বড় হয়ে অনেক কিছু হওয়ার শখ ছিল। ইচ্ছা ছিল। জীবনের লক্ষ্য ছিল। আজকে হয়ত একটা শখ, আবার কিছুদিন পর আরেকটা। একজনকে দেখে একটা ইচ্ছা জাগল তো আবার অন্যজনকে দেখে দেখে আরেকটা। এর প্রায় সবগুলোই উড়ে উড়ে গেছে। শুধু ফেব্রুয়ারি আসলেই অনেক ইচ্ছার মধ্যে একটা ইচ্ছা মাথা চারা দিয়ে উঠে।
অনেক ইচ্ছার মধ্যে ছিল—শিক্ষক হওয়া। নরসিংদি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ফরিদা আপা আর হুসনেরা আপাকে খুব ভাল লাগত। ফরিদা আপা ছিলেন গম্ভীর ও ধীর স্থির। জবেদা আপার মেয়ে হুসনেরা আপা চঞ্চল হলেও এ যেন নিজের জানাকে আমাদের জানানোর আকাঙ্ক্ষায় চাঞ্চল্য। বছর খানেক শিক্ষকতা করেছিও। তাছাড়া একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারী সংস্থায় প্রশিক্ষণ কর্মকর্তার চাকরি করে সে সাধ কিছুটা পুর্ণ হয়েছে বৈ কি।

আরেকটা ইচ্ছা ছিল সাংবাদিক হওয়ার। ছাপার অক্ষরে আমার লেখা ছাপবে। খবরদাতা হব। সৌখিন সাংবাদিকতা কিছুদিন করেছিও এবং এখনও সে সুযোগ রয়েছে।
মুদির দোকানদার হওয়ার শখ কোন এক ফাঁকে যেন হাওয়া।
এর প্রায় সবগুলোই উড়ে উড়ে গেছে। শুধু ফেব্রুয়ারি আসলেই বই বিক্রেতা হওয়ার ইচ্ছাটা পাগল পাগল করে দেয়। বইয়ের প্রতি নিকষিত হেমের সুধার রসে ভাসতে ইচ্ছে করে। বইয়ের দোকানী হবার স্বপ্নটা মাথাচারা দিয় উঠে। অনেক অনেক বইয়ের সংস্পর্শে থাকার আকাংঙ্ক্ষাটা টানতে থাকে। এতে বাড়তি লাভ হিসেবে বই পড়ার সুযোগ তো রয়েছেই।
স্নাতকোত্তর পরীক্ষার পর গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে ছয় মাসের সার্টিফিকেট কোর্সও করেছিলাম শুধুমাত্র বইয়ের প্রেমে। বইয়ের রাজ্যে চাকরি করব ভেবে।
সব শখ, ইচ্ছা, জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বৈষয়িক কারণে এসে মিলেছে ভাল বেতনের একটা চাকরিতে। হায়রে জীবন ও জীবিকার দ্বন্দ্ব! অবশ্য এ দ্বন্দ্ব উপভোগের মাত্রাকে সংযত করতে সহায়তা করে। বই পড়ার অভ্যাস আবার জীবনকে সাজাতে দেয় প্রয়োজনীয় উপকরণ। আর জীবিকাও যোগ হয় ভিন্ন মাত্রা।
যদিও সারা বছরই বই সঙ্গী হিসেবে থাকে। ফসল উঠলেই কৃষক যেমন সংবৎসরের আহার চলবে কি না হিসেব করে, তেমনি আমিও ফেব্রুয়ারির মেলা থেকেই মোটামুটি সংবৎসরের আহার কিনে নেই, আমার ফেব্রুয়ারি কৃষকের হেমন্তের মতোই গোলা ভরে রাখি ; ফাঁকে ফাঁকেও কেনা চলে। কৃষকের ফসলে বছর না গেলে হাহাকার; আর আমার থাকলে। প্রতিবছরই উদ্ধৃত্ত হয় আর আপসোস বাড়ে। কারণ আমার সাথে ছেলেমেয়ের ফসলও যে যোগ হয়! শেষ করতে পারি না।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অমলকান্তির মত আকাঙ্ক্ষিত কিছু না হতে পারার, না করতে পারার বেদনা অনুভব করি।

আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।

‘আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
———————–
আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।’

আমার ছেলেরও সেই একই আর্তি। সে যা হতে চেয়েছিল তা হতে পারেনি। তা হতে আমি নাকি দেইনি। আমি যা হতে চেয়েছি তাতে আমার মা সায় দিয়েছেন। কিন্তু আমি আমার ছেলেকেও তার ইচ্ছে মত কিছু হতে দিইনি বলে আমার বিরুদ্ধে তার অনুযোগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়তে চেয়েছিল। দেইনি। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়িয়েছি। কবি হতে চেয়েছিল। ‘বোধন’ নামে বন্ধুর সাথে যৌথভাবে একটি কবিতার বইও ছাপিয়েছিল। তারপরও কবিতার পিছে ছুটতে লাগাম ছাড়িনি। জীবন সম্বন্ধে তাকে তার উপলদ্ধিটি নাকি আমি উপভোগ করতে দেইনি।

সে ২৯ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার গেছে বৃত্তি নিয়ে। আর্টিফিসিয়েল ইন্টালিজেন্ট নিয়ে পি এইচ ডি করতে। এখন তারও মন খারাপ এবং আমারও। ই মেইল করে এবং পেয়েও শান্তি নেই। তার কন্ঠ শুনতে হয়। কণ্ঠ শুনে আবার আবেগ ধরে রাখতে পারি না । যাওয়ার জন্যে একটু আধটু মানসিক চাপ হয়তো দিয়েছি। এখন সংকটে পড়েছি। ছেলে তো তা চায়নি। ব্যথায় ব্যথায় বুক ছিঁড়ে যায়।
আসলে এ বৈষয়িক যুগে টিকে থাকার – বেঁচে থাকার সামর্থ্য তো সঞ্চয় করতে হবে। যা আমি পারিনি তা তো আমার উত্তর প্রজন্মকে করতে হবে। আমার মা ও তো নিজে যা করতে পারেননি আমাকে তা হতে সহযোগিতা করেছে, উদ্ধুদ্ধ করেছে। আর আমি যা করছি তা তো এরই ধাবাহিকতায় করছি – যদিও আমার ছেলে এ গতানুগতিকতা আমার কাছে প্রত্যাশা করেনি।