে দম্পতির জন্যেও সেটা পাপ। গর্ভনিরোধও পাপ এমনকি যদি চিকিৎসাশাস্ত্র বলেও যে এটাই মা-কে বাঁচানোর একমাত্র পথ। কারণ, চিকিৎসাশাস্ত্রেও ভুল হতে পারে আর ঈশ্বরের করুণা হলে অলৌকিক ক্ষমতায়, দরকার হলে, যেকোন প্রাণ বেঁচে যেতে পারে (কানেকটিকাটের আইনে এই ধারণাই গৃহীত)। যৌনরোগ হচ্ছে পাপের কারণে ঈশ্বরের প্রদত্ত শাস্তি। এটা সত্যি যে দোষী স্বামীর দেহ থেকে এই রোগ নিরীহ নিষ্পাপ স্ত্রী এবং তাদের সন্তানে সংক্রমিত হতে পারে, কিন্তু এটা ঈশ্বরের বিধানের এক রহস্যময় লীলা যেটা নিয়ে প্রশ্ন করাও অধর্ম। কলম্বাসের আগ পর্যন্ত এই যৌনরোগের উদ্ভাবনটা কই ছিলো এই প্রশ্ন করাটাও ঠিক না। যেহেতু এটা পাপের জন্যে প্রদত্ত শাস্তি, এটা এড়ানোর সব পদ্ধতিও পাপ-অবশ্য ধর্মময় জীবনযাপন এর মধ্যে পড়বে না। বিবাহ মৌলিকভাবেই অবিচ্ছেদ্য, অবশ্য অনেক বিবাহিত লোকজন দেখা যায় যারা ঠিক তা নয়। প্রভাবশালী ক্যাথলিকদের বেলায় বিচ্ছেদের কোন কারণ পাওয়া গেলেও যেতে পারে, কিন্তু গরীবদের বেলায় সম্ভবত নপুংসকত্ব বাদে পালানোর আর কোন পথ নেই। যারা বিচ্ছেদ করে আবার বিয়ে করে তারা ঈশ্বরের চোখে ব্যভিচারের অপরাধী।

‘ঈশ্বরের দৃষ্টিতে’ বাগভঙ্গিটা আমায় বেশ ধন্দে ফেলে দেয়। লোকেরা ধরে নেয় যে ঈশ্বর সবকিছু দেখতে পান। তিনি রেনো দেখতে পান না, কারণ ঈশ্বরের দৃষ্টিতে আপনি ডিভোর্সড হতে পারেন না। রেজিস্টার অফিসগুলো অবশ্য সন্দেহের জন্ম দেয়। আমি খেয়াল করেছি যে শ্রদ্ধেয় লোকেরা, যাঁরা খোলাখুলি পাপ করে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন না, কিন্তু যারা সিভিল ম্যারেজ করে তাদের সাথে সাক্ষাতে তাঁদের আপত্তি নেই; তাহলে দেখা যাচ্ছে ঈশ্বর রেজিস্টার অফিসগুলো দেখতে পান।

কিছু বিখ্যাত লোক অবশ্য এটাও মনে করেন যে, যৌনতাসংক্রান্ত ব্যাপারে ক্যাথলিক চার্চ নিন্দনীয়ভাবে ছাড় দেয়। বুড়ো বয়েসে তলস্তোয় আর গান্ধী দুজনেরই এই ধারণা হয়েছিলো যে সব ধরনের যৌন মিলনই দোষাবহ, এমনকি যদি সেটা বিয়ের পরে এবং সন্তানের জন্যেও যদি হয়। ম্যানিকিয়ানেরাও একই রকম ভাবেন, মানুষের আদি পাপের কারণে তাঁদের নতুন শিষ্যের সংখ্যা বেড়েই চলে। এই মত অবশ্য ঈশ্বরদোহিতার সামিল, যদিও বিয়ে ব্রহ্মচর্যের মতোই প্রশংসার্হ, এই মতও একইরকমের ঈশ্বরদ্রোহিতা। তলস্তোয় তামাককে যৌনতার মতোই খারাপ ভাবেন। তাঁর একটা উপন্যাসের এক চরিত্র খুন করার চিন্তা করতে গিয়ে আগে একটা সিগারেট ধরায় যাতে নরহত্যার প্রবৃত্তিটা তার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অবশ্য ধর্মগ্রন্থে তামাক নিষিদ্ধ নয়, যদিও স্যামুয়েল বাটলার ঠিকই বলেছেন যে, জানলে সেন্ট পল এটাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিতেন।

অদ্ভুত ব্যাপার যে চার্চ কিংবা আধুনিক জনমত কোনটাই প্রকাশ্যে চুমু-খাওয়ার নিন্দে করে না, অবশ্য যদি এটা নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে থাকে। ঠিক কোন জায়গা থেকে পাপটা শুরু হয় তা নিয়ে অবশ্য কারণবাদীরা নানা ভাগে বিভক্ত। এক বিখ্যাত অর্থোডক্স ক্যাথলিক মত দিয়েছেন যে একজন পাপস্বীকারকারী (confessor) খারাপ নিয়ত নিয়ে কোন নানের স্তনে হাত বোলাতে পারে। কিন্তু আমার ঠিক মনে হয় না আজকাল ধর্মকর্তারা তাঁর সাথে একমত হবেন।

আধুনিক নীতিবোধ দুটো উপাদানের মিশ্রণে তৈরি: এক দিকে, সবাই মিলেমিশে শান্তিতে একটা সমাজে বাস করার বিবেচনাপ্রসূত ধারণা, অন্য দিকে মূলত আদিম কুসংস্কার, কিন্তু বাহ্যত খ্রিস্টীয়, মুসলিম, হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ পবিত্র গ্রন্থ থেকে পাওয়া চিরাচরিত মানা না-মানার ব্যাপার। কিছু কিছু জায়গায় দুটো মিলে যায়, যেমন: খুন বা চুরির ব্যাপারে নিষেধ, এটা মানববিবেক আর ঐশী নির্দেশ দুটোর মধ্যেই পাওয়া যায়। কিন্তু গরু বা শুয়োর খাওয়ার নিষেধাজ্ঞা শুধু শাস্ত্রনির্দেশ, তা-ও নির্দিষ্ট কিছু ধর্মে। ভাবতে অবাক লাগে যে আধুনিক লোক, যারা জানে যে নতুন জ্ঞান তৈরিতে আর সামাজিক জীবনের অবস্থা পরিবর্তনে বিজ্ঞান কী ভূমিকা রেখেছে, সেই তারা এখনও অতীব পুরনো এবং অত্যন্ত অজ্ঞ পশুচারণ বা কৃষিজ গোত্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে-ভরা শাস্ত্রের অনুশাসন মেনে নিতে অসম্ভব আগ্রহী। দেখে হতাশ হতে হয় যে এরকম অনেক ব্যবহারবিধি যেগুলোর পবিত্র চরিত্র এরকম প্রশ্নহীনভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়, সেগুলো পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয় কিছু দুর্ভোগ তৈরি করে। যদি মানুষের সদয় অনুভূতি আরো বাড়তো, তারা এসব শাস্ত্রবাণী আক্ষরিক অর্থে না নেওয়ার কোন উপায় খুঁজে পেতো, যেমন পেয়েছে এটার ক্ষেত্রে, “বিক্রি করে দাও তোমার যা কিছু আছে, আর দান করো দরিদ্রদের।”

(ক্রমশ)