(মন চাইছিল, আরো কিছু লিখি। তাই দিয়ে দিলাম)
শেষের শুরু———-
(গুলি বর্ষনের অংশটুকু দিয়ে লেখাটা শেষ দিয়েছিলাম। তাই শুরুটাও ওখান থেকেই হোক……… )
আগের নিবন্ধটুকু: একুশের দিন
তিনজন শহীদ ছাত্রের নাম হল আবুল বরকত, জব্বার আর রফিক উদ্দিন। চতুর্থ জন শহীদ সালাম ছিলেন বাদামতলীর এক প্রেসের কর্মচারী। এছাড়া আরো কিছু লাশ পুলিশ নিয়ে যায়, যাদের পরিচয় অজ্ঞাত থেকে যায়। আর আহতদের সেবা দেয়া হচ্ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে তৎকালিন চাকুরিরত ইংরেজ ডাক্তার এলিংসনের কথা না লিখলে কিছুটা দুঃখবোধ বাকি থেকে যাবে। তিনি সেই ২১ ফেব্রুয়ারীতে যেভাবে একটার পর একটা অপারেশন করেছেন তা অকল্পনীয় ও অতুলনীয়। এই ডাক্তার এলিংসন না থাকলে মৃতের সংখ্যা আরো অনেক বেড়ে যেত।
গুলি বর্ষণের পরও পুলিশ পুরানো মেডিক্যাল হোস্টেল দখলে নিতে পারে নি। ছাত্ররা এই হোস্টেলে মাইক্রোফোন লাগিয়ে কথা বলা শুরু করল। সাথে সাথেই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলে, সলিমুল্লাহ হল, সদরঘাটে জগন্নাথ কলেজ, সিদ্দিক বাজারে ঢাকা কলেজ প্রভৃতি জায়গায় মাইক লাগিয়ে বক্তব্য দেয়া শুরু করে। ফলে পরিস্থিতি আরো ভয়ানক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
আর ইতিমধ্যেই মিছিলে গুলি বর্ষণের খবর দাবানলের মত সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে অফিস আদালত, দোকান-পাট, যানবাহন সবই বন্ধ করে দেয়া হল। এমনকি নাজিমউদ্দিন রোডে রেডিও শিল্পিরা পর্যন্ত বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এল। সব মানুষের গন্তব্য হাসপাতাল। এদের নিয়েই ২১শে ফেব্রুয়ারীর পূর্বপরিকল্পিত ও বহু আকাঙ্খিত হরতাল শুরু হল বিকাল ৪টায়।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই শহরে জারি করা হল সান্ধ্য আইন, রাস্তায় এল সেনাবাহিনী। সান্ধ্য আইনের সময়ই সশস্ত্র প্রহরায় মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বেতার থেকে আপত্তিজনক ভাষায় ছাত্রসমাজকে তিরস্কার করলেন।
মেডিক্যাল কলেজে অধ্যক্ষের আশ্বাস স্বত্তেও সরকার হতে মর্গে প্রহরা জারি করা হল, যাতে করে পরের দিন এইসব লাশ নিয়ে আর কেউ শোক মিছিল করতে না পারে। শেষ পর্যন্ত রাত আনুমানিক দুটোয় সশস্ত্র একদল পাঞ্জাবী সৈন্যের সাহায্যে লাশ সরানোর জন্য হাসপাতাল ঘেরাও করা হল, এবং একপ্রকার জোর করেই সৈন্যরা লাশ গুলো মর্গ থেকে নিয়ে গেল। মেডিক্যাল কলেজের দুই অসীম সাহসী ছাত্র সেই কারফিউর মধ্যেও সৈন্যদের পিছন পিছন বেরিয়ে এল, এবং আজিমপুর গোরস্থানে লাশগুলো কবর দিয়ে সৈন্যরা চলে যাবার পর এই দুই ছাত্র শহীদদের কবরগুলো চিহ্নিত করে আসল। এই দুই ছাত্রের জন্যই আজও আমরা ওইসব শহীদদের সরাসরি শ্রদ্ধা জানাতে পারছি।
আরো একটা ঘটনা উল্লেখ না করলে ২১ তারিখের তাৎপর্য অসম্পুর্ন থেকে যাবে। বর্তমান জগন্নাথ হল ছিল তৎকালিন প্রাদেশিক পরিষদের সভাকক্ষ। ২১ তারিখে ঐ সভাকক্ষে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের পুর্বঘোষিত বাজেট অধিবেশন ছিল এবং মূলত সে কারনেই ২১ তারিখে হরতাল ডাকা হয়। সেদিন এত আন্দোলনের ভেতরেও বেলা ৩টার কিছু আগে বাজেট সভা শুরু হয়। কোরান তেলাওয়াত শেষ হবার সাথে সাথেই বিরোধী দলীয় নেতা খয়রাত হোসেন গুলি বর্ষণজনিত পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে মুলতবী প্রস্তাব উত্থাপন করলে সভায় প্রচুর বাদানুবাদ শুরু হয়। স্পীকার বারবার এ প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তখন বিরোধীদলীয় সদস্যরা গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করার হুমকি দেন। এসময় বিরোধী দলের কংগ্রেসী সদস্য ছাড়া আর মাত্র চারজন মুসলিম সদস্য ছিলেন। এরা হলেন রংপুরের খয়রাত হোসেন, ঢাকার আনোয়ারা খাতুন, যশোরের শামসুদ্দিন এবং কুমিল্লার আলী আহাম্মদ।
এছাড়া ছিলেন তৎকালীন মুসলীম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সদস্য (পাবনা থেকে নির্বাচিত) মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। তিনি সেদিন স্পিকারের অনুমতিক্রমে ছাত্রদের উপর গুলী চালানোর প্রতিবাদে কিছু বক্তব্য পেশ করলে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং স্পীকারের আদেশ অমান্য করে তদন্তের দাবি এবং সভাপতিকে সরেজমিনে স্থান পরিদর্শন ও বিবৃতি প্রদানের কথা পেশ করলে স্পীকারের সাথে তার বাকবিতন্ডা শুরু হয়। তিনি বারবার স্পীকারের কথা অগ্রাহ্য করে তদন্তের দাবি জানাতে থাকেন, এ পরিস্থিতিতে ১৫ মিনিটের জন্য সভা মুলতবী ঘোষণা করা হয়। মুলতবীর পর আবার তর্কবাগীশ বলে ওঠেন।
যখন আমাদের বক্ষের মাণিক, আমাদের রাষ্ট্রের ভাবি নেতা ৬ ছাত্র রক্তশয্যায় শায়িত, তখন আমরা পাখার নিচে বসে হাওয়া খাব এ আমি বরদাশত করতে পারি না। আমি জালেমের এই জুলুমের প্রতিবাদে পরিষদ গৃহ ত্যাগ করছি এবং মানবতার দোহাই দিয়ে আপনাদের মধ্যস্থতায় সকল মেম্বারের কাছে পরিষদ গৃহ ত্যাগের আহবান জানাচ্ছি।………
এর পরের দিনই অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারীতেই মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে পুলিশে গ্রেফতার করে।
২২ ফেব্রুয়ায়ী:
২১ তারিখ দিবাগত রাতে কারফিউর মধ্যেই ছাত্ররা একত্রিত হয়ে রাস্তায় কয়েকটি ব্যারিকেড সৃষ্টি করল। এর ফলে পুলিশের সাথে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হল। এরাতে পুলিশ আরো ৬২ জনকে গ্রেফতার করে। সারা রাত ধরে ছাত্ররা আশেপাশের বিভিন্ন স্থানের মানুষদের সংগঠিত করতে থাকে। যাতে করে পরেরদিন আহবান করা হরতাল এবং জানাজা সফল হয়।
সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত অমান্য করে মিছিল বের করা ও হরতাল আহবান করার ফলে মূলত ২১ ফেব্রুয়ারীতেই এই সর্বদলীয় কর্মপরিষদ অকার্জকর হয়ে পরে এবং গোলাগুলির সময়ই রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। ফলে ২১ ফেব্রব্রুয়ারি রাতে নতুন কমিটি গঠন করা হয়, এবং যুবলীগের তৎকালীণ সাধারন সম্পাদক অলি আহাদ সেই পরিষদের আহবায়ক মনোনীত হন। নতুন কর্ম পরিষদের প্রথম দুটো সিদ্ধান্ত হচ্ছে-
(ক) ২২ ফেব্রুয়ারী থেকে পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত প্রতিদিন পূর্ণদিবস হরতাল।
(খ) ২২ ফেব্রুয়ারী মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে জানাজা ও শোক মিছিল।
এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোন প্রকার প্রচার পত্র এত রাতে জনগণের কাছে বিলি করা সম্ভব নয় বলে ছাত্ররা সলিমুল্লাহ হল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল, সিদ্দিক বাজারের ঢাকা কলেজ এবং সদরঘাটের জগন্নাথ কলেজের ভবনে মাইক লাগিয়ে এসব সিদ্ধান্তের কথা প্রচার করতে লাগলো। এর সাথে সাথেই এই সব মাইকের উপর পুলিশরা হামলা চালায় এবং একমাত্র সলিমুল্লাহ হল ছাড়া বাকি সব জায়গার মাইক বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়। সলিমুল্লাহ হলে ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে পুলিশ প্রবেশ করতে পারেনি, এবং সেখানে তখনো প্রচার চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এর মধ্যেই ২২ফেব্রুয়ারী ভোরের দিকে পুলিশ এসে লাশগুলো নিয়ে যায়। এ খবরও সাথে সাথে মাইকে প্রচার শুরু হয় এবং সবাইকে গায়েবানা জানাজার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। সকাল সাড়ে নটার দিকে এই জানাজা অনুষ্ঠিত হয়, যাতে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, খয়রাত হোসেন, মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ সহ আরো কয়েকজন এম এল এ। এছাড়া আরো যোগ দেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং ও আরো কিছু অ্যাডভোকেট ও ডাক্তার। এই ঐতিহাসিক গায়েবানা জানাজার পুর্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন যুবনেতা ইমাদুল্লাহ লালা।
জানাজা শেষে কয়েকটি বাঁশের মাথায় শহীদদের রক্তাক্ত কাপড় জড়িয়ে নিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল শুরু করা হয়। মিছিলের দৈর্ঘ্য এতই বিশাল ছিল যে মিছিলের অগ্রভাগ যখন বিভিন্ন স্থান অতিক্রম করে ঠাঠারি বাজার এলাকায় পৌছেছে, তখন মিছিলের শেষ প্রান্ত মেডিক্যালের হোস্টেল থেকে বের হয়েছে মাত্র। এর কিছুক্ষনের মধ্যেই পাকিস্তান আর্মীর ১৪তম ডিভিশনের সৈন্যরা মিছিলে হামলা করল। এতে ট্রাকের নিচে পড়ে একজন নিহত এবং বেয়নেট চার্জের কারনে আরো বেশ কজন আহত হল। এই অবস্থায় শুরু হল পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ। এত কিছুর পরও ২২ ফেব্রুয়ারী সর্বাত্মকভাবে হরতাল পালিত হল।
এদিকে ২২ ফেব্রুয়ারী রাতে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা ২১ তারিখে পুলিশের গুলিবর্ষণের স্থানে রাতারাতি একটি শহীদ মিনার নির্মানের সিদ্ধান্ত নেয়। ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্র বদরুল আলম কয়েকঘন্টার মধ্যেই শহীদ মিনারের জন্য একটি নকশা তৈরি করে দিলেন। মাদারীপুরের তৎকালীণ মেডিক্যাল ছাত্র গোলাম মওলা ও নওগাঁর মঞ্জুর হোসেনের নেতৃত্বে রাতের অন্ধকারেই নির্ধারিত স্থানে শহীদ মিনার নির্মিত হল। এই মিনার নির্মানের জন্য নার্সেস কোয়ার্টারের ইট ব্যবহৃত হয়। আর ঐ রাতের ভেতরেই মুখে মুখে এই শহীদ মিনারের কথা সারা শহরে রটে যায়। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারীতে মানুষ দলে দলে এই মিনারে ফুল দিতে চলে আসে।
আর এভাবেই গড়ে ওঠে বাঙালির আন্দোলনের প্রতীক, সকল আন্দোলনের অনুপ্রেরণা শহীদ মিনার।
_______________________________________________
[ কিছু বিভ্রান্তি: এই একুশে ফেব্রুয়ারীতে দুনিয়া কাঁপানো ৩০ মিনিট অনুষ্ঠানে ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারীর মিছিলে গুলি করার সময় উল্লেখ করা হয় বিকাল ৩.২০/৩.২৫ এ, কিন্তু এম আর আখতার মুকুলের বই হতে প্রাপ্ত তথ্য হতে দেখা যায়যে গুলি করার সময় হলো- ৩.১০। আবার অনুষ্ঠানটিতে দেখানো হয় যে লাশ নিয়ে মিছিল হচ্ছে, যেটার ব্যপারে বইটাতে কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। এছাড়া এখানে শুধুমাত্র ৩০ মিনিটকে ফোকাস করা তে সামগ্রীক ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও সঠিক ঘটনা প্রবাহ ঢাকা পরে গেছে, যা ভয়ানক বিভ্রান্তির উদ্রেক করে। সুতরাং বলতে হয়, এসব অযৌক্তিক ব্যবসামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইতিহাসকে হেয় করা অর্থহীন ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ বিভ্রান্তিকর। ]
_____________________
এই নিবন্ধের সকল ঐতিহাসিক তথ্যাবলী এম আর আখতার মুকুলের “একুশের দলিল” বই হতে নেয়া।
জনাব তানভী – সরদার ফজলুল করিমের সাক্ষাতকারের অংশ বিশেষ কপি করে দিলাম, রেফারেন্স arts.bdnews24.com থেকে।
* রাজ্জাক স্যার এখানে প্রফেসর রাজ্জাক স্যার।
– ”আপনি একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা বলবেন রাজ্জাক স্যার সম্পর্কে। সেটা তো আর বললেন না। কী যেন? ঘটনাটা সম্ভবত ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। ভাষা-আন্দোলন সম্পর্কে প্রফেসর রাজ্জাক কোনো কথা বলেন নাই। একবার বলেছিলেন, আমি ভালো করে দেখি নাই, শুনলাম গুলি হয়েছে, শুধু গুলির কথাটা বলেছেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রফেসর রাজ্জাকের মুখে আমি কখনো কিছুই শুনি নাই।
তাহলে কি আপনি বলতে চান রাজ্জাক স্যার ভাষা-আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন?
না, ভাষা-আন্দোলনের বিরোধী নন তিনি। ভাষা-আন্দোলনের সময় মুনির চৌধুরী জেলে গেল, তখন উনি তাঁর ফ্যামিলিকে পেট্রোনাইজ করেছেন। মুনিরের স্ত্রী লিলিকে তিনি নানাভাবে সাহায্য করেছেন। লিলি তখন তো বাসায় থাকত। কাজেই তিনি যদি ভাষা-আন্দোলনের বিরোধী লোক হন, তাহলে মুনিরের ফ্যামিলির লোকের সাথে এভাবে কানেকশন রাখতে যাবেন কেন?
ওই যে শহীদ, শহীদ বরকত…?
কথাটা কেড়ে নিয়ে বললেন, ও বুঝেছি, বুঝেছি। আমার নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রফেসর রাজ্জাক একটা কথা বলেছিলেন। এটা নিয়ে খুব আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। একজন পুলিশ অফিসার নাকি তাঁকে বলেছিল, বরকতরে নিয়া আপনারা ক্যান এত লাফালাফি করেন? হে তো পুলিশের ইনফর্মার ছিল। আমি তাঁর সেই কথা রেকর্ড করেছি। ঐ যে…, ঘটনাটা তো আমি অনেক জায়গায় বলেছি, আমার একটা টেপ রেকর্ডার ছিল। উনার কথাকে ধরে রাখার জন্য কিনেছিলাম। ১৯৭৬ সালে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রফেসর রাজ্জাকের একটা ডায়লগ ছাপা হয়েছিল। বিরাট এই ডায়ালগটা শাহাদৎ চৌধুরী ছেপেছিল। আমি তখন বিচিত্রায় যাতায়াত করতাম। ডায়ালগটা ছাপা হওয়া মাত্রই সারা দেশে একেবারে শোরগোল পড়ে যায়। রাজ্জাক সাহেব এক জায়গায় বলেছিলেন, একজন পুলিশ অফিসার আমাকে বলেছেন, এই মিয়া, আপনারা বরকতকে নিয়া ক্যান এত নাচানাচি করেন? তখন প্রফেসর রাজ্জাকের এই কথাটা আমি টেপ করেছিলাম। তিনি পুলিশ অফিসারকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনাদের লোক মানে কী? তখন পুলিশ অফিসার বলেছিলেন, বরকত পুলিশের ইনফরমার। বরকত রাস্তায় যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে সে গুলি খায়, তখন সে শহীদ হয়। এই রেফারেন্সটা আমি রেকর্ড করি। তখন রাজ্জাক সাহেব আমাকে বলেছিলেন, আপনার হাতে যেটা বাজাইতেছেন রেকর্ডারটা বন্ধ করেন। কিন্তু আমি রেকর্ডার বন্ধ করি নাই। ঘটনাটা আমি ধরে রেখেছিলাম, কিন্তু ছাপাবার কথা চিন্তাও করি নাই, সিদ্ধান্তও নেই নাই, শাহাদৎ চৌধুরী আমার সঙ্গে আলাপ না করে ডায়লগটা বিচিত্রায় ছেপেছিল। ওরই মধ্যে একটা জিনিস আলাপ না করে ছাপা উচিত হয় নাই। রাজ্জাক সাহেবকে অবশ্য জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কি এই কথা বলেছেন? তিনি হ্যাঁও বলতে পারেন নাই, নাও বলতে পারেন নাই, এই রকম একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। আর না বলবেন কী করে যেখানে তিনি বলেছেন।
আপনি তো কাজটা ভালো করেন নাই। তাঁকে একটা অ্যামবারেসিং অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন। নিকটজন হয়ে এমন করাটা কি ঠিক করেছিলেন বলে মনে করেন?
আরে তা না। শাহাদৎ চৌধুরী আমার সঙ্গে আলাপ না করে কাজটা করেছে। আর আমি তো মনে করি, শহীদ শহীদই। তাঁকে কোনোভাবেই খাটো করার কিছু নেই। আন্দোলন করতে গিয়া কেউ পুলিশের গুলি খাইলেই শহীদ হয়, কে মরছে সেটা দেখার বিষয় না।
হয়েছিলাম।”
@রায়হান আবীর,
এই বিভ্রান্তি তো কিছুই না। আমাদের দেশের ভিত্তি যে স্বাধীনতা সেই স্বাধীনতার ঘোষনা নিয়েই রইয়েছে কত বিভ্রান্তি।
ভাষা শহিদ বরকত নাকি পুলিশের সোর্স ছিল ।সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল সরদার ফজলুল করিমের এক ইন্টারভিউতে। টোয়েন্টি ফোর ব্লগে এই তথ্য আছে। জনাব তানভী এই বিষয়ে আপনার মনতব্য কি ?
@অপু,
আমি যতদুর জানি আবুল বরকত ছাত্রই ছিলেন। আগের পোস্টে দিয়েছিলাম – বরকত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। আর মূর্তজা বশিরের লেখায়ও এরকমই পেয়েছি।
বরকত পুলিশের লোক ছিলেন, এরকম কিছু কোথাও পাইনি।
ঐ বারোটা বাজানো ৩০ মিনিট নিয়ে আরেকটা কথা বলার আছে। আমি প্রথমে অনুষ্ঠানটা সরল দৃষ্টিতে পছন্দ করে ফেললেও পরে আরো অনেকের অনেক লেখা পড়ে ও ছবি দেখে আসল জায়গাটা ধরতে পেরেছি। (আমার এই দোষটা খুব প্রকট!)
এখন আরো দুঃখের ব্যপার হচ্ছে যে অনুষ্ঠানের(পড়ুন রংবাজির) আগের দিন আমি প্রথম প্রবন্ধটা লেখায়, ২১ তারিখ আন্দোলনের মিছিলে কারা ছিল আমার তা মোটামুটি ভালই মনে ছিল। এখন এক এক করে যখন ভাষাসৈনিকদের মঞ্চে আনা হচ্ছিল তখন আমি প্রথমেই খেয়াল করলাম যে ওখানে বিচারপতি হাবিবুর রহমান (শেলী) [তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাক্তন প্রধান উপদেষ্টা] নেই!!!
ইতিহাসে উনি ছিলেন প্রথম মিছিলের প্রথম সারিতে, এবং তাকে গ্রেফতারও করা হয় সবার প্রথমে! আর এই ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। আর বর্তমানে তার নামটাও কেন উল্লেখ করা হল না এটা নিয়ে আমি সন্দিহান হয়ে পড়লাম! তাকে তো আনাও হল না সাথে তার নামটাও উচ্চারিত হয়নি! (জানি না এটা কেন করা হল। হয়ত তিনি এসব ফাজলামি তে আসতে চান নাই!! তাই তার নামটাও বলা হয়নাই!)
সম্পূর্ণ সহমত। :yes:
যারা পুরো ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘদিনের সংগ্রামকে কেবল ত্রিশ মিনিটের খাঁচায় বৃত্ত বন্দি করে গালভরা নাম দেন – দুনিয়া কাঁপানো ৩০ মিনিট, আর তা নিয়ে মাতামাতি শুরু করেন, আর পোষা চ্যালা চামুণ্ডাদেরও নাচতে বাধ্য করেন অযথাই – একুশকে নিয়ে তাদের ব্যবসায়ী মনোবৃত্তি স্পস্ট থেকে স্পষ্টতর হয়। সামনের দিনগুলোতে মতিমামার কাছ থেকে মনে হয় এধরনের আরো সার্কাস আসছে বলে মনে হচ্ছে।
এখানে আরো একটা কথা বলে নেই।
আমাদের দেশে সাধারন ভাবে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এই চার শহীদের সাথে শফিউরের নামও উল্লেখিত হয়। কিন্তু বইতে আমি যেটা পেলাম সেটা হচ্ছে, শফিউর রহমান এক সাদামাটা পরিবারের ছেলে, যার স্ত্রী ছিল সেসময় সন্তান সম্ভবা। বৃদ্ধ পিতা ও ছোট ভাই বোন এবং স্ত্রী ও এক কন্যা নিয়ে তার একান্নবর্তী পরিবার। তিনি ছিলেন হাইকোর্টের তরুন কর্মচারী ও আইন ক্লাসের ছাত্র। রাজনীতির সাথে বা ভাষা আন্দলনের সাথে তার খুব একটা সম্পৃক্ততা ছিল না অথবা একেবারেই ছিল না।
২২শে ফেব্রুয়ারী সাইকেলে করে (সময় উল্লেখ নেই) তিনি রমনা এলাকায় যাচ্ছিলেন। এমন সময় একটি মিলিটারী জিপ চারিদিকে গুলি করতে করতে এগিয়ে আসতে থাকে। শফিউর “খোশ মহল” নামের এক হোটেলের পাশের গলি দিয়ে ঢুকে পড়েন। কিন্তু শেষপর্যন্ত মিলিটারী তাকে জিপ থেকে নেমে গলির মুখে এসে গুলী করে। সেদিন বিকালেই মিটফোর্ড হাসপাতালে শফিউর রহমান মৃত্যুবরন করেন।
@তানভী,
আপনার লেখাটি একুশ ও একুশের পর নিয়ে। আমার জানতে ইচ্ছে করে একুশের প্রেক্ষাপটে কিছু বিষয় নিয়ে। প্রবাসে একুশের উপর লেখা বই খুব একটা পাওয়া যায়না। আমার কনফিউসনটা হচ্ছে, জামাতে ইসলামীরা প্রায়ই গোলাম আজমকে ভাষা সৈনিক বলে গর্বের সাথে দাবী করে। যেমন এ সপ্তাহে তাদের পত্রিকায় নিজামীর ভাষায়- ৪৮ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় ছাত্রদের পক্ষ থেকে স্মরকলিপি দেয়া হয়েছিল। এটি পাঠ করেছিলেন এ দেশে ইসলামী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, ডাকসুর তৎকালীন নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর গোলাম আযম। সেই স্মারকলিপিতে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবীর পাশাপাশি এ অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ, বাক স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীও ছিল।
কার্জন হলে কায়েদে আজমের রাষ্ট্র ভাষা উর্দু ঘোষনা আর ঐ স্মারক লিপির সময়ের দুরত্ব কতটুকু? এদিকে বদরুদ্দীন ওমর ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের কোন অবদান বা সম্পৃক্ততা মানতে রাজী নন, যার পরিপ্রেক্ষিতে আব্দুল গাফফার চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার লেখা একটি প্রবন্ধে। আপনি যেহেতু বাংলাদেশে আছেন আমার বিশ্বাস ভাষা আন্দোলনের ঐ নির্দিষ্ট সময়ের ঘটনা সম্বলিত বই সংগ্রহ করতে পারবেন। এ দিকটার উপর সময় পেলে একটু আলোকপাত করলে কৃতার্থ হবো।
@আকাশ মালিক,
গোলাম আজম ৪৮ সালে জিন্নাহর ঘোষনার প্রতিবাদ করেছিল, এটা আমার ধারনা ছিল সত্য। এখন দেখছি ধারনা ভুল হতে পারে, তবে ৫২ সালে মনে হয় না তার আদৌ কোন ভূমিকা ছিল বলে। এটা দেখতে পারেন।
আরেকটি পোষ্ট দেখতে পারেন, এখানে বদরুদ্দিন উমর সাহেবের বক্তব্য আছে।
আরো
এবার বংগবন্ধুর ভূমিকা সম্পর্কে দুটি কথা। কিছুদিন আগে হাসিনা দাবী করেছেন যে ভাষা আন্দোলন নাকি বংবন্ধুর নির্দেশেই হয়, তিনি জেল থেকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই দাবী নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি। বংগবন্ধু ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় জেলে ছিলেন, তবে তার নির্দেশেই ভাষা আন্দোলন হয় এহেন দাবী অযৌক্তিক। এর প্রতিক্রিয়ায় বদরুদ্দিন উমর বলে বসেছেন যে সমগ্র ভাষা আন্দোলনেই বংবন্ধুর কোন ভূমিকা ছিল না। এ দাবীও যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। বংগবন্ধু ৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের কারনেই অলি আহাদদের সাথে জেলে গেছিলেন তার বহু রেফারেন্স আমি দেখেছি। কিন্তু উমর সাহেবের মতে তিনি নাকি তখন কলকাতায় ছিলেন।
আমাদের দেশে ইতিহাস চর্চা খুবই কঠিন। কেউ এক আধা সত্য দাবী করেন, সেটা মিথ্যা প্রমান করতে আরেকজনায় আবার ততোধিক গাজাখুরি কিছু ফেদে বসেন।
@আদিল মাহমুদ,
অশেষ ধন্যবাদ। আন্যান্য ফোরামে খুব একটা যাইনা তো তাই চোখে পড়ে নাই। অনেক কিছু জানতে পারলাম। থ্যাঙ্ক ইউ– :yes:
@আদিল মাহমুদ,
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, এ ব্যপারটা নিয়ে অনেক শুনেছি, কিন্তু কখনো আমলে নেই নি। আর বইটইয়ে ও তেমন পাইনি। আসলে ৫২র উপর বইও খুব একটা পাওয়া যায় না। যেটুকু যায়, তাও আমার কাছে নেই। আর একটা প্রশ্ন- আপনি একসাথে এত ব্লগে সময় দ্যান ক্যমনে?
@আকাশ মালিক,
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এরকম একটা ব্যপার তুলে আনবার জন্য। নাহলে এটা জানার বাইরে থেকে যেত।
@তানভী,
ভাষা আন্দোলন নিয়ে আসলেই তেমন কোন ভাল নেই, নেই মুক্তিযুদ্ধের মত স্মৃতিকথা। খুবই দূঃখজনক।
অন্য সাইটেও ঘোরাঘুরি কিছুটা করি এইসব কারনে। অনেক সময় ভাল ভাল কাজের লেখা পাওয়া যায়। আরো মজা, মোটামুটি বাংলাদেশের খবরের কাগজ আর পড়তে হয় না। আমার ব্লগে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভাল ভাল কিছু লেখা মাঝে মাঝে বের হয়। আমি রহমান পিয়াল নামে একজনের লেখা পড়তে পার। এইবার সে বই ও বের করেছে।
@আদিল মাহমুদ,
পিয়াল ভাইয়ের লেখা চোখের সামনে পেলেই পড়ি। অনেক খাটাখাটনি করে একএকটা লেখা দাড়া করান, পড়লেই বোঝা যায়। কিন্তু সব লেখা চোখের সামনে পাওয়া যায় না। আর অন্য ব্লগে বিরক্তিকর পোস্ট এত বেশি থাকে যে যেতে ইচ্ছা করে না। খালি পড়ার জন্য সচলায়তনে যাই। সামহয়্যারে মাঝে মধ্যে। আর অন্য গুলাতে যাওয়াই হয়না।
সামহয়্যারে পিয়াল ভাইয়ের অনেক লেখা পড়েছি, উনি লিখেনও দারুন।