দেশ থেকে ফিরে এসেছিলাম ভালোলাগা এবং অতৃপ্তি নিয়ে। আরো অনেকদিন থাকা যেত। কিন্তু হয়, ফিরে আসতে হয়, কাজে যোগ দিতে হয়। যতই আপন মানুষগুলোর কাছে মন পড়ে থাকুক, ফিরে আসতে হয় নিজেদের স্মৃতিগোনা সময়ে।

নাগাসাকি পৌঁছেছি অনেক রাত্রে। ঘরে ফিরতে ফিরতে প্রায় ভোর রাত। জিনিসপত্র কোনোরকমে রেখে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ব, শুনি পাশের ঘরে মেয়ে কন্ঠের গোঙানী। অস্পষ্ট এবং অনুমান করা দুস্কর। আমার বরকে বলি -কি হচ্ছে বলতো!
ওর আগের মতই জবাব,’ তুমি ঘুমাও, ওদের ঘরে কিসের শব্দ তা নিয়ে ভাবার দরকার নাই।’ প্রচন্ড ক্লান্ত দুজনেই, নিজেদের অজান্তেই ঘুমিয়ে যাই।

পরেরদিন আবার মধ্য রাত্রিতে ঘুম ভেঙে একই রকম শব্দ, তবে আজ কন্ঠস্বরটি অতটা চিকন নয়, কিছুটা ভারী গলায়। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমার বর বলে,’ কিমুচি মানে হচ্ছে -ভালো লাগা, জাপানীজ মেয়েদের শীৎকার, এবার ঘুমাও। কোনো কৌতূহল দেখাবার প্রয়োজন নেই।’

এর পর থেকে প্রায়ই এরকম শুনি আমরা। এক একদিন এক এক রকম কন্ঠে। একটি মেয়ে হিসেবে আমার খুব কষ্ট হয় তাসনীম এর জন্যে। মেয়েটি কি ঘন বিশ্বাস নিয়ে এই লোকের সন্তান বয়ে বেড়াচ্ছে নিজের মধ্যে। তার মা হবার কষ্টটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। মায়া লাগে। আর এই লোক!

এরই মধ্যে একদিন রাত দুটোর দিকে বাইরে প্রচন্ড হল্লা। আমরা উঠে জানালা খুলি। বাইরে পুলিশের গাড়ী, প্রায় সব বোর্ডাররা উঠে এসে জড়ো হয়েছে তাসনীমদের রুমের সামনে। সুপার এসেছেন। আনোয়ার, একটি খুবই অল্পবয়সী জাপানীজ মেয়ে আর আল-ফয়েজ বলে একজন ইন্দোনেশিয়ান ছেলের সাথে দুই পুলিশ আর সুপার কথা বলছেন। একসময় তারা তিনজনই সুপার সহ পুলিশের সাথে নিচে নেমে গেলো।

পরে সবার থেকে ঘটনার একটা রূপ পাওয়া যায়। রাতের কোন এক সময়ে এই মেয়েটি প্রচন্ড জোড়ে আনওয়ারের ঘরের দরোজা খুলে বাইরে যাবার চেষ্টা করছিল, আর আনওয়ার দরজা বন্ধ করার চেষ্টা করছিল। লোহার দরোজায় তাতে খুব জোড়ে শব্দ হওয়ায় আল-ফয়েজ এর ঘুম ভেঙে যায়। সে শব্দ বন্ধ করার অনুরোধ করতে এসে এই মেয়েকে বা আনওয়ারকে নিয়ে কিছু বলে থাকবে। ফলস্বরূপ তাকে আনওয়ারের একটি শক্তিশালী ঘুসি হজম করতে হয়। তাদের সম্মলিত চীৎকারে আশেপাশের সবাই উঠে পুলিশ ডাকে।

এই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা আনওয়ারকে হস্টেল ছাড়তে দেখি।

#####
বেশ অনেকদিন পরেই হবে আমার কাছে তাসনীম আসে। ফোন করেই আসে। আমি জানি কেন আসছে। ওর কোলে একটি ফুটফুটে মেয়ে বাচ্চা। বাচ্চাটির হাসি দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না। ওর হাঁটাচলায় ক্লান্তি ধরতে পারি। ক্লান্তভাবেই ডাইনিং টেবিলের একটি চেয়ারে বসে বাচ্চাকে মেঝেতে খেলতে দিয়ে। আমায় বলেঃ’ তুমি আমার মুসলিম বোন, আমার একটা উপকার কর প্লিজ!’
থেমে থেমে আবার বলে,’ কেউ আমায় কিচ্ছু বলছে না, সুপারের কাছে গিয়েছিলাম, এমন কি ফয়েজ নামের ওই ছেলেটার কাছেও, কেউ কিছু বলবে না!’ আমি ওর চোখে গড়িয়ে পরা অশ্রুবিন্দু দেখি। তাসনীম বলে,’ কেনো ওকে হস্টেল ছাড়তে হয়েছে, তোমরা নিশ্চই জানো।’
আমি বলি,’তাসনীম, সব জানলে তুমি কি করবে? এই লোকটাকে ছেড়ে চলে যাবে? নাকি ওর সাথেই থাকবে?’
–তোমার হলে কি করতে?
–সেজন্যেই জানতে চাইছি, আমার হলে যা করতাম তা যদি তুমি করতে পারো তবে আমার যা জানি বলতে অসুবিধা নেই। আর যদি এই লোকটার সাথেই তোমার বাকী জীবন কাটাতে হয়, তাহলে না শোনাই ভালো তোমার জন্যে।
–আমি কোথায় যাবো বল! বাচ্চার বয়স চার মাস মাত্র, আব্বা বেঁচে থাকলে একটা কিছু হতো…।। সে কাঁদতে থাকে।
আমি বলি,’ তুমি কি আমার কথা বুঝতে পাচ্ছো, তাসনীম?’
সে মাথা নাড়ে। বুঝতে পারছে!
চলে যাবার আগে তাসনীম আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার বলে,’তুমি শুধু আমার কওমের বোন নও, আমি সবসময় তোমাকে নিজের বোন বলে মনে করবো।’
আমার বলতে ইচ্ছে করে না তবুও সেদিন কেন যেন বলে ফেলি,’ তাসনীম, আমি মুসলমান নই।’
সে অবাক চোখে আমার দিকে তাকায়, সেই দৃশ্যটি আমি আজও ভুলিনি। কিন্তু সেখানে ঘৃণা বা বিদ্বেষ আমি সেদিন দেখিনি। আমার কোল থেকে নিজের মেয়েটিকে নেবার সময় সে বলে,’ আমি তবুও তোমায় নিজের বোন বলেই জানব।’

তাসনীমের সাথে এর পরেও আমার অনেকবার দেখা হয়েছিল। সেইসব দেখা আগের গুলোর থেকে অনেক ভিন্ন ছিল।সে গল্প না হয় অন্য সময় বলব!