শিরোনাম দেখে বিভ্রান্ত হবেন না যেন! স্বগতোক্তি বলে নির্ধারিত করলেও, প্রত্যুক্তির আশা নিয়েই যে নারীবাদের মতো বিতর্কমূলক একটা বিষয় নিয়ে জনসাধারণ্যে ব্লগ লিখছি, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন? অতএব, ধৈর্য্য ধরে শেষ পর্য্যন্ত যদি পড়েই ফেলেন, আপনার দ্বিমত/ভিন্নমত/অন্যমত নির্দ্বিধায় জানিয়ে যাবেন – আমার ‘বহুমত’এর ঝুড়িটিতে সেটিকে সানন্দে পুরে দেবো।

শুরুটা হয়েছিলো একার পোস্ট থেকে। তারপর আসলো আরেকটি পোস্ট, আকাশ মালিকের। একার পোস্টে মূলত পুরুষকে নারীর প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও একা বলছেন – নারীর শত্রু শুধু পুরুষ নয়, নারীর শত্রু এমনকি নারীও হতে পারেন বা হন, কিন্তু একথাটার মধ্যে যে বিশ্বাস বা সিদ্ধান্তটা খুব জোরালোভাবে উপস্থিত সেটা হলো – নারীর শত্রু হিসেবে প্রাথমিকভাবে পুরুষকে ধরা হলেও, তারাই একমাত্র নন। অথবা, অন্যভাবে বলতে গেলে – নারীর শত্রু কিন্তু নারীও হয়, যদিও এতদিন আমরা শুধু পুরুষকেই দায়ী করে এসেছি। এই পোস্টটিতে নানারকম মন্তব্য টন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আকাশ মালিক তাঁর অভিমত ব্যক্ত করলেন এই বলে যে, আমরা নারীর প্রকৃত শত্রুকে সনাক্ত করতে পারছি না – সেটি বা সেগুলো হচ্ছে অর্থ এবং ক্ষমতা, এবং আরো একটু বিস্তারিত করলে শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে সমানাধিকারের অভাব।

এবং, ঠিক এ জায়গাটাতে এসেই আমি বুঝতে পারলাম, এবার আমাকে কিছু একটা লিখতেই হবে। আর কোন কারণে নয়, অন্য কাউকে আমার যুক্তি দিয়ে প্রভাবিত করতেও নয়, বরং আমার নিজের চিন্তাক্ষেত্রেই যে নারীবাদ ব্যাপারটাই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, সেটা একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই আমাকে আমার এখনকার ধারণাগুলোকে নথিবদ্ধ করে ফেলতে হবে। যুক্তি ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একথাটা যে কি ভীষণভাবে সত্যি, তা যাঁরা এসব বিষয়ের বিভিন্ন শাখায় গবেষণা করেন তাঁরা আরও মর্মান্তিকভাবে টের পান। নারীবাদ সম্বন্ধে আমার যা বিশ্বাস, যা সিদ্ধান্ত বা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী হয়েছে, তা ‘আমার’ যুক্তির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। এবং, সেসব যুক্তি কোনভাবেই পরম বা চূড়ান্ত নয়, বরং একটা চলমান প্রক্রিয়ার অংশ, যে প্রক্রিয়ায় আমার আগেকার অনেক যুক্তি বাতিল হয়ে এখনকার অনেকগুলোকে জায়গা করে দিয়েছে। ভবিষ্যতেও দেবে বলে মনে করি। অতএব, এই পোস্ট।

একার পোস্টে আমি পুরুষ নয় বরং ‘পুরুষতন্ত্র’কে নারীর প্রধান প্রতিপক্ষ বলে উল্লেখ করেছিলাম। আকাশ মালিকের মতে – অর্থ এবং ক্ষমতা (বা তার অভাব) হলো আসল অপরাধী। ওদিকে, একা তাঁর একাধিক মন্তব্যে বলেছেন – অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসলেই যে বিরাট কোন নারীমুক্তি ঘটে যাবে এমনটি আশা করার কোন কারণ নেই, বরং ধর্মকে উৎপাটিত করতে পারলেই মোটামুটি অর্ধেক কম্ম সাবাড়। অনেকের মন্তব্যে দেখলাম সমাজে সুশিক্ষার হার বাড়লে এসব সামাজিক বৈষম্য এমনিতেই লোপ পাবে বলে ধারণা। অভি তার মন্তব্যে নারী পুরুষের জেনেটিক বৈষম্যকে যে সমাজবিজ্ঞানের ধুঁয়ো তুলে ব্যাখ্যা (বা অস্বীকার) করা যাবে না সেটা বলেছে। মোট কথা – ধর্ম, অর্থনীতি, বিবর্তন, শিক্ষাব্যবস্থা, নারীদের জন্য কোটা-নীতি, পূঁজিবাদ ইত্যাদি অনেকগুলো বিষয় আলোচনায় এসেছে।

প্রথমেই বলে রাখি – নারীর ‘নারী’ত্ব নিয়ে আমার কোন সন্দেহও নেই, আপত্তিও নেই। নারী এবং পুরুষ শারীরিকভাবে এবং কিছুক্ষেত্রে চরিত্রগতভাবে আলাদা। ঠিক যেমন জাতি বা বর্ণের ওপর ভিত্তি করে আলাদা করলে দেখা যাবে পুরুষদের মধ্যেও শারীরিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য রয়েছে। তো? তার মানে তো এই নয় যে, সেই পার্থক্যকে ন্যায্যতা হিসেবে দাঁড় করিয়ে বৈষম্যকে যৌক্তিকতা দিতে হবে! সমাজে ধর্ম, অর্থনীতি কি বিজ্ঞান এসব যখন প্রসারিত হচ্ছিলো, নারীদের যে সেসব নীতি নির্ধারণ বা জ্ঞানচর্চার প্রক্রিয়ায় কোন প্রবেশাধিকারই ছিল না, সেটা তো আমার চাইতে যে কোন ইতিহাস-জ্ঞানী ব্যক্তি আরও ভালোভাবেই বলতে পারবেন। ধর্মের উৎপত্তি যদি পুরুষেরই কারণে হয়ে থাকে, অর্থনীতি বা শিক্ষানীতি বা যে কোন নীতি যদি পুরুষদ্বারাই প্রণীত হয়ে থাকে – তাহলে এটাই কি স্বাভাবিক নয় যে এগুলো পুরুষের স্বার্থরক্ষা করতেই সাহায্য করবে? অর্থ এবং ক্ষমতা বহুক্ষেত্রেই আলাদা উৎস থেকে আগত হলেও, এর একটি যে অপরটির আগমনে সহায়তা করে, সে কথাটাও তো নতুন নয়। যদি বা ধরেও নেই যে, অর্থ থাকলেও ক্ষমতা থাকে না বহু নারীর, তাহলে আমার প্রশ্ন হবে – কেন অর্থ থাকলেও ক্ষমতা থাকে না বহু নারীর? এখানে সামাজিক নিয়মের কথা বলবেন তো? আমিও তো তাইই বলছি এতোক্ষণ ধরে!

এই যে ‘সামাজিক নিয়ম’, যে বিশাল umbrella termটি আসলে অনেকগুলো নিয়ামকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তার মধ্যে ধর্ম থেকে শুরু করে, শিক্ষানীতি, অর্থনীতি (পূঁজিবাদ তো অবশ্যই), কর্মনীতি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি নীতি পার হয়ে একেবারে এমনকি নারীর কোট খুলে নিয়ে পুরুষের শিষ্টাচার প্রদর্শনের যে চল, এ সবকিছুই পড়ে এবং এ সবকিছুই কিন্তু প্রকারান্তরে পুরুষ’তন্ত্র’কে নির্দেশিত করে। পুরুষতন্ত্র তো একটি গালি নয়, সর্বরোগহর ঔষধের মতো যে কোন সমস্যাতেই অভিযোগ করার জন্য নারীবাদের একটি বুলি নয়, এটি একটি কাঠামো। চিন্তার ক্ষেত্রেও, প্রয়োগের ক্ষেত্রেও। অর্থ কিংবা ক্ষমতা, কীভাবে পাওয়া সম্ভব যদি এই কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ না করা হয়? ধর্ম কিংবা সুশিক্ষা/সচেতনতার অভাব, কেনই বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে না, যদি এই কাঠামোটিকে বজায় রাখার ইচ্ছে পোষণ করা হয়?

নারীবাদে এখন women এর বদলে gender এর ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ যে করা হয় তার কারণ শুধুমাত্র ‘নারী’ এবং ‘পুরুষ’ ছাড়াও অন্যান্য লৈঙ্গিক পরিচয়কে স্বীকৃতি দেয়াই নয়, gender relations এখন অত্যন্ত আলোচিত এবং দরকারি একটি বিষয়। নারী আর পুরুষকে প্রতিদ্বন্দী হিসেবে দাঁড় করানোর চাইতে নারী এবং পুরুষের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক পার্থক্যকে স্বীকার করে নিয়ে, নারী এবং পুরুষের মিথষ্ক্রিয়ার ধরন এবং উৎস বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়। ঠিক যে কারণে শুধু লৈঙ্গিক পরিচয়কেই শেষ কথা হিসেবে ধরে নেয়া হয় না, আর্থ-সামাজিক শ্রেণী বা classও এখানে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গূণণীয়ক। যে নারী তার একই শ্রেণীর পুরুষের চাইতে ক্ষমতার স্পেকট্রামে নিচে অবস্থান করে, সে-ই তার চাইতে নিম্ন আর্থ-সামাজিক শ্রেণীর একজন পুরুষের চাইতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে, যে কোন সময়ে।

এই পোস্ট পড়ে যদি আপনার আমাকে প্রশ্ন করবার ইচ্ছে হয়, পুরুষের বদলে নাহয় পুরুষতন্ত্রকেই দোষারোপ করা হলো, এবার তাহলে সমাধানটা ঠিক কী হবে? আমার উত্তর হবে – ‘সমাধান’ বলতে যা বোঝায় তা আমার জানা নেই। আমি মনে করি এটা একটা প্রসেস, একটা চলমান প্রক্রিয়া। অনেক কিছু বদলেছে, আরও বদলাবে, চেষ্টাটুকু জারি থাকলে। আর সেই চেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে এটুকু বলতে পারি যে, ধর্মই বলুন, কিংবা অর্থনৈতিক নির্ভরতা, অথবা শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্য – এগুলোর কোনটিকেই আলাদাভাবে বা এককভাবে দায়ী না করে, প্রত্যেকটাকে একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হিসেবে দেখে, সেই সম্পর্কের ভিত্তিতে ক্ষেত্রবিশেষে, এবং প্রয়োজনভেদে ‘আলাদাভাবে’ বদলটা আনতে হবে। অর্থাৎ, চিন্তার ক্ষেত্র হোক একীভূত আর প্রয়োগের ক্ষেত্র হোক পৃথক। এটুকুই বক্তব্য।