মোর গাঁয়ের সীমানার পাহাড়ের ওপারে
নিশীথ রাত্রির প্রতিধ্বনি শুনি
কান পেতে শুনি আমি বুঝিতে না পারি
চোখ মেলে দেখি আমি দেখিতে না পারি
চোখ বুজে ভাবি আমি ধরিতে না পারি
হাজার পাহাড় আমি ডিঙুতে না পারি
হতে পারে কোন যুবতীর শোক ভরা কথা
হতে পারে কোন ঠাকুমার রাতের রূপকথা
হতে পারে কোন কৃষকের বুক ভরা ব্যাথা
চেনা চেনা সুরটিকে কিছুতে না চিনি
নিশীথ রাত্রির প্রতিধ্বনি শুনি
শেষ হল কোন যুবতীর শোক ভরা কথা
শেষ হল কোন ঠাকুমার রাতের রূপকথা
শেষ হল কোন কৃষকের বুক ভরা ব্যাথা
চেনা চেনা সুরটিকে কিছুতে না চিনি
নিশীথ রাত্রির প্রতিধ্বনি শুনি
মোর কাল চুলে সকালের সোনালী রোদ পড়ে
চোখের পাতায় লেগে থাকা কুয়াশা যায় সরে
জেগে ওঠা মানুষের হাজার চিৎকারে
আকাশ ছোঁয়া অনেক বাঁধার পাহাড় ভেঙে পড়ে
মানব সাগরের কোলাহল শুনি
নতুন দিনের যেন পদধ্বনি শুনি
(ভুপেন হাজারিকা)
httpv://www.youtube.com/watch?v=EDuU-vFlS34
যারা পত্রিকার খবরে প্রতিদিনই চোখ রাখছেন তারা ইতোমধ্যেই জেনে গেছেন, খাগড়াছড়ি শহরে নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ি-বাঙালি ভয়াবহ সংঘর্ষ। গত মঙ্গলবার শহর ও শহরতলিতে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে দুপুরে প্রশাসন জেলা শহরে ১৪৪ ধারা এবং রাতে কারফিউ জারি করেছে। ঘটনার সূত্রপাত হইয়েছিলো দিন কয়েক আগে – একুশে ফেব্রুয়ারির আগের দিন – বাগাইছড়িতে সেনাসদস্যদের গুলিতে পাঁচ জন পাহাড়ির মৃত্যুর ঘটনায়। পাহাড় হয়ে উঠেছে আবারো অশান্ত, উত্তাল। আবারো দেশদ্রোহীদের শায়েস্তা করতে শুরু হয়েছে আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর দমন নিপীড়ন। ভাবছিলাম এ নিয়ে কিছু লিখি। লিখতে গিয়ে আমার একটা পুরোন লেখার কথা মনে পড়ে গেলো।
মুক্তমনা শুরুর প্রথমদিককার সময়ে আমি একটি লেখা লিখেছিলাম ‘যুক্তির আলোয় দেশের ভাবমূর্তি এবং দেশপ্রেম‘ শিরোনামে। পরবর্তীতে আওয়ামিলীগ নেতা কিবরিয়ার উপর গ্রেনেড হামলার পর আবারো সেটা মুক্তমনায় দেই একটু পরিবর্তন করে। লেখাটা দেখা যাবে এখানে। লেখাটিতে আমি কিছু কথা লিখেছিলাম, যা এখনও প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি –
:line:
প্রিয় পাঠক আমায় বলুন তো, ‘দেশ’ ব্যাপারটি আসলে কি? সাদা চোখে কিন্তু দেশের মাটিকে আর ফল-মূল, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালাকেই দেশ বলে মনে করা হয়, তাই না? বাংলাদেশ টিভির দেশাত্মবোধক গানগুলির একটু স্মরণ করুন। কি মনে পড়ছে? ব্যকগ্রাউন্ডে ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার প’রে ঠেকাই মাথা’ বা ‘ফুলে ও ফসলে রাঙ্গা মাটি জলে’ ধরনের গান বেজে চলছে আর দেশকে তুলে ধরতে টিভি পর্দায় বারে বারেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানো হচ্ছে পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, ফুল-ফল আর সুজলা-সুফলা বাংলার প্রকৃতিকে। সিনেমায়, যাত্রায়, নাটক-উপন্যাসে, নেতা-নেত্রীর বক্তৃতায় যখন ই দেশ আর দেশপ্রেমের প্রসংগ এসেছে, সাধারণ মানুষের মগজ ধোলাই করতে বার বার বোঝানো হয়েছে দেশ মানে হচ্ছে এই ‘পবিত্র ভূমি’ আর নদী-পাহাড় সমৃদ্ধ শস্য-শ্যামল প্রকৃতি, অন্য কিছু নয়। দরকার হলে রক্ত পর্যন্ত ঢেলে দিয়ে এই পবিত্রভূমির অখন্ডতা আর তার ভাবমুর্তি রক্ষার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে আজ দেশপ্রেমিক শক্তির কাছে!
কিন্তু ঢালাও প্রচারণা আর ক্রমাগত মগজ ধোলাই-এ দেশ আর দেশপ্রেমের যে সংজ্ঞা গণ মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা কিন্তু এক নির্জলা মিথ্যা আর প্রতারণামাত্র। একজন যুক্তিবাদী মানুষমাত্রই বোঝেন, দেশ মানে দেশের মাটি নয়, দেশ প্রেম মানে কখনই দেশের মাটির প্রতি বা প্রাণহীন নদী-নালা আর পাহাড়-পর্বতের জন্য ভালবাসা হতে পারে না। দেশ প্রেম মানে হওয়া উচিৎ দেশের মানুষের প্রতি প্রেম; লাঞ্ছিত, বঞ্চিত অবহেলিত গণ-মানুষের প্রতি ভালবাসা। আমরা সকলেই জানি রাষ্ট্রের একটি প্রধাণতম উপাদান হল জনসমষ্টি। এই জনসমষ্টিকে বাদ দিয়ে শুধু কতকগুলি প্রাণহীন নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত আর মাটির প্রতি ভালবাসা সৃষ্টিকে আর যাই বলা হোক, ‘দেশ-প্রেম’ বলে অভিহিত করার কোন যৌক্তিকতা নেই।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আত্মপরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছিলেন,
‘দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়, দেশ চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশমান হয়, তবেই দেশ প্রকাশিত। সুজলা, সুফলা মলয়শীতলা ভূমির কথা যতই উচ্চকণ্ঠে রটান ততই জবাবদিহির দায় বাড়বে, প্রশ্ন উঠবে প্রাকৃতিক দেশ তো উপাদানমাত্র, তা নিয়ে মানবিক সম্পদ কতুকু গড়ে তোলা হল। মানুষের হাতে দেশের জল যদি শুকিয়ে যায়, ফল যদি যায় মরে, মলয়জ যদি বিষিয়ে ওঠে মরিবীজে, শস্যের জমি যদি হয় বন্ধ্যা, তবে কাব্য-কথায় দেশের লজ্জা চাপা পড়বে না। দেশ মাটিতে তৈরী নয়, দেশ মানুষে তৈরী।’
রবীন্দ্রনাথ যে ব্যাপারটি প্রায় একশ বছর আগে বুঝতে পেরেছিলেন, তা আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবি মহল আজও হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। প্রতিদিনের মিথ্যা প্রচারণা আর ভঙ্গুর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমরা ভাবতে শিখেছি দেশপ্রেমিক বলতে বোধহয় বোঝায় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ওই সব দুর্নীতিবাজ নেতা-নেত্রী, ‘ম্যাডাম’ অথবা আপারা। আর অবহেলিত, নির্যাতিত গণমানুষের বঞ্চনার ছবি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে গিয়ে জাহানারা ইমা্মের মত ব্যক্তিরা দেশপ্রেমের সাজানো সংজ্ঞায় অবলীলায় ব’নে যান ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’। …
‘দেশপ্রেম’-এর বিষয়ে ধুরন্ধর রাজনীতিবিদদের মগজ ধোলাই এর ব্যাপারটি আরও পরিস্কার হবে পাক-ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সংগ্রামে লিপ্ত ছিল, তখন আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবর রহমানকে পাকিস্তানিরা চিহি¡ত করেছিল ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে আর স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত যোদ্ধাদের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে। কিন্তু বাংলাদেশ এবং ভারতীয়দের চোখে সঙ্গত কারণেই তারা তখন ছিল ‘মুক্তিযোদ্ধা’। সেই ভারতীয়রাই যারা কিনা বাংলাদেশের ব্যাপারে ৭১’এ এত্ত উদার, কাশ্মীরি যোদ্ধাদের প্রতি তাদের মনোভাব হয়ে যায় আবার ঠিক উলটা। তাদের চোখে কাশ্মীরি জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম তখন হয়ে যায় স্রেফ ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন’।
বিচ্ছিন্নতাবাদী আসলে কারা? চতুর রাষ্ট্রীয় প্রচারণার দৌলতে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ শব্দটি ‘নাস্তিক’ শব্দের মতই জনগণের মধ্যে এক ধরনের নেগেটিভ এপ্রোচ বহন করে। কিন্তু আমাদের বোঝা উচিৎ দুধে-ভাতে থাকলে কেউ বিচ্ছিন্ন হতে চায় না। বিচ্ছিন্নতাবাদের ধারণা মানুষের মনে উঠে আসে তখনই যখন কোন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি মনে করে যে তারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠি দ্বারা সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংষ্কৃতিক বা অর্থনৈতিকভাবে অবহেলিত, নিষ্পেশিত আর নির্যাতিত। পূর্ব বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ‘বিচ্ছিন্ন’ হতে চেয়েছিল অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক শোষণের কারণেই। কিন্তু ন’মাস ব্যাপী দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যে বাংলাদেশের উত্থান, তারাই আবার স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ক’বছরের মধ্যেই পাকিস্তানি কায়দায় সামাজিক, রাজনৈতিক শোষণের স্টিম রোলার চালিয়ে দিল পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত চাকমা জনগোষ্ঠির উপর যখন তারা তাদের নিজেদের জন্য এক স্বতন্ত্র পরিচয় দাবী করল। ইতিহাসের কি নির্মম পুনরাবৃত্তি! ঠিক পাকিস্তানী স্টাইলেই বাংলাদেশী সেনাবাহিনী চাকমাদের উপর চালালো দমন, নিপীড়ন, গণহত্যা। দেশের মানুষ নয়, ‘মাটির প্রতি ভালবাসায়’ অন্ধ হয়ে দেশের মানুষও ভাবতে শুরু করল, শান্তিবাহিনী আমাদের পবিত্র জন্মভূমির অঙ্গহানী ঘটাতে চায়। সরকারের কৌশলী প্রচার্নণায় শান্তি বাহিনীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামের উপর এঁটে দেওয়া হল ‘বিচ্ছিন্নতাবাদের’ তকমা! ভারত সরকারও একই কৌশল অবলম্বন করেছে কাশ্মিরে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলনকে দমন করতে। দেশপ্রেমের সাজানো সংজ্ঞায় আমরা প্রায়শঃই ভুলে যাই যে, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক আর সাংষ্কৃতিক শোষণ যখন লাগামছাড়া, সেই সমাজ থেকে কোন জনগোষ্ঠি যদি বেরিয়ে আসতে চায়, তবে তাদের সেই উচ্চশির স্পর্ধিত সংগ্রামকে প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষেরই আসলে অভিবাদন জানানো উচিৎ। নিপিড়িত, নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের কথা ভুলে গিয়ে আমরা আনেক সময় দেশের ইমেজ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ি। শোষিত মানুষের আধিকার আদায়ের সংগ্রামকে অভিনন্দিত না করে দেশ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কায় অঙ্গহানীর ব্যথা অনুভব করি। শোষণের যাঁতাকল পিস্ট করে কেউ যদি বেরিয়ে আসতে পারে, ওই বিচ্ছিন্ন অংশটা কিন্তু হয়ে দাঁড়াবে মুক্তিকামী কিছু মানুষেরই জয়ের প্রতীক – যা কিনা ভবিষ্যতে বহু মুক্তিকামী মানুষকেই স্বাধীকার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করবে। এই স্বচ্ছতাটুকু অন্ততঃ আমাদের থাকা উচিৎ ছিল। সেজন্যই ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক প্রবীর ঘোষ যখন তার ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক গ্রন্থে বলেন – ‘দেশ মাটিতে নয়, দেশ মানুষে তৈরী – এই সত্যকে মাথায় রেখেই আজ আমাদের ‘দেশপ্রেমী’ ও ‘দেশদ্রোহী’ শব্দগুলোর সংজ্ঞা খুঁজতে হবে’, তখন একমত না হয়ে পারি না।
:line:
কিছু দিন আগে – ফরিদ আহমেদ মুক্তমনার পাতায় পাহাড়ি জীবনকে উপজীব্য করে লিখেছিলেন একটি দুর্দান্ত ছোটগল্প – নীল পাহাড়ের চূড়ায়। বাংলা সাহিত্যে আমার পড়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পগুলোর একটি। ফরিদ আহমেদ সেই লেখায় সুনিপুনভাবে তুলে ধরেছেন মা বোন হারানো অত্যাচারে জর্জরিত এক সাধারণ ছেলের অবশেষে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হয়ে উঠার কাহিনী। ফরিদ ভাইয়ের ‘নীল পাহাড়ের চূড়ায়’ গল্প হলেও আদিবাসী-পাহাড়িদের উপর লাগাতার অত্যাচার কোন গালগপ্প নয়। পাহাড়িদের উপর আমরা বাঙ্গালিরা দেশ প্রেমের মোহে উদ্বুদ্ধ হয়ে কি কম অত্যাচার করেছি? যেভাবে তাদের জমিজমা কেড়ে নিয়ে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় ভাবে খু্ন ধর্ষণ করা হয়েছে তা রূপকথাকেও হার মানায়। কল্পনা চাকমার কথাই ধরুন। আমাদের সেনাবাহিনীর সদস্য লেফটেন্ট ফেরদৌসের নেতৃত্বে পোষাকধারী সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো নারী অধিকার কর্মী কল্পনা চাকমাকে সেই ১৯৯৬ সালে। এখনো কল্পণার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। লেফটেন্ট ফেরদৌসের কোন শাস্তি হয়নি। এ নিয়ে বিপ্লব রহমান মুক্তমনায় একটা চমৎকার লেখা লিখেছিলেন – কল্পনা চাকমা এখন কোথায়? শুধু কল্পনা চাকমাই তো কেবল নয়, আমরা জেনেছি রাংলাই ম্রোর উপর সেনাবাহিনীর অত্যাচারের কথা, আমরা জানি মধুপুরের আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিল হত্যার কথা। সেনাক্যাম্পে নির্মমভাবে নির্যাতন চালিয়ে চলেশকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে তা পত্রপত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছে। পাহাড়িদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে সেই ১৯৯৭ সালে আর আজকে ২০১০। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি তো দেখি না। এখনও পিঁপড়ের মতো যত্র তত্র পাহাড়ি মানুষ গুম হচ্ছে, খুন হচ্ছে, আর্মির বুলেটে ঝাঁজরা আমাদের পাহাড়ি জনগণ। সর্বশেষ ঘটনা বিগত ২০ ফেব্রুয়ারিতে যেদিন আরও পাঁচজন পাহাড়ি মানুষ নিহত হলেন আর্মির গুলিতে। পত্রিকায় আসে বাঙালি পাহাড়ি সংঘর্ষের কথা, কিন্তু মৃত্যুতালিকায় চোখ রাখলে অবাক হয়ে কেবল পাহাড়িদের নামই দেখি।
ছবি: উপরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে খাগড়াছড়ির আদিবাসী অধ্যুষিত মহাজনপাড়ায়। আর নীচে খাগড়াছড়ি শহরে লাঠিসোটা নিয়ে বিক্ষুব্ধ আদিবাসীরা
ইতিহাসের পাতায় একটু চোখ রাখি। স্বাধীনতার পর পরই আমাদের বাংলাদেশের স্থপতি শেখমুজিব পাহাড়িদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন – ‘তোরা সব বাঙালি হইয়া যা’। যে দেশটি দীর্ঘ নয় মাসের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ তুচ্ছ করে স্বাধীন হয়েছিলো, তার নির্বাচিত প্রতিনধি, স্বাধীন রাষ্ট্রের কর্ণধর মুজিব সেই একই পাকাস্তানী কায়দায় সাম্রাজ্যবাদের জোয়াল তুলে দিলেন সংখ্যালঘু পাহাড়িদের উপর, অস্বীকার করলেন আদিবাসীদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়টুকু। তার পরে জেনারেল জিয়া তার রাজত্বকালে পার্বত্য চটগ্রামে ৪ লাখ বাঙালিকে পুনর্বাসনের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। তাদের কিছু অংশকে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের ৩ মাইল দক্ষিণে ভুয়াছড়ি মৌজায় একটি চাকমা গ্রামের পাশে বসান হয়েছিল । সেই থেকে শুরু হয়েছিলো পাকিস্তানী কায়দায় পাহাড়িদের সংস্কৃতির উপর বাঙালি আগ্রাসন। ২০০৩ সালের ১৯ এপ্রিল গভীর রাতে সেই গ্রামের সেটেলার বলে কথিত উদ্বাস্তু বাঙালিরা সেনা ক্যাম্পের কিছু সেনা সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে পাশের চাকমা গ্রামে গিয়ে লুটপাট কর, এরপর করে অগ্নিসংযোগ। সেই একই বছর আগাস্ট মাসে খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার মহালছড়ি বাজারের দোকানি এবং মহালছড়ি ইউনিয়নের উদ্বাস্তু বাঙালিরা আবারো আদিবাসিদের বাড়িঘরে লুটপাট চালায়, এরপর বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে । এতে ৯টি গ্রামের ৩৫০টির ও অধিক বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মহালছড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বিনোদ বিহারী খীসা যিনি সন্ত্রাসীদের নিবৃত্ত করতে চেয়েছিলেন তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। এছাড়া সন্ত্রাসীরা ২টি বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়ে দেয়,২টি বৌদ্ধ মন্দির তছনছ করে এবং মুল্যবান ধাতুর তৈরি ৪টি বুদ্ধ মূর্তি লুট করে নিয়ে যায় ;মা-মেয়ে সহ ৮ জন মহিলা এবং একজন অপ্রাপ্তবয়ষ্ক বালিকাকে ধর্ষন করে। এদের মধ্যে কয়েকজন গণধর্ষণের শিকার হয়। ২০০৭ সালের মার্চ থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত খাগড়াছড়ি সদর থানার ২টি ইউনিয়নে এবং মহালছড়ি উপজেলার ২টি ইউনিয়নে মোট ১৪টি গ্রামের ১৩৩ ব্যক্তির এবং একটি স্কুলের ৩৯৯.২২ একর জমি সেটেলার বাঙালিরা ইতিমধ্যে দখল করে নিয়েছে। তাছাড়া রাঙ্গামাটির বুড়ীঘাটে ১০জন আদিবাসির ২৫ একর জমি সন্ত্রাসী বাঙ্গালিরা দখল করে নিয়েছে। এগুলো পত্রিকাতেই এসেছে। তবে পত্রিকায় যা এসেছে তা মহাসমুদ্রের মাঝে এক দু ফোঁটা জলবিন্দু ছাড়া কিছু নয়। হাজারো কান্না, কষ্ট আর হতাশ্বাসের কথা হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অন্তরালে।
আগন্তুক কিছুদিন আগে মুক্তমনায় একটা লেখা লিখেছিলো – দেশদ্রোহ না দেশপ্রেম!! শিরোনামে। লেখাটিতে ছিলো চমৎকার একটি লাইন –
‘স্বাজাত্যবোধ ভাল, কিন্তু উগ্র স্বাজাত্যবোধ বিধ্বংসী।শাসনযন্ত্রে অধিষ্ঠিত হয়ে প্রায় সবাইই নরপশু হয়ে ওঠে -ইতিহাস তাই বলে’।
সাইফুল ইসলাম লিখেছেন অসামান্য ক’টি লাইন ‘আমার ক্লীবত্ব’ নামের তার একটি চমৎকার কবিতায় –
আমি হতাশাগ্রস্থ হই
যখন দেখি আমার দেশেরও নাকি ধর্ম আছে
আমি অসহায় বোধ করি
যখন দেখি ওরা দেশ বলতে দেশের মাটিকে বোঝে…
আমাদের ক্লীবত্বকে পুঁজি করে আর আমাদের দেশের মাটি আর দেশপ্রেমের আপ্লুত মোহে জড়ভরত রাষ্ট্রগুলি হয়ে উঠেছে একেকটি ঈশ্বর। আর রাষ্ট্রের পোষা সেনাবাহিনীরা ঈশ্বরের নির্বাচিত পয়গম্বর। মুক্তমনাদের উচিৎ অলৌকিক ঈশ্বরের পাশাপাশি এই সুপরিচিত ঈশ্বরের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে সামিল হওয়া। তাতে যদি আমাদের দেশদ্রোহী হতে হয়, তাতেও সই।
মানব সাগরের কোলাহল শুনি
নতুন দিনের যেন পদধ্বনি শুনি…
হুমায়ুন আজাদ, সবুজ পাহাড়ের ভেতর প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা, পৃঃ ২৮।
অভিজিত দা’কে অত্যন্ত ধন্যবাদ -এমন এক স্পর্শকাতর ইস্যুকে চমৎকারভাবে তুলে ধরার জন্য। আমি যখন থেকে মুক্তমনাকে খুঁজে পেয়েছি (বিপ্লব দা’র লিখনির সহযোগিতায়) -শুধুই পড়ে চলেছি অভিজিত দা’এর লেখাগুলো -খুবিই ভালো লাগে -হতে চাই উনার মতো একজনা -যদি ও সম্ভবপর নয়। সম্ভবপর এই জন্য নয় যে আমার লেখাকে অন্যভাবে তুলে ধরা হবে -কেননা আমি যে একজন সংখ্যালঘুর মানুষ। ঠাঁই দিতে চাইবে না লুক্কায়িত সত্যকে। তাই আপনাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। মাঝে-মাঝে বামপন্থী রাজনীতির দলগুলো কয়েকটি ইস্যুটে একাত্বতা জানাই -কিন্তু উনাদের সৎদিচ্ছার প্রতি আমার সন্দেহ হয়। যেমন বর্তমান সরকারের তারা ও এক-এক অংশের দাবিদার। ভারতে আরেক চাকমার মানবাধিকার কর্মী আছেন (সুহাস চাকমা)
-আপনারা উনার সাথে আপনাদের আসল পরিচয় এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে লিখলে উনি নিশ্বয় হতাশ করবেন না। তবে জানেন তো আমাদের পাহাড়ীরা কিন্তু সহজে অন্য এক বাঙালীকে আর বিশ্বাস করতে পারি না। কারণ অনেক প্রতারণার শিকার হতে হয়েছে -এর জন্য এমনটা হলে আপনারা কিছু মনে করবেন না।
@জয়েন্টু, (Y) (Y) (Y)
এই দেশে যতদিন ধর্মের নোঙড়া টুপি, রাজনীতির বিসাক্ত সাপ ও সেনাবাহিনি নামের অাবজর্না থাকবে ততদিন মানুষের মুক্তি অাসবেনা ।
অনেকের মত অামারও লজ্জা করে নিজেকে নির্যাতন কারীদের একজন ভাবতে।
অভিজিত ভাই কে ধন্যবাদ এমন একটা লেখার জন্য ।
বিদেশীর উপর ভরসা করা মনে হয় না কোন কার্যকরি সমাধান দিতে পারবে। বিদেশীরা নিজেদের কোন স্বার্থ ছাড়া স্রেফ মানবিকতার খাতিরে এসে সমাধান করে দেবে ভাবাটা মনে হয় না বাস্তবসম্মত হবে। তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলি, জাতিসংঘের মাধ্যমে কিছু করার চিন্তা করা যেতে পারে। তাতে অন্তত সরকারের টনক পড়তে পারে যে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপারটা সমালোচিত হচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্থ জনসাধারনদের নিয়ে শর্ট ডকুমেন্টরী বানানো যয়, আজকাল এমন ধরনের ডকু বানানো খুব একটা ব্যায়বহুল বা কঠিন নয়। আমার মতে মূল সমাধান আমাদের দেশের মানুষকেই করতে হবে। মানুষের বিবেক এখনো তেমনভাবে এসব ব্যাপারে সাড়া দেয় না, বিশেষ করে যেখানে সংখ্যালঘু শব্দটা জড়িত সেসব ব্যাপার মানুষ তেমন আমলে নয় না। চিত্র প্রদর্শনি, শর্ট ফিল্ম এসব প্রচার করা গেলে মানুষ নিজের চোখে অমানবিক ব্যাপারগুলি দেখতে পাবে। তাতে বিবেক সাড়া দিতে বাধ্য।
সুধা বলেছেন–
বিদেশে পাড়ি জমানো সবার জন্যে সহজ সাধ্য নয়। হেঁটে হেঁটে তো আর পাশ্চাত্যের দেশে যাওয়া যাবে না!
পৃথিবী বলেছেন—
আমি সম্পূর্ণ একমত হতে পারলাম না।
আমার জানা বেশ কিছু পাহাড়ী জাতিগত সংখ্যালঘুর প্রতিনিধি হিসেবে উন্নত দেশে উন্নত জীবন যাপন করছেন আর বিভিন্ন ফোরামে (হয়ত?) তাদের ইস্যুটিও তুলছেন। আমি একজন পাহাড়ী ছাত্রনেতেকে জানি যিনি জেনেভায় ছিলেন এ বিষয়ে কাজ করার জন্যে। তবে তার সাথে কথা বলে বুঝতে পারিনি কতটুকু কী করছেন।
একজন ভূটানের নেতাকে জানতাম ( নাম জগৎ) যিনি দীর্ঘদিনি নেপালে আশ্রিত ছিলেন। কাজ করতেন South Asian Human Rights Forum এ। তিনি ভুটানের নেপালে আশ্রিত উদ্বাস্তুদের নিয়ে কাজ করতেন। মাস চারেক আগে খবর পেলাম উনি উন্নত বিশ্বে যাচ্ছেন ছেলেমেয়ের ভবিষ্যত চিন্তা করে।
আমার তাৎক্ষণিক মতামতঃ
১। অনেক পাহাড়ী জাতিগত সংখ্যালঘু বিদেশে আছেন। তাদেরকে মুক্ত-মনার প্রবাসী সদস্যরা সন্নিবেশিত করে তাঁদের পক্ষে মতামত গড়ে তুলতে পারেন এবং বাংলাদেশের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন।
২। বাংলাদেশের মুক্ত-মনার সদস্যরা এ মূহুর্তে ঘটনার শিকারদের জন্য, ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্য ও চিকিৎসায় সহযোগিতা করতে পারেন।
৩। সরকারর সাথে লবিং করায় সহযোগিতা করতে পারেন।
৪।তাদের পুনর্বাসনের পদক্ষেপ নিতে পারেন।
৫। পাহাড়ে বাঙালী আদিবাসীদের মধ্যে সম্প্রীতির জন্যে নির্দিষ্ট কিছু কর্মসূচি নিতে পারেন।
একমত
@গীতা্দি,
আপনার বেশ কিছু পয়েন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হল। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। বিশেষত এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা ভাবছি –
বিশেষত অমিত চাকমা – যিনি ক্যানাডার একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট পদ অলঙ্কৃত করে আছেন, তার মত ব্যক্তিত্বদের যদি অন্তর্ভুক্ত করা যায় তবে ব্যাপারটি আন্তর্জাতিকভাবেও গুরুত্ব পাবে। চেষ্টা করা হচ্ছে। দেখি কি হয়। গীতাদির অন্য সাজেশনগুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক দেরীতে বলছি। অভিজিৎ দার তথ্য ও বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ লেখটি ভালো লাগলো।
লেখাটি পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল, ছো্ট বালক চন্দ্র সাগর চাকমা’র কথা। ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল খাগড়াছড়ির পানছড়ির দুর্গম লোগাং নামক গ্রামে গণহত্যায় শদুয়েক পাহাড়ির সঙ্গে এই শিশুটির মা-বাবা-ভাই-বোন সবাইকে সেনা মদদে বাঙালি সেটেলাররা কসাইয়ের মতো দা দিয়ে কুপিয়ে খুন করেছিল। চন্দ্র সাগর জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে কোনো রকমে প্রাণে রক্ষা পায়। …
ওই শিশুটি এখন বড় হয়েছে। বৌদ্ধ বিহারের আনুকূল্যে পড়াশুনা শিখেছে। সেদিন আমাকে একটি ই-মেইল বার্তায় বললো, দাদা, তুমি লোগাং গ্রামটিকে কখনো ভুলতে পার না কেনো? আমি ওকে ছোট্ট করে বলেছি, কারণ– আমিও বাঙালি! বিভৎস সব স্মৃতি, তীব্র অনুশোচনা, জাতিগত অপরাধবোধ — আমাকে কিছুই ভুলতে দেয় না চন্দ্র, আমার ঘুম আসে না।…
দেশের আপামর জণতা এই সমস্যা নিজের করে না দেখলে কোন সমাধান হবে না।
আদিবাসীরা যে আমাদের দেশেরই আর দশজনের মতই মানুষে এটা আগে সবার বুঝতে হবে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেই যে সংখ্যালঘূ কোন গোষ্ঠীর উপর গায়ের জোর দেখিয়ে অন্যায় জবরদস্তি করা হালাল এই ধারনা থেকে বাস্তবিকভাবেই বের হতে হবে।
নিজের দেশের সেনাবাহিনী সকল আলোচনা সমালোচনার উর্ধ্বে ও তাদের সমালোচনা করা মানে দেশদ্রোহিতা এহেন উদ্ভট সামন্তবাদী মানসিকতা থেকে বের হতে হবে। মিডীয়া কর্মীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে যে যেন যে কোন বাহিনীরই অপকর্মের খবর পেলে তা প্রকাশে কোনরকম রাখঢাক করা না হয়।
মাঝে মাঝে মনে হয় বাংলাদেশের(তৎকালীন পুর্বপাকিস্তান) আপামর জনসাধারনের ওপর নির্যাতন না চালিয়ে পাকিস্তানীরা যদি শুধু বেছে বেছে সংখ্যালঘুদের(আনুপাতিক তুলণায় সংখ্যালঘুরা সংখ্যায় বেশীই ছিলো তখন এখনকার চেয়ে) ওপর নির্যাতন চালাতো, চালিয়েই যেতো যতক্ষণ না পর্যন্ত শেষ সংখ্যালঘুটি অব্দি মরে যায় বা পালিয়ে যায় — যত পাশবিক, নিমর্ম হোক না কেন সে অত্যাচার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী কোনো সরাসরি সংঘাতে যেতো কি? মনে হয় না।
সেনাবাহিনীদেরতো বটেই অধিকাংশ বাঙালী সেটেলারদেরও সম্ভব হলে নামিয়ে আনা উচিত পাহাড় থেকে। অন্তত কমিয়ে আনা এবং নতুন একটিও বাঙালী যেন ওখানে আস্তানা গাড়তে না পারে – সেটা নিশ্চিত করা খুব কঠিন হবার কথা নয়। – যদিও আমরা সবাই খুব ভালো করেই জানি যে এর উল্টোটাই ঘটবে। আদিবাসীরা এমনই মরতে থাকবে বারবার, আরো মার খাবে, আরো কোনঠাসা হবে, তারপর হারিয়ে যাবে – হয় বর্ডার পেরিয়ে অন্য কোন দেশে নয় বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠী’র মাঝে স্বকীয়তা হারিয়ে – এদেশের আরো, আরো সংখ্যালঘুদের মতো। আদিবাসী কেউ পড়ছেন কি এসব? পড়লে প্লিজ লিখুন আপনাদের কথা, এখানে।
@অভিজিত রায়
কদিন আগে পত্রিকায় প্রথম যখন দেখি আবারো আগুন জ্বলছে পাহাড়ে – যে কথাটা সবার আগে মনে হয়েছিলো – সেটা হলো Ethnic Cleansing’এর শিকার এই জনগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে উদ্বাস্তুর মর্যাদা পায় কিনা। পেলে অন্তত কিছু আদিবাসী মানুষেরা যদি বেরিয়ে আসতে পারে। আর উদ্বাস্তুই যদি হতে হয় পাশের দেশে না গিয়ে পাশ্চাত্যের কোন দেশে যাওয়া শ্রেয়। এতে দুটি লাভ হবে।
১, এটা দুনিয়ার লোকের চোখে পড়বে। এতে সরকার তথা সেনাবাহিনী সংযত হবে( হতে পারে)।
২, দেশ ছেড়ে আসা আদিবাসীরা আশা করা যায় ফেলে আসা পাহাড়, মানুষ, সংগ্রামের কথা ভুলে যাবে না। এদের কাছ থেকেই সত্যিকারের সহযোগিতা পেতে পারে দেশে থেকে যাওয়া আদিবাসীরা( বিদেশে বসবাসকারী বাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের ভুমিকা উল্লেখ্য)।
মুক্তমনা এব্যাপারে কিছু করতে পারে কি?
@সুধা,
দীর্ঘ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। কিছু ভাল সাজেশন পাওয়া গেল। অন্যরাও এ ধরণের আলোচনা চালিয়ে গেলে হয়তো গঠনমূলক একটা জায়গায় আমরা যেতে পারবো। আপনার আর্তির ব্যাপারটা ভালভাবেই বুঝতে পারছি – তবুও সব আদিবাসীদের ধরে পাশ্চাত্যের কোন দেশে নিয়ে যাওয়া বা আশ্রয় দেয়া বোধ হয় সম্ভব নয়, এবং ব্যাপারটা বাস্তবসম্মতও হয় নয়, সেটা বোধ করি আপনিও জানেন। এভাবে একজন/দুজন আদিবাসীর সমস্যা সমাধান করা গেলেও সমস্যার মূল উৎস জিইয়ে রেখে সমাধান পাওয়া সম্ভব নয় বলে আমার ব্যক্তিগত ধারনা।
যা হোক, আলোচনা চলুক। এ থেকেই হয়ত ফলপ্রসু কিছু বেরিয়ে আসবে। মন্তব্যের জন্য আবারো ধন্যবাদ। মুক্তমনায় আপনাকে সদস্য হিসেবে পেয়ে সত্যই আমরা আনন্দিত।
@অভিজিৎ,
আদিবাসীদের মধ্যে key figure জাতীয় কয়েকজনকে যদি পশ্চিমা বিশ্বে পাঠিয়ে দেওয়া যায় এবং সেখান থেকে তাঁরা যদি তাঁদের পক্ষে মতামত গড়ে তুলতে পারেন, তবে কি বাংলাদেশের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা যাবে না? ব্লগে বিপ্লবদার মত নিশ্চয়ই কয়েকজন আছেন যাঁরা পাহাড়ীদের সাথে ভাল মতই পরিচিত, উনারা হয়ত এমন কয়েকজনের কথা বলতে পারবেন।
@পৃথিবী,
এক কানা কয় আরেক কানারে, চল এবার ভব পাড়ে…..
নিজে কানা পথ চেনেনা, পরকে ডাকে বারে বার!!!
এসব দেখি কানার হাট বাজার!!!
কাদের কাছে যাবা! সবাই তো কানা!! :-Y সরকার যতদিন নিজে থেকে অন্ধ হয়ে থাকবে, তত দিন আদৌ কিছু হবে কিনা সন্দেহ। হলেও সেই দুদিন বা তিনদিন! তারপর একই গল্পের নতুন চেহারা!
মন্তব্যগুলি দেখে মুক্তমনার দীর্ঘদীনের সদস্য হিসাবে গর্বিত বোধ করছি।
পশ্চিম বাংলাতেও দার্জিলিং পার্বত্য এলাকার গুর্খারা আলাদা গোর্খালান্ডের দাবিতে বহুদিন আন্দলোন করছে। স্বতন্ত্র রাজ্য তাদের বহুদিন আগেই পাওয়া উচিত ছিল। কিন্ত “সাম্রাজ্যবাদ বিরোধি বাম বাঙালী” ক্রমাগত এখানে স্বাধীন গোর্খারাজ্যের দাবী অস্বীকার করেছে। ফলে পাহাড়ে হিংসা ছড়িয়েছে। খুবী আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে এইসব বামবাঙালী আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ চোখে দেখতে পায়, আর নিজেদের বাঙালী সাম্রাজ্যবাদ চোখে পড়ে না।
এই সব দেখে শুনে, আমি আরো দৃঢ় সিদ্ধান্তে এসেছি এই সব কমিনিউস্ট , জাতীয়তাবাদি, ধর্মিয় দলগুলি কখনোই মানবিক পথে পরিচালিত হতে পারে না। এটা ফ্যাক্ট। পৃথিবীর সব দেশেই এক ঘটনা দেখছি। তাই ভবিষ্যতের পৃথিবী গড়তে গেলে, মুক্তমনার বিজ্ঞানভিত্তিক চেতনার উন্মেষই একমাত্র মানব মুক্তির পথনির্দেশ।
এই থ্রেডে সেটা আবার প্রমাণ হল।
মার্কসবাদীদের মধ্যেও পাহাড়ী ইস্যুতে বিভিন্ন মত দেখা যাচ্ছে। মার্কসবাদের নাম করে এমন কিছু আলোচনার প্রেক্ষিতে আমাদের কিছু বক্তব্য:
চিন্তা গোষ্ঠীর বক্তব্য পইড়া তো মনে হইতাছে স্রেফ শভিনিষ্ট কইলে হইবনা এরা তো দেখি একেবারে ততকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ভাষায় কথা কইতাছে। তারাও তো সে সময় কইছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন ভারতীয় ষড়যন্ত্রের ফল।
আরে পাহাড়িরা মোটেই ভারতীয়গো পেটে হান্দায়তো চায়নাই। তারা বাংলাদেশের সাথে থাকতে চেয়েছিল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সহ।
আর তর্কের খাতিরে যদি ধইরাও নেই যে তারা ভারতীয়গো খপ্পরে পড়বো তাইলেও তো প্রতিরক্ষার হিসেবে বাড়তি কোন সমস্য দেখি না— পুরো বাংলাদেশটা তো তিনদিক দিয়াই ভারতে ঘেরা– নতুন কইরা ঘেরাও হওয়ার তো কিছু দেখি না!
আসল কথা হইল এই সব প্রতিরক্ষা/টক্ষা কিছুইনা- আপনে যেই রকম কইছেন- এই সব হইল ফ্যাসিস্ট জাতীয়তাবাদের অযুহাত।
@দিনমজুর,
আপনার মন্তব্যগুলো সম্ভবতঃ অন্য কোন ব্লগ থেকে কাট এন্ড পেস্ট করা। এই লেখার সাথে “চিন্তা গোষ্ঠীর বক্তব্য পইড়া তো মনে হইতাছে স্রেফ শভিনিষ্ট কইলে হইবনা” জাতীয় উত্তরের কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনার অন্যান্য মন্তব্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকার কারণে গ্রহণ করা হলেও এই মন্তব্যটিতে প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনাকে অনুরোধ করা হচ্ছে লেখা বা আলোচনার সাথে প্রাসঙ্গিক বক্তব্যই শুধু পাঠাতে। অন্য ব্লগ থেকে টুকরো টুকরো লেখা তুলে না দিয়ে বরং মুক্তমনায় আলোচনায় অংশ নিন।
কিছু প্রশ্ন ও জবাব/ তর্ক-বিতর্ক-আলোচনা:
১। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গাগুলোতে যে উপজাতিরা আছে, তাদের জন্য কি কোন আলাদা ভূমি ব্যবস্থা আছে? তাদের ওখানে কি বাঙ্গালীরা গিয়ে থাকতে পারে?
==>> কোথাও আদিবাসীদের ভূমি দখলদার হাত থেকে নিরাপদ নয়। বাস্তবে দখল দারের হাত থেকে কোন দুর্বলের জমিই নিরাপদ নয়। আদিবাসীসহ সংখালঘুরা তুলনামূলক ভাবে বেশি দুর্বল বলেই তাদের উপর দখলদ্বারিত্বটা বেশি হয়। আপনার “উপজাতি” শব্দের ব্যাবহারটা প্রবলেমেটিক। তাদেরকে কেন “উপ” মনে হচ্ছে, পুরো জাতি নয় কেন তারা? হালুয়াঘাট বলেন, মধুপুর বলেন, দিনাজপুর বলেন সবগায়তেই আদিবাসীদের ভূমির জন্য বিশেষ ব্যাবস্থা থাকার প্রয়োজন থাকলেও, যেহেতু তারা যুগ যুগ ধরে তাদের বসবাস করা জমিতে কোন ব্যাক্তিমালিকানা পদ্ধতি চালু করার পক্ষপাতি ছিল না, ফলে তাদের জামির কোন দলিল পত্রও হয় নি, বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের অধিকারও নিশ্চিত হয়নি(এ বিষয়টা নিয়েও আদিবাসীদের মধ্যে আন্দোলন রয়েছে যেমন: মধুপুরের ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলন, আমরা এ আন্দোলনও সমর্থন করি)। ভূমিকামিশনের কাজ ছিল এই ভূমি মালিকানার দলিল তৈরী করা।
আমার আপনার বাপ দাদার জমিতে কি অন্য কাউকে থাকতে দিতে রাজী হবো আমরা?
২। পশ্চিম পাকিস্তানের আমলে কি পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষেরা স্বায়ত্তশাসন দাবী করেছিল, নাকি বাংলাদেশ হবার পরে? তবে সংবিধানে তাদের উপজাতিদের জাতিসত্তা স্বীকার করা দরকার ছিল, যেমন স্বীকার করা হয়েছে চার ধর্মকে।
===>>>> লেখাটিতে তো বলেইছি যে পশ্চিম পাকিস্তান হওয়ার সময়ই তারা পূর্ব-পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হতে চায় নি। ১৯৪৭ সালের আগে থেকেই তারা আসাম-মিজোরাম-ত্রিপুরা কিংবা বার্মার আদিবাসীদের সাথে থাকতে চেয়েছিল। সংবিধানে আপনার ভাষায় “উপজাতি জাতিসত্তা” নয় বরং তাদের “জাতিসত্তা”র স্বীকৃত দেয়ার প্রয়োজন ছিল( এবং এখনও আছে)
৩। আমি যতদূর জানি বাংলাদেশের সব জমির মালিক সরকার, যাদের ব্যক্তিমালিকানায় জমি আছে তাদেরকে বাৎসরিক খাজনা দিতে হয় এবং কোন জনউন্নয়ন কাজে চাহিবামাত্র সরকার ওইসব জায়গা দখল নিতে পারে ক্ষতিপূরণ দিয়ে। ১৯৫০ সালের আগে জমিদারপ্রথা থাকাকালীন অবস্থায় জমিদারদের কাছে খাজনা দিতে হতো। পরে সেটা বিলুপ্ত হয়ে সরকার সকল জমি অধিগহণ করে, সে আইনে কি পার্বত্য চট্টগ্রামের জায়গাগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল না? তারা কি তাদের রাজাকে খাজনা দেয়?
====>>>> ১৯০০ সাল থেকেই চিটাগাং হিলট্র্যাক্টস ম্যানুয়ালের রুল ৩৪ এর মাধ্যমে বহিরাগতদেরকে পার্বত্যচট্টগ্রামে জমি কেনা তো দূরের কথা বসবাসও নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৯ এ জিয়ার আমলে এই ধারাটি রদ করা হয় এবং বহিরাগতদের পার্বত্যচট্টগ্রামে পাঠানো শুরূ হয়। তারা ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকেই সার্কেল চিফ এর মাধ্যমে দখলদারকে খাজনা দিয়ে আসছে।
৪। আমরা বাঙ্গালীরা যেমন এক জেলা থেকে অন্য জেলাতে গিয়েও জমি কিনতে পারি, তদ্রূপ কি পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা অন্য জেলাতে জমি কিনতে পারে না?
===>>> ৪। জমি কেনার ব্যাপারটা নির্ভর করে যে জায়গার জামি আপনি কিনতে চাচ্ছেন সে জায়গায় জমি কেনা বেচার ব্যাপারটি চালু আছে কি-না এবং যার কাছ থেকে জমি কিনতে চাচ্ছেন সে বিক্রি করতে রাজী আছে কি-না। পাহাড়িরা যেহেতু মার্জিনালাইজড বা প্রান্তিকীকৃত সেকারণে আরো মারজানিলাইজড হওয়া(আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের মত)তারা তাদের অঞ্চলে অন্যকোন জাতিসত্তার উপস্থিতি চাইছে না।
৫। আর জনবহুল এ দেশে সব জায়গাতেই তো জমির তুলনায় জনসংখ্যার চাপ বেশী, ঘনত্ব বেশী, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করে হাইলাইট করা কেন? সরকারী খাদ্যব্যবস্থা কি সেখানে চালু নেই? তারা কি শুধু জুম চাষ করেই তাদের খাবার চাহিদা মেটাতে পারে? মানে, তারা কি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ?
===>>>> পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করে হাইলাট করা কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর খাস জমির কথা বলে আসলে জমির মালিকদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদ করে উদ্বাস্তু বানানো হয়েছে।
সরকারী খাদ্যব্যবস্থা সেখানে চালু আছে কিন্ত পাহাড়িদের জন্য নয়(পাহাড়িদের মাঝে মাঝে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয় ক্ষতিপূরণের জন্য যেমন এখন বাঘাইছড়ির বেলায় দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরাকার)- মিলিটারি এবং বাঙ্গালি সেটলারদেরকে রেশন দেয়ার জন্য।
তারা একসময় জুম চাষ করেই তাদের প্রয়োজন মেটাতো পারতো। কিন্তু রাজনৈতিক অভিবাসনের মাধ্যমে তাদের জমি দখল করে নেয়ার ফলে তাদের নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর মতো প্রয়োজনীয় জমি-জমা আর তাদের নেই।
বাঘাইছড়ি হত্যাযজ্ঞ: পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব নাকি শাসক শ্রেণীর ঔপনিবেশিক আধিপত্য?
২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ৯:১৫
লিংক: http://www.somewhereinblog.net/blog/dinmojurblog/29104837
“গভীর রাতে ৫০ জনের মতো আর্মি এসে গ্রামের সমস্ত মানুষকে একজায়গায় জড়ো করলো। ভোর নাগাদ সবাই গ্রেফতার। আমাকে উলংগ করে হাত পা বেধে রাখা হলো। আমাকে তারা ধর্ষণ করলো। সেখানে আরো তিনজন নারী ছিল। সবার সামনে এমনকি আমার শ্বশুরের সামনে আমাকে ধর্ষণ করলো। আমার চোখের সামনে বাকি তিনজন নারীকেও ধর্ষণ করলো তারা।”
একজন ধর্ষিতা নারীর দেয়া এই বর্ণনাটি আমাদের ১৯৭১ সালের নয় মাস ধরে চলা পাক-হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা মনে করিয়ে দিলেও এই ঘটনাটি কিন্তু ১৯৭১ সালের নয়, পশ্চিম তীর কিংবা গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের উপর চলা ইসরাইলি আগ্রাসনের বর্ণনাও এটি নয় কিংবা আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের উপর চলা আগ্রাসনও এটি নয়, ঘটনাটি স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের, যার ফলস্রুতিতে সে সময় ৫৬ হাজার পাহাড়ি উদ্বাস্তু হিসেবে ত্রিপুরা পালিয়ে যায়। (সূত্র: ’জীবন আমাদের নয়’:পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন-১৯৯১)
এই ঘটনার আগে-পরে বিভিন্ন সময়েই গণ-হত্যা, খুন, ধর্ষন, লুটপাট, জামি দখল, মন্দির ভাংচুর ইত্যদি এরকম আরো ঘটনা ঘটেছে যেমন: কাউখালি(১৯৮০), মাটি রাঙ্গা(১৯৮১), লংগাদু(১৯৮৯ ও ১৯৯২), দিঘীনালা(১৯৮৬), পানছড়ি(১৯৮৬ ও ১৯৮৯), মিতিঙ্গাছড়ি(১৯৯১), বেতছড়ি(১৯৯০), লোগাং(১৯৯২), নানিয়ারচর(১৯৯৩), বাবুছড়া(১৯৯৯) ইত্যদি স্থানে ধারাবাহিক ভাবেই এ ধরনের আগ্রাসন ঘটিয়ে চলেছে বাংলাদেশের বাঙ্গালি বুর্জোয়া শাসক গোষ্ঠী তাদের ঔপনিবেশিক আধিপত্য জারি রাখার জন্য; গত ১৯-২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঘটা বাঘাইছড়ি হত্যাকান্ড এর সর্বশেষ নজির। আমাদের মনে রাখা দরকার এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়-পাহাড়ি আদিবাসীদের ভূমি দখল করার জন্যই এই ঘটনা ঘটিয়েছে শাসক গোষ্ঠী। সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় বাঙ্গালি সেটলারকর্তৃক আদিবাসীদের ভূমি-সম্পত্তি দখলকে কেন্দ্র করেই এই ঘটনাটি ঘটেছে।
বাঘাইছড়ির ঘটনার প্রেক্ষিত
নতুন করে ভূমি দখলের বিরুদ্ধে বাঘাইহাটের রেতকাবা গ্রামের অধিবাসীরা সাজেক ভূমি রক্ষা সমিতির ব্যানারে এর আগে গত ১০ জানুয়ারিতে বাঘাইছড়ির ইউএনও’র কাছে একটি স্মারক লিপি প্রেরণ করেন। স্মারক লিপিতে তারা ১৬ জানুয়ারির মধ্যে নতুন করে ভূমি দখল বন্ধ এবং ইতোমধ্যে দখলকৃত সকল ভূমি ফিরিয়ে দেয়ার আলটিমেটাম দেয়। কিন্ত এতে কোন ফলাফল না হওয়ায় তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং বাঘাইহাট বাজার বর্জন কর্মসূচীও পালন করেন। এই বয়কট কর্মসূচীর জন্য সেনা সদস্যরা ২১ জানুয়ারি সেখানে ৮ জন আদিবাসীকে পিটিয়ে আহত করে। এরপর ২৩ জানুয়ারিতে সাজেক নারী সমাজ দিনব্যাপী দীঘিনালা-বাঘাইছড়ি এবং বাঘাইছড়ি-দীঘিনালা সড়ক অবরোধ কর্মসূচী পালন করেন এবং সেখানেও বাঙ্গালি সেটলারদের হামলায় ১৬ জন আহত হয়।(সূত্র: ডেইলিস্টার, ২১ ফেব্রুয়ারি)
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তারিখে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তি অনুসারে আদিবাসীদেরকে তাদের হারানো ভূমি ফিরিয়ে দেয়ার কাজটি তো হচ্ছেই না উল্টো বরং নতুন করে সামাজিক বনায়ন, রাবার বাগান, বনের কাঠ আহরণ, বসতি স্থাপন ইত্যাদি নানান অযুহাতে আদিবাসীদের ভূমি দখল চলছেই। আর এটাকে কেন্দ্র করে শান্তিচুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ১১ বার আদিবাসীদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। ১৯৯৯ সালের ৪ এপ্রিল বাঘাইহাটে এবং ১৬ অক্টোবর বাবুছড়ায়, ২০০১ সালের ১৮ই মে বোয়ালখালী ও মেরুং এবং ২৫শে জুন রামগড়ে, ২০০২ সালের ১০ অক্টোবর রাজভিলায়, ২০০৩ সালের ১৯ এপ্রিল ভূয়াছড়ায় এবং ২৬ আগষ্ট মহালছড়িতে, ২০০৬ সালের ৩ এপ্রিল মাইসছড়িতে এবং ২০০৮ সালের ২০ এপ্রিলের হামলার ঘটনায় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুসারে নিহত হয়েছেন ৭ জন পাহাড়ি, নিখোঁজ হয়েছেন ৪ জন, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৬ আদিবাসী নারী এবং ঘরবাড়ি পুড়েছে ৮০০রও বেশি।(সূত্র: কালের কন্ঠ, ২০ ফেব্রুয়ারি)
এই রকম একটা পরিস্থিতিতে গঙ্গারাম মুখে যখন বাঙ্গালি সেটলারদের দিয়ে নতুন করে বসতি স্থাপন করার পায়তারা করা হয় তখন পাহাড়িদের প্রতিরোধের মুখে তারা ২০ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাতে আদিবাসীদের ৪০ টি ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং পরিদিন শনিবার সকালে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতেই গুচ্ছগ্রাম, গঙ্গারামমুখ, হাজাছড়া, সীমানাছড়া,রেতকাবা, জারুলছড়ি, দ্বিপপাড়া, ডানে ভাইয়াছড়া, বামে ভাইয়াছড়া, এমএসএফ পাড়া এবং পূর্বপাড়ার মোট ১৬০টি ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এ ঘটনার সময় মন্দির, চার্চ এবং স্কুল পোড়ানোর ঘটনাও ঘটেছে।(সূত্র: ডেইলিস্টার, ২১ ফেব্রুয়ারি)
দখলের ইতিহাস
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক লেখালেখিতে এবং গণ-মাধ্যমের খবরাখবর থেকে মনে হতে পারে পার্বত্য-চট্টগ্রামের সংকটের জন্য বুঝি বাঙ্গালি-পাহাড়ির জাতিগত বা সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বই দায়ী। বস্তুত শাসক শ্রেণীর মতাদর্শ প্রসুত এ ধারণাটি পার্বত্য সংকটের প্রকৃত কারণ হিসেবে পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ, বনজসম্পদ এবং ভূমি দখলের পুজিবাদি খায়েসটিকে আড়াল করে ফেলে। আড়ালটুকু সরানোর জন্য একটু পেছন ফিরে তাকানো দরকার। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময়, বাংলাদেশকে যেমন পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে জোর করে জুড়ে দেয়া হয়েছিল, একই ভাবে চট্টগ্রাম বন্দর সহ পার্বত্য চট্টগ্রামকেও জোর করেই কলকতা বন্দর হারানোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছিল। জাতিস্বত্তাগত ঐক্যের জায়গা থেকেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠি পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে বরং আসাম, নাগাল্যান্ড,মিজোরাম ইত্যদি পাহাড়ি অঞ্চলের সাথে ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের সাথে কিংবা কেউ কেউ বার্মা ইউনিয়নের সাথে যুক্ত থাকতে চেয়েছিল। তারপরও পাকিস্তান পর্যায়ে তারা পূর্বপাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে স্বাভাবিক ভাবেই সেটা বাঙালি জাতীয়তাবাদের বশ্যতা স্বীকার করে নয়। যেকারণে বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার পর আদিবাসীদের নেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা শেখমুজিবর রহমানের কাছে গিয়েছিলেন সহাবস্থানের শর্ত হিসেবে পার্বত্যঅঞ্চলের স্বায়ত্বশাসন, সংবিধানে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম আইনের স্বীকৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অ-পাহাড়িদের অনুপ্রবেশ রোধের নিশ্চয়তা ইত্যদি দাবী নিয়ে। কিন্ত শাসক শ্রেণী বোধহয় চিরকালই ভুলে যায় যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পারস্পরিক সহাবস্থানের প্রথম এবং প্রধান শর্ত হচ্ছে বিচ্ছিন্নতার অধিকার বা স্বায়ত্বশাসন এবং সমঅধিকার। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে শেখ মুজিব বাঙ্গালি জাতির যেসব অধিকার আদায়ের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, পাহাড়িদের সেই অধিকারগুলোরই স্বীকৃতি দেয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করলেন না, উল্টো বাঙ্গালি হওয়ার আহবান জানিয়ে এবং বাঙ্গালি মুসলমান পাঠিয়ে পাহাড়ি অঞ্চল দখল করে নেয়ার হুমকী দিয়ে তাদের দিকে স্মারক লিপিটা ছুড়ে মেরেছিলেন। তখন থেকেই সংঘাতের শুরু।[শেখ মুজিবর রহমানের সাথে মানবেন্দ্রর স্বাক্ষাতের ঘটনাটি বর্ণানর পর লেখা হয়েছে “তখন থেকেই সংঘাতের শুরু।” এই কথাটির একটু ব্যাখ্যা করার দরকার রয়েছে। কারণ এইটুকু পড়ে মনে হতে পারে সব সমস্যার শুরু বোধ হয় এইখান থেকে! আসলে এই পর্যায়টিকে আদিবাসীদের আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক প্রতিরোধের শুরুর বিন্দু বলা যায়। তাদের বঞ্চনার অনুভূতির সূচনা বিন্দু আরো আগে থেকে। ব্রিটিশ আমলে খাজনা শোষন ছিল। কিন্তু অন্তত ভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হয়নি তখণও। ভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদ শুরূ হয় পাকিস্তান আমলে-
১) ১৯৫৩ সালে ততকালীন পাকিস্তান সরকার বিশ্বব্যাংকের ঋনের টাকায় চন্দ্রঘোনায় একটি কাগজের কল স্থাপন করে। এই কারখানাটা স্থাপন করতে গিয়ে ঐ এলাকার আদিবসী মারমাদের সর্ম্পূর্ণ উচ্ছেদ করা হলেও কারখানায় যে দশহাজার কর্মসংস্থান হয় তাতে তাদের অংশ ছিল নিম্ন শ্রেনীর কর্মচারী হিসেবে মাত্র ১০-২০ জন।
২) ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার রাঙ্গামাটির কাপতাইয়ে একটি জলবিদ্যূত কেন্দ্র নির্মান করে যার জলাধারের আকার ৫৫০ বর্গমাইল। এই জলাধারের কারণে কর্ণফুলি অববাহিকার প্রায় সমস্ত উর্বর জমি এবং চেঙ্গি, ফেনী ও মাইনি নদী অববাহিকার অধিকাংশ উর্বর জামি প্লাবিত হয়ে যায় যার পরিমাণ ৫৪ হাজার একর(পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আবাদি জমির ৪০%)। উচ্ছেদ হয় ১ লক্ষ আদিবাসী।
বিশেষ করে এই কাপ্তাইয়ের ঘটনাটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠির মধ্যে বঞ্চনার যে দাগ কেটে ছিল সেটা বাংলাদেশ আমলে এসে হালকা হওয়ার বদলে উল্টো গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে।]
শেখ মুজিবর রহমানের দেয়া এই হুমকীটি পুরোদমে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৭৯ সাল থেকে জিয়ার রহমানের শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিষদের মাধ্যমে। আর এ কাজে ব্যাবহার করা হয় গরীব উদ্বাস্তু বাঙালিদেরকে- কি চমৎকার কাটা দিয়ে কাটা তোলার ব্যাবস্থা! পরিবার পিছু পাঁচ একর জমি, ৩,৬০০ টাকা নগদ অর্থ সাহায্য এবং প্রথম কয়েকমাস রেশনের লোভ দেখিয়ে তাদেরকে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে ঠেলে দেয়া হয়- কাপ্তাই, রাঙামাটি, লামা, বান্দারবান, নাইক্ষংছরি এলাকাতে ১৯৮০ সালের শেষ নাগাদ এভাবে মোট ২৫,০০০ পরিবারকে পাঠানো হয়। ১৯৮০ সালের অগাষ্ট মাস থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের অভিবাসন শুরু হয়- এইবার প্রতিশ্রুতি হলো পরিবার পিছু ২.৫ কাঠা সমতল ভূমি, ৪ কাঠা সমতল-পাহাড়ি মিশ্র ভূমি অথবা ৫ একর পাহাড়ি ভূমি, এককালীন ৭০০ টাকা এবং পরিবর্তীতে পাঁচ মাস পর্যন্ত মাসিক ২০০ টাকা এবং প্রথম ছয় মাস পরিবার প্রতি ১২ কেজি করে গম। একই ভাবে তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৯৮২ সালের জুলাই মাস থেকে। এবং সব মিলিয়ে ১৯৮৪ সালের শেষ নাগাদ মোট ৪ লক্ষ গরীব বাঙ্গালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ভূমিহীন বাঙ্গালিদের জন্য বিষয়টা ভালো মনে হলেও আখেরে ইতিমধ্যেই ভূমি সংকটে ভুগতে থাকা পার্বত্য অঞ্চলে এই বিশাল সংখ্যক মানুষের রাজনৈতিক অভিবাসন পাহাড়ি-বাঙ্গালি কারো জন্যেই সুফল বয়ে আনেনি। সরকার যেটাকে বাড়তি খাসজমি হিসেবে গরীব বাঙ্গালিদের মাঝে বিলিবন্টন করে, সেটা ছিল যুগ যুগ ধরে পাহাড়ি জনগোষ্ঠির যৌথ সম্পত্তি; সম্পত্তির কোন ব্যাক্তি মালিকানা তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল না, ফলে কোন ধরনের দলিল পত্র ছাড়াই তারা ভাগযোগ করে জুম চাষ করে আসছিল। বাস্তবে পাহাড়ি জমির ধরন এবং জুম চাষের প্রকৃতি যদি হিসেব করি তাহলে সেখানে ৪ লক্ষ বাঙ্গালির মাঝে বিলিবণ্টন করার মতো কোন বাড়তি জমিই ছিলনা। জুম চাষ করার সময় যেহেতু পাহাড়ি জামিকে ন্যূনতম পাঁচ বছর ফেলে রাখতে হয় হারানো উর্বরতা ফিরে পাওয়ার জন্য, সেকারণে দেখা যায় প্রতি বর্গ কি.মি পাহাড়ি জমি ২৫ থেকে ৫০ জন মানুষের খাদ্য উৎপাদন করা যায়। অথচ বাঙ্গালি অভিবাসনের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৮৮ সাল নাগাদ প্রতি বর্গকিমি এ জনসংখ্যা দাড়ায় ১৪০ করে। ফলে অতিরিক্ত ৪ লক্ষ বাঙ্গালিকে পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমির জন্য ১ লক্ষ পাহাড়িকে তাদের ভূমি থেকে উৎখাত করা হলেও, বন-জঙ্গল কেটে সাফ করা হলেও সেই গরীব বাঙ্গালিদেরকে প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ৫ একর করে চাষ উপযোগী জমি দেয়া যায়নি কেননা তখন মাথা পিছু মোটামুটি আবাদ যোগ্য জমির পরিমান দাড়ায় ৩.৭ একর থেকে ৪.৬৩ একর করে!
(সূত্র: আমেনা মহসিন ,চিটাগাঙ হিল ট্র্যাক্টস: লাইফ এন্ড নেচার অ্যাট রিস্ক-জুলাই, ২০০০)
যাপন নয় উদযাপন
পুরোপুরি পরিকল্পিত এই বাঙ্গালি অভিবাসন বা সেটেলমেন্ট প্রকল্পের ফলে ১৯৫৯ সালে যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালি ছিল মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯.৬১ শতাংশ, সেখানে ১৯৮১ সালে হলো ৪০.৮৩ শতাংশ এবং ১৯৯১ সালে দাড়ালো ৪৮.৬৬ শতাংশে। হঠাৎ করে বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালির এই কৃত্রিম অভিবাসনের ফলে পুরো পার্বত্য অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক চেহারা পাল্টে গেল। অফিস আদালতসহ বিভিন্ন প্রাশাসনিক কাজ থেকে শুরু করে পাড়া মহল্লার নাম ধাম পর্যন্ত বাংলা ভাষার দখলে চলে গেল। খাগড়াপুর হয়ে গেল ইসলামপুর, কানোনগো পাড়া হয়ে গেল মহম্মদ পুর, উদ্দাছড়ি হলো রসুলপুর, পা-ওঙ কাবারি পারা হলো ফাতেমানগর ইত্যাদি। নামকরনে ধর্মের প্রভাবটি লক্ষণীয়। ১৯৭১ সালে খাগড়াছড়িতে মসজিদ ছিল মোটে ১ টি, ১৯৮২ সালে হলো ৫ টি এবং ২০০০ সাল নাগাদ এসে হলো মোট ২০টি। (সূত্র:জোবায়দা নাসরিন, পলিটিকস অব ডেভেলাপমেন্ট: পাহাড়ি বাঙ্গালি ডিসকোর্স ইন দ্য চিটাগাং হিলট্র্যাক্টস)পাহাড়ি ভূমির চাষাবাদ পদ্ধতিও পাল্টে দেয়ার চেষ্টা হতে লাগলো। পাহাড় কাটা, বন ধবংস, রাবার চাষ ইত্যাদির ফলাফল স্বরূপ ভূমিক্ষয় ও ভূমি ধ্বস বেড়ে গেলে জুমচাষকে দায়ী করে যে পার্বত্য উন্নয়ন পরিষদের মাধ্যমে বাঙালি অভিবাসন কার্যক্রম চালানো হয়েছিল, সেই পরিষদের মাধ্যমেই হাতে নেয়া হলো ”লাঙ্গল চাষ কর্মসূচী”, ইউএসএইডের অর্থসাহায্যে চালানো হলো ”জঙ্গল পরিস্কার” কর্মসূচী যার সবই ভূমি ও পরিবেশের ধবংস ত্বরান্বিত করেছে। নিরাপত্তার নামে আদিবাসীদের জমি দখল করে তৈরী করা হয়েছে ক্যান্টমেন্ট ও আর্মি ক্যাম্প। আর আদিবাসীদের প্রয়োজনের চেয়ে এই সব আর্মি ক্যাম্পের ষ্ট্রাটেজিক গুরুত্বের কথা মাথায় রেখেই তৈরী হয়েছে রাস্তাঘাট।
এভাবে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচীর মাধ্যমে আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতি ধ্বংসের পর আবার সেই ধবংসপ্রায় সংস্কৃতিকে নিয়ে শুরু হলো আরেক তামাশা। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিষদের আওতায় দাড় করানো হলো ”উপজাতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র” যার কাজ হলো আদিবাসী নাচ-গান, এসবের অনুষঙ্গ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি জাদুঘরে সংরক্ষণ। এভাবে আদিবাসী সংস্কৃতি যাপনের বদলে হয়ে উঠলো উদযাপনের বিষয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটনের মূল আকর্ষণ এক বিক্রয় যোগ্য পণ্য।
শাসক শ্রেণীর খায়েস এবং দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পুঁজিতান্ত্রিক শোষণের খায়েশ তাকে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন ধরনের এবং বাড়তি একটা দ্বন্দ্বের মুখে ঠেলে দেয়। একদিকে উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল পুজির শোষনের সুবিধার জন্য আদিবাসীদের সমস্ত পাহাড়-জমি, বনজ সম্পদ ইত্যদির ঐতিহ্যগত যৌথ মালিকানা ও ব্যাবস্থাপনা থেকে মুক্ত করে এগুলোর পণ্যায়ন বা কমোডোফিকেশানের প্রয়োজনীয়তা ( জমি-বন বেচা কেনা করার জন্য দখল, রাবার বাগান, তামাক চাষ, হর্টিকালচার, যোগাযোগ খাত ইত্যদিতে দেশী-বিদেশী উৎপাদনশীল/অনুৎপাদনশীল পুঁজি বিনিয়োগের জন্য) অন্যদিকে এসব করতে গিয়ে আদিবাসীদের প্রতিরোধের মুখে সামরিক আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ফলাফলস্বরূপ পরোক্ষভাবে উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল পুজির অবাধ চলাচলে বাধা তৈরী করা(পুঁজি চলাচলের জন্য বাধা তৈরী করলেও সামরিক-বেসামরিক আমলতন্ত্রের জন্য এ সামরিকীকরণ আবার নানান সুযোগ-সুবিধার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়, ফলে এ ব্যাবস্থার সুবিধা ভোগী গোষ্ঠী এই সামরিকীকরণ বজায় রাখার পক্ষপাতি প্রেসারগ্রুপ হিসেবে আবির্ভূত হয়)। অর্থাৎ পুজির শোষনের সুবিধার জন্য সব বাধা দূর করতে গিয়ে প্রতিরোধের মুখে পড়ে আবার নতুন ধরনের বাধা তৈরী করে বসেছে শাসক শ্রেণী। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও শাসক শ্রেণী উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল পুঁজির শোষনের জাল বিস্তার করতে গিয়ে নানান প্রতিরোধ ও দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হচ্ছে কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি ব্যাবস্থাপনার বিশেষ রূপ, নিজস্ব প্রথা, সংস্কৃতি এবং শাসক-শ্রেণীর জাতীয়তা থেকে ভিন্ন ধরনের জাতিস্বত্তার পূর্ব-অস্তিত্বের কারণে শাসক শ্রেণী আদিবাসীদের জুম্ম জাতীয়তাবাদের প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। পুঁজির এই দ্বিমুখী সংকটের বিষয়টি মাথায় রাখলে শাসক শ্রেণীর মধ্যে শান্তি-চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান অথবা পার্বত্য চট্ট্রগ্রাম থেকে সেনা-দখলদ্বারিত্ব প্রত্যাহার করা না করা ইত্যদি নিয়ে একদিকে পরস্পর বিপরীত মুখী অবস্থান অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকটের প্রকৃত সমাধানের জন্য উপযুক্ত কোন পদক্ষেপ গ্রহন না করার বিষয়ে ঐক্যমত্যের মাজেজা পরিস্কার হয়ে যায়।
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে একটা উক্তি পড়েছিলাম- Patriotism is the conviction that one’s country is superior to all the others for the sole purpose that one was born to it. ভয়ংকর এক অহংবাদী অনুভূতি বটে। জাতীয়তাবাদকে মানবতাবাদের উপর স্থান দিলে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটবে।
গত বছর লাউয়াছরা আর বান্দরবানের সীমান্তে একটা পাহাড়ী এলাকায় গিয়েছিলাম। পাহাড়ীদের জীবনযাপন ও নম্রতা দেখে খুবই মুগ্ধ হয়েছিলাম। অত্যন্ত খারাপ লেগেছিল যখন দেখলাম ওরা ধীরে ধীরে ওদের সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছে। ওদের সংস্কৃতিকে বাঙ্গালী সংস্কৃতি গ্রাস করছে, কিন্তু ওরা বাঙ্গালী হতে পারছে না। এই পাহাড়ীরা আমাদের দেশের সৌন্দর্যকে বর্ধন করতে পারত, আমাদের দেশেরই মূল্যবান সম্পদ হতে পারত। নিষ্ঠুর বাস্তবতা হল- জোর যার, মুল্লুক তার। পাকিস্তানী স্বৈরাচারীদের হটিয়ে বাঙ্গালী নিজেই স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে আমাদের পরিণতি কি হবে ভাবলে ভয় লাগে।
এক অবসরপ্রাপ্ত জার্মান আর্মির সাথে পরিচয় হয়েছিলো আমার। নাম তার আন্দ্রেস। দেখলাম দিন দুনিয়ার ভালই খবর সে রাখে। আমাদের আর্মিদের পোষাক, স্বাস্থ তাকে বেশ সন্তুষ্ট করেছিলো। পাশের দেশ মায়ানমারের আর্মিকে সে দেখেছে দুই পায়ে দু রকম জূতো পড়তে।
আমি বলেছিলাম আসলেই আমদের মত গরীব দেশের জন্য আর্মি পোষা খুব কঠিন ও অপ্রয়োজনীয় একটা ব্যাপার। একজন প্রাক্তন আর্মি হিসাবে এটা আন্দ্রেসের কাছে খুবই আপত্তিকর ভাবনা মনে হয়েছিলো। কারন ডিফেন্সের কি বিকল্প হতে পারে তা সে আমার কাছেই উল্টো জানতে চায়। আমি তাকে বলেছিলাম, আমাদের দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত আর মায়ানমার, আমরা স্বপ্নেও তাদেরকে আক্রমনের কথা ভাবতে পারিনা। তারা যদি আমাদেরকে আক্রমন করে, সেক্ষেত্রে আমাদের আর্মি আমাদেরকে রক্ষা করতে পারবেনা। এখানে মূল প্রতিরোধটা আসবে জনগনের মধ্যে থেকে। উদাহরন স্বরূ্প বললাম, ইরাকের কথা। আমেরিকার আক্রমনের সামনে ইরাকি বাহিনী কিন্তু দাড়াতেই পারেনি। কিন্তু যুদ্ধটা এখনও চলমান। জনগনই প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যায়। আমরা যেহেতু আক্রমনাত্তক নীতি ধারন করিনা ফলে আমাদের আর্মির কোন দরকার নেই। প্রতিরোধ যুদ্ধে জনগনই একমাত্র ভরসা, ফলে, স্কুল-কলেজে সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করলে সেটা প্রতিরক্ষা নিতীর জন্য অনেক বেশী কার্যকর হতে পারে।
বলাবাহুল্য যে আমি এখনো আমাদের আর্মির ক্ষেত্রে একই ধারনা পোষন করি। আর শান্তি মিশনের অর্থিক মহিমার ফলে আনুগত্যের প্রশ্নে দেশ আগে না জাতিসংঘ আগে তার একটা পরীক্ষা নেয়া গেলে আমাদেরকে হয়তো আতংকিতই হতে হবে।
ক্লাস এইটে পড়ি তখন। বন্ধু রনির সাথে মহাতর্ক, যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে। আমি রাজাকারদের রীতিমত ধুয়ে দিচ্ছি। আর রনি তার ইসলামী চেতনা থেকে তাদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ ও আমাকে বলল “পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হচ্ছে ওখানে তুমি কাকে সাপোর্ট করবে?” আমি কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, “ন্যায়-নীতি আর ন্যায্যের দিকে।”
পাহাড়ীদের ওপর বাঙালি আগ্রাসনের পরিণাম খুব খারাপ হবে। আর অত কথা কয়া কি লাভ? আমগো আর্মি কারো কথা শোনে নি? সরকারের কাছে অঢেল সু্যোগ-সুবিধে নিয়ে এরা দয়া করে সরকার চালাতে দেয়। আমাদের গনতন্ত্র এখন ব্যবসায়ী আর আর্মিদের কাছে পুরোপুরি জিম্মি।
বাঙালি হবার লজ্জায় লজ্জিত আমি। যদি পারতাম তবে বাংলাদেশের বাঙালিদের পক্ষ হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতাম পাহাড়ী মানুষ জনের কাছ থেকে। শুধু সংখ্যায় কম হবার কারণে আর কাউকে যেন কখনো অত্যাচারিত হতে না হয়।
রাজনৈতিক কারণে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে দীর্ঘদিন ধরে বাঙালি চোর গুন্ডা বদমায়েশদের পাহাড়ে বসতি গড়ানো হয়েছে। হেন কোন কুকর্ম নেই যা এই বদমায়েশরা করেনি ওইখানে। এদেরকে এবং এদের সকল কুকর্মকে পরম ভালবাসায় রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সেনাবাহিনী পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গিয়েছে। শুধু পৃষ্ঠপোষকতাই না, মাঝে মাঝে তারা নিজেরাই এই সব কুকর্মে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। আর মাশুল দিয়ে চলেছে নিরীহ পাহাড়ী জনগোষ্ঠী।
দেশ মানে শুধু মাটি, পতাকা আর সীমানা নয়। মানুষ নিয়েই আসল দেশ। সেখানেই যদি গোলমাল থাকে তবে সেই দেশ থাকলেই কী আর না থাকলেই কী। ওই রকম দেশপ্রেমের কোন মূল্যই নেই আমার কাছে। মানুষ দেশের কাছে দায়বদ্ধ না, বরং দেশই মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। যে নাগরিক তার দেশের কাছ থেকে নিরাপত্তা পায় না, নাগরিক হিসাবে সম্মান পায় না, সে কোন দুঃখে সেই দেশের কথা বলবে? সেই দেশের প্রতি ভালবাসা দেখাবে? গোল্লায় যাক না সেই দেশ।
দেশ কীরকম হওয়া উচিত সেটা নিয়ে লোপামুদ্রার অসাধারণ একটা গান আছে। সেই গানের কথার সাথে সুর মিলিয়ে বলছি, এ মানচিত্র জ্বলছে জ্বলুক, এই দাবানল পোড়াক চোখ, আমার কাছে দেশে মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক।
httpv://www.youtube.com/watch?v=7iy9EAI9fxc
মুক্ত-মনার পক্ষ থেকে বাস্তব সম্মত কিছু পসক্ষেপ নেয়ার আবেদন জানাচ্ছি।
@আকাশ মালিক,
মুক্তমনার পক্ষ থেকে কি কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে, তা নিয়ে একটু আলোচনা করুন। মুক্তমনায় এখন বিপ্লব রহমান সহ অনেকেই আছেন, যারা পাহাড়িদের সমস্যা নিয়ে কাজ করেছেন। আলোচনার মাধ্যমে পদক্ষেপের বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছুতে পারবো আশা করছি।
এ ব্যাপারে আপনি সহ অন্যান্যদের মতামত আশা করছি
ভূপেনের সেই প্রিয় গানের প্রথম লাইন দেখেই বুঝেছিলাম বিষয় কি।
কদিন ধরেই ব্লগে ব্লগে দেখছি এ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে।
অনেকের কাছেই যা শুনেছি তাতে মনে হচ্ছে বগুড়া থেকে জামাতী টাইপের কিছু বহিরাগত সন্ত্রাসী টাইপের লোকে ইচ্ছাকৃতভাবে এসব ঘটাচ্ছে। জামাতী লকের ছবিও ছাপা হয়েছে পিটঠে রামদা লুকানো অবস্থায়। সেনাবাহিনী তো তৈরী আছেই। দেশসেবার এই মোক্ষম সুযোগ কি তারা হেলায় হারাতে পারে? কাজেই যা হবার তা হচ্ছে।
নানান সূত্র থেকে শুনি কিভাবে বহিরাগতরা পাহাড়িদের বসত বাড়ির যায়গা সেনা ও প্রশাসনের মদদে দখল করে নিচ্ছে। তবে স্বাধীন গনতান্ত্রিক দেশের গর্বিত নাগরিক আমরা, তাই কোনদিন সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের কৈফিয়ত তো দূরে থাক, সমালোচনা করার অধিকারও আমরা রাখিনি। অনেক রেখে ঢেকে তাদের কথা বলতে হয়।
এর বিরুদ্ধে কথা বলবে কে? এর বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে উলটা নিজের গায়ে দেশোদ্রোহীর সিল পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। আজকাল ব্লগে ব্লগে দেখি জামাতী বদমায়েশেরা যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবীর বিরুদ্ধে যুক্তি দেখাতে গিয়ে ধূর্ত উকিলের মত প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে, আজকে পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীনতা ঘোষনা করলে তোমরা কি বলবে? তাদের স্বাধীনতাকামী বলবে নাকি বিচ্ছিন্নতাবাদী বলবে?
ইরতিয়াশাদ ভাই এর মত আমারো খুব ছোটবেলা চট্টগ্রামে কেটেছে। কক্সবাজার, কাপ্তাই রাঙ্গামাটির লোকজনের সাথে গভীড় যোগাযোগ ছিল তখন। তখন খুব ছোট হলেও বুঝতে পারি যে তারা আসলে এতই সরল যে বেশীরভাগ লোকে দেশের সংজ্ঞা, বিচ্ছিন্নতাবাদ এসব তত্ত্বীয় কথাবার্তার মানেও মনে হয় বোঝে না।
কল্পনা চাকমার অপহরনকারীদের বাচাতে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র কাজ করেছে, তেমন কাজ করেছে আলফ্রেড সোরেনের হত্যাকারীদের বাচাতেও। এই সরকারও তেমন কিছু করতে পারবে এমন ভরসা হয় না। না হয় ক্রশফায়ারের বিরুদ্ধে এর বড় বড় কথা বিরোধী দলে থাকতে বলতে পারলে ক্ষমতায় গিয়ে ক্রশফায়ারের গুনগানই বা গাইতে হয় কাদের চাপে?
মনে কর পৃথিবী সীমানা বিহীন
এ খুব কঠিন নয়, নয়কো অর্থহীন।
তখন, যুদ্ধের কোন দরকার নেই,
ধর্মের কোন স্থান নেই…
শুধু সবাই একসাথে
শান্তিতে বেঁচে থাকা……।
তুমি বলবে আমি স্বপ্নবাজ,
কিন্তু আমি একা নই আজ।
হয়তো একদিন তুমি আমায় বুঝবে,
আমার মত করে স্বপ্নটা খুঁজবে।
সেদিনই পৃথিবীটা বদলে যাবে……!- জন লেনন (ইমাজিন)
আর কিছুই বলার নাই………..
ধন্যবাদ অভিদা আপনার পোস্টের জন্য। গতকয়েকদিন ধরে খুব খারাপ লাগছে, এই কয়েকদিন আগেইই বান্দরবন থেকে ঘুরে এসেছি। মানুষগুলো এতো অসহায়, এতো অসহায় আর আজকে তাদের উপরই এমন আগ্রাসনের খবর শুনে কী করবো বুঝে উঠতে পারিনা।
আমরা পাহাড়ে আর নিশিথ রাতের পদধ্বনি শুনতে চাই না । চাই ভোর। নতুন সকাল।
অভিজিৎ লিহেছেন —
অথচ বি এন পি ইতোমধ্যে পাহাড়ে আবারো সেনা মোতায়েনের দাবী জানিয়েছে যা কোন মতেই কাম্য নয়।
আমরা এ নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা সাপেক্ষে সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে সুষ্ঠ তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি চাই।
পাহাড়ে আর একটি প্রাণও যাতে না ঝরে এর নিশ্চয়তা চাই।
ভূমি নিয়ে ধারাবাহিকতাভাবে পরিস্থিতির ক্রমানুবতী ঘটছে, অথচ ভূমি কমিশন অকার্যকর। ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়া একান্ত জরূরী। এ বিষয়ে সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপের দাবি করছি।
দাবি করছি ২০ ফেব্রুয়ারিতে ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্য, চিকিৎসাসহ পুনর্বাসনের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্যে।
এ নিয়ে মুক্ত-মনা বাস্তব সম্মত কিছু পসক্ষেপ নিতে পারে।
@গীতা দাস,
কি পদক্ষেপ নেয়া যায় একটু সাজেশন দিন, গীতাদি।
আজ আমি ক্ষমা চাই অমিত চাকমার কাছে, যাঁকে আমরা সুযোগ পেলেই গর্বের সাথে বাংলাদেশী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিই। তাঁর আত্নীয়-বন্ধুরা তাঁর প্রিয় জন্মভূমিতে কেমন আছেন? ভাল থাকার তো কথা নয়। আমরা যেমন ছিলাম না, একাত্তরের নয় মাসে আমাদের মাতৃভূমিতে।
মনে পড়ছে আমার আরাকানিজ বন্ধু মং-এর কথা। বাংলাদেশী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার মাঝে গৌরবের কিছু খুঁজে পায় না মং। ঠিক যেমন আমরা পেতাম না নিজেদের পাকিস্তানী হিসেবে পরিচয় দিতে, একাত্তরের আগে। আজ আমি ক্ষমা চাই তাঁর কাছেও।
বাঙ্গালী হিসেবে আমি আজ লজ্জিত।
অভিজিৎকে ধন্যবাদ এই বিষয়ে লেখার জন্য।
এই মন্তব্যের মাধ্যমে প্রগতিশীল বাংলাদেশীদের আহবান জানাই – চাকমা জনগণের পাশে দাঁড়ান। প্রতিবাদে সোচ্চার হোন, সরকারের/সামরিক বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে।
ছোটবেলায় চাকমা এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের উপজাতীয় সংস্কৃতি খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শোনা গান আমার কানে এখনো বাজে। ইউটিউব থেকে দু’টো তুলে দিলাম মুক্তমনার পাঠকদের জন্য। চাকমা জনগণের জন্য সহানুভূতি আর শুভকামনা রইলো।
httpv://www.youtube.com/watch?v=iCp6UBDcxMc&feature=related
httpv://www.youtube.com/watch?v=CknxyLaV0UM&feature=related
@ইরতিশাদ ভাই,
শুধু চাকমা কেন? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় চাকমারা সবার তুলনায় মোটামুটি ভালো অবস্থানে আছে। বরঞ্চ ম্রো, মারমা, ত্রিপুরা +++++++++ এদের অবস্থা শোচনীয়।
@রায়হান আবীর,
না, শুধু চাকমারা কেন, আমি সব উপজাতীয় আর আদিবাসী গোষ্ঠীর কথা বোঝাতে চেয়েছি। ম্রো, মারমা, ত্রিপুরা তো আছেই, সাঁওতাল গারোরাও নির্যাতিত।
@ইরতিশাদ,
অনেক ধন্যবাদ ইরতিশাদ ভাই, চমৎকার মন্তব্যের জন্য, এবং দারুন ভিডিও গুলোর জন্য।
অভিজিৎ দা,
শব্দটা গায়ের না (গাঁয়ের) ?
@আকাশ মালিক,
অবশ্যই গাঁয়ের। একটু আগেই তো গায়ের মুছে গাঁয়ের করলাম। তারপর দেখি আপনার কমেন্ট।
ধন্যবাদ আপনার নজরেও ব্যাপারটা পড়েছিলো বলে।
আমরা কত আবেগ নিয়ে নিজের ভাষার জয়গান গাই, ‘একুশে’ পালন করি, নিজেদের স্বাধীনতা নিয়ে আত্মহারা হয়ে উঠি। অথচ আবার নিজের দেশেই পাহাড়ি জনগনের উপর ‘৭১ এর পাকিদের মত এমনকি রাজাকারদের মত ব্যবহার করতে পিছপা হই না। জাতীয়তাবাদের কি এক অপূর্ব নমুনা!!! এতটুকু একটা দেশ, এত কম বৈচিত্র আমাদের জনংখ্যায়, তারপরও যেখানেই সুযোগ পাই সেখানেই সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার চালাতে একটুও দ্বিধা করি না……