গত ২১ জানুয়ারী ২০১০ তারিখে ছোটবোন বীথির বিয়ে উপলক্ষ্যে নিমন্ত্রণ আর আমন্ত্রণ শিখলাম। আমাদের গ্রাম হাজিপুর এখন আর গ্রাম নেই। নগরায়নের ফলে এক ধরণের ঘিঞ্জি এলাকায় রূপান্তরিত হয়েছে। অপরিচিত ভাড়াটিয়া আর নতুন বসতি গড়াদের আশেপাশে পুরানো বাসিন্দাদের বসবাস আর পাওয়ারলুমের খটখটানি। আমরা ভাইবোনরা থাকি না বলে নতুন বসতিদের সাথে সমাজ গড়ে উঠেনি। কাজেই ঢালাও নিমন্ত্রণের রেওয়াজ পালন করা যায়নি। খুঁজে খুঁজে পুরানো বাসিন্দাদের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বিয়ের রাতে খেতে ডাকা হয়নি বলে অনেকেই আসেনি। তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি আমাদের গোচরিভূত হয়নি। শহরের নিয়মে অভ্যস্ত আমরা ভুলেই গিয়েছি—
‘ঘরেও খেয়ো না
না ডাকলেও যেয়ো না’ —- রীতিটি। এখানে এখনো যে নিমন্ত্রণ করবে তার দায়িত্ব অতিথিকে খোঁজ খবর করে ডেকে নিয়ে খাওয়ানো। অর্থাৎ আমন্ত্রণ করে আনা। ছোটবেলার সে রীতিটি কেন যেন মাথায় এলো না!
এরই মধ্যে আমার এক আত্মীয় ক্ষোভে ও অবহেলায় বলে বসলো —– নিত খায় , তবে নিমন্ত্রণ খায় না।
অর্থাৎ দৈনন্দিন খাবার খেতে ডাকতে হয় না, অথচ নিমন্ত্রণ করলে আবার আমন্ত্রণের অপেক্ষা!
আমি এ নিয়ে মন্তব্য করতে না করলাম। আমন্ত্রণের বিষয়টি মনে এলো না বলে নিজে অনুশোচনায় জ্বলছি, আর আরেকজন কিনা প্রতিবেশীদেরই দোষ দিচ্ছে। আমার মন এতে সায় দিচ্ছে না। যে যতটুকু পারে ধরে রাখুক না তার নিজস্ব রীতি নীতি।
আর আমাদের নাগরিক জীবনে নিমন্ত্রণ পত্রেই টেলিফোন নম্বর লেখা থাকে — যে নিমন্ত্রিত তার দায়িত্ব না যেতে পারলে তাকেই জানাতে হয়।
আমার গ্রামের ভৌগোলিক পরিবেশ সম্পূর্ণই পাল্টে গেছে। রাস্তা- ঘাট পাকা, কিন্তু চাপা। শস্য ক্ষেত অদৃশ্য, কিন্তু কৃষি সমাজের রীতি দৃশ্যমান। পাড়াপ্রতিবেশী বেশীরভাগই অপরিচিতি,ঘরে ঘরে রঙিন টিভি, স্যাটেলাইট সংযোগ, ফ্রিজসহ আধুনিক নাগরিক জীবনের আনুসঙ্গিক সরঞ্জামাদিতে ভরপুর, কিন্তু সামাজিক রীতিটি রয়ে গেছে অপরিবর্তিত। আমন্ত্রণের জন্যে অপেক্ষা করার প্রচলন এখনো বিদ্যমান।

স্মৃতির সাথে বসবাস। শ্রুতির সাথে কথোপকথন। সে স্মৃতি ও শ্রুতি অবয়ববিহীন। অস্তিত্ববিহীন। দেখি। শুনি। অথচ ধরতে পারি না। ধরতে পারলে মন বেড়ি দিতাম তাহার পায়। কিশোর বেলার ভাললাগা এখন আর ফিরে পাই না।
কিশোর বেলায় টেপ রেকর্ডার শুনা ছিল নেশা। লতা, হেমন্ত,সন্ধ্যা, জগন্ময় মিত্র, সতীনাথ। মধুকাকার কেনা পছন্দের তালিকায় সব ভারতীয় শিল্পী। জ্যেঠতুত ভাইদের কেনা যাত্রা পালাও শুনেছি। মা, মাটি ও মানুষ। নটি বিনোদিনী। সিরাজদ্দৌল্লা। একই পালা বহুবার শুনে শুনে প্রায় মুখস্ত। ভানুর কৌতুক। হা হা হি হি হাসির হিরিক। সারা বাড়িতে একটাই টেপ রেকর্ডার । মধু কাকার কেনা। এ নিয়ে সবার জমায়েত। ক্যাসেটের ফিতা মাঝে মাঝে টেপ রেকর্ডারের সাথে প্যাঁচিয়ে যেত। ধীরে ধীরে খুলে আবার সাজানো। রোদে দেয়া, কত কাজ ছিল।
এখন পি সি তে গান শুনি। কোথায় ক্যাসেট ঘুরে বুঝি না। জানি না কীভাবে এতো এতো গান মজুদ রাখে। শুধু গান? সিনেমা পযর্ন্ত ।
এখনও গান শুনি নিয়মিত। তবে আগের মতো নেশা নেই।
৭১ থেকে ৭৫ পযর্ন্ত আমি কোন সিনেমা দেখিনি। সংগ্রামের পর পর আমাদের লুঠ হয়ে যাওয়া ঘর বাড়ি ঠিক করার আগে অনেকে পরিবার এক প্রাইভেট কোম্পানীর বাংলোতে থাকতাম। তখন ৭২ সালে আমার এক গ্রামপাঠীর স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার দোষ ঢাকতে আমি সিনেমায় গেছি আর সে স্কুল করে গেছে প্রমাণ করতে মিথ্যা কথা বলে আমাকে মায়ের হাতে মার খাইয়েছিল। অথচ আমি তখন স্কুলে। কিশোর বয়সের পণ — এস এস সি পরীক্ষা না দিয়ে সিনেমাই দেখব না।

৭১ এর আগে কাকাদের ও মায়ের সাথে ময়না মতি, নীল আকাশের নীচে,এতটুকু আশা, অরুণ বরুণ কিরণ মালা এসব দেখা সিনেমার কাহিনী স্মৃতিতে অতটা স্পষ্ট নয়। ৭৫ এ এস এস সি পরীক্ষার পর ওয়াসিম ও সুচরিতার ‘জলপরী’ সিনেমা দিয়ে আমার যাত্রা শুরু। এরপর থেকে প্রতি সপ্তাহে বাছ বিচার ছাড়া অন্তত একটি করে ছবি দেখা। ছবি দেখা মানে দল বেঁধে যাওয়া। পরে ধীরে ধীরে বুলবুলের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে। আলমগীর কবীরের সূর্‌্য কন্যা আর রূপালী সৈকত দেখেছিলাম এক টিকিটে। নরদিংদীর সংগীতা সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ দর্শক টানতে এরকম ব্যবস্থাই করেছিলেন। আমজাদ হোসেনের গোলাপী এখন ট্রেনে এবং কসাই খুব ভালো লেগেছিল।
শামসুন্নাহার হলে থাকার সময় বি ডি আর এ গিয়ে ভারতীয় সিনেমাও দেখেছি ।

এরপর দীর্ঘদিন আর হল মুখো হইনি। লম্বা বিরতির পর হলে গিয়ে ‘মাটির ময়না’ দেখা। আর পুনেতে গিয়ে হলে ‘যোধা আকবর’ দেখা। যদিও হিন্দি সংলাপ সব বুঝিনি। ভ্রমণ দলের টানে দেখা। মেয়ে তো সাথে ছিল না। আমার মেয়ে আমাকে নিজে সংলাপ বুঝিয়ে বুঝিয়ে হিন্দি ‘ব্ল্যাক’ দেখিয়েছিল। পরে ‘তারি যমিন পর ‘‘চাক দে ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি ছবি। ধুম ধারাক্কার বাইরে ও যে হিন্দি ছবি হয় তা জেনেছি আমার ছেলেমেয়ের বদৌলতে। এখন ছেলেমেয়েদের তালে পরে তাদের সাথে কিছু সিনেমা দেখেছি এবং দেখি। ‘জলপরী’ দিয়ে শুরু করা আমি No Man’s Land, Cast Away, Innocent Voice দেখি। আমার প্রজন্ম আমাকে পৃথিবী চেনায় — জীবন জানায় নতুন করে।