বৈজ্ঞানিক সত্যেন্দ্রনাথ বসু
জন্মঃ ১ জানুয়ারি ১৮৯৪
মৃত্যুঃ ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪

আলবার্ট আইনস্টাইন আমাদের কাছে যতটা পরিচিত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু ততটা নন। কারণ প্রচার মাধ্যমে আইনস্টাইন সুযোগ পেয়েছেন সত্যেন বসুর চেয়ে বেশি। তাছাড়া স্বদেশী বিজ্ঞান সাধকের প্রতি আমাদের উৎসাহ বরাবরই কম। এ আমাদেরই দীনতা। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের কিছু কিছু বিষয়ে সত্যেন বসুর অবদান আইনস্টাইনের অবদানের চেয়ে বেশি। ‘বোস-আইনস্টাইন’ তত্ত্বের আলোচনায় সত্যেন বসুর নামের ঠিক পরেই আইনস্টাইনের নাম উচ্চারিত হয়। কিন্তু বিশ্ব-বিখ্যাত এই তত্ত্বের প্রায় পুরো কৃতিত্বই সত্যেন বসুর। আইনস্টাইন সত্যেন বসুর মূল গবেষণাপত্রটি ইংরেজি থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন ১৯২৪ সালে এবং প্রকাশের সময় সত্যেন বসুর সাথে নিজের নামটাও যোগ করে দিয়েছিলেন। অবশ্য এটাও ঠিক যে সত্যেন বসুর নামের সাথে নোবেল বিজয়ী আইনস্টাইনের নাম যুক্ত না হলে হয়তো সত্যেন বসুকে যতটুকু সম্মান আজ দেয়া হয় তাও দেয়া হতো না। যেমন বেতার-তরঙ্গ সংক্রান্ত গবেষণা ও আবিষ্কারের জন্য জগদীশ বসুর প্রাপ্য সম্মান তাঁকে দেয়া হয়নি।

আলোর মৌলিক কণা ফোটন, হিলিয়াম নিউক্লিয়াস বা আলফা পার্টিক্যল ইত্যাদি ‘বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন তত্ত্ব’ (Bose-Einstein Statistics) মেনে চলে। এ ধরণের কণাগুলো সত্যেন বসুর নামানুসারে ‘বোসন’ (Boson) নামে পরিচিত। কী অসাধারণ মৌলিক আবিষ্কারের বিনিময়ে এরকম স্বীকৃতি পাওয়া যায় তা বলাই বাহুল্য। আইনস্টাইন নিজেই সত্যেন বসুর কাজ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন “এক কথায় অসাধারণ”।

বিজ্ঞান বিশ্বের এই অসাধারণ পন্ডিত সত্যেন্দ্রনাথ বসু খুব সাধারণ বাঙালি পরিবারের সন্তান ছিলেন। ১৮৯৪ সালের ১লা জানুয়ারি উত্তর কলকাতার গোয়াবাগান অঞ্চলে ঈশ্বর মিত্র লেনের পৈত্রিক বাড়িতে তাঁর জন্ম। বাবা সুরেন্দ্রনাথ বসু, মা আমোদিনী দেবী। সুরেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন রেলওয়ের হিসাব রক্ষক। নর্মাল স্কুলে প্রাথমিক ও হিন্দু স্কুলে মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন সত্যেন্দ্রনাথ। ১৯০৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ৫ম স্থান অধিকার করেন তিনি। তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১১ সালে আই-এস-সি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯১৩ সালে গণিতে অনার্স সহ বি-এস-সি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ১৯১৪ সালে এম-এস-সি পরীক্ষার আগে সত্যেন বসু ডাক্তার যোগেন্দ্রনাথ ঘোষের মেয়ে ঊষাবতী দেবীকে বিয়ে করেন। ১৯১৫ সালে এম-এস-সি পরীক্ষায় মিশ্র গণিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

বিদেশে গিয়ে পড়ালেখা করার ইচ্ছে সত্যেন বসুর ছোটবেলা থেকেই ছিল। এম-এস-সি’তে রেকর্ড পরিমাণ নম্বর পাবার পর তাঁর শিক্ষক প্রফেসর ডি এন মল্লিক সস্নেহে ডেকে বললেন, “এত বেশি নম্বর পেয়েছ পরীক্ষায়, বড় বেমানান লাগছে হে”। সত্যেন্দ্রনাথ ভাবলেন এবার মনে হয় সুযোগ এলো বিদেশ যাবার। কিন্তু হলো না। সে বছর পদার্থবিদ্যা বা গণিতের জন্য কোন বৃত্তি দেয়া হলো না। সবগুলো বৃত্তি পেলো রসায়নের শিক্ষার্থীরা। এত ভালো রেজাল্ট করার পরেও ভালো কোন চাকরির ব্যবস্থা হলো না। কিংবা বলা যায় এত ভাল রেজাল্টের কারণেই কোন চাকরি পাওয়া গেলো না। এত ভাল ছাত্রকে কেউ সাধারণ চাকরি দিতে চান না। তাঁর বাবা রেলওয়ের বড় অফিসারদের ধরে রেলওয়েতে একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে চাইলেন। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ রাজী হলেন না। তিনি বাবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আসামে চলে গেলেন। সেখানে গৌরীপুরের জমিদারের ছেলেকে প্রাইভেট পড়ানোর দায়িত্ব নিলেন।

এর অনেক পরে সত্যেন বসু এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “পাশ করার পর প্রথম একটা বছর আমি টিউশনি করে কাটিয়েছি। এই এক বছরে বাইরের দু’একটা কলেজে ও অন্যান্য সরকারি অফিসেও চাকরির চেষ্টা করেছিলাম। হয়নি। যাকে প্রাইভেট পড়াতাম সে এখন সিনেমা জগতের দিকপাল কুমার প্রমথেশ বড়ুয়া। পাটনা কলেজে একটা দরখাস্ত পাঠিয়েছিলাম। উইলসন সাহেব তখন সেখানকার প্রিন্সিপাল। স্যার যদুনাথ সরকার তখন সেখানে অধ্যাপনা করতেন। কিন্তু সেখানেও আমার চাকরি হলো না। তাঁরা জানালেন তাঁদের দরকার একজন সেকেন্ড ক্লাস এম-এস-সি। তখন ভাবলাম ফার্স্ট ক্লাস না পেয়ে সেকেন্ড ক্লাস পেলেই বুঝি ভালো ছিল। আর একবার বাবার বন্ধুর কথামত আলিপুর আবহাওয়া অফিসে একটা দরখাস্ত পাঠিয়েছিলাম। জবাব এলোঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কৃতী ছাত্রের উপযুক্ত কোন চাকরি এখানে খালি নেই। প্রার্থী অন্য কোথাও দরখাস্ত করলে ভালো হয়”।

চাকরির জন্য দরখাস্ত করতে করতে ক্লান্তি এসে গেল। নিজের পড়াশোনাটা আবার শুরু করার কথা ভাবছেন। এ সময় কলকাতার সায়েন্স কলেজে রসায়নে গবেষণা করছেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ডঃ প্রফুল্ল মিত্র প্রমুখ। সত্যেন বসু কেমিস্ট্রি পড়েন নি। ভাবছেন কী করা যায়। এদিকে জগদীশ বসু তখন পদার্থবিদ্যার গবেষণা থেকে সরে গিয়ে উদ্ভিদবিদ্যার দিকে ঝুঁকেছেন। উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জির আহবানে সায়েন্স কলেজে ফলিত গণিতের অধ্যাপক পদে যোগ দিয়েছেন ডঃ গণেশ প্রসাদ। উনি জার্মানি থেকে ডঃ কাইনের কাছে গবেষণা করে এসেছেন। সত্যেন বসু একদিন হাজির হলেন ডঃ গণেশ প্রসাদের কাছে। সত্যেন বসুর এম-এস-সি থিসিসের পরীক্ষক ছিলেন ডঃ প্রসাদ। পরীক্ষার খাতায় অত্যন্ত কম নম্বর দেয়া এবং পরে কম নম্বর পেয়েছে বলে ছাত্রদের খোঁচা দেয়া ছিল তাঁর স্বভাব। কিন্তু সত্যেন বসুর থিসিসে খুব কম নম্বর দেয়া সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষেও। তাই ডঃ প্রসাদ তাঁর স্বভাব-খোঁচাটা দিতে পারলেন না সত্যেন বসুকে। কিন্তু তাঁর আরেকটি অভ্যাস ছিলো – অন্যের বদনাম করা। প্রেসিডেন্সি কলেজের ভালো ভালো শিক্ষকের বদনাম করতেন তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের পেলেই। ছাত্ররা, বিশেষ করে গবেষক ছাত্ররা ভয়ে কোন প্রতিবাদ করতো না। কিন্তু স্পষ্টভাষী সত্যেন বসু গুরুনিন্দা শুনে চুপ করে থাকতে পারলেন না। প্রতিবাদ করলেন। তাতে ডঃ প্রসাদ ভীষণ রেগে গেলেন। বললেন, “তুমি পরীক্ষায় যতই ভাল কর না কেন, তোমার দ্বারা গবেষণা হবে না”। কী আর করা। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এলেন। ভাবলেন নিজেই যা পারেন করবেন। তত্ত্বীয় কিছু কাজও শুরু করে দিলেন।

এর কয়েকদিন পর বিহার সরকার কয়েকটি পদে নতুন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলো। সত্যেন বসু প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপাল জেম্‌স, ডঃ মল্লিক প্রমুখ বিশিষ্টজনের প্রশংসাপত্র সংগ্রহ করে দরখাস্ত পাঠালেন। মনে মনে আশা করলেন যে এবার নিশ্চয় কিছু হবে। কিন্তু তাঁর চাকরি হলো না এখানেও। ডঃ মল্লিক একদিন তাঁকে ডেকে বললেন, “বিহারের ডি-পি-আই আমাকে লিখেছেন – আপনার ছাত্র সত্যেন্দ্রনাথ বসু এত ভাল যে আমাদের ঠিক দরকারে লাগবে না”। আশার বাতি আবারো নিভলো।

একদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জির কাছ থেকে ডাক এলো। শুধু সত্যেন বসু নয়, তাঁর মত আরো সব কৃতী ছাত্রদের ডেকেছেন তিনি। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে লাইব্রেরি ঘরের পাশে স্যার আশুতোষের খাস কামরায় হাজির হলেন সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা, শৈলেন ঘোষ। সবাই কৃতী ছাত্র, কিন্তু পরিপূর্ণ বেকার। স্যার আশুতোষের বিরাট ব্যক্তিত্বের সামনে ভয়ে ভক্তিতে সকলেই বিনীত, নম্র। স্যার আশুতোষ শুনেছেন এই নবীন ছাত্ররা চাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের নতুন নতুন বিষয় পড়ানো হোক। তিনি সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, “তোরা পড়াতে পারবি?” সত্যেন বসু উত্তর দিলেন, “আজ্ঞে, যা বলবেন তা-ই যথাসাধ্য চেষ্টা করবো”। স্যার আশুতোষ সস্নেহে হাসলেন।

তখন পদার্থবিজ্ঞানে নানারকম নতুন নতুন আবিষ্কার শুরু হয়েছে। বেশির ভাগই জার্মানিতে। ম্যাক্স প্ল্যাংক, আলবার্ট আইনস্টাইন, নিল্‌স বোর – এঁদের নামই শুধু শুনেছেন সত্যেন বসু। জানতে গেলে পড়তে হবে জার্মান ভাষায় লেখা বই, গবেষণাপত্র এবং আরো সব বিজ্ঞান পত্রিকা। কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে তখন সে সব ভারতে আসে না। শেষ পর্যন্ত নতুন পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তাঁদের জন্য বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা করা হলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মাসিক ১২৫ টাকা। মেঘনাদ সাহার উপর ভার পড়লো কোয়ান্টাম থিওরি নিয়ে পড়াশোনার। সত্যেন বসুকে পড়তে হবে আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি থিওরি। স্যার আশুতোষের কাছে তাঁরা স্বীকার করে এসেছেন যে এক বছরের মধ্যে পড়াশোনা করে নিজেদের তৈরি করে নেবেন এবং তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করবেন। বলে তো এলেন, কিন্তু বই পাবেন কোথায়? রিলেটিভিটির কিছু ইংরেজি বই পাওয়া গেলো। শিবপুর কলেজের ইংরেজ অধ্যাপক ডঃ ব্রাউলের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে পাওয়া গেল ম্যাক্স প্ল্যাংক, লুডবিগ বোল্‌টজম্যান (Ludwig Boltzman) ও উইলহেল্‌ম বিন (Wilhelm Wien) – এর জার্মান বই। মেঘনাদ সাহা জার্মান শিখলেন এবং বইগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন। কিছু প্রয়োজনীয় বই পাওয়া গেল ফরাসী ভাষায়। সত্যেন বসু ফরাসী ভাষা শিখলেন বইগুলো পড়ার জন্য।

এক বছরের মাথায় ১৯১৭ সাল থেকেই সায়েন্স কলেজে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ানো শুরু হলো ফলিত গণিত, পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন। পদার্থবিদ্যা পড়ানোর দায়িত্ব পেলেন শৈলেন ঘোষ, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বসু, যোগেশ মুখার্জি, জ্ঞান ঘোষ প্রমুখ। কিছুদিনের মধ্যে জ্ঞান ঘোষ ‘পালিত স্কলারশিপ’ নিয়ে লন্ডনে চলে গেলেন উচ্চতর শিক্ষার জন্য। যোগেশ মুখার্জিও পেলেন সেই বৃত্তি। সত্যেন বসুও ভাবলেন বৃত্তিটা পেলে ভালো হয়। বিদেশ যাওয়াও হয়, উচ্চশিক্ষাও হয়। স্যার আশুতোষ মুখার্জির কাছে এই কথা তুলতেই তিনি হেসে বললেন, “বিয়ে করেছো যে। ব্যাচেলর ছাত্র-গবেষকদের জন্যই ‘পালিত স্কলারশিপ’”। তারকনাথ পালিত – যিনি এই বৃত্তিটা চালু করেছিলেন, ভাবতেন বিবাহিত ছাত্ররা বৃত্তির টাকায় বিদেশে গেলে সব টাকা পড়াশোনা ও গবেষণার কাজে খরচ করবে না। টাকা জমিয়ে দেশে পাঠাবার চেষ্টা করবে, স্ত্রী ও সন্তানদের মনোরঞ্জন করতে চাইবে। তাই তিনি বিবাহিতদের ‘পালিত স্কলারশিপ’ পাবার অনুপযুক্ত ঘোষণা করেছিলেন। কাজেই এখানেও ব্যর্থ হলেন সত্যেন বসু।

১৯১৭ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত সায়েন্স কলেজেই কাটলো। ১৯২০ সালে সত্যেন বসু মেঘনাদ সাহার সাথে যৌথভাবে আইনস্টাইনের “থিওরি অব রিলেটিভিটি” বাংলায় অনুবাদ করেন। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সত্যেন বসু যোগ দিলেন এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রিডার বা এসোসিয়েট প্রফেসর পদে। তখন মাসিক বেতন ছিল চারশ’ টাকা। সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম অংশ অতিবাহিত করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর খ্যাতির উৎস ও বিস্তার ভূমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাধারণ অপরিসর ঘরে বসে সত্যেন বসু লিখলেন “প্ল্যাঙ্কের সূত্র ও আলোক কোয়ান্টাম তত্ত্ব”। চার পৃষ্ঠার প্রবন্ধটি পাঠালেন ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান সাময়িকী ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে। কিন্তু সেখানে লেখাটি প্রকাশের যোগ্য বিবেচিত হলো না। এতে দমে গেলেন না সত্যেন বসু। তিনি লেখাটি পাঠিয়ে দিলেন জার্মানিতে খোদ আইনস্টাইনের কাছে। সত্যেন বসু আইনস্টাইনকে লিখলেন, “Respected Sir, I have ventured to send you the accompanying article for your perusal and opinion”।

বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সত্যেন বসুর প্রতিভাকে চিনতে ভুল করলেন না। তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ‘সাইটশ্রিফ্‌ট ফ্যুর ফিজিক’ (Zeits Fur Physik) জার্নালে নিজের মন্তব্য সহ প্রকাশের ব্যবস্থা করলেন। সত্যেন বসুর প্রবন্ধ সম্পর্কে আইনস্টাইন লিখলেন, “আমার মতে বোস কর্তৃক প্ল্যাঙ্কের সূত্র নির্ধারণ পদ্ধতি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ”।

সত্যেন বসুর কাছে লেখা আইনস্টাইনের চিঠির সূত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সত্যেন বসুর জন্য দুই বছরের শিক্ষাছুটি মঞ্জুর করলো। ১৯২৪ সালে সত্যেন বসু গেলেন ইউরোপে। জার্মানিতে গিয়ে দেখা করলেন আইনস্টাইনের সাথে। খোলামেলা বৈজ্ঞানিক আলোচনা করলেন আইনস্টাইন ও সত্যেন বসু। জার্মানি থেকে প্যারিসে গিয়ে মাদাম কুরির সাথে দেখা করলেন। মাদাম কুরির ল্যাবোরেটরিতে কিছু কাজ করারও সুযোগ পেলেন সত্যেন বসু। দ্য ব্রগলির ল্যাবেও কাজ করেছিলেন কিছুদিন। ১৯২৪ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ইউরোপের বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানীদের সাথে বৈজ্ঞানিক সাক্ষাৎ সত্যেন বসুর গবেষণা ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দেশে ফেরার পর ১৯২৭ সালে সত্যেন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার প্রধান অধ্যাপক এবং সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন নির্বাচিত হন।

১৯২৯ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে পদার্থবিদ্যা ও গণিত শাখার সভাপতি এবং ১৯৪৪ সালে বিজ্ঞান কংগ্রেসের প্রধান সভাপতি মনোনীত হন তিনি। ১৯২১ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জীবনের শ্রেষ্ঠ পঁচিশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিবাহিত করেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ সৃষ্টিতে সত্যেন বসুর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

১৯৪৫ সালে সত্যেন বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ‘খয়রা অধ্যাপক’ হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ঐ পদে কাজ করেন। ১৯৫৪ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্ম বিভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৫২ সালে সত্যেন বসু রাজ্যসভার সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে ‘খয়রা অধ্যাপক’ পদ থেকে অবসর নেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর দুই বছরের জন্য তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সত্যেন বসুকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৫৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক পদে মনোনীত করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সত্যেন বসু এই পদ অলংকৃত করে গেছেন।

মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বলতেন, “যারা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, তাঁরা হয় বাংলা জানেন না, নয়তো বিজ্ঞান জানেন না”। স্মরণযোগ্য যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকেও তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই লিখিয়ে নিয়েছিলেন। সত্যেন বসুর প্রত্যক্ষ উৎসাহেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক বই ‘বিশ্ব পরিচয়’ লেখেন ১৯৩৭ সালে। রবীন্দ্রনাথ সত্যেন বসুকেই উৎসর্গ করেছিলেন ‘বিশ্ব পরিচয়’। এ প্রসঙ্গে সত্যেন বসু বলেন, “নোবেল পুরষ্কার লাভ করলেও আমি এতটা কৃতার্থ বোধ করতাম না”। এটা অবশ্যই সত্যেন বসুর বিনয়। সত্যেন বসুকে নোবেল পুরষ্কার না দেয়াটা নোবেল কমিটির অনেক সদস্যের কাছেও এখনো বিস্ময় এবং হতাশার কারণ। আর হবে নাই বা কেন? সত্যেন বসুর আবিষ্কারের উপর গবেষণা করে পরবর্তীতে কমপক্ষে তিনজন পদার্থবিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।

অবশ্য এটা সত্য যে দশক বা শতাব্দীর বিচারে কোন বিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কার পেলেন কি পেলেন না তা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো বিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর নাম অক্ষয় হবে কি না। তাঁর অবদান সর্বদাই আলোচিত, পঠিত এবং ব্যবহৃত হবে কি না। সত্যেন বসু আলোচিত হবেন, সম্মনিত হবেন ততদিন যতদিন বিজ্ঞানের চর্চা থাকবে। তিনি চিরঞ্জীব তাঁর সৃষ্ট সংখ্যায়ন তত্ত্বে, তাঁর নামে নামকৃত বোসন কণাসমূহে, বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যানে, প্রাইম নাম্বার থিওরিতে, পদার্থের পঞ্চম অবস্থা নামে পরিচিত বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবনে, গণিতে, সাহিত্যে এবং সঙ্গীতে। বলাবাহুল্য আইনস্টাইন যেমন বেহালা বাজাতেন, গণিতজ্ঞ পিন্‌লে বাজাতেন পিয়ানো, রিচার্ড ফাইনম্যান বাজাতেন বঙ্গো ড্রাম, তেমনি সত্যেন্দ্রনাথ বসুও বাজাতেন এস্রাজ – পেশাদারী দক্ষতায়।

সত্যেন বসু ছিলেন আত্মভোলা মানুষ। সব বিজ্ঞানীই মনে হয় কম-বেশী আত্মভোলা। নিউটন, আইনস্টাইন, আর্কিমেডিস, গ্যালিলিও সম্পর্কেও আমরা শুনেছি। সত্যেন বসুরও অনেক মজার ঘটনা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সময়ের একটা ঘটনার উল্লেখ করেছেন কাজী মোতাহার হোসেন সত্যেন বসুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে। একদিন সত্যেন বসুর মেয়ে বায়না ধরলো সিনেমা দেখতে যাবে। সত্যেন বসু তখন গণিতের একটা জটিল সমস্যার সমাধানে ব্যস্ত। তবুও মেয়ের পীড়াপীড়িতে রাজী হলেন। মেয়েকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে গেলেন মুকুল সিনেমায় (পরে এই সিনেমা হলের নাম হয়েছে আজাদ)। গাড়ী থেকে নেমে গাড়োয়ানকে টাকা দিতে গিয়ে দেখেন মানিব্যাগ ফেলে এসেছেন বাসায়। চিন্তিত মুখে মেয়েকে বললেন, “তুই এখানে একটু অপেক্ষা কর মা, আমি বাসায় গিয়ে মানিব্যাগটা নিয়ে আসি”। একই ঘোড়ার গাড়ীতে ফিরে এলেন বাসায়। নিজের টেবিলের ওপর থেকে মানিব্যাগটা তুলে নিতে গিয়ে নজর পড়লো যে বৈজ্ঞানিক সমস্যাটির সমাধান খুঁজছিলেন তার ওপর। অমনি সব ভুলে গিয়ে সমস্যাটির সমাধানে বসে গেলেন। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে। গাড়োয়ান অপেক্ষা করছেন তো করছেনই। সাহস করে হাঁকডাকও করতে পারছেন না। এত বড় বিজ্ঞানীর বাড়ীতে কি হাঁকডাক দেয়া চলে? কিন্তু দু’ঘন্টা পরেও যখন তাঁর প্রিয় ‘বোস সাহেব’ বেরোলেন না, গাড়োয়ান সাহস করে ঘরে ঢুকে দেখলেন সত্যেন বসু চেয়ারে বসে অংক কষছেন নির্বিকার চিত্তে। গাড়োয়ানের ডাকে চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার?” গাড়োয়ান কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “হুজুর, আপনি টাকা নিয়ে সিনেমা হলে যাবেন বলেছিলেন। আপনার মেয়ে সেখানে অপেক্ষা করছে”। এবার সত্যেন বসু সম্বিত ফিরে পেলেন, “তাই তো, বড্ড ভুল হয়ে গেছে”।

জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত কাজের মধ্যে অতিবাহিত করেছেন প্রফেসর সত্যেন্দ্রনাথ বসু। মৃত্যুর আগের দিনও তিনি প্রাইম নাম্বার নিয়ে গবেষণা করেছেন। ১৯৭৪ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ভোর ছ’টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন সত্যেন বসু। আশি বছরের একটা কর্মময় জীবন কাটিয়ে গেলেন এই পৃথিবীতে। পেছনে রেখে গেলেন তাঁর অমর কীর্তি।