(মন চাইছিল, আরো কিছু লিখি। তাই দিয়ে দিলাম)

শেষের শুরু———-
(গুলি বর্ষনের অংশটুকু দিয়ে লেখাটা শেষ দিয়েছিলাম। তাই শুরুটাও ওখান থেকেই হোক……… )
আগের নিবন্ধটুকু: একুশের দিন

তিনজন শহীদ ছাত্রের নাম হল আবুল বরকত, জব্বার আর রফিক উদ্দিন। চতুর্থ জন শহীদ সালাম ছিলেন বাদামতলীর এক প্রেসের কর্মচারী। এছাড়া আরো কিছু লাশ পুলিশ নিয়ে যায়, যাদের পরিচয় অজ্ঞাত থেকে যায়। আর আহতদের সেবা দেয়া হচ্ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে তৎকালিন চাকুরিরত ইংরেজ ডাক্তার এলিংসনের কথা না লিখলে কিছুটা দুঃখবোধ বাকি থেকে যাবে। তিনি সেই ২১ ফেব্রুয়ারীতে যেভাবে একটার পর একটা অপারেশন করেছেন তা অকল্পনীয় ও অতুলনীয়। এই ডাক্তার এলিংসন না থাকলে মৃতের সংখ্যা আরো অনেক বেড়ে যেত।
গুলি বর্ষণের পরও পুলিশ পুরানো মেডিক্যাল হোস্টেল দখলে নিতে পারে নি। ছাত্ররা এই হোস্টেলে মাইক্রোফোন লাগিয়ে কথা বলা শুরু করল। সাথে সাথেই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলে, সলিমুল্লাহ হল, সদরঘাটে জগন্নাথ কলেজ, সিদ্দিক বাজারে ঢাকা কলেজ প্রভৃতি জায়গায় মাইক লাগিয়ে বক্তব্য দেয়া শুরু করে। ফলে পরিস্থিতি আরো ভয়ানক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
আর ইতিমধ্যেই মিছিলে গুলি বর্ষণের খবর দাবানলের মত সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে অফিস আদালত, দোকান-পাট, যানবাহন সবই বন্ধ করে দেয়া হল। এমনকি নাজিমউদ্দিন রোডে রেডিও শিল্পিরা পর্যন্ত বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এল। সব মানুষের গন্তব্য হাসপাতাল। এদের নিয়েই ২১শে ফেব্রুয়ারীর পূর্বপরিকল্পিত ও বহু আকাঙ্খিত হরতাল শুরু হল বিকাল ৪টায়।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই শহরে জারি করা হল সান্ধ্য আইন, রাস্তায় এল সেনাবাহিনী। সান্ধ্য আইনের সময়ই সশস্ত্র প্রহরায় মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বেতার থেকে আপত্তিজনক ভাষায় ছাত্রসমাজকে তিরস্কার করলেন।
মেডিক্যাল কলেজে অধ্যক্ষের আশ্বাস স্বত্তেও সরকার হতে মর্গে প্রহরা জারি করা হল, যাতে করে পরের দিন এইসব লাশ নিয়ে আর কেউ শোক মিছিল করতে না পারে। শেষ পর্যন্ত রাত আনুমানিক দুটোয় সশস্ত্র একদল পাঞ্জাবী সৈন্যের সাহায্যে লাশ সরানোর জন্য হাসপাতাল ঘেরাও করা হল, এবং একপ্রকার জোর করেই সৈন্যরা লাশ গুলো মর্গ থেকে নিয়ে গেল। মেডিক্যাল কলেজের দুই অসীম সাহসী ছাত্র সেই কারফিউর মধ্যেও সৈন্যদের পিছন পিছন বেরিয়ে এল, এবং আজিমপুর গোরস্থানে লাশগুলো কবর দিয়ে সৈন্যরা চলে যাবার পর এই দুই ছাত্র শহীদদের কবরগুলো চিহ্নিত করে আসল। এই দুই ছাত্রের জন্যই আজও আমরা ওইসব শহীদদের সরাসরি শ্রদ্ধা জানাতে পারছি।

আরো একটা ঘটনা উল্লেখ না করলে ২১ তারিখের তাৎপর্য অসম্পুর্ন থেকে যাবে। বর্তমান জগন্নাথ হল ছিল তৎকালিন প্রাদেশিক পরিষদের সভাকক্ষ। ২১ তারিখে ঐ সভাকক্ষে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের পুর্বঘোষিত বাজেট অধিবেশন ছিল এবং মূলত সে কারনেই ২১ তারিখে হরতাল ডাকা হয়। সেদিন এত আন্দোলনের ভেতরেও বেলা ৩টার কিছু আগে বাজেট সভা শুরু হয়। কোরান তেলাওয়াত শেষ হবার সাথে সাথেই বিরোধী দলীয় নেতা খয়রাত হোসেন গুলি বর্ষণজনিত পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে মুলতবী প্রস্তাব উত্থাপন করলে সভায় প্রচুর বাদানুবাদ শুরু হয়। স্পীকার বারবার এ প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তখন বিরোধীদলীয় সদস্যরা গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করার হুমকি দেন। এসময় বিরোধী দলের কংগ্রেসী সদস্য ছাড়া আর মাত্র চারজন মুসলিম সদস্য ছিলেন। এরা হলেন রংপুরের খয়রাত হোসেন, ঢাকার আনোয়ারা খাতুন, যশোরের শামসুদ্দিন এবং কুমিল্লার আলী আহাম্মদ।
এছাড়া ছিলেন তৎকালীন মুসলীম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সদস্য (পাবনা থেকে নির্বাচিত) মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। তিনি সেদিন স্পিকারের অনুমতিক্রমে ছাত্রদের উপর গুলী চালানোর প্রতিবাদে কিছু বক্তব্য পেশ করলে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং স্পীকারের আদেশ অমান্য করে তদন্তের দাবি এবং সভাপতিকে সরেজমিনে স্থান পরিদর্শন ও বিবৃতি প্রদানের কথা পেশ করলে স্পীকারের সাথে তার বাকবিতন্ডা শুরু হয়। তিনি বারবার স্পীকারের কথা অগ্রাহ্য করে তদন্তের দাবি জানাতে থাকেন, এ পরিস্থিতিতে ১৫ মিনিটের জন্য সভা মুলতবী ঘোষণা করা হয়। মুলতবীর পর আবার তর্কবাগীশ বলে ওঠেন।

যখন আমাদের বক্ষের মাণিক, আমাদের রাষ্ট্রের ভাবি নেতা ৬ ছাত্র রক্তশয্যায় শায়িত, তখন আমরা পাখার নিচে বসে হাওয়া খাব এ আমি বরদাশত করতে পারি না। আমি জালেমের এই জুলুমের প্রতিবাদে পরিষদ গৃহ ত্যাগ করছি এবং মানবতার দোহাই দিয়ে আপনাদের মধ্যস্থতায় সকল মেম্বারের কাছে পরিষদ গৃহ ত্যাগের আহবান জানাচ্ছি।………

এর পরের দিনই অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারীতেই মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে পুলিশে গ্রেফতার করে।

২২ ফেব্রুয়ায়ী:
২১ তারিখ দিবাগত রাতে কারফিউর মধ্যেই ছাত্ররা একত্রিত হয়ে রাস্তায় কয়েকটি ব্যারিকেড সৃষ্টি করল। এর ফলে পুলিশের সাথে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হল। এরাতে পুলিশ আরো ৬২ জনকে গ্রেফতার করে। সারা রাত ধরে ছাত্ররা আশেপাশের বিভিন্ন স্থানের মানুষদের সংগঠিত করতে থাকে। যাতে করে পরেরদিন আহবান করা হরতাল এবং জানাজা সফল হয়।
সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত অমান্য করে মিছিল বের করা ও হরতাল আহবান করার ফলে মূলত ২১ ফেব্রুয়ারীতেই এই সর্বদলীয় কর্মপরিষদ অকার্জকর হয়ে পরে এবং গোলাগুলির সময়ই রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। ফলে ২১ ফেব্রব্রুয়ারি রাতে নতুন কমিটি গঠন করা হয়, এবং যুবলীগের তৎকালীণ সাধারন সম্পাদক অলি আহাদ সেই পরিষদের আহবায়ক মনোনীত হন। নতুন কর্ম পরিষদের প্রথম দুটো সিদ্ধান্ত হচ্ছে-
(ক) ২২ ফেব্রুয়ারী থেকে পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত প্রতিদিন পূর্ণদিবস হরতাল।
(খ) ২২ ফেব্রুয়ারী মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে জানাজা ও শোক মিছিল।

এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোন প্রকার প্রচার পত্র এত রাতে জনগণের কাছে বিলি করা সম্ভব নয় বলে ছাত্ররা সলিমুল্লাহ হল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল, সিদ্দিক বাজারের ঢাকা কলেজ এবং সদরঘাটের জগন্নাথ কলেজের ভবনে মাইক লাগিয়ে এসব সিদ্ধান্তের কথা প্রচার করতে লাগলো। এর সাথে সাথেই এই সব মাইকের উপর পুলিশরা হামলা চালায় এবং একমাত্র সলিমুল্লাহ হল ছাড়া বাকি সব জায়গার মাইক বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়। সলিমুল্লাহ হলে ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে পুলিশ প্রবেশ করতে পারেনি, এবং সেখানে তখনো প্রচার চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এর মধ্যেই ২২ফেব্রুয়ারী ভোরের দিকে পুলিশ এসে লাশগুলো নিয়ে যায়। এ খবরও সাথে সাথে মাইকে প্রচার শুরু হয় এবং সবাইকে গায়েবানা জানাজার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। সকাল সাড়ে নটার দিকে এই জানাজা অনুষ্ঠিত হয়, যাতে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, খয়রাত হোসেন, মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ সহ আরো কয়েকজন এম এল এ। এছাড়া আরো যোগ দেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং ও আরো কিছু অ্যাডভোকেট ও ডাক্তার। এই ঐতিহাসিক গায়েবানা জানাজার পুর্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন যুবনেতা ইমাদুল্লাহ লালা।
জানাজা শেষে কয়েকটি বাঁশের মাথায় শহীদদের রক্তাক্ত কাপড় জড়িয়ে নিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল শুরু করা হয়। মিছিলের দৈর্ঘ্য এতই বিশাল ছিল যে মিছিলের অগ্রভাগ যখন বিভিন্ন স্থান অতিক্রম করে ঠাঠারি বাজার এলাকায় পৌছেছে, তখন মিছিলের শেষ প্রান্ত মেডিক্যালের হোস্টেল থেকে বের হয়েছে মাত্র। এর কিছুক্ষনের মধ্যেই পাকিস্তান আর্মীর ১৪তম ডিভিশনের সৈন্যরা মিছিলে হামলা করল। এতে ট্রাকের নিচে পড়ে একজন নিহত এবং বেয়নেট চার্জের কারনে আরো বেশ কজন আহত হল। এই অবস্থায় শুরু হল পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ। এত কিছুর পরও ২২ ফেব্রুয়ারী সর্বাত্মকভাবে হরতাল পালিত হল।

এদিকে ২২ ফেব্রুয়ারী রাতে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা ২১ তারিখে পুলিশের গুলিবর্ষণের স্থানে রাতারাতি একটি শহীদ মিনার নির্মানের সিদ্ধান্ত নেয়। ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্র বদরুল আলম কয়েকঘন্টার মধ্যেই শহীদ মিনারের জন্য একটি নকশা তৈরি করে দিলেন। মাদারীপুরের তৎকালীণ মেডিক্যাল ছাত্র গোলাম মওলা ও নওগাঁর মঞ্জুর হোসেনের নেতৃত্বে রাতের অন্ধকারেই নির্ধারিত স্থানে শহীদ মিনার নির্মিত হল। এই মিনার নির্মানের জন্য নার্সেস কোয়ার্টারের ইট ব্যবহৃত হয়। আর ঐ রাতের ভেতরেই মুখে মুখে এই শহীদ মিনারের কথা সারা শহরে রটে যায়। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারীতে মানুষ দলে দলে এই মিনারে ফুল দিতে চলে আসে।
আর এভাবেই গড়ে ওঠে বাঙালির আন্দোলনের প্রতীক, সকল আন্দোলনের অনুপ্রেরণা শহীদ মিনার।
_______________________________________________

[ কিছু বিভ্রান্তি: এই একুশে ফেব্রুয়ারীতে দুনিয়া কাঁপানো ৩০ মিনিট অনুষ্ঠানে ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারীর মিছিলে গুলি করার সময় উল্লেখ করা হয় বিকাল ৩.২০/৩.২৫ এ, কিন্তু এম আর আখতার মুকুলের বই হতে প্রাপ্ত তথ্য হতে দেখা যায়যে গুলি করার সময় হলো- ৩.১০। আবার অনুষ্ঠানটিতে দেখানো হয় যে লাশ নিয়ে মিছিল হচ্ছে, যেটার ব্যপারে বইটাতে কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। এছাড়া এখানে শুধুমাত্র ৩০ মিনিটকে ফোকাস করা তে সামগ্রীক ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও সঠিক ঘটনা প্রবাহ ঢাকা পরে গেছে, যা ভয়ানক বিভ্রান্তির উদ্রেক করে। সুতরাং বলতে হয়, এসব অযৌক্তিক ব্যবসামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইতিহাসকে হেয় করা অর্থহীন ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ বিভ্রান্তিকর। ]
_____________________
এই নিবন্ধের সকল ঐতিহাসিক তথ্যাবলী এম আর আখতার মুকুলের “একুশের দলিল” বই হতে নেয়া।