বিজ্ঞান এখন কিভাবে বাংলাভাষী কিশোরদের কাছে উপস্থাপিত হচ্ছে তার স্বরূপ
টা জানা প্রয়োজন। বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনার জনপ্রিয়তা তাদের মাঝে অনেকদিনের। ভালো বেতন, অসাধারণ বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া, বিখ্যাত বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন, এগুলি কিশোরদেরকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়। কিন্তু তাদের কাছে বিজ্ঞানের অর্থ কি? তাদের যদি জানতে চাওয়া হয়, বিজ্ঞান মানে কি? তারা কী ভাবে? এটা জানা দরকার। আমাদের দেশে যারা বিজ্ঞানের প্রসারে কাজ করে যাচ্ছেন, তারা বিজ্ঞান নিয়ে লেখায় বিজ্ঞানকে কিভাবে উপস্থাপন করছেন জানাটা জরুরি

লেখকের নিজের বিজ্ঞান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলে বিজ্ঞানের ব্যাপারে উত্সাহিত করে যা কিছুই লিখুন না কেন তাতে নিজের খামখেয়ালিপনা, অবিজ্ঞানসুলভ ব্যাপারগুলো নিয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ থেকেই যাবে

বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠার পরে যখন একজন মানুষ বিজ্ঞানের সাথে অন্যান্য বিষয়গুলোর সংঘাতপূর্ণ ব্যাপারগুলো নিয়ে প্রশ্ন শুরু করে, সেগুলোর উত্তর করতে আমাদের (অন্তত মুক্তমনাদের) অনেকের যথেষ্ট সময় ব্যয় হয়। অবৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনা করে সন্ধান দেবার চেষ্টা করা হয় বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তাদের স্বরূপ কি


এই সংঘাতময় বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্নের নিরসন একান্ত জরুরী
। কারণ আমাদের বিশ্বাস, প্রগতির পথে এই সংঘাত একটি অপচয়। এগিয়ে চলার পথে বাঁধা। তাই আমাদের প্রয়োজন পড়ে সেই বাঁধাগুলোকে অপসারণ করার

বিজ্ঞানের বাইরের সংঘাতময় বিষয়গুলো নিয়ে বিজ্ঞানের সবচেয়ে শক্তিশালী দর্শনটির কিন্তু অনেক শক্তিশালী একটি অবস্থান আছে। আমাদের প্রয়োজন প্রশ্নগুলো নিরসনে এই দর্শনটির দিকে মনোনিবেশ করা। আর কেবল নিরসনের নিমিত্তেই নয়, বিজ্ঞানের সবচেয়ে শক্তিশালী দর্শন হিসেবে প্রয়োজন বিজ্ঞানের প্রসারে এই দর্শনের প্রসারকে অন্তর্ভুক্ত করা। কেননা বিজ্ঞানের উত্থানের পেছনের দর্শন ছিল এটি। আধুনিক বিজ্ঞানেও এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি

আর এই দর্শনটি হলো প্রত্যক্ষবাদ (positivism)। যা মানুষের জল্পনা-কল্পনাপ্রসূত নয় বরং কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং যাচাইযোগ্য পর্যবেক্ষণকেই যথার্থ জ্ঞান মনে করে এটি একটি সহজ সংজ্ঞা, তবে এর নিহিতার্থ কিন্তু ব্যাপক। যে তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ-অসাধ্য তার আলোচনা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অর্থহীন। কেননা তা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়, যাচাই করা সম্ভব নয়। যাচাই-অযোগ্য কোনো কথার উপর ভরসার মানে কি?

প্রত্যক্ষবাদ যে পুরোপুরি বিজ্ঞানকে সংজ্ঞায়িত করে ফেলেছে তা নয় তবে এর হাত ধরে অর্থপূর্ণভাবে এগোনো গেছে। খুব সহজ একটি সংজ্ঞায় আসা গেছে – “বিজ্ঞান হল পর্যবেক্ষণসংক্রান্ত পূর্বাভাসের প্রণালীবদ্ধ চর্চা” ঠিক তাই। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে পূর্বাভাস করতে পারতে হবে কারণ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে হতে হবে যাচাইযোগ্য, যথার্থতা-নির্ধারণযোগ্য (falsifiable)। তত্ত্ব যখন পর্যবেক্ষণের উপর কোনো পূর্বাভাস দেবে, কেবল তখনই সুযোগ থাকবে পূর্বাভাসের নির্ভুলতার উপর ভিত্তি করে তার যথার্ততা নির্ধারণের

প্রত্যক্ষবাদের সমালোচক আছে, বিশেষ করে সমাজ বিজ্ঞানে আমার আগ্রহ, এ বিষয়ে প্রথমে বিজ্ঞানানুরাগীদের মাঝেই আলোচনার শুরু করা লক্ষ্য, বাংলাভাষীদের মাঝে বিজ্ঞানের প্রসারে প্রত্যক্ষবাদী দর্শনকে সামনে নিয়ে আসা

আমি বিজ্ঞানের বেশকিছু দেশী-বিদেশী ছাত্র, গবেষকের সাথে আলোচনা করে দেখতে পেয়েছি বিজ্ঞান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার অভাব যেমন একজন আমাকে প্রস্তাব করেছেন – “বিজ্ঞানের লক্ষ্য যেহেতু পর্যবেক্ষণের সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা, সেখানে একজন অধিকর্তার অনুমান বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেই কাঙ্ক্ষিতআমি তার প্রস্তাব নিয়ে কুতর্কে যাই নি, আমি কেবল ব্যাখ্যা করেছি যে বিজ্ঞানের লক্ষ্য পর্যবেক্ষণের সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা নয়, বরং পর্যবেক্ষণের সবচেয়ে নিঁখুত পূর্বাভাস। ফলে ঘটে যাওয়া কোনো পর্যবেক্ষণকে একটি তত্ত্ব বা প্রস্তাব দ্বারা ব্যাখ্যা করা গেলেই কেবল চলবে না, সেই পর্যবেক্ষণের উপর তার পূর্বাভাস করার ক্ষমতা থাকতে হবে, যাতে প্রস্তাবটির যথার্থতা/সত্য-মিথ্যা যাচাই করা যায় একজন যুক্তিপূর্ণ মানুষ এই ব্যাখ্যার পর আর অযৌক্তিক প্রস্তাব করেন না। কাব্যগ্রন্থে গ্রহ-নক্ষত্রের উল্লেখের পেছনে বিজ্ঞানকে খোঁজেন না

আমার আকাঙ্ক্ষা, আগামী প্রজন্মে একদল বিজ্ঞানানুরাগী আসবে, যারা বিজ্ঞানের লক্ষ্য, দর্শন নিয়ে নিশ্চিত থাকবে
। সংঘাতের প্রশ্নে যাদের নিরসন আছে সদা প্রস্তুত। যারা তাই সংঘাতের তর্কে কালাতিকাল ব্যয় করবে না, সহজে অন্যকে বুঝিয়ে দিবে ও এগিয়ে যাবে