পূর্ববর্তী পর্বের পর…

tiktaalik

ফসিলবিদ্যার মত অত্যন্ত প্রাচীন শাখাটিকে এভু ডেভু কিভাবে নতুন আঙ্গিকে রাঙ্গিয়ে তুলছে তা বোঝার জন্য প্রথমে একটা মাছের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। নগন্য এক মাছ নিয়ে গল্প বলতে যাচ্ছি শুনে পাঠকেরা নাক সিঁটকাবেন না যেন। এই মাছ কিন্তু যে সে মাছ নয়, সাড়ে ৩৭ কোটি বছর আগে মাটিতে হেটে বেড়ানো মাছ! হ্যা, ঠিকই পড়েছেন, এই সেই বিখ্যাত টিকট্যালিক যার বৈশিষ্ট্যগুলো মাছের পানি থেকে ডাঙ্গায় উঠে আসার সেই ‘মাহেন্দ্রক্ষণের’ সাক্ষ্য বহন করে। বিবর্তনের দীর্ঘ ইতিহাসে সে যুগটা এক বিশেষ যুগ, মানব প্রজাতির বিবর্তনের ইতিহাসেও কিন্তু এর গুরুত্ব কম নয়। কারণ মাছ থেকেই বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় উদ্ভব ঘটেছে মাটির বুকে হেটে চলে ফিরে বেড়ানো সকল চতুষ্পদী বা দ্বিপদী প্রাণীর। লুসি কিংবা আর্ডির ফসিল যেমন আমাদের অতীতের পূর্বপুরুষদের প্রাইমেট জীবনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনি টিকট্যালিকের ফসিল আমাদেরকে নিয়ে যায় সুদূর অতীতের সেই সময়টাতে যখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা পানিতে বিচরণ করতো। এই ফসিলগুলো যেন এক একটা টাইম বোমা, আমাদের কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের স্ন্যাপসট ধারণ করে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সামনে।

চলুন এক কাজ করি, প্রথমে টিকট্যলিকের একটা সাক্ষাৎকার নেই। হ্যা, ঠিকই ধরেছেন, টিকট্যলিকের ফসিল কেন, কোন মাছেরই কথা বলার কথা নয়। সাক্ষাৎকারটা নিতান্তই কাল্পনিক, যদি সে কথা বলতে পারতো তাহলে হয়তো এভাবেই সে নিজের পরিচয় দিত :

প্রশ্নঃ আপনার নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন, টিকট্যালিক নামটা কেমন লাগছে?
আমার নাম টিকট্যালিক, ২০০৪ সালে যার ফসিল আবিষ্কার করে আপনাদের মানুষ প্রজাতিটি ভীষণভাবে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। নাহ, এই টিকট্যালিক নামটা আমার নিজের নাম নয়, আপনাদেরই দেওয়া নাম। অদ্ভুত এই নামটা শুনে প্রথমে বেশ বিরক্ত হলেও, পরে ভাবলাম, থাক না, কী আছে? উত্তর আমেরিকার এক সময়ের নীপিড়িত আদিবাসীদের ভাষা থেকে নামটা নেওয়া হয়েছে[৭], সেই শ্রদ্ধাবোধ থেকেই শেষ পর্যন্ত নামটা মেনে নিলাম। আমার জন্ম এবং মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৩৭ কোটি বছর আগে, সে সময় পানিতে বিভিন্ন রকমের ভয়ঙ্কর সব জলজ প্রানীর জয় জয়াকার থাকলেও মাটিতে কিন্তু কিছু স্থলজ উদ্ভিদ আর পতংগ ছাড়া আর কোন জীবের বসবাস ছিল না। শুনলাম পানির সেই ভয়ানক দৈত্যদের বেশিরভাগেরই কোন অস্তিত্ব নেই, অথচ কি ভয়ংকর এক সময় ছিল তখন! আমার দৈর্ঘ্য মাত্র ৭ ফুটের মত, এখন আমাকে বেশ বড় মনে হলেও সে সময় কিন্তু আমি বেশ ছোট খাটোই ছিলাম। আমার মত পানির কিছু মাছ তখন ডাঙ্গায় বিচরণ করতে সক্ষম হয়েছিল বলেই হয়তো বেঁচে গিয়েছিল। না হলে সেই ষোল ফুটি, বিশ ফুটি ভয়ানক এবং হিংস্র মাছগুলোর খাদ্য হওয়া ছাড়া মনে হয় আমাদের আর কোন গতি থাকতো না।

প্রশ্নঃ আপনাকে অনেকেই মধ্যবর্তী ফসিল বলছে, আপনি এ সম্পর্কে কি বলবেন?
এই একটা ব্যাপার নিয়ে আমার মনটা বেশ খারাপ হয়ে আছে। মধ্যবর্তী ফসিল আবার কি কথা? মধ্যবর্তী প্রাণী বলে কি কিছু আছে না থাকার কথা? এই কথাটি খুবই বিভ্রান্তিকর। ধরুন আজ থেকে কয়েক লক্ষ বছর পরে আপনাদের প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হয়ে অন্য আরেক প্রজাতির উদ্ভব ঘটলো। তার অর্থ কি এই যে, আজকের মানুষ প্রজাতিটি, অর্থাৎ, আপনারা আসলে আপনাদের পূর্বপুরুষ (মানুষ এবং শিম্পাঞ্জীর সাধারণ পূর্বপুরুষ)কোন নরবানর আর সেই নতুন প্রজাতির একটি মধ্যবর্তী রূপ? আপনারা কি নিজেদের মধ্যবর্তী কোন প্রাণী বলে ভাবতে পারেন? তাহলে তো সেই আদিম এক কোষী সাধারণ পূর্বপুরুষ ছাড়া বাকী সবাই কারও না কারও মধ্যবর্তী রূপ! সাড়ে সাইত্রিশ কোটি বছর আগে আমার প্রজাতিটি, আপনাদের মতই, একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রজাতি ছিল। আমাদের হাজার বছর আগে বা পরে বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় কোন প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছিল বা ঘটবে তা নিয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যাথাই ছিল না। মিসিং লিঙ্ক কথাটাও একটু বিভ্রান্তকর। এ পর্যন্ত তো আপনারা মাছ আর চারপায়ী প্রাণীর মাঝামাঝি বিভিন্ন ধরণের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আরও অনেক প্রাণী আবিষ্কার করেছেন, ভবিষ্যতে হয়তো আরও হবে, তাই বলে তো তারা কেউই মধ্যবর্তী ফসিল বা মিসিং লিঙ্ক হয়ে যাচ্ছে না।

first-4-legged-animal-_-timescale

ছবিঃ আমরা এখন য আধুনিক মাছ দেখি তাদের বেশীরভাগই ছড়ানো পাখা বিশিষ্ট মাছের উত্তরসূরী যাদের রে ফিনড মাছ বলে অভিহিত করা হয়। কোলাকান্থ, লাংফিশ, টিকট্যালিক এরা উভচর এবং মাছের মধ্যবর্তী বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে (সৌজন্য এখানে)

প্রশ্নঃ’ একদিকে পৃথিবীর বেশীর ভাগ মানুষই এখনও বিবর্তনে বিশ্বাস করে না, আবার অন্যদিকে আমরা এখনও আমাদের বিবর্তনের ইতিহাসটা সম্পূর্ণভাবে জানি না। ভূতাত্ব্বিক সময়ের হিসেবে আপনার ফসিলের বয়স তো নিতান্তই কম নয়, এ ব্যাপারটাতে আপনার অভিমত জানতে ইচ্ছে করছে।
ভূতাত্ত্বিক সময়ের বিচারে ৩৭ কোটি বছর হয়তো তেমন কিছু না, আমার মত ফসিলে পরিণত হয়ে ভুত্বকের গভীরে চ্যাপ্টা হয়ে থাকার জন্যও হয়তো ৩৭ কোটি তেমন বেশী সময় নয়, কিন্তু এই পৃথিবীর যে কোন প্রাণীর জন্য কোটি কোটি বছরের পরিধি কল্পনা করাও কিন্তু একটা দুঃসাধ্য একটা ব্যাপার। সেদিনের পৃথিবীতে বসে আপনাদের মত মানুষ নামক একটা প্রজাতি যে পৃথিবীর বুকে কখনও ঘুরে বেড়াবে সেটা কল্পনা করা শুধু দুঃসাধ্য নয় একরকম অসম্ভবই ছিল। কিন্তু তার চেয়েও বেশী দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল কল্পনা করা যে, পৃথিবীর বুকে একদিন এমন এক প্রজাতির উদ্ভব ঘটবে যার বুদ্ধিমত্তা এমন এক পর্যায়ে যাবে যে সে তা দিয়ে নিজের অস্তিত্ব, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষৎ সম্পর্কে এত কিছু ভাবতে সক্ষম হবে! আপনারা যে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে এতখানি সচেতন তার ফলাফল হিসেবেই মানুষ মনে হয় এইসব সৃষ্টিতত্ত্ব বানিয়েছে – সময় তো লাগবেই সেখান থেকে বেড়িয়ে আসতে, ! আপনাদের প্রজাতির জ্ঞান যত বাড়বে ততই আপনারা এক সময়ের অলৌকিক কল্পণাপ্রসূত সব ব্যখ্যা থেকে বেড়িয়ে আসতে সক্ষম হবেন।

আপনাদের প্রজাতিটির অস্তিত্ব তো আসলে খুব বেশী দিনের নয়, মাত্র দেড়-দুই লাখ বছরের ব্যাপার, আর আপনাদের এই তথাকথিত সভ্যতা তো আরও অল্পদিনের, মাত্র কয়েক হাজার বছরের। এত অধৈর্য হওয়ার কি আছে? আপনাদের বিজ্ঞান আজকে যে গতিতে যাচ্ছে, কয়েক দশকের মধ্যেই হয়তো আপনারা অতীতের সব কিছুই জেনে যাবেন। এব্যাপারে আপনাদের জন্য শুভ কামনা রইলো।

টিকট্যলিকের সাক্ষাৎকারটা না হয় কাল্পনিক, কিন্তু তার ফসিলের আবিষ্কারক শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ফসিলবিদ ডঃ নীল সুবিনের বক্তব্য জানার জন্য তো আর আমাদের কল্পনার আশ্রয় নেওয়ার কোন দরকার নেই। তিনি তার লেখা ‘ইয়োর ইনার ফিস’ বইটিতে, বিভিন্ন পত্রিকার সাথে সাক্ষাতকারে এবং বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখায় তার বক্তব্যগুলো তুলে ধরেছেন অত্যন্ত চমৎকারভাবে।

ডঃ সুবিন বিবর্তনের মৌলিক ধারণাটির উপর ভিত্তি করেই দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে তার অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন। ডারউইনের দেওয়া বিবর্তনতত্ত্ব অনুযায়ী সব জীবই কোন না কোনভাবে সম্পর্কিত – মানুষ এসেছে বানর জাতীর স্তন্যপায়ী প্রাইমেটদের থেকে, পাখীর বিবর্তন ঘটেছে ডাইনোসর থেকে, সরীসৃপেরা এসেছে উভচর প্রানী থেকে আবার উভচর প্রানীর উৎপত্তি ঘটেছে মাছ থেকে……। অর্থাৎ, এভাবে পৃথিবীর সকল জীবের মেলবন্ধনের ধারাবাহিতায় পিছাতে থাকলে আমরা একসময় পৌঁছে যাবো সেই আদি এককোষী সাধারণ পূর্বপুরুষে। ডারউইনের প্রস্তাবিত বহু গুরুত্বপূর্ণ অনুকল্পের মধ্যে এটিই বোধ হয় সবচেয়ে রোমাঞ্চকর! আজ দেড় শ’ বছরে আবিষ্কৃত কোটি কোটি ফসিল রেকর্ড এবং জেনেটিক্সের আলোয় আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পেয়েছি যে ডারউইনের দেওয়া অনুকল্পটি আসলে সঠিক ছিল। সকল জীবে যে বিবর্তন ঘটছে এবং বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এক প্রজাতি থেকে যে আরেক প্রজাতির উদ্ভব ঘটে চলেছে এটা আর কোন অনুকল্প নয়, সার্বজনীনভাবে গৃহীত একটি বৈজ্ঞানিক সত্য বা ফ্যাক্ট। আর এর উপর ভিত্তি করেই নীল সুবিন তার গবেষণার তাত্ত্বিক ভিত্তিটি তৈরি করেন –

ডারউইন যদি সঠিক হয়ে থাকেন, বিবর্তনতত্ত্ব যদি ঠিক হয়ে থাকে তাহলে কোন এক সময় পানির মাছ থেকেই ডাঙ্গার প্রাণীদের রূপান্তর ঘটতে শুরু করেছিল। আমরা যদি অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে থাকি তাহলে কখনও না কখনও এমন কিছু প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাবো যাদের মধ্যে মাছ এবং উভচরের মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান ছিল। কোন না কোন এক সময় মাছের পাখনা থেকে উভচর প্রাণীর পায়ের বিবর্তন ঘটেছিল। বিবর্তন যেহেতু সাধারণত ধীর গতিতে ঘটে নির্দিষ্ট একটা সময় জুড়ে এমন কিছু মাছের ফসিল অবশ্যই পাওয়া যাবে যাদের মধ্যে পাখনা এবং পায়ের মধ্যবর্তী গঠন দেখা যাচ্ছে। এখন প্রশ্নটা হচ্ছে সেই নির্দিষ্ট সময় এবং জায়গাটা কখন এবং কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে? ফসিল রেকর্ড থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সাড়ে ৩৬ কোটি বছর আগে পায়ের উদ্ভব ঘটে গেছে। তাহলে নিশ্চয়ই তার ঠিক আগের কয়েক লক্ষ বা কোটি বছরে এই রূপান্তর ঘটে থাকতে হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে দু’টিঃ
১) ঠিক কখন এই রূপান্তর ঘটতে শুরু করে? আর
২) এই রূপান্তর ঘটলো কিভাবে?

টিকট্যলিকের ফসিল আবিষ্কারের মাধ্যমে তারা প্রথম প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন। ফসিলবিদেরা আজকে প্রায় দেড় শ’ বছরেরও বেশী সময় ধরে এভাবেই বিবর্তনের বিভিন্ন ধাপ প্রমাণ করে আসছেন।

অভিযানের শুরুতে অনেক বিচার বিশ্লেষণের পরে প্রফেসর সুবিন এবং তার দল সিধান্ত নেন যে, তারা কানাডার উত্তর মেরু অঞ্চলে এলস্মিয়ার দ্বীপে অনুসন্ধান শুরু করবেন। অনেকটা যেন খড়ের গাঁদার মধ্যে সুই খুঁজে বের করার মতই ব্যাপারটা। আজ পর্যন্ত কোটি কোটি ফসিল আবিষ্কার হলেও কাজটা কিন্তু খুব সোজা নয়, ফসিলবিদেরা বছরের পর বছর ধরে নিজেদের জীবন বাজি রেখে এধরণের আবিষ্কারগুলো করেন। নীল সুবিনের দলও কিন্তু এর ব্যাতিক্রম নন। একসময় আমাজন নদীর অববাহিকার মত চির সবুজ থাকেলেও আজকে এই জায়গাটি গাছপালাহীন অসহনীয়রকম ঠান্ডা মেরু অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। হাজার মাইলের মধ্যে কোন মানববসতি নেই কিন্তু হিংস্র ভালুকের দেখা মিলতে পারে যে কোন সময়। ছয় বছর ধরে তিন তিনটা ব্যর্থ এবং ব্যয়বহুল অভিযানের পর তারা একরকম আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারপরও শেষ বারের মত সেখানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ২০০৪ সালে। আর সেখানেই তারা সন্ধান পান টিকট্যালিকের [৬]!

tiktalik_fossil-and-prototype

ছবিঃ টিকট্যালিকের ফসিল এবং কল্পিত পূর্ণ দেহের ছবি (সৌজন্য এখানে)।

সাড়ে সাইত্রিশ কোটি বছরের পুরোনো ভূতাত্বিক স্তরে ফ্ল্যাট মাথা বিশিষ্ট এক মাছের ফসিলের অংশ বিশেষ দেখেই বুঝে গিয়েছিলেন যে বছরের পর বছর ধরে তারা যা খুঁজছেন শেষ পর্যন্ত তারই সন্ধান পাওয়া গেছে! পানির মাছ এবং ডাঙ্গায় উঠে আসা প্রথম প্রাণীদের মধ্যে কতগুলো বড় পার্থক্য আছে – মাছের মাথা কোন্ বা মোচাকৃতি বিশিষ্ট যার দু’পাশে চোখ থাকে, আঁশ আছে, পাখনা আছে, কিন্তু তাদের কোন গলা নেই; আর ডাঙ্গার আদি প্রাণীদের মাথা ছিল ফ্ল্যাট, চোখ দু’টি ছিল উপরে আর সেই সাথে ছিল গলা, এবং আঙ্গুল, কব্জি এবং গোড়ালীসমৃদ্ধ হাত ও পায়ের অস্তিত্ব। কিন্তু এই টিকট্যালিকের মধ্যে যেন এই দু’দলের প্রাণীদের সব বৈশিষ্ট্যই মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে!

মাছের মত এর যেমন আশ আছে, পাখনা বা ডানা আছে, তেমনি আবার আদি-ডাঙ্গার প্রাণীর মত আছে ফ্ল্যাট মাথা, দুপাশে চোখ। মাছের কোন গলা নেই তাদের ঘাড়ের হাড় মাছের খুলির সাথে যুক্ত থাকে , কিন্তু টিকট্যালিকের ফসিলে পরিষ্কারভাবে গলার অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু। নীল সুবিনের গবেষণা দল যখন টিকট্যালিকের পাখার ভিতরের গঠনের দু’পাশের দিকে নজর দিলেন তখন শুরু হল আরও বিস্মিত হওয়ার পালা। পাখনার জালের মধ্যে মাছের পাখনার ভিতরের হাড় নয় বরং পরিষ্কারভাবে আমাদের হাতের মত হাড়ের গড়ন দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ, বাইরে থেকে দেখতে মাছের পাখনার জালের মত হলে কি হবে, টিকট্যালিকের পাখনা আংশিক হাত আর আংশিক পাখনার রূপ ধারণ করেছে। তার মধ্যে ইতোমধ্যেই হাতের কব্জির এবং কনুই এরও অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। এতদিন ধারণা করা হতো পানি থেকে মাটিতে পরিপূর্ণ অভিযোজনের পরেই শুধুমাত্র কব্জির মত এত জটিল গঠনের বিবর্তন ঘটেছিল [4]। সেই ধারণাকেও ভুল প্রমাণ করে দিল টিকট্যালিক। অর্থাৎ, নিজের শরীরের উপর ভর দিয়ে ডাঙ্গায় মাথা উঁচু করে বুকডন দেওয়ার মত ক্ষমতাও ছিল তার।

finstrusture_tiktalik

ছবিঃ টিকট্যালিকের পাখার ভিতরে মাছের পাখার জাল নয় বরং চতুষ্পদী প্রাণীর হাড়ের গঠন দেখানো হয়েছে [4]।

ডারউইনের তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে করা অনুকল্প থেকে আবারও ভূত্বকের সঠিক স্তরে, সঠিক সময়ের পরিধিতে, দুই রকমের প্রজাতির মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণীর ফসিল পাওয়া গেল। ফসিলবিদেরা বহুদিন ধরেই এভাবেই প্রাণের বিবর্তনের অগুন্তি সাক্ষী দিয়ে আসছেন।

আমাদের প্রথম প্রশ্নটার উত্তর তো পাওয়া গেল টিকট্যালিকের আবিষ্কারের মাধ্যমে। কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তর কিভাবে দেওয়া হবে? বিবর্তনের ধারায় কখন কোন প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে তা না হয় জানলাম, কিন্তু এক প্রজাতি থেকে আরেক তৈরির জন্য, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই যে বড় বড় রূপান্তরগুলোর প্রয়োজন হয় সেগুলো ঘটছে কিভাবে? গ্যালাপেগাস দ্বীপের ফিঙ্গেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধরণের ঠোঁটের আকৃতির বিবর্তন ঘটা এক কথা কিন্তু পা-হীন পাখনাওয়ালা পানিতে সাঁতড়ে বেড়ানো মাছ থেকে চার পা বিশিষ্ট ডাঙ্গায় হেটে চলে বেড়ানো জীবের বিবর্তন ঘটা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়!

আজকের আধুনিক বিবর্তনবিদ্যার জনক হিসেবে ডারউইনের নামই বলা হলেও তিনি কিন্তু প্রথম বিবর্তনের ধারণাটি প্রবর্তন করেননি। তার আগে অনেকেই বিবর্তনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তাদের কথাগুলো ঘাটে পানি পায়নি। বিবর্তনবিদ্যায় কয়েকটি মৌলিক অনুকল্প হাজির করেছিলেন ডারউইন, যা তার আগে আর কেউ পরিষ্কারভাবে বলতে পারেননি। তার দেয়া তত্ত্বকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক প্যারাডাইম শিফট হিসেবেই গন্য করা হয়ে থাকে। আমরা জানি যে তিনিই প্রথম বিবর্তন কিভাবে ঘটতে পারে তার ব্যখ্যা দিয়েছিলেন প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। শুধু তাইই নয়, তিনি জীবের মধ্যে ছোট ছোট পরিবর্তনগুলোর কথা বলেই ক্ষান্ত দেননি। তার সাথে সাথে আমাদেরকে উপহার দিয়েছিলেন অলৌকিকতার ছোঁয়া ছাড়া নিতান্ত প্রাকৃতিক উপায়ে নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভবের সেই ‘মহা বিতর্কিত’ ধারণাটিও।

ফসিল রেকর্ডগুলো খুব পরিষ্কারভাবে নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভবের সাক্ষী দিচ্ছে সেটা ঠিক, আবার জীবের জেনেটিক রেকর্ড থেকেও যে নতুন নতুন প্রজাতি তৈরির সুষ্পষ্ট নিদর্শনা পাওয়া যাচ্ছে তা নিয়েও সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কিন্তু এত বড় বড় রূপান্তরগুলো ঘটার পিছনে ঠিক কোন পদ্ধতি কাজ করছে বা করেছে তা বলতে না পারলে তো বিবর্তনবাদের গোড়ায় পৌঁছানো যাচ্ছে না, গল্পের অর্ধেকটাই যেন বাদ পড়ে যাচ্ছে! দেড়’ শ বছর আগে ডারউইন যখন বিবর্তনের ধারণাটি প্রস্তাব করেন তখন বিজ্ঞানীদের জিন বা বংশগতি সম্পর্কেই কোন জ্ঞানই ছিল না। আর সেখানে, নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভবের জন্য যে ‘বিশাল’ জৈবিক বা বংশগতিক রূপান্তর বা ট্র্যান্সফরমেশনের দরকার হয় তা নিয়ে ধারণা থাকার প্রশ্নটাই তো এখানে অবান্তর।

কিন্তু অন্যান্য অনেক বিষয়ের মত এই দুর্বোধ্য বিষয়টা নিয়েও ডারউইন এবং টি এইচ হাক্সলি তাদের মতামত দিতে পিছপা হননি। তারা তখনই সন্দেহ করেছিলেন যে, ভ্রূণতত্ত্বের ভিতরেই এর উত্তর লুকিয়ে থাকতে থাকতে পারে এর উত্তর। ডারউইন তার ‘অরিজিন অফ স্পিশিজ’ (১৮৫৯) এবং ‘দ্য ডিসেন্ট অফ ম্যান’ (১৮৭১) বইএ এবং হাক্সলি তার ‘এভিডেন্স আ্যজ টু ম্যান’স প্লেস ইন নেচার’ (১৮৬৩) বইতে বিবর্তনের অকাট্য সাক্ষী হিসেবে ভ্রূণতত্ত্বকে হাজির করেছিলেন [১]। সেই সাথে এও বলেছিলেন যে মানুষকে বিবর্তনের ধারায় বাকি জীবকুলের সাথে একই কাতারে দাঁড় করাতে হলে ভ্রূণতত্ত্বরই দ্বারস্থ হতে হবে[১]। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, আরও অনেক অনুকল্পের মতই তাদের এই অনুকল্পও আজ সঠিক বলে প্রমাণিত হতে চলেছে!

কিন্তু অনুমান করা সহজ হলেও জীববিজ্ঞানকে এখানে আসতে অপেক্ষা করতে হয়েছে বহুদিন। ভ্রূণতত্ত্বের পুরো ব্যাপারটাই এতদিন আমাদের সামনে যেন সমস্যার এক মহা-দুর্ভেদ্য দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়ে ছিল। টেলিস্কোপের আবিষ্কার যেমন জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিপ্লবের সূচনা করেছিল, ঠিক তেমনিভাবে গত কয়েক দশক ধরে ক্লোনিং, জিন লেভেলে বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষার অগ্রগতির ফলেই আম্রা এভু ডেভুর মত একটা বিষয়ে মনোনিবেশ করতে পেরেছি। অত্যাধুনিক মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে ভ্রূণের মধ্যে কোন গঠন তৈরি হওয়ার অনেক আগেই তার রাসায়নিক পরিবর্তনগুলোকে চিহ্নিত করতে পারার উপায়গুলো আমাদের সামনে ভ্রূণতত্ত্বের বদ্ধ দুয়ারটাকে খুলে দিতে সাহায্য করেছে।

আমাদের জিনোমের মাত্র শতকরা ১.৫ ভাগ ডিএনএ প্রোটিন সংকেতাবদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত, অর্থাৎ মাত্র দেড়ভাগ ডিএনএ জিন হিসেবে কাজ করে। তাহলে আমাদের জিনোমের বাকি সাড়ে ৯৮ ভাগের মধ্যে কি আছে? এতদিন বিজ্ঞানীরা এর সবটাকেই জাংক বা বাতিল ডিএনে বলে ধরে নিয়েছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে এর মধ্যে প্রায় ৩ ভাগ ডিএনএ আসলে নিয়ন্ত্রক জিন বা রেগুলেটরী জিন হিসেবে কাজ করে। এই জিনগুলোই ভ্রূণাবস্থায় কোন জিন কোথায় এবং কখন কোন অংগ গঠন করবে তার জন্য প্রয়োজনীয় সংকেত পাঠায়। দু’টি প্রজাতির মধ্যে জিনের সংখ্যা কত, তা দিয়েই শুধু তাদের মধ্যেকার পার্থক্যগুলো নির্ধারণ করা যাবে না, তাদের বিভিন্ন অংগ, প্রত্যংগ এবং গঠনের পিছনে এই নিয়ন্ত্রক জিনের সুইচগুলোর কি ভূমিকা রেখেছে তাও দেখতে হবে। অর্থাৎ, বিবর্তনের নতুন নতুন প্রজাতির উৎপত্তি এবং বিকাশকে বুঝতে হলে শুধু কয়টি জিন দিয়ে তার জিনোম তৈরি হয়েছে তা জানলেই হচ্ছে না, বরং এই জিনগুলো কোথায় কখন কিভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং কোন নিয়ন্ত্রক জিন এর পিছনে ভূমিকা রেখেছে তাও বুঝতে হবে।[১]।

কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, টিকট্যালিকের মত পুরনো ফসিল থেকে তো আর ডিএনএ খুঁজে পাবার কোন আশা নেই, তাই ঠিক কোন জিনের মিউটেশনের ফলে আসলে এই বিবর্তন ঘটেছিল তা বলাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে বসে গবেষণা করার ফলে ডঃ সুবিনের হাতে এমন কিছু অস্ত্র আছে যা ডারউইনের সময় তো দুরের কথা কয়েক দশক আগেও যা বিজ্ঞানীদের কল্পনার বাইরে ছিল। তাই, এবার ডঃ সুবিন এবং তার দল ফসিল থেকে তাদের দৃষ্টি ফেরালেন হাই-টেক আনবিক ডিএনএর গবেষণায়। অনেক কিছু বিবেচনা করে, তারা প্যাডেল মাছ (Polyodon spathula) নামে অত্যন্ত প্রাচীন এক মাছের ডিম নিয়ে কাজ শুরু করলেন। একে তো প্যাডেল মাছের ডিম বেশ সহজলভ্য অন্যদিকে তারা এবং টিকট্যালিক একই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। পার্থক্যটা হচ্ছে প্যাডেল মাছ এখনও বেঁচে বর্তে আছে আর টিকট্যালিক বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেই কবে! একই শ্রেণীর হওয়ায় ধরে নেওয়া যায় যে, তাদের জিনের গঠনও একই রকম ছিল। তারা তাদের কাজ কেন্দ্রীভূত করলেন ‘হক্স জিন’ নামে এক দল জিনের উপর।

এভু ডেভুর জগতে এই হক্স জিনে খুবই ‘নামী দামী’ এক নিয়ন্ত্রক জিন। অনেকে রসিকতা করে এদেরকে ‘জিন সম্প্রদায়ের’ মধ্যে ‘অভিজাতবর্গ’ বলেও অভিহিত করে থাকেন! প্রাণীর দেহের বিভিন্ন অংশের গঠনে এর ভূমিকা শুনলেই বুঝবেন এই ডাকটা কোন অত্যুক্তি নয়। এরা ভ্রূণ থেকে যে কোন প্রাণীর দেহ এবং আকার গঠনের প্রক্রিয়ায় ‘কম্যান্ডার ইন চীফ’এর ভূমিকা পালন করে । এদের অঙ্গুলীহেলনে ভ্রূণের মধ্যকার বিভিন্ন রকমের জিন সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরাই নির্দেশ দেয় দেহের ডান বাম কিভাবে গঠিত হবে, কোন দিকতা ভিতর যাবে কোনটা বাইরের, হাত কোথায় যাবে, পা কোথায় যাবে, চোখের অবস্থান কোথায় হবে, পাকস্থলী, হৃৎপিন্ড কোথায় তৈরি হবে… । গত ৬০ কোটি বছর ধরে এই হক্স জিনের গঠনে বিশেষ কোন পরিবর্তন ঘটেনি, সামান্য কৃমি থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত সবার দেহ গঠনে এরা মৌলিক ভূমিকা পালন করে থাকে [৬]।

কি পেলেন ডঃ সুবিন তার হক্স জিনের গবেষণা থেকে? তার এই গবেষণা থেকে যা বেড়িয়ে এল, তার মোদ্দা কথা মোটামুটি এরকম : প্যডেল মাছের মধ্যেই একই হক্স জিনের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে যা আমাদের এবং আরও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে রয়েছে। শুধু তাই নয়, যে হক্স জিনগুলো আমাদের হাত এবং পায়ের গঠনের জন্য দায়ী ঠিক সেই একই জিনগুলোই কাজ করে চলেছে প্যাডেল মাছের মত অতি প্রাচীন এক মাছের পাখনা তৈরির কাজে। এমনকি যে জিনগুলো পাখনার উপরের বড় হাড়টা তৈরিতে কাজ করছে ঠিক সেটিই কাজ করছে আমাদের হাতের উপরের বড় হাড়টি তৈরির পিছনে। এর পরের যে জিনটি কাজ করছে পাখনার পরবর্তী হাড়গুলোর গঠনে সেগুলোই দায়ী আমাদের হাতের কব্জি থেকে কনুই পর্যন্ত বিস্তৃত দু’টি হাড় তৈরির পিছনে। একই কাহিনী দেখা যাচ্ছে আমাদের হাতের এবং পায়ের আঙ্গুলের হাড় এবং প্যডেল মাছের পাখনার শেষের ছোট ছোট হাড়গুলো তৈরির ক্ষেত্রেও [৬]। এবং এই সাদৃশ্যটা শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা কিন্তু নয়, পৃথিবীর যাবতীয় চারপেয়ে এবং দুপেয়ে জীবের হাত এবং পা তৈরির ক্ষেত্রেই এই একই জিনগুলো কাজ করে চলেছে!

hox_gene_expression

উপরের ছবিতে মাছের পাখনা ( বা পাশের কলামে টিকট্যালিকসহ বিভিন্ন বিলুপ্ত প্রাণীর পাখনার গঠন, মাঝের কলামে প্যাডেল মাছ এবং মানুষ সহ এখনও টিকে থাকা বিভিন্ন প্রাণীর পাখনা এবং হাত পায়ের গঠন) এবং অন্যান্য প্রাণীর পাখনা, ডানা বা হাতের গঠনে হক্স জিনের এক্সপ্রেশান দেখানো হয়েছে। বিবর্তনীয় জীবিবিজ্ঞানের জগতে এখনকার তিন মহারথী ডঃ শন ক্যরাল, ক্লিফ ট্যাবিন এবং নীল সুবিন ২০০৯ সালে বৈজ্ঞানিক জারনাল নেচার এ Deep homology and the origins of evolutionary novelty নামের প্রবন্ধে তাদের এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন (Nature 457, 818-823(12 February 2009)।

তাহলে মাছের পাখনা থেকে চারপায়ী জীবের হাতপায়ের বিবর্তন ঘটতে কোন বিশেষ এক নতুন জিনের বিবর্তনের দরকার পড়েনি? প্রাণীজগত বিবর্তনের নাটকের এত বড় একটা অধ্যায় পার হয়ে এসেছে ‘মহা-নাটকীয়’ কোন ঘটনা ঘটা ছাড়াই? এত বিশাল একটা রূপান্তর ঘটে গেছে কোন অভিনব জিনের উদয় হওয়া ছাড়াই? বিশাল কোন উল্লম্ফনের প্রয়োজন হয়নি বিবর্তনীয় ইতিহাসে?………. না হয়নি।

তাহলে এর অর্থ কি দাঁড়াচ্ছে? আর কিছুই না, হাত পা তৈরির জন্য যে জিনের প্রয়োজন তা ইতোমধ্যেই সেই প্রাচীন মাছের জিনোমেই ছিল। যে জিন মাছের পাখনা তৈরিতেও ভূমিকা রেখে এসেছে সেই একই জিন থেকেই আজকের গরু, ঘোড়া, মানুষ, পাখীর মধ্যে হাত পা র উদ্ভব হয়েছে। এর জন্য কোন নতুন জিনের আবির্ভাবের দরকার পড়েনি, সেই প্রাচীন নিয়ন্ত্রক জিনগুলোর উপর ঘটা কিছু মিউটেশনের ফলেই ঘটে গিয়েছিল প্রাণীজগতের এত বড় রূপান্তর। কোথায় কখন কিভাবে এই জিনগুলো সক্রিয় হয়ে উঠবে, ভ্রূণাবস্থায় কোন জিন কখন ‘অন বা অফ’ হবে শুধু সেটুকুর উপর ঘটা মিউটেশন এর কারণেই এরকম একটা বড় রূপান্তর ঘটে যাওয়া সম্ভব। হঠাৎ করেই যেন, বিবর্তনীয় বিকাশমান জীববিদ্যা বা এভু ডেভুর অগ্রগতির মধ্যে দিয়েই, দেড় শ’ বছরের এক বিশাল ধাঁধার জট খুলে যেতে শুরু করেছে। ডারউইন যে মহানাটকের সূচনা করে গিয়েছিলেন আমাদের চোখের সামনেই যেন ঘটে চলছে তার বিভিন্ন অঙ্কের ক্রমিক উন্মোচন।

শুনতে খারাপ শুনালেও আজ বলতেই হয় যে ডারউইন তার আবিষ্কৃত বিবর্তন তত্ত্বের বেশীর ভাগটাই জানতেন না। একবিংশ শতাব্দীতে বসে আমরা যা জানি তার ৯৯% ও তিনি জানতেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা যেতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী ফ্রান্সিস্কো আয়ালাকে বিবর্তন সম্পর্কে ডারউইনের জ্ঞানের পরিধি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি হেসে জবাব দিয়েছিলেন, এটা তো খুবই সোজা প্রশ্ন। আমরা যা জানি ডারউইন তার ৯৯% ই জানতেন না। তবে তিনি যে ১% জানতেন সেটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ!!!

চলবে

তথ্যসূত্র:

1) Carroll S, 2005, Endless forms so beautiful. W.W. Norton & Company.
2) http://discovermagazine.com/2009/mar/19-dna-agrees-with-all-the-other-science-darwin-was-right
3) যুক্তি, সংখ্যা ৩, জানুয়ারি ২০১০, শন ক্যারলের সাথে সাক্ষাকারঃ ডি এন এ এবং অন্যান্য বিজ্ঞান প্রমাণ করছে যে ডারউইন সঠিক ছিল।
4) Shubin N, 2008, 2009,Your Inner Fish. Vintage Books.
5) http://www.nytimes.com/2007/06/26/science/26devo.html
6) http://www.pbs.org/wgbh/nova/beta/evolution/darwin-never-knew.html এই ভিডিওটা এখান থেকে ডাউনলোড করা যেতে পারে ( ধন্যবাদ পথিক কে ডাউনলোড এর এই উপায়টা খুঁজে বের করার জন্য)
veoh2://veoh.com/?cmd=DA782A7C-3538-4dd9-B28B-90F927E31BF1
7) ইনুয়িটরা (Nunavut) কানাডার উত্তর মেরুতে নুনাভেট টেরিটরী অফ আর্কটিক এ বসবাসকারী আদি আমেরিকান গোষ্ঠী। তাদের এই এলাকাতেই টিকট্যালিকের ফসিলের সন্ধান পান ডঃ সুবিন এবং তার গবেষণা দল। ইনুয়িট গোষ্ঠীর প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যই ডঃ সুবিন নুনাভেট কাউন্সিল অফ এল্ডারস দের কাছে তাদের সদ্য আবিষ্কৃত ফসিলটির জন্য নাম চেয়ে পাঠান। ডঃ সুবিন তার ‘ইয়োর ইনার ফিস’ বইটিতে মজা করে বলেছেন যে, যে কমিটির নাম ছিল Inuit Qaujimajatuquangit Katimajiit তারা সে ফসিলের জন্য কি নাম ধরণের দুর্বোধ্য নাম প্রস্তাব করবেন কে জানে। তাদের কাউন্সিল দু’টি নাম পাঠান, Siksagiaq এবং Tiktalik। নামটির সহজবোধ্যতা এবং অর্থের (large fresh water fish) কথা বিবেচনা করে তারা টিকট্যালিক নামটি রাখার সিদ্ধান্ত নেন।