ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন [০১] [০২] [০৩] [০৪] [০৫] [০৬] [০৭] [০৮] [০৯]
১০
শুক্রবার ১৭ জুলাই ১৯৯৮
ইয়ারা ইয়থ হোস্টেল

রাত বারোটার পর শুক্রবারকে কি তুমি শনিবার বলো, নাকি সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো? বাংলা নিয়মে ঠিক কীভাবে চব্বিশ ঘন্টা হিসেব করা হয় কোনদিন ভেবেও দেখিনি। কেউ কেউ বলেন সূর্যোদয় থেকে পরের দিনের সূর্যোদয় পর্যন্ত একটা দিন। সেরকম হিসেব করলে তো একেক দিনের দৈর্ঘ্য একেক রকম হবে। কারণ সূর্যোদয় তো প্রতিদিন একই সময়ে হয় না। ব্যাপারটা জটিল মনে হচ্ছে আমার কাছে। তার চেয়ে ইংরেজি কায়দা অনেক সহজ- রাত বারোটার পর দিন বদলে যায়। তবে এখানে এখন রাত দুটো বেজে গেলেও শুক্রবারকে আমি শনিবার বলছি না। কারণ আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি মেনে চলার চেষ্টা করছি। আমি শনিবারে বলবো – আর তুমি শুক্রবারে বসে তা শুনবে তা তো হয় না। একই রেফারেন্স ফ্রেম দরকার, বুঝলে?

আজকেও লাউঞ্জে বসে আছি কি না? ইয়েস। না – ‘নাসিকা গর্জন’ চলে গেছে সকালে আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই। এখন আরেকজন ঘুমাচ্ছেন – পরিচয় হয়নি এখনো। আরে না, মেয়ে না, সব দিন মেয়ে আসবে নাকি? আজ অনেক ঘটনা ঘটেছে, অনেক অভিজ্ঞতা আর অনেক বাংলাদেশীর সাথে দেখা হয়েছে একটা বাসায়। আলী সাহেব নিয়ে গিয়েছিলেন। হ্যাঁ, শুরু থেকেই বলছি।

সকালে ঘুম ভেঙেছে আটটার দিকে। উঠে দেখি স্টেফির কোন চিহ্নই নেই রুমে। ভোরে উঠেই চলে গেছে। মনে হলো বাঁচা গেলো। ইচ্ছে করছিলো সারাদিন ঘুমিয়ে রাতের ঘুমটা উশুল করে নিই। কিন্তু উপায় নেই। আজ অনেক কাজ। বাসার এপ্লিকেশানটা করতে হবে। একটা বাসা পাওয়া ভীষণ দরকার। যে রকমই হোক – স্বাধীনভাবে ঘুমানো তো যাবে।

কাউন্টারে গিয়ে আজ রাতের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে কার্ডে একটা সিল নিয়ে নিলাম। মাত্র তিনটা হলো – আরো ছয়টা সিল লাগবে হোস্টেলের মেম্বারশিপ পেতে। আমার অবশ্য খুব একটা উৎসাহ লাগছে না। রাতের গেটের কোড নাম্বারটা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইউনিভার্সিটি। কেনের অফিসের সামনেই আমার অফিস হওয়াতে প্রতিদিনই দেখা হবে কেনের সাথে। মাত্র সাড়ে ন’টা বাজে- অথচ কেন্‌কে দেখে মনে হলো অফিসে এসেছেন অনেকক্ষণ। আমাকে ঠিক ক’টায় আসতে হবে জেনে নিতে হবে।

নিজের চাবি দিয়ে অফিসরুম খুলে ভেতরে ঢুকতে অন্যরকম একটা অনুভূতি হলো আজ। ডেস্কে ধুলো জমে আছে। এখানে নিজের ডেস্ক নিজেকেই পরিষ্কার করতে হবে। বেয়ারা বা পিয়ন বা ঝাড়ুদার বা এরকম চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী বলতে যাদের বোঝায় – সেই শ্রেণীটাই মনে হয় নেই এ দেশে।

বাসা ভাড়ার দরখাস্তটা ফিল আপ করতে গিয়ে মেজাজ খারাপ হবার জোগাড়। কোন তথ্যই তো দিতে পারছি না ঠিকমত। বর্তমান ঠিকানা – ইয়ারা ইয়থ হোস্টেল। ফোন নাম্বার – হ্যাঁ, অফিসের ফোন নাম্বারটা ব্যবহার করা যাবে। আগের বাড়িওয়ালার নাম-ঠিকানাঃ আবদুস ছালাম, চকবাজার, চট্টগ্রাম। কিন্তু বাড়ি ভাড়ার রসিদ পাবো কোথায়? তার ওপর ব্যাংক স্টেটমেন্ট। দু’দিন আগে যে একাউন্টটা খুলেছি তাতে আছে মাত্র পাঁচ ডলার। পাঁচ ডলারের ব্যাংক হিসাব দেখলে রিয়েল এস্টেট এজেন্টের মেজাজ যা হবে না! কোন মানে হয় না দরখাস্ত করার। কিন্তু বাসা তো পেতে হবে।

“ডোন্ট ইউ ওয়ারি প্রাডিব, আই উইল রাইট এ রেফারেন্স লেটার ফর ইউ” – কেনের কাছে গিয়ে বাসার দরখাস্তের ব্যাপারে বলতেই অভয় দিলেন তিনি। বললেন স্কলারশিপ অফিস থেকে একটা চিঠি জমা দিলেই হয়ে যাবে। আমার থাকা খাওয়া বাবদ ইউনিভার্সিটি যা দিচ্ছে বাসা পাওয়ার জন্য ওটাই যথেষ্ঠ।

স্কলারশিপ অফিসে গিয়ে চিঠির কথা বলার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হয়ে গেল। মনে হয় এরকম চিঠি এরা অনেকের জন্যই লিখে থাকেন। ফরম্যাট করা আছে, কেবল নামটা বদলে দিলেই হলো। চিঠি চাইলাম একটা – বুড়ো অফিসার চার কপি প্রিন্ট করে সবগুলোতে সাইন করে দিলেন। বললেন, “ইউ মে নিড লাইটার”। লাইটার? শুনে একটু খট্‌কা লাগলো। লাইটার দিয়ে কী করবো আমি? একটু পরেই বুঝতে পারলাম – ‘লাইটার’ মানে ‘লেইটার’। এটার পর আরো দরখাস্ত করতে হলে যেন বার বার আসতে না হয় সেজন্য একবারেই চারটা দিয়ে দিলেন।

কেন্‌ একটা জোরালো সুপারিশপত্র লিখে নিজের লেটারহেডে প্রিন্ট করে দিলেন তিন কপি। রেফারেন্স লেটারে সাইন করতে করতে বললেন, “ইট্‌স নট অলওয়েজ ইজি টু গেট এক্‌জেক্টলি হোয়াট ইউ ওয়ান্ট। সো ইট্‌স বেটার টু কিপ মোর দ্যান ওয়ান চয়েজ”। সোজা বাংলা অর্থ হলো আমাকে একাধিক বাসার জন্য দরখাস্ত করতে হবে। একটা তো আগে করে দেখি – কী অবস্থা হয়।

এগারোটার দিকে গেলাম হকিং স্টুয়ার্টের অফিসে। গতকালের মেয়েটিই কাজ করছে রিসেপশানে। দরখাস্ত জমা নেবার সময় দেখে নিলো সব ঠিকঠাক দিয়েছি কি না। সব ঠিক আছে। বাসা পাবো কি পাবো না কখন জানতে পারবো জিজ্ঞেস করলে সে জানালো – আমি ছাড়াও আরো ছ’জন দরখাস্ত করেছে এই বাসাটির জন্য। সব দরখাস্ত পাঠিয়ে দেয়া হবে বাসার মালিকের কাছে। মালিক যাকে ঠিক করবেন – তাকেই বাসা দেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে মালিকের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত। এখানে ফেয়ার সিলেকশানের আশা করা বৃথা।

নিজের ডেস্কে বসে কিছুটা আত্মস্থ হবার চেষ্টা করলাম দুপুরে। যে তিনজনের সাথে আমার অফিস শেয়ার করতে হবে – তারা কেউই নেই। সোমবার থেকে সেমিস্টার শুরু হচ্ছে। তখন হয়তো আসবে তারা। আজ শুধু পিটারের সাথে দেখা হলো। কাঁধ সমান লম্বা চুলের বাচ্চা-বাচ্চা দেখতে ছেলেটির পরিচয় জানার পর কী যে অবাক হয়েছি। গতকাল কেন্‌ একবারও বলেন নি যে এই পিটার-ই হলেন ডঃ পি জে ডর্টস্‌ম্যান। যার পেপার আমি ব্যবহার করেছি আমার মাস্টার্স থিসিসের রেফারেন্স হিসেবে।

পিটার কেনের ছাত্র। পিএইচডি শেষ করেছেন ১৯৯২ সালে। তারপর থেকে কেনের প্রজেক্টে কাজ করছেন পোস্টডক্টরেট ফেলো হিসেবে। এদেশে ছাব্বিশ বছর বয়সে পিএইচডি কমপ্লিট করা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। সে হিসেবে পিটারের বয়স এখন বত্রিশ। কিন্তু দেখতে মনে হয় বড়জোর বাইশ। ইতোমধ্যেই তার তেইশটি পেপার পাবলিশড হয়েছে ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার আর ফিজিক্যাল রিভিউর মত প্রেস্টিজিয়াস জার্নালে।

পিটারের অফিস ৬০১ নম্বর রুমে। ৬১২ নম্বর রুমে বসে কাজ করছেন – কারণ আমাদের রিসার্চ গ্রুপের মূল কম্পিউটার ‘হিগ্‌স’ এর অবস্থান এই রুমেই। এত বড় বড় কম্পিউটার দেখেই ভয় লাগছে আমার। কাজ করবো কীভাবে জানি না। আমার ডেস্ক থেকেই দেখা যায় পিটারের কম্পিউটার স্ক্রিন। বাংলাদেশে যে ধরণের কম্পিউটারের সাথে আমার অতি সামান্য পরিচয় আছে – এ কম্পিউটারগুলোর সাথে তাদের চেহারার কিছুটা মিল আছে বটে – কিন্তু কর্মপদ্ধতির কোন মিল নেই। বুঝতে পারছি না আমার মত কম্পিউটার-অশিক্ষিতের যে কী অবস্থা হবে।

আলী সাহেব বলেছিলেন সাড়ে পাঁচটার দিকে রেডি হয়ে থাকতে। তিনি কাজ শেষে যাবার পথে হোস্টেল থেকে তুলে নেবেন আমাকে। পাঁচটার আগেই রুমে চলে এসেছি। এসে দেখি হ্যাঙ্গারে অপরিচিত তোয়ালে ঝুলছে। তার মানে আজকেও আরেকজন এসে গেছে রুমে। অন্য কোন জিনিসপত্র চোখে পড়ছে না। আগন্তুক পুরুষ না মহিলা বুঝতে পারছি না। যাই হোক কোন সমস্যা নেই – কেবল নাক না ডাকলেই হলো।

ছ’টা বাজতে না বাজতেই কিচেনে ব্যস্ততা আর ভীড় বাড়তে থাকে এখানে। নানারকম মানুষের নানারকম রান্না। তারপর লাউঞ্জের সোফা চেয়ার টেবিল দখল করে খেতে বসা। যারা রান্না করে খাচ্ছে তাদের বেশির ভাগই দু’তিনজনের গ্রুপ। লাউঞ্জের সোফা দখল করে খেতে বসেছে পাঁচজনের একটা গ্রুপ। আমার ডিনার আজ কোথায় হবে ঠিক জানি না। আলী সাহেব বলেছেন একটা বাংলাদেশী পরিবারের পার্টিতে নিয়ে যাবেন। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা বাড়িতে অনাহুত গিয়ে খাবারের টেবিলে বসে যাবো! ভাবতেই অস্বস্তি লাগছে। কিন্তু আলী সাহেবের মুখের ওপর ‘যাবো না’ বলি কীভাবে? তাছাড়া এদেশে প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী বাংলাদেশীদের লাইফ-স্টাইল জানার কৌতুহলও আছে।

জানালার পাশে একটা চেয়ার দখল করে বসেছি। এখান থেকে হোস্টেলের সামনের রাস্তা দেখা যায়। সাড়ে ছ’টার দিকে আলী সাহেবের ফোর্ড ফ্যালকন এসে থামলো হোস্টেলের সামনে। দ্রুত বেরিয়ে এলাম রাস্তায়।

শুক্রবারের সন্ধ্যা জমজমাট। রাস্তায় গাড়ির ভীড়। সিটি ছাড়িয়ে সাবার্বের দিকে চলেছে আলী সাহেবের গাড়ি। রাস্তার দু’পাশে অনেক খালি জায়গা। হবে না কেন? এত বড় দেশের জনসংখ্যা দু’কোটিরও কম। প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র পাঁচ জন লোক বাস করে এ দেশে। কিছুদূর পর পর ছোট ছোট টাউনশিপ। প্রত্যেক সাবার্বই স্বয়ং সম্পূর্ণ। বড় বড় সুপারমার্কেট আছে সব সাবার্বেই। দেখতে দেখতে আলী সাহেবের বাড়ি এসে গেল। রাস্তার আলোতেই দেখতে পাচ্ছি – বিশাল প্রাসাদের মত একটা বাড়ি।

গাড়িতে বসেই টিভির রিমোটের মত একটা রিমোটের বোতামে চাপ দিতেই গ্যারেজের দরজা খুলে গেল। গাড়ি ঢুকে গেল গ্যারেজে, থেমে গেলো বিশাল এক পাজেরোর পাশে। গ্যারেজের ভেতর দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকার একটা দরজা আছে। ঢুকেই মনে হলো – এ আমি কোথায় এলাম! এত বড় লাউঞ্জরুম একটা বাড়ির!

কিচেন এরিয়াটা মনে হচ্ছে মসৃণ কালো পাথরের তৈরি। নিজের চেহারা দেখা যায় – মেঝেতে, দেয়ালে, যেদিকে তাকাই। ছোট বড় তিনটা আলাদা আলাদা বসার জায়গা লাউঞ্জে। পুরু মখমলের কার্পেটে পা ডুবে যাচ্ছে।

“মিনিট পাঁচেক বসো প্রদীপ। আমি বিট্টুকে ডেকে দিচ্ছি। বিট্টু- বিট্টু”
চারদিক নিঃস্তব্ধ। এত বড় বাড়ি – অথচ কোথাও কোন শব্দ নেই। আলী সাহেব টিভি ছেড়ে দিয়ে দোতলায় উঠে গেলেন একপাশের সিঁড়ি দিয়ে। সিনেমায় দেখা বড়লোকের বাড়ির বৈঠকখানা যেমন হয় – ঠিক সেরকম মনে হচ্ছে। এক পাশের দেয়ালে লাগানো বাংলাদেশের পতাকা দেখে হঠাৎ একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো। দেশের বাইরে না গেলে মনে হয় দেশের প্রতি ভালোবাসাটা এত বেশি বোঝা যায় না।

টিভিতে নিউজ চলছে – এবিসি নিউজ। এত বড় টিভিও দেখিনি আগে কখনো। এখানে সব কিছুই সাইজই অনেক বড় মনে হচ্ছে। সিঁড়িতে শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখলাম। দ্রুত নেমে আসছেন একজন মোটাসোটা মানুষ। কাছে এসে হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে- “বিট্টু”।
“প্রদীপ”
“কেমন আছেন?”
মোলায়েম কন্ঠ বিট্টুর। মনে হলো বেশ হাসিখুশি মানুষ। কিছুক্ষণ কথা হলো তাঁর সাথে। আমার কথা কিছুটা শুনেছেন তাঁর দুলাভাইয়ের কাছে। আমার জন্য পার্ট-টাইম কাজ দেখবেন বললেন।

মিনিট দশেকের মধ্যেই রেডি হয়ে নেমে এলেন আলী সাহেব। সাথে তাঁর স্ত্রী আর বারো-তেরো বছরের ছেলে- মণি। পরিচয় হলো। ভাবীও আলী সাহেবের মতই উদার আর ভীষণ অমায়িক। চা খাওয়ার জন্য জোর করলেন। তাঁকে নিজের হাতেই চা বানাতে হলো। বাংলাদেশে হলে এই বাড়িতে অন্তঃত দশজন কাজের লোক থাকতো। এখানে একজনও নেই। আবার ধরতে গেলে এখানে যারা থাকেন সবাই কাজের লোক। সবাইকেই সব কাজ করতে হয়। ভাবী নিজেও ব্যবসা দেখাশোনা করেন, আবার রান্না থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজও দেখে রাখেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার গাড়িতে। এবার পাজেরো। এত দামী গাড়িতে আগে চড়িনি কখনো। আলী সাহেব গাড়ি চালাচ্ছেন, পাশে তাঁর স্ত্রী। আমি কিছুটা সংকুচিত হয়ে বসেছি পেছনে মণির পাশে। মণি পড়ে ক্লাস সেভেনে। বাংলা বোঝে – তবে ফ্লুয়েন্টলি বলতে পারে না। আর বয়সের তুলনায় তাকে বেশ গম্ভীর বলেই মনে হলো। গাড়িতে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে রেজওয়ানার কন্ঠে- “যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে- এই নিরালায় রব আপন কোণে”। কতদিন পরে শুনলাম! কান-মন দুটোই জুড়িয়ে গেল।

বেশিক্ষণ লাগলো না পৌঁছুতে। বিশাল এক বাড়ির সামনে বিশ-তিরিশটা গাড়ি পার্ক করা আছে রাস্তার পাশে, বাড়ির গেটে, এখানে-সেখানে। কার বাড়ি, কোন্‌ সাবার্ব কিছুই জানি না। গাড়ি থেকে নেমে আলী সাহেবের পিছু পিছু ঢুকে গেলাম বাড়ির ভেতর। আলী সাহেবকে দেখে এগিয়ে এলেন পাজামা-পাঞ্জাবী পরা একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক।
“আস্‌সালামুয়ালাইকুম আলী ভাই। আসেন আসেন। আস্‌সালামুয়ালাইকুম ভাবী। আসেন। মণি কেমন আছ? সনি আসে নাই? আসেন আসেন। ভাবী আপনি উপরে চলে যান”

ভদ্রলোকের মাথায় একটা গোল জালি-টুপি। গোঁফহীন লম্বা দাড়ি। চেহারায় এক ধরণের কাঠিন্য। আলী সাহেব আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন- “চৌধুরি, ও হলো প্রদীপ। গত সপ্তাহে এসেছে বাংলাদেশ থেকে। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে”।

“আস্‌সালামুয়ালাইকুম” বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন চৌধুরি সাহেব। বেশ শক্ত হাত। হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন,
“আপনি কি প্রদীপ রায়হান? নাকি রহমান?”
“আমি প্রদীপ দেব”
“প্রদীপ দেব – হিন্দু না?”

এ ধরণের প্রশ্নের মুখোমুখি হবো ভাবিনি। মেলবোর্নের বাংলাদেশীদের মধ্যে কি ধর্মীয় বিভাজনটা খুব প্রকট? বুঝতে পারছি না কোথায় এসে পড়েছি। অস্বস্তি লাগছে খুব। চৌধুরি সাহেব সম্ভবত বুঝতে পারলেন আমার অবস্থা।

“কিছু মনে করবেন না। আমাদের একজন প্রদীপ রায়হান আছেন তো। তাই জিজ্ঞেস করলাম। আসেন আসেন বসেন”।

ভদ্রলোক চলে গেলেন অন্য অতিথিদের দেখাশোনা করতে। বিশাল বসার ঘর। দেয়ালে মক্কা-মদিনার ছবি। বড় বড় সোফা। প্রাচুর্য উপচে পড়ছে। অতিথিদের সবাই যে খুব ধনী তা তাদের দামী পোশাক পরিচ্ছদ দেখে আর কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারছি। আলোচনার বিষয়-বস্তুর বেশিরভাগই অর্থনৈতিক। ইন্টারেস্ট রেট কত, কোন্‌ সাবার্বে বাড়ির দাম কত, কে সম্প্রতি বাড়ি কিনেছেন, গাড়ি কিনেছেন। কথাবার্তা বাংলায় চললেও ইংরেজি শব্দ আর বাক্যাংশের প্রাধান্যই বেশি।

অপরিচিতির অস্বস্তি নিয়ে বসে থাকা আর তাঁদের কথাবার্তা শোনা ছাড়া আমার আর কোন ভূমিকা নেই। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছেন আমি কী করছি, কখন এসেছি ইত্যাদি। তারপর নিজেদের পরিচিতদের সাথে কথা বলছেন। আলী সাহেব তাঁর পরিমন্ডলে প্রধান বক্তার ভূমিকা পালন করছেন। অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে হাওয়ার্ড গভমেন্ট কী ভূমিকা রাখছেন – ২০০০ সাল থেকে জি-এস-টি চালু হচ্ছে। তার সুবিধে অসুবিধে নিয়ে আলাপ চলছে। জি-এস-টি কী বস্তু আমি জানিই না।

একটা জিনিস খেয়াল করলাম – এই পারিবারিক পার্টিতে পুরুষ-মহিলার বিভাজন খুবই প্রকট। পরিবারের সবাই এক সাথে এলেও ঘরে ঢুকেই পুরুষ মহিলা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। পুরুষরা সব এখানে বসেছেন। মহিলারা চলে যাচ্ছেন উপরে। বাচ্চারা নিজেদের মত খেলছে দৌড়োচ্ছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এলো। আসর গরম করার জন্য আর কিছুর দরকার নেই। অতিথিরা প্রধানতঃ দু’ভাগ হয়ে গেলেন। আলী সাহেব সহ আরো কয়েক জন আওয়ামী লীগ আর বেশির ভাগই বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক। শেষের দলের গলার জোর বেশি। ছিয়ানব্বই থেকে আটানব্বই – এই দু’বছরেই হাসিনা সরকার যে বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করে ফেলেছে তা প্রমাণ করার জন্য নানারকম অর্ধসত্য আর মিথ্যা এমন ভাবে পরিবেশিত হতে শুরু করলো! তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না যে এই আলোচনা মেলবোর্নে বসে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই আলোচনা চলছে বাংলাদেশের কোন পাড়ার চায়ের দোকানে বা সেলুনে।

একটু পরে একজন যুবক এসে বসলো আমার পাশে। নাম জাহাঙ্গীর। বাড়ি নাকি চট্টগ্রাম। খুশি হয়ে আলাপ জমাতে চাইলাম। বাড়ি চট্টগ্রাম শুনে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কাজ হলো না। জাহাঙ্গীর চট্টগ্রামে গিয়েছিলো জীবনে মাত্র কয়েকবার – তাও ছোটবেলায়। স্কুল-জীবন থেকেই সে বড় হয়েছে লন্ডনে। তার বাবা বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ-পদস্থ আমলা। ভীষণ প্রভাবশালী সচিব ছিলেন বিএনপি’র আমলে। ছিয়ানব্বই-তে আওয়ামী সরকার আসার পর অবসরে গেছেন। জাহাঙ্গীর মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে এসেছে এক বছরের জন্য। এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট হিসেবে। পৃথিবীর অনেক দেশের ভালো ভালো ইউনিভার্সিটির মধ্যে এরকম স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ চুক্তি আছে। স্টুডেন্টরা চাইলে কয়েকটা সেমিস্টার অন্য কোন দেশে গিয়ে করে আসতে পারে।

জাহাঙ্গীরের বাবার সাথেও কথা হলো একটু করে। ভদ্রলোকের ব্যবহার বেশ মোলায়েম। বড় বড় আমলাদের ব্যবহার হয়তো এরকমই হয়। ডিপ্লোম্যাটিক। চেহারা দেখে বা কথা শুনে মনের ভাব বোঝার কোন উপায় নেই।

চৌধুরি সাহেব এসে খবর দিলেন- খাবার দেয়া হয়েছে। সবাই উঠে দাঁড়ালেন। আলী সাহেব আমাকে বললেন, “খাবার নিতে লজ্জা করো না। লজ্জা করলে কিন্তু খেতে পারবে না। এখানে যার খাবার তাকে নিয়ে খেতে হয়”। অর্থাৎ এখানে খাবার কেউ পাতে তুলে দেয় না। সিস্টেমটা একটু অন্যরকম। এক কোণায় টেবিলে সব খাবার রাখা আছে। সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে টেবিল থেকে খাবার প্লেটে তুলে সোফায় এসে বসে খাচ্ছে। দরকার হলে আবার গিয়ে নিয়ে আসছে। সিস্টেমটা ভালো। যে যার মত নিয়ে নিচ্ছে। ডায়নিং টেবিলের দরকার নেই। প্লাস্টিকের প্লেট-চামচ ধোয়ার দরকার নেই- খাওয়া হয়ে গেলে ফেলে দিলেই হলো।

খাবার নেবার সময় মহিলাদের দেখা গেলো। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। পুরুষেরা কেউ কেউ “ভাবী কেমন আছেন? মেয়ে কোথায় পড়ছে? আমাদের বাসায় তো অনেকদিন আসেন না” জাতীয় বাক্যালাপ করছেন। বেশ হৈ চৈ হচ্ছে। খাওয়ার শব্দ, খাবার নেবার শব্দ, বাচ্চার কান্না, হাসির শব্দ সব মিলিয়েই তো পার্টি।

অনেকদিন পর বাংলাদেশী স্টাইলের রান্না খেয়ে ভালোই লাগলো। বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে ফিরে এসে দেখি আলী সাহেব কথা বলছেন একজন মহিলার সাথে। শাড়ীপরা মহিলা হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আলী সাহেবের সামনে। আমার দিক থেকে মহিলার মুখ দেখা যাচ্ছে না। আলী সাহেব বলছেন,

“ভাবী শুনলাম দেশে গেসিলেন?”
“জ্বি ভাই। এক মাস থাইকা আইলাম”
“ফিরলেন কবে?”
“লাস্ট থার্সডে”
“সো হাউ ওয়াজ ইট্‌?”
“দ্যাসে বোঝেন তো – বের অওয়া যায় না। রাস্তায় জ্যাম, ময়লা, ধুলো আর কী যে বিস্‌টি। ঢাকায় তো একটু বিস্‌টিতেই হাঁটু-পানি”
“এলেন কিসে? সিঙ্গাপুরে?”
“না ভাই, চিঙ্গাপুর পাই নাই, তাইতে আইলাম”
“জ্বি?”
“তাই এয়ারলাইন্স”
“ও, থাই এয়ারলাইন্স। আমাকেও যেতে হতে পারে। আমার মায়ের শরীরটা ভালো নেই। সার্ভিস কেমন থাইয়ের?”
“সার্বিচ খারাপ না। তবে ছমচ্যা করে তো বাংলাদ্যাসী পেচেঞ্জাররা। চিল্লা-পাল্লা করে একছ্যাস”
“আমিও শুনেছি। ঢাকা থেকে ব্যাংকক পর্যন্ত নাকি খুব গোলমাল করে। মদটদ খেয়ে নাকি মাতাল হয়ে যায় সব”
“বেংকক পয্যন্ত তো আছেই। কী যে যন্ত্রণা করছে একজন এইবার। আমার পাসে বসছে বুজচেন। একটু পর পর ড্যাবড্যাব কইরা মুখের দিকে তাকাই থাকে। ছামচ দিয়া খাইতে জানে না – হাত দিয়া খায়। ছ্যাসে না পাইরা উইঠা চইলা গেসি পিছনে”

মহিলাকে খুব চেনা চেনা লাগছে।
“ব্যাংকক থেকে মেলবোর্নের অবস্থা কেমন?”
“খারাপ না। তবে পচুর বাংলাদ্যাসী আসতাচে ত, চিল্লাপাল্লা হয় খুব। অই ছ্যালেটা ত বেংকক নাইমাও আমার পিচু ছারে নাই। যেই খানে যাই ঘার ফিরালেই দ্যাকি ড্যাব ড্যাব কইরা তাকাই আচে। চিডনিতে নামচি – সেখানেও সে। মেলবোনে আইসাও”

“এত তাড়াতাড়ি তোমার খাওয়া হয়ে গেল প্রদীপ? ডিসার্ট খাওনি তো”

আলী সাহেবের কথা শুনে আমার দিকে ফিরে তাকালেন ভদ্রমহিলা। বিরক্তি বেগম। ভূত দেখার মত চমকে উঠেছেন আমাকে দেখে। এসময় তার চেহারাটা যদি তুমি দেখতে। আমার কথাই বলছিলেন এতক্ষণ! খুব বিরক্ত করেছি তাঁকে! ঢাকা থেকে ব্যাংকক, ব্যাংকক থেকে সিডনি, সিডনি থেকে মেলবোর্ন! এমনকি মেলবোর্নে এসেও রেহাই নেই। চৌধুরি সাহেবের বাসা পর্যন্ত চলে এসেছি তাঁকে ফলো করে! ইচ্ছে হলো একবার জিজ্ঞেস করি- এতক্ষণ কার কথা বললেন। আবার মনে হলো – কী দরকার এই অসুস্থ মহিলার সাথে কথা বলে। নিজেকে অহেতুক গুরুত্বপূর্ণ মনে করার এই অসুখ অনেকেরই আছে।

রাত সাড়ে বারোটা বাজার পরেও পার্টি শেষ হবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আলী সাহেব আমার অবস্থাটা বুঝতে পারলেন। চৌধুরি সাহেবকে বললেন আমাকে সিটিতে পৌঁছে দিতে হবে, তাই তাঁকে উঠতে হচ্ছে। মণি ঘুমিয়ে পড়েছিল কোথাও। তাকে জাগিয়ে নিয়ে গাড়িতে তোলা হলো। গাড়িতে উঠেই সে ঘুমিয়ে পড়লো আবার। আলী সাহেবের পাজেরোর ঠিক পেছনেই একটা লাল রঙের নতুন গাড়ি পার্ক করেছেন কেউ। সে জন্য আলী সাহেব গাড়ি বের করতে পারছেন না। আবার ভেতরে গিয়ে নতুন গাড়ির মালিককে খুঁজে আনা হলো। মালিক এসে গাড়ি সরিয়ে আলী সাহেবের গাড়ির কাছে এসে বললেন,

“সরি আলী ভাই”
“নতুন কিনলেন বুঝি?”
“এই আর কি। ছোট গাড়ি আলী ভাই। আপনাদের তুলনায় কিছুই না”

দ্রুত চলছে আলী সাহেবের পাজেরো। এত রাতেও রাস্তায় অনেক গাড়ি। তবে সন্ধ্যার মত অত ভীড় নেই। লো ভলিউমে রেজওয়ানার রবীন্দ্রসঙ্গীত চলছে। মিস্টার এন্ড মিসেস আলী কথা বলছেন পার্টির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। ভাবী বলছেন মহিলা মহলের কথা।

“রোজী ভাবীকে নাকি এবারো কোন্‌ একটা ছেলে খুব ডিস্টার্ব করেছে বাংলাদেশ থেকে আসার সময়”
“হ্যাঁ, আমাকেও তো বললো। কতটা সত্যি কে জানে”
“এটা উনার মানসিক সমস্যা। উনার ধারণা দুনিয়ার সবাই শুধু তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে, তাঁকে ফলো করে”

বিরক্তি বেগমের নাম তাহলে রোজী। তাঁর মানসিক সমস্যা এঁদেরও অজানা নয় দেখছি।

“জুলফিকার আমার গাড়ির পেছনেই তার গাড়ি কেন রেখেছিল জানো? নতুন গাড়ি কিনেছে দেখানোর জন্য”

টুকটাক আরো কত রকমের কথা হচ্ছে। আমি পেছনে বসে শুনছি আর বুঝতে পারছি আমাদের কিছু কিছু মানসিকতা বিদেশে এসেও বেসিক্যালি খুব একটা পাল্টায় না। নিজের পরিমন্ডলে অহেতুক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা তার একটি।

সোজা হোস্টেলে না গিয়ে অন্য একটা বাড়ির সামনে গাড়ি থামালেন আলী সাহেব। এত রাতে আবার কোথায়?
“প্রদীপ, চলো তোমাকে একজন বাংলাদেশী ডাক্তারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। দেখি সে কোন বাসার খোঁজ দিতে পারে কি না”।

রাত একটায় কারো বাসার কলিং বেল টেপাটা কতটা গ্রহণযোগ্য আমি জানি না। কারণ এ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা আমার নেই। ভাবী আর মণি গাড়ি থেকে নামলেন না। আমি আলী সাহেবের পিছু পিছু দোতলায় উঠে এলাম। আলী সাহেব বেল বাজালেন। একটু পর দরজা খুলে দিলেন একজন ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী মহিলা। ইনিই বাংলাদেশী ডাক্তার। অজ-এইড স্কলারশিপ নিয়ে পাবলিক হেল্‌থে মাস্টার্স করতে এসেছেন। আলী সাহেবকে দেখে এত রাতেও খুব খুশি হয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা। বসতে বললেন। কিন্তু বসাটা ঠিক হবে না। ঘুম থেকে ওঠানো হয়েছে তাঁকে। লাউঞ্জরুমের কার্পেটেও বিছানা দেখা যাচ্ছে। দুটো বাচ্চা ঘুমাচ্ছে সেখানে। বোঝাই যাচ্ছে ওয়ান বেড রুমের এপার্টমেন্ট। ভদ্রমহিলা স্বামী আর ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকেন। আমার বাসার ব্যাপারে বললেন আলী সাহেব। জানা গেলো এই বাসার ভাড়া সপ্তাহে দেড়শো ডলার। ডাক্তার ভদ্রমহিলা বললেন খোঁজ পেলে জানাবেন আমাকে। আমার সদ্য পাওয়া অফিসের টেলিফোন নাম্বার দিলাম তাঁকে। তিনি আমাকে তাঁর বাসায় যখন খুশি বেড়াতে আসার জন্য বললেন।

এবার আমার হোস্টেল। আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে যাবার সময় ভাবী বললেন, সুবিধামত বাসা পাওয়া না গেলে আমি নির্দ্বিধায় তাঁদের বাড়িতে থাকতে পারি। আমার মত একজন অচেনা মানুষকেও এরকম করে আশ্রয় দেবার মত উদার মানসিকতা ক’জনের থাকে। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। হুমায়রা আপা এঁদের ঠিকানা না দিলে আমার যে কী অবস্থা হতো।

হোস্টেলের গেটে ইলেকট্রনিক লকে কোড নাম্বারটা প্রেস করে ও-কে বাটনে চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। ভালো লাগলো সিস্টেমটা ব্যবহার করতে পেরে। রুমে ঢুকে লাইট জ্বালাতেই চোখ গেলো ঘুমন্ত মানুষটির দিকে। কালো কম্বলে ঢাকা বিশাল শরীর। চোখে কালো পট্টি বাঁধা। প্লেনে এধরনের পট্টি দেয়া হয়েছিল। চোখে আলো পড়লে যারা ঘুমাতে পারে না তাদের জন্য খুব উপকারী। এই লোক মনে হয় জানতেন যে আমি এসে লাইট জ্বালাবো। মুখে লাল দাড়ি দেখে নিশ্চিন্ত হলাম যে ইনি মহিলা নন। নাক ডাকার শব্দও পাচ্ছি না। তবুও এতক্ষণ লাইট জ্বালিয়ে রাখলে তাঁর ঘুম ভেঙে যেতে পারে। তাই কাগজ-কলম নিয়ে নিচে চলে এসেছি। এখন ইচ্ছে করছে এখানে লাউঞ্জের সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। কেবলই মনে হচ্ছে- “আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে, যদি আমায় পড়ে তাহার মনে”। একটুও কি মনে পড়ে না আমাকে?

ক্রমশঃ____________________