মোর গাঁয়ের সীমানার পাহাড়ের ওপারে
নিশীথ রাত্রির প্রতিধ্বনি শুনি
কান পেতে শুনি আমি বুঝিতে না পারি
চোখ মেলে দেখি আমি দেখিতে না পারি
চোখ বুজে ভাবি আমি ধরিতে না পারি
হাজার পাহাড় আমি ডিঙুতে না পারি

হতে পারে কোন যুবতীর শোক ভরা কথা
হতে পারে কোন ঠাকুমার রাতের রূপকথা
হতে পারে কোন কৃষকের বুক ভরা ব্যাথা
চেনা চেনা সুরটিকে কিছুতে না চিনি
নিশীথ রাত্রির প্রতিধ্বনি শুনি

শেষ হল কোন যুবতীর শোক ভরা কথা
শেষ হল কোন ঠাকুমার রাতের রূপকথা
শেষ হল কোন কৃষকের বুক ভরা ব্যাথা
চেনা চেনা সুরটিকে কিছুতে না চিনি
নিশীথ রাত্রির প্রতিধ্বনি শুনি

মোর কাল চুলে সকালের সোনালী রোদ পড়ে
চোখের পাতায় লেগে থাকা কুয়াশা যায় সরে
জেগে ওঠা মানুষের হাজার চিৎকারে
আকাশ ছোঁয়া অনেক বাঁধার পাহাড় ভেঙে পড়ে
মানব সাগরের কোলা‌হল শুনি
নতুন দিনের যেন পদধ্বনি শুনি

(ভুপেন হাজারিকা)

 httpv://www.youtube.com/watch?v=EDuU-vFlS34

যারা পত্রিকার খবরে প্রতিদিনই চোখ রাখছেন তারা ইতোমধ্যেই জেনে গেছেন, খাগড়াছড়ি শহরে নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ি-বাঙালি ভয়াবহ সংঘর্ষ। গত মঙ্গলবার শহর ও শহরতলিতে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে দুপুরে প্রশাসন জেলা শহরে ১৪৪ ধারা এবং রাতে কারফিউ জারি করেছে। ঘটনার সূত্রপাত হইয়েছিলো দিন কয়েক আগে – একুশে ফেব্রুয়ারির আগের দিন – বাগাইছড়িতে সেনাসদস্যদের গুলিতে পাঁচ জন পাহাড়ির মৃত্যুর ঘটনায়। পাহাড় হয়ে উঠেছে আবারো অশান্ত, উত্তাল। আবারো দেশদ্রোহীদের শায়েস্তা করতে শুরু হয়েছে আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর দমন নিপীড়ন। ভাবছিলাম এ নিয়ে কিছু লিখি। লিখতে গিয়ে আমার একটা পুরোন লেখার কথা মনে পড়ে গেলো।

মুক্তমনা শুরুর প্রথমদিককার সময়ে আমি একটি লেখা লিখেছিলাম ‘যুক্তির আলোয় দেশের ভাবমূর্তি এবং দেশপ্রেম‘ শিরোনামে।  পরবর্তীতে  আওয়ামিলীগ নেতা কিবরিয়ার উপর গ্রেনেড হামলার পর  আবারো সেটা মুক্তমনায় দেই একটু পরিবর্তন করে। লেখাটা দেখা যাবে এখানে।  লেখাটিতে আমি কিছু কথা লিখেছিলাম, যা এখনও প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি –

:line:

প্রিয় পাঠক আমায় বলুন তো, ‘দেশ’ ব্যাপারটি আসলে কি? সাদা চোখে কিন্তু দেশের মাটিকে আর ফল-মূল, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালাকেই দেশ বলে মনে করা হয়, তাই না? বাংলাদেশ টিভির দেশাত্মবোধক গানগুলির একটু স্মরণ করুন। কি মনে পড়ছে? ব্যকগ্রাউন্ডে ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার প’রে ঠেকাই মাথা’ বা ‘ফুলে ও ফসলে রাঙ্গা মাটি জলে’ ধরনের গান বেজে চলছে আর দেশকে তুলে ধরতে টিভি পর্দায় বারে বারেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানো হচ্ছে পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, ফুল-ফল আর সুজলা-সুফলা বাংলার প্রকৃতিকে। সিনেমায়, যাত্রায়, নাটক-উপন্যাসে, নেতা-নেত্রীর বক্তৃতায় যখন ই দেশ আর দেশপ্রেমের প্রসংগ এসেছে, সাধারণ মানুষের মগজ ধোলাই করতে বার বার বোঝানো হয়েছে দেশ মানে হচ্ছে এই ‘পবিত্র ভূমি’ আর নদী-পাহাড় সমৃদ্ধ শস্য-শ্যামল প্রকৃতি, অন্য কিছু নয়। দরকার হলে রক্ত পর্যন্ত ঢেলে দিয়ে এই পবিত্রভূমির অখন্ডতা আর তার ভাবমুর্তি রক্ষার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে আজ দেশপ্রেমিক শক্তির কাছে!

কিন্তু ঢালাও প্রচারণা আর ক্রমাগত মগজ ধোলাই-এ দেশ আর দেশপ্রেমের যে সংজ্ঞা গণ মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা কিন্তু এক নির্জলা মিথ্যা আর প্রতারণামাত্র। একজন যুক্তিবাদী মানুষমাত্রই বোঝেন, দেশ মানে দেশের মাটি নয়, দেশ প্রেম মানে কখনই দেশের মাটির প্রতি বা প্রাণহীন নদী-নালা আর পাহাড়-পর্বতের জন্য ভালবাসা হতে পারে না। দেশ প্রেম মানে হওয়া উচিৎ দেশের মানুষের প্রতি প্রেম; লাঞ্ছিত, বঞ্চিত অবহেলিত গণ-মানুষের প্রতি ভালবাসা। আমরা সকলেই জানি রাষ্ট্রের একটি প্রধাণতম উপাদান হল জনসমষ্টি। এই জনসমষ্টিকে বাদ দিয়ে শুধু কতকগুলি প্রাণহীন নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত আর মাটির প্রতি ভালবাসা সৃষ্টিকে আর যাই বলা হোক, ‘দেশ-প্রেম’ বলে অভিহিত  করার কোন যৌক্তিকতা নেই।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আত্মপরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছিলেন,

‘দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়, দেশ চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশমান হয়, তবেই দেশ প্রকাশিত। সুজলা, সুফলা মলয়শীতলা ভূমির কথা যতই উচ্চকণ্ঠে রটান ততই জবাবদিহির দায় বাড়বে, প্রশ্ন উঠবে প্রাকৃতিক দেশ তো উপাদানমাত্র, তা নিয়ে মানবিক সম্পদ কতুকু গড়ে তোলা হল। মানুষের হাতে দেশের জল যদি শুকিয়ে যায়, ফল যদি যায় মরে, মলয়জ যদি বিষিয়ে ওঠে মরিবীজে, শস্যের জমি যদি হয় বন্ধ্যা, তবে কাব্য-কথায় দেশের লজ্জা চাপা পড়বে না। দেশ মাটিতে তৈরী নয়, দেশ মানুষে তৈরী।’

রবীন্দ্রনাথ যে ব্যাপারটি প্রায় একশ বছর আগে বুঝতে পেরেছিলেন, তা আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবি মহল আজও হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। প্রতিদিনের মিথ্যা প্রচারণা আর ভঙ্গুর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমরা ভাবতে শিখেছি দেশপ্রেমিক বলতে বোধহয় বোঝায় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ওই সব দুর্নীতিবাজ নেতা-নেত্রী, ‘ম্যাডাম’ অথবা আপারা। আর অবহেলিত, নির্যাতিত গণমানুষের বঞ্চনার ছবি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে গিয়ে জাহানারা ইমা্মের মত ব্যক্তিরা দেশপ্রেমের সাজানো সংজ্ঞায় অবলীলায় ব’নে যান ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’। …


‘দেশপ্রেম’-এর বিষয়ে ধুরন্ধর রাজনীতিবিদদের মগজ ধোলাই এর ব্যাপারটি আরও পরিস্কার হবে পাক-ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সংগ্রামে লিপ্ত ছিল, তখন আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবর রহমানকে পাকিস্তানিরা চিহি¡ত করেছিল ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে আর স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত যোদ্ধাদের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে। কিন্তু বাংলাদেশ এবং ভারতীয়দের চোখে সঙ্গত কারণেই তারা তখন ছিল ‘মুক্তিযোদ্ধা’। সেই ভারতীয়রাই যারা কিনা বাংলাদেশের ব্যাপারে ৭১’এ এত্ত উদার, কাশ্মীরি যোদ্ধাদের প্রতি তাদের মনোভাব হয়ে যায় আবার ঠিক উলটা। তাদের চোখে কাশ্মীরি জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম তখন হয়ে যায় স্রেফ ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন’।

বিচ্ছিন্নতাবাদী আসলে কারা? চতুর রাষ্ট্রীয় প্রচারণার দৌলতে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ শব্দটি ‘নাস্তিক’ শব্দের মতই জনগণের মধ্যে এক ধরনের নেগেটিভ এপ্রোচ বহন করে। কিন্তু আমাদের বোঝা উচিৎ দুধে-ভাতে থাকলে কেউ বিচ্ছিন্ন হতে চায় না। বিচ্ছিন্নতাবাদের ধারণা মানুষের মনে উঠে আসে তখনই যখন কোন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি মনে করে যে তারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠি দ্বারা সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংষ্কৃতিক বা অর্থনৈতিকভাবে অবহেলিত, নিষ্পেশিত আর নির্যাতিত। পূর্ব বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ‘বিচ্ছিন্ন’ হতে চেয়েছিল অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক শোষণের কারণেই। কিন্তু ন’মাস ব্যাপী দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যে বাংলাদেশের উত্থান, তারাই আবার স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ক’বছরের মধ্যেই পাকিস্তানি কায়দায় সামাজিক, রাজনৈতিক শোষণের স্টিম রোলার চালিয়ে দিল পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত চাকমা জনগোষ্ঠির উপর যখন তারা তাদের নিজেদের জন্য এক স্বতন্ত্র পরিচয় দাবী করল। ইতিহাসের কি নির্মম পুনরাবৃত্তি! ঠিক পাকিস্তানী স্টাইলেই বাংলাদেশী সেনাবাহিনী চাকমাদের উপর চালালো দমন, নিপীড়ন, গণহত্যা। দেশের মানুষ নয়, ‘মাটির প্রতি ভালবাসায়’ অন্ধ হয়ে দেশের মানুষও ভাবতে শুরু করল, শান্তিবাহিনী আমাদের পবিত্র জন্মভূমির অঙ্গহানী ঘটাতে চায়। সরকারের কৌশলী প্রচার্নণায় শান্তি বাহিনীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামের উপর এঁটে দেওয়া হল ‘বিচ্ছিন্নতাবাদের’ তকমা! ভারত সরকারও একই কৌশল অবলম্বন করেছে কাশ্মিরে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলনকে দমন করতে। দেশপ্রেমের সাজানো সংজ্ঞায় আমরা প্রায়শঃই ভুলে যাই যে, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক আর সাংষ্কৃতিক শোষণ যখন লাগামছাড়া, সেই সমাজ থেকে কোন জনগোষ্ঠি যদি বেরিয়ে আসতে চায়, তবে তাদের সেই উচ্চশির স্পর্ধিত সংগ্রামকে প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষেরই আসলে অভিবাদন জানানো উচিৎ। নিপিড়িত, নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের কথা ভুলে গিয়ে আমরা আনেক সময় দেশের ইমেজ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ি। শোষিত মানুষের আধিকার আদায়ের সংগ্রামকে অভিনন্দিত না করে দেশ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কায় অঙ্গহানীর ব্যথা অনুভব করি। শোষণের যাঁতাকল পিস্ট করে কেউ যদি বেরিয়ে আসতে পারে, ওই বিচ্ছিন্ন অংশটা কিন্তু হয়ে দাঁড়াবে মুক্তিকামী কিছু মানুষেরই জয়ের প্রতীক – যা কিনা ভবিষ্যতে বহু মুক্তিকামী মানুষকেই স্বাধীকার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করবে। এই স্বচ্ছতাটুকু অন্ততঃ আমাদের থাকা উচিৎ ছিল। সেজন্যই ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক প্রবীর ঘোষ যখন তার ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক গ্রন্থে বলেন – ‘দেশ মাটিতে নয়, দেশ মানুষে তৈরী – এই সত্যকে মাথায় রেখেই আজ আমাদের ‘দেশপ্রেমী’ ও ‘দেশদ্রোহী’ শব্দগুলোর সংজ্ঞা খুঁজতে হবে’, তখন একমত না হয়ে পারি না।

:line:

কিছু দিন আগে – ফরিদ আহমেদ মুক্তমনার পাতায় পাহাড়ি জীবনকে উপজীব্য করে লিখেছিলেন একটি দুর্দান্ত ছোটগল্প – নীল পাহাড়ের চূড়ায়। বাংলা সাহিত্যে আমার পড়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পগুলোর একটি। ফরিদ আহমেদ সেই লেখায় সুনিপুনভাবে তুলে ধরেছেন মা বোন হারানো অত্যাচারে জর্জরিত এক সাধারণ ছেলের অবশেষে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হয়ে উঠার  কাহিনী। ফরিদ ভাইয়ের ‘নীল পাহাড়ের চূড়ায়’ গল্প হলেও আদিবাসী-পাহাড়িদের উপর লাগাতার অত্যাচার কোন গালগপ্প নয়। পাহাড়িদের উপর আমরা বাঙ্গালিরা দেশ প্রেমের মোহে উদ্বুদ্ধ হয়ে কি কম অত্যাচার করেছি? যেভাবে তাদের জমিজমা কেড়ে নিয়ে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় ভাবে খু্ন ধর্ষণ করা হয়েছে তা রূপকথাকেও হার মানায়। কল্পনা চাকমার কথাই ধরুন। আমাদের সেনাবাহিনীর সদস্য লেফটেন্ট ফেরদৌসের নেতৃত্বে পোষাকধারী সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো নারী অধিকার কর্মী কল্পনা চাকমাকে সেই ১৯৯৬ সালে। এখনো কল্পণার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। লেফটেন্ট ফেরদৌসের কোন শাস্তি হয়নি। এ নিয়ে বিপ্লব রহমান মুক্তমনায় একটা চমৎকার লেখা লিখেছিলেন – কল্পনা চাকমা এখন কোথায়? শুধু কল্পনা চাকমাই তো কেবল নয়,  আমরা জেনেছি রাংলাই ম্রোর উপর সেনাবাহিনীর অত্যাচারের কথা,  আমরা জানি মধুপুরের আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিল হত্যার কথা। সেনাক্যাম্পে নির্মমভাবে নির্যাতন চালিয়ে চলেশকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে তা পত্রপত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছে। পাহাড়িদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে সেই ১৯৯৭ সালে আর আজকে ২০১০। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি তো দেখি না। এখনও পিঁপড়ের মতো যত্র তত্র পাহাড়ি মানুষ গুম হচ্ছে, খুন হচ্ছে, আর্মির বুলেটে ঝাঁজরা আমাদের পাহাড়ি জনগণ। সর্বশেষ ঘটনা বিগত ২০ ফেব্রুয়ারিতে যেদিন আরও পাঁচজন পাহাড়ি মানুষ নিহত হলেন আর্মির গুলিতে। পত্রিকায় আসে বাঙালি পাহাড়ি সংঘর্ষের কথা, কিন্তু মৃত্যুতালিকায় চোখ রাখলে অবাক হয়ে কেবল পাহাড়িদের নামই দেখি।

pahari1

 pahari2

ছবি:  উপরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে খাগড়াছড়ির আদিবাসী অধ্যুষিত মহাজনপাড়ায়। আর নীচে খাগড়াছড়ি শহরে লাঠিসোটা নিয়ে বিক্ষুব্ধ আদিবাসীরা

 ইতিহাসের পাতায় একটু চোখ রাখি। স্বাধীনতার পর পরই আমাদের বাংলাদেশের স্থপতি শেখমুজিব পাহাড়িদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন – ‘তোরা সব বাঙালি হইয়া যা’। যে দেশটি দীর্ঘ নয় মাসের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ তুচ্ছ করে স্বাধীন হয়েছিলো, তার নির্বাচিত প্রতিনধি, স্বাধীন রাষ্ট্রের কর্ণধর মুজিব সেই একই পাকাস্তানী কায়দায় সাম্রাজ্যবাদের জোয়াল তুলে দিলেন সংখ্যালঘু পাহাড়িদের উপর, অস্বীকার করলেন আদিবাসীদের  স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়টুকু। তার পরে  জেনারেল জিয়া তার রাজত্বকালে পার্বত্য চটগ্রামে ৪ লাখ বাঙালিকে পুনর্বাসনের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। তাদের কিছু অংশকে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের ৩ মাইল দক্ষিণে ভুয়াছড়ি মৌজায় একটি চাকমা গ্রামের পাশে বসান হয়েছিল । সেই থেকে শুরু হয়েছিলো পাকিস্তানী কায়দায় পাহাড়িদের সংস্কৃতির উপর বাঙালি আগ্রাসন। ২০০৩ সালের ১৯ এপ্রিল গভীর রাতে সেই গ্রামের সেটেলার বলে কথিত উদ্বাস্তু বাঙালিরা সেনা ক্যাম্পের কিছু সেনা সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে পাশের চাকমা গ্রামে গিয়ে লুটপাট কর,  এরপর করে অগ্নিসংযোগ।  সেই একই বছর আগাস্ট মাসে খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার মহালছড়ি বাজারের দোকানি এবং মহালছড়ি ইউনিয়নের উদ্বাস্তু বাঙালিরা আবারো আদিবাসিদের বাড়িঘরে লুটপাট চালায়, এরপর বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে । এতে ৯টি গ্রামের ৩৫০টির ও অধিক বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মহালছড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বিনোদ বিহারী খীসা যিনি সন্ত্রাসীদের নিবৃত্ত করতে চেয়েছিলেন তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। এছাড়া সন্ত্রাসীরা ২টি বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়ে দেয়,২টি বৌদ্ধ মন্দির তছনছ করে এবং মুল্যবান ধাতুর তৈরি ৪টি বুদ্ধ মূর্তি লুট করে নিয়ে যায় ;মা-মেয়ে সহ ৮ জন মহিলা এবং একজন অপ্রাপ্তবয়ষ্ক বালিকাকে ধর্ষন করে। এদের মধ্যে কয়েকজন গণধর্ষণের শিকার হয়। ২০০৭ সালের মার্চ থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত খাগড়াছড়ি সদর থানার ২টি ইউনিয়নে এবং মহালছড়ি উপজেলার ২টি ইউনিয়নে মোট ১৪টি গ্রামের ১৩৩ ব্যক্তির এবং একটি স্কুলের ৩৯৯.২২ একর জমি সেটেলার বাঙালিরা ইতিমধ্যে দখল করে নিয়েছে। তাছাড়া রাঙ্গামাটির বুড়ীঘাটে ১০জন আদিবাসির ২৫ একর জমি সন্ত্রাসী বাঙ্গালিরা দখল করে নিয়েছে। এগুলো পত্রিকাতেই এসেছে। তবে পত্রিকায় যা এসেছে তা মহাসমুদ্রের মাঝে এক দু ফোঁটা জলবিন্দু ছাড়া কিছু নয়। হাজারো কান্না, কষ্ট আর হতাশ্বাসের কথা হারিয়ে  গেছে বিস্মৃতির অন্তরালে।

আগন্তুক কিছুদিন আগে মুক্তমনায় একটা লেখা লিখেছিলো – দেশদ্রোহ না দেশপ্রেম!! শিরোনামে। লেখাটিতে ছিলো  চমৎকার একটি লাইন  –

 ‘স্বাজাত্যবোধ ভাল, কিন্তু উগ্র স্বাজাত্যবোধ বিধ্বংসী।শাসনযন্ত্রে অধিষ্ঠিত হয়ে প্রায় সবাইই নরপশু হয়ে ওঠে -ইতিহাস তাই বলে’।

 সাইফুল ইসলাম লিখেছেন অসামান্য ক’টি লাইন ‘আমার ক্লীবত্ব’ নামের তার একটি চমৎকার কবিতায় –

আমি হতাশাগ্রস্থ হই
যখন দেখি আমার দেশেরও নাকি ধর্ম আছে
আমি অসহায় বোধ করি
যখন দেখি ওরা দেশ বলতে দেশের মাটিকে বোঝে

 আমাদের ক্লীবত্বকে পুঁজি করে আর আমাদের দেশের মাটি আর দেশপ্রেমের আপ্লুত মোহে জড়ভরত রাষ্ট্রগুলি হয়ে উঠেছে একেকটি ঈশ্বর। আর রাষ্ট্রের পোষা সেনাবাহিনীরা ঈশ্বরের নির্বাচিত পয়গম্বর। মুক্তমনাদের উচিৎ অলৌকিক ঈশ্বরের পাশাপাশি এই সুপরিচিত ঈশ্বরের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে সামিল হওয়া। তাতে যদি আমাদের দেশদ্রোহী হতে হয়, তাতেও সই।

মানব সাগরের কোলা‌হল শুনি
 নতুন দিনের যেন পদধ্বনি শুনি…