(১) আধুনিক বিশ্বে প্রতিটা মানুষই জন্মের সাথে সাথে কিছু লেবেল নিয়ে আসে, আমিও জন্মের সাথে সাথে বিনামূল্যে কতগুলো লেবেল পেয়ে গিয়েছিলাম- বাঙালি, বাঙলাদেশি, আস্তিক, হিন্দু, ব্রাহ্মণ, ইত্যাদি। বেশির ভাগ মানুষই জন্মসূত্রে পাওয়া লেবেলগুলো থেকে মুক্ত হতে পারে না, বিনা প্রশ্নে এগুলোকে মেনে বড় হতে থাকে। তবে কিছু মানুষের সন্দেহপ্রবণতা জন্ম দিতে থাকে অসংখ্য প্রশ্নের, ফলশ্রুতিতে এক বা একাধিক লেবেলকে তারা ছিন্ন করতে বাধ্য হয়।

একটা শিশুর কোন ধর্ম থাকতে পারে না, কারণ একটা শিশুর পক্ষে ধর্ম কি তা উপলব্দ্ধি করা সম্ভব নয়। কিন্তু শিশুরাও ধর্ম পালন করে, কারণ তাদেরকে ধর্ম পালন করতে বাধ্য করা হয়।আমি কোন মুসলিম শিশুকে দেখিনি খুশিমনে, স্বইচ্ছায় নামাজ পড়তে; বরং ধর্মীয় আচারাদি পালনে শিশুদের মধ্যে তীব্র বিরক্তিবোধই বেশি দেখা যায়। তবে শৈশবে শিশুদের মধ্যে যে শিক্ষার সঞ্জার করা হয়, তা থেকে পরিণত বয়সেও তারা মুক্ত হতে পারে না। তাই শৈশবে যে শিশু বাধ্য হয়ে ধর্মীয় কর্ম পালন করে, বড়কালে সে স্বইচ্ছায় সেই কর্ম পালন করে যেতে থাকে। নাস্তিক হওয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে শৈশবের শেখানো শিক্ষাগুলো থেকে মুক্ত হতে পারা, বলা বাহুল্য এটাই সবচেয়ে কঠিন ধাপ।

(২) আমার জন্ম হয়েছে না রক্ষণশীল না উদারপন্থী এরকম একটা পরিবারে।
আমার মা-বাবা দু’জনেই ধার্মিক, তবে গোঁড়া নন। আমার বড় ভাইকে কখনোই ধর্মকর্ম তেমন একটা পালন করতে দেখিনি। তাই পারিবারিক আবহটা খুব একটা গোঁড়া ছিল না, যা আমাকে নাস্তিক হতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে। অবশ্য আমার ছোটবেলার বন্ধুদের প্রায় সবাই ছিল মুসলিম। তারা বেশ কঠিন রকমের ধার্মিক ছিল! তারা নিয়মিত রোজা রাখত, নামাজ পড়ত, হুজুরের কাছে কোরান ও আরবি পড়তে যেত। এরকম কোন ধর্মীয় কর্মের মধ্য দিয়ে আমাকে যেতে হয়নি, শুধু বিশেষ পুজোগুলোতে মন্দিরে প্রার্থনা করতে যেতে হত।

আমার উপনয়ন (যে অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণ সন্তানরা আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করে; পৈতাধারণ) হয় নয় বছর বয়সে। এরপর থেকে আমাকে নিয়মিত পুজো দিতে হত। সত্যি কথা বলতে কি, পুজো দেওয়াটা তখন আমি বেশ উপভোগই করতাম! পুজো কেন দিচ্ছি বা কাকে দিচ্ছি এরকম প্রশ্ন নিয়ে ভাবার বয়স তখনও হয় নি, সংস্কৃত মন্ত্রগুলো সজোরে পাঠ করার যে মজা সে মজা নেওয়াটাই ছিল আমার পুজো দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য!

এভাবেই কেটে গিয়েছিল অনেকগুলো বছর। মনের মধ্যে ন্যূনতম সন্দেহ না রেখে ধর্ম পালন করে যাওয়া- এটাই হয়ত চলতে থাকত যদি না আমার হাতে আসত রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ বইটি। সম্ভবতঃ উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে পড়ছি তখন, বই পড়ার নেশাটা হয়ে উঠেছিল দুর্দমনীয়। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়ায় বই কেনার জন্য হাতে তেমন টাকা থাকত না। কলেজে বাসের পরিবর্তে হেঁটে গিয়ে যে কয়টা টাকা বাঁচাতাম তার সবকটাই ব্যয় হত পুরোনো বই কিনতে। রাহুলের পাইরেটেড বইটাও এভাবেই কেনা।

যে মুনি-ঋষিদেরকে (ব্যাসদেব, বশিষ্ঠ) ছোটবেলা থেকেই অসীম শ্রদ্ধা করে আসছিলাম, রাহুলের বইতে তাদের স্বরূপটা দেখে রাতারাতি হিন্দু ধর্মের প্রতি আমার বিশ্বাস চলে গেল। আমার ধার্মিক থেকে অধার্মিক হওয়ার প্রক্রিয়াটা হয়েছে খুব দ্রুত। রাহুলের ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ সচেতনভাবে পড়ার পরও যদি কোন হিন্দু অধার্মিক না হয়ে ওঠে সে জন্মান্ধ ছাড়া আর কিছুই না।

যে গোহত্যাকে বর্তমানকালে হিন্দু ধর্মে মহাপাপ বলে গণ্য করা হয়, তা ছিল প্রাচীনকালে মুনি-ঋষিদের প্রধান আহার্য; নতুন ধর্মমতের (প্রধানতঃ বৌদ্ধ) আগ্রাসন থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করার জন্যই মূলতঃ গোহত্যাকে নিষিদ্ধ করা হয়- এই তথ্যটা আমার কাছে একটা ধাক্কার মত এসেছিল! হিন্দুধর্মের অপরাপর অসঙ্গতিগুলোও ক্রমশঃ চোখে ধরা পড়তে লাগল। অন্যান্য ধর্মের মত হিন্দুধর্মের নেই কোন নির্দিষ্ট গ্রন্থ, এমনকি এক গ্রন্থের সাথে অন্য গ্রন্থের রয়েছে চরম বৈপরীত্য- এই ব্যাপারটাও আমার মনে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটাল। একই ধর্মের দু’টো গ্রন্থে দু’রকম বক্তব্য থাকবে কিভাবে?- এই প্রশ্নের উত্তর একটাই হতে পারে, ধর্মটাতেই সমস্যা আছে! হিন্দুধর্মকে তাই পুরোপুরি বাতিল করে দিলাম।

অতঃপর পড়া শুরু করলাম প্রবীর ঘোষের ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’। অলৌকিকত্ব বলে সত্যিই কিছু আছে- আর সবার মত আমিও তা বিশ্বাস করতাম, কিন্তু প্রবীরের বইটা পড়ে এই বিশ্বাসটাও কেমন যেন টলে গেল।

প্রতিটা ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোই অলৌকিকত্বের কাহিনীতে ভরপুর। দুর্গা দেবী কতৃক মহিষাসুর বধ, নূহের নৌকা দ্বারা সমগ্র জীবকূলকে বাঁচানো, কুমারী মেরীর গর্ভে যীশুর জন্ম- এগুলো ধর্মপ্রাণ মানুষ বিনাপ্রশ্নই মেনে নেয়, কিন্তু সন্দেহপ্রবণ মানুষকে এসব কাহিনী বিশ্বাস করাতে গেলে প্রমাণ দিতে হয়। রাহুল আর প্রবীরের বই পড়ে আমে হয়ে পড়েছিলাম পুরোদস্তুর সন্দেহবাদী, তাই এহেন অলৌকিকত্বকে আমার কাছে ঘটনার বদলে রটনা বলেই মনে হল।

অতএব আমি হয়ে উঠলাম পুরোপুরি অ-ধার্মিক। আমি বুঝতে পারলাম, ধর্ম বলে আসলে কিছুই নেই, সবগুলো ধর্মই মানুষের হাতে তৈরী। তবে অ-ধার্মিক হওয়ার পরও ঈশ্বর যে আছেন তা নিয়ে তখনও আমার মনে কোন সন্দেহ দেখা দেয়নি।

প্রবীরেরই আরেকটা বই ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’ যখন আমার হাতে আসল, তখন আমার মধ্যে একরকম ভয় কাজ করছিল! আমার মনে হচ্ছিল, যদি এই বই পড়ার পর আমি ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হয়ে যাই! আমি চাচ্ছিলাম না ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হতে, কিন্তু বইটা পড়ার ইচ্ছা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী না হতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে বড় হয়ে উঠল।

বইটা শেষ করার পর তাই আমি হয়ে গেলাম নাস্তিক।

আমার ঈশ্বর হয়ে ওঠার কারণটা খুবই সোজাসাপ্টা। যেহেতু ধর্মগুলো সব মানুষের তৈরী, ধর্মীয় ঈশ্বরও মানুষের তৈরী- তাই প্রচলিত ঈশ্বরগুলো (আল্লাহ্, গড, ভগবান ইত্যাদি) এমনিতেই বাতিল হয়ে যায়। ধর্মনিরপেক্ষ একজন সৃষ্টিকর্তা তারপরও থাকতে পারেন, তবে এখন পর্যন্ত তিনি বৈজ্ঞানিকভাবে অনাব্ষিৃকতই রয়ে গেছেন। আর যৌক্তিকভাবে তাকে ছাড়াও মহাবিশ্বের অস্তিত্ব বর্ণণা করা যায়, তাই তাকে যৌক্তিকভাবে বিশ্বাস করাটা এখন পর্যন্ত অপ্রয়োজনীয়।

তখন আমার যৌক্তিক মনের পক্ষে তাই ঈশ্বরে অবিশ্বাসী না হয়ে আর কোন উপায় ছিল না।

(৩) ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন কোন মানুষের সংস্পর্শে আসিনি যে আমাকে নাস্তিকতার পথে যেতে উৎসাহ যুগিয়েছে; আস্তিক থেকে নাস্তিক হওয়ার পথে কিছু বইয়ের দ্বারাই বরং আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি।

আমার নাস্তিকতার গুরু মূলতঃ তিনজন: রাহুল সাংকৃত্যায়ন, প্রবীর ঘোষ, এবং হুমায়ুন আজাদ। এদের মধ্যে হুমায়ুন আজাদ দ্বারা আমি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছি, তার কারণ বোধহয় তাঁর মত আমিও প্রথাবিরোধিতাকে বেশ পছন্দ করি। হুমায়ুন আজাদের ‘আমার অবিশ্বাস’ আমার কাছে বাইবেলের মত, যদিও তাঁর অনেক বক্তব্যের সাথেই আমি একমত হতে পারি না।

(৪) উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করতে করতে আমি ঈশ্বরে অবিশ্বাস করা শুরু করা দিয়েছি, তবে তখনও কতগুলো ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের সাথে ধর্মগ্রন্থগুলোর মিলের কথা শুনে আসছিলাম। প্রতিটা ধর্মগ্রন্থেরই নাকি এমন কিছু বক্তব্য আছে যা বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সাথে মিলে যায়! বইয়ের দোকানগুলোতে প্রায়ই দেখতাম ‘কোরআন ও বিজ্ঞান’, ‘বাইবেল ও বিজ্ঞান’, ‘বেদ ও বিজ্ঞান’ জাতীয় বইগুলো। এর মধ্যে এক বিশিষ্ট পন্তিতের নাম ঘন ঘন শোনা যেতে লাগল। ভদ্রলোকের নাম ডঃ জাকির নায়েক! লোকমুখে শোনা যেতে লাগল, ইনি অসাধারণ এক পন্ডিত, সবগুলো ধর্মগ্রন্থই যার পড়া রয়েছে; বিজ্ঞানের সাথে কোরআনের একটার পর একটা সম্পর্ক নাকি তিনি আবিষ্কার করে চলেছেন!

আমি ধর্মগ্রন্থগুলোকে আগেই বাতিল করে দিয়েছিলাম, তাই আমি প্রায় নিশ্চত ছিলাম এগুলো বুজরুকিই হবে। কিন্তু বুজরুকিটা যে কোথায় তাই ধরতে পারছিলাম না।

তাছাড়া লোকমুখে আরও যেটা শুনতাম সেটা হচ্ছে বিবর্তনবাদ (যেটা এক চপেটাঘাতে সমস্ত ধর্মগ্রন্থগুলোকে বাতিল করে দিয়েছে) নাকি এখনও অপ্রমাণিত, এটা একটা অনুকল্প (hypothesis) মাত্র।

এইসব ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য কোন মাধ্যম তখন আমার কাছে ছিল না, তাই আমাকে একরকম নিরূপায় হয়েই বসে থাকতে হয়েছিল।

অবশেষে আলোকবর্তিকা নিয়ে হাজির হল আধুনিক বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার আর্ন্তজাল (Internet)। আমি আর্ন্তজাল নিয়মিত ব্যবহার করছি মাত্র এক বছর ধরে, কিন্তু এই এক বছরের মধ্যেই একে পাগলের মত ভালোবেসে ফেলেছি। নাস্তিক হওয়ার পরও আমার মধ্যে যে গুটিকয়েক সন্দেহের বীজ ছিল তা নিমেষে দূর হয়ে গেল মুক্তমনার হাত ধরে। মুক্তমনার হাত ধরেই আমি ডঃ জাকির নায়েকেসহ অন্যান্য ছদ্মবিজ্ঞানী ও ধর্মব্যবসায়ীদের বিজ্ঞানের সাথে ধর্মকে মেলানোর দাবির অসারতা সম্পর্কে জানতে পারলাম, জানতে পারলাম বিবর্তন বিজ্ঞানে এখন মাধ্যাকর্ষণের মতই প্রমাণিত সত্য। যতই জানতে থাকলাম, ততই নিঃসন্দেহ হতে থাকলাম ধর্মগুলোর অসারতা সম্পর্কে।

এ প্রসঙ্গে ফেইসবুকের কথাও বলতে হয়। ফেইসবুকের ‘Atheist Bangladesh’ গ্রুপটা প্রথম যখন আমার নজরে আসল, আমি তখন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে বাংলাদেশেও এরকম ‘Hardcore’ নাস্তিক রয়েছে। এদের অনেকের সাথেই পরবর্তীতে আমার ‘Virtual’ বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। মুক্তমনা আমাকে দিয়েছে একটি ‘Clarified concept’, আর ফেইসবুক দিয়েছে কিছু ‘Conceptual friend’ (যার অভাব বোধ করছিলাম অনেক দিন ধরে)। আমরা ফেইসবুক এর বন্ধুরা মিলে সম্ভবতঃ বাঙলাদেশী নাস্তিকদের প্রথম সঙ্ঘ (Atheist Association of Bangladesh) গড়ে তুলেছি (যার কার্যক্রম এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র ফেইসবুকেই সীমাবদ্ধ রয়েছে)। আমার নাস্তিকতার ধারণাটা পোক্ত করতে এদের অবদানও কম নয়।

(৫) মাঝখানে আমি কয়েকদিন অজ্ঞেয়বাদী (Agnostic) ছিলাম, আমার মনে হয়েছিল সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে মানুষ হয়তো কোনদিনই কিছু জানতে পারবে না। কিন্তু আমি এখন আগের চেয়ে কিছুটা আশাবাদী। মানুষ হয়তো কোনও একদিন মহাবিশ্বের আদিম রহস্য উন্মোচিত করতে পারবে- এই আশাবাদই আমাকে আবার নাস্তিকতায় ফিরিয়ে এনেছে।

আমি ‘Weak atheism’ এ বিশ্বাসী। Weak atheist রা ঈশ্বরকে পুরোপুরি বাতিল করে দেয়নি, তাদের মধ্যে শুধু ঈশ্বরে বিশ্বাসের ব্যাপারটা অনুপস্থিত (Absence of the belief in the existence of God) । ‘Strong atheist’ রা ঈশ্বরকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছে (Denial in the existence of God)।

আমি সর্বদাই প্রস্তুত নতুন চিন্তাধারা গ্রহণ করতে, যদি সে চিন্তাধারার পেছনে পর্যাপ্ত প্রমাণ অথবা যুক্তি থাকে। একজন যুক্তিবাদীর সর্বশেষ গন্তব্য বলে কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না, বরং চিরন্তন সন্দেহবাদিতাই হওয়া উচিত তার চিরকালের পথ।

আমি নিজেকে সেই অনন্তপথের এক যাত্রী বলেই মনে করি।

(জানুয়ারি ৪ থেকে জানুয়ারি ৬, ২০১০)