জলদেবী
মামানী মোরে একটু জল দ্যাবা? বলেই কচি হাতটা সামনে বাড়িয়ে ধরে সোহাগ। হাতটার দিকে চোখ পড়তেই মাথা ঘুরে যায় জমিলার। গত রাতের মারের চিহ্ন দগদগ করে জ্বলছে। ছোট ছোট ট্যাপা ট্যাপা আঙ্গুলগুলো থেতো হয়ে আছে যেনো। কেন যে এই ছোট্ট মানুষটাকে ওর বাবা মাটিতে ফেলে গরুর মত পেটায় বুঝে পায় না জমিলা। প্রায়শঃ মারের আওয়াজ শোনে। কিন্তু বিষয়টা ঠাহর করতে পারেনা, ভাবতে পারে না সোহাগের মা কি করে সামনে দাঁড়িয়ে এই কান্ড দেখে। রাত বাড়ে। বাচ্চাটার কান্না ক্রমে গোঙ্গানীতে মিশে যায়। একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। নির্ঘুম চোখে জমিলা আর রাতের জোনাকিরা জেগে থাকে শুধু।
জমিলা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিতে গিয়েও কি মনে করে নিজেই পানিটা খাইয়ে দেয় সোহাগকে। চাঁদা মাছের মত চোখগুলো ছলছল করে সোহাগ জিজ্ঞেস করে ‘মামানী হ্যারা যে মোরে এত্তো মারে, বোজে না মুই ব্যাতা পাই? পরথমে তো মুই কান্দি না, ভাবি বাপের রাগ হইসে তাই মারতেয়াসে, যহন আর সইতে পারি না তহন কান্দন আসে’। জমিলা কোনদিন বাড়তি কিছু জানতে চায় নি, কখনো কিছু বলে নি পাছে ওর কথার কারণে বাচ্চাটার মনে বাবা মার প্রতি ঘৃণা জন্মায়। শুধু একদিন জিজ্ঞেস করেছিল ‘বাবুরে তোরে যহন তর বাপে পেডায়, মা কি ক্যাল খাড়াইয়া থাহে, নাকি কিসু কয় টয়?’ সোহাগ এদিক ওদিক ঘাড় নেড়ে বলেছিলো ‘মা দারে আহে না’। একদিন কানতে কানতে হের কাসে গেসি, হ্যাও ধাক্কা দিয়া সরাইয়া দ্যাসে। জমিলা কান্না চেপে শুধু বলে, ‘অ মনা মোর কোলে একডু বয় দেহি’।
জমিলা খুব শিক্ষিত না হলেও বোঝে স্বামী স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি কোন চাপা রাগ এই ছোট্ট দেহটার ওপরেই আছড়ে পড়ে যখন তখন বিনা কারনেই। জমিলা সোহাগকে কখনো নিজে থেকে ঘরে ডাকে না। বাচ্চাটাই আসে। এসেই উঠোনে পিড়ি পেতে বসে। জমিলা তখন হয় চুলোয় লাকড়ি দিচ্ছে, না হয় হাঁস মুরগীকে খেতে দিচ্ছে। হাতের সব কাজ ফেলে জমিলা ঘরে ঢুকে এক গাদা খাবার নিয়ে আসে। দেহের ক্ষত সারাতে পারবে না জানে, মনের ক্ষত সারাবার চেষ্টা করে নিয়ত । সোহাগের আধো আধো কথা তাকে কি যে আনন্দ দেয় সে নিজেও জানে না। বাচ্চাটার জন্যে তার কোন করুণা নেই, আছে শুধু প্রীতি।
সোহাগ মাঝে মাঝে অদ্ভুত প্রশ্ন করে। একদিন বলে ‘আচ্ছা মামানী, ম্যাঘে কি শাপলা ফোডে?’ জমিলা বলে ‘এইডা কি কও বাপ? সোহাগ হাসতে হাসতে বলে ‘মামানী তুমি না কইসো ম্যাঘের বিতরে জল আছে, হেই লাইগ্যা বিশটি নামে? আর জলে না শাপলা ফোডে তয় ম্যাঘেও শাপলা ফোডে’।
জমিলা না পাওয়া সন্তানের জন্যে আকুতি নেই তবে সোহাগ তার নিজের হলে আনন্দ কম হতো না এটা সে জানে।
স্বামী আজমল সাহেবের ঢাকায় চাকরী হয়েছে, সাথে একটা থাকার জায়গাও। আত্মীয় স্বজন সবাই খুশী। জমিলাই শুধু নয়। এই ভরা সংসার ছেড়ে সে যেতে রাজী নয়। কথাটা স্বামীকে বলেও দিয়েছে। আজমল সাহেবের আপত্তি নেই, জমিলার যাতে আনন্দ তাতে তারও। তিন দিন পরই তিনি চলে যাবেন নতুন কাজে।
আজ সন্ধ্যে থেকেই পাশের বাসা থেকে হৈ চৈ এর আওয়াজ আসছে। সোহাগের জেলে বাবা মাছ ধরে ঘরে ফিরেছে। আশঁটে গন্ধ আসছে, বোধ হয় আজ বেশ মাছ ধরা পড়েছে।। বিক্রীর পরেও ঘরেও এসেছে কিছু। কদিন ধরেই সোহাগের বাবা বেড় জাল লাগাচ্ছিল ধারের জলাটায়। জমিলার স্বামী কি জেনো বলছিলো একবার যে ‘সরকারতো আইন করসে, এত্তো ছোডোছোডো মাসগুলারে ধরতেয়াসে, এইডা তো ঠিক না। মাছ বড় না হইলে চলবে নাকি? আর অই বিলডায় মোরা নাইতে যাই না? গোসলে গিয়া ওই জাউলাগো দ্যাখতে ভালো ঠেহে কও? কবে না জানি কার বিপদ ঘডে ওই জালের বিতরে পা জড়াইয়া। জমিলা জেলে বাড়ির মেয়ে জানে কিভাবে জাল ফেলতে হয়। কোন জালে কি মাছ ধরা পড়ে তা সে জানে। সে এও জানে আজকাল এই বেড় জাল দিয়ে জেলেরা ছোট ছোট মাছগুলোকে ধরছে। স্নানের পুকুরেই পেতে রাখা হচ্ছে এ ধরণের চিকন জাল আর এতে পা জড়িয়ে মানুষ মারা পড়তে পারে তার ও সম্ভাবনা যে নেই তাও নয়।
প্রতিদিনের মত আজো জমিলা কান খাঁড়া করে আছে। হ্যাঁ শুরু হল, প্রথমে বকাবকির শব্দ তার পর জিনিষপত্র ভাঙ্গার। এরপরেই সেই ধুপধুপ শব্দ। জমিলা চোখ বন্ধ করে দেখতে পায় সোহাগের কচি দেহটা একেকটা আঘাতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। ইদানীং সোহাগকে দড়ি দিয়ে পেটায় ওর বাবা। সাথে বাঁধা থাকে জালের গুটি। নরম শরীরের যেখানে যেখানে সেগুলো আঘাত হানে ওখানে গুটি পোকার মত রক্ত জমে ওঠে।
জমিলা সিদ্ধান্তটা ভোর রাতেই নিয়ে নিলো। ঠিক মত আলো ফোটেনি তখন। এসে দাড়াঁলো সোহাগদের উঠোনে। উঠোনে ছড়ানো সেই বেড়ি জাল! যার খুটগূলো বেধে দেয়া হয় বেষ্টনীর মত তারপর কুচি কাচা ছোট বড় যত মাছ সব আটকে পড়ে, কারো আর রক্ষা নেই । মরণ ফাঁদ পাতা। আর তাতে শুধু আত্মাহুতি।
সোহাগের মা ভাতের মাড়ের সাথে খোল মাখাচ্ছিলো গরুর খাবারের জন্যে। জমিলাকে দেখে ময়লা হাতেই উঠে এসেছে। বললো, ‘অ দিদি, কিছু হইছে নাকি? বেয়ান বেলায় মোগো বাড়িতে আইছো? জমিলা ভনিতা না করেই বললো, ‘দিদি, পোলাডারে আমারে দ্যাবা? কাল তোমার দাদার লগে মোরাও তাইলে ঢাহা চইল্লা যাই? সোহাগের মা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থেকে বললো, ‘এইডা তুমি কি কও দিদি? অলুক্ষন্যা কতা, হ্যার বাপে জানলে মোগো দুজনারেই কাইটগা থোবে আনে’।
জমিলা শুধু বললো, ‘দিদি, তুমিতো রক্ষা করতে পারলা না, আমারে একবার সুযোগ দাও। ছাওয়ালডারে আমারে দাও দিদি। তয় মোরা চইল্লা যাওনের পর তোমারে কে রক্ষা করবে এইডা কিন্তু ভাইবো’।
সোহাগের মা গম্ভীর হয়ে ভাবলো খানিক। হাত ধুয়ে এসে বললো, ‘দিমু । তয় মোর একটা শর্ত আছে’। বলেই বেড়ি জালটা জমিলার হাতে তুলে দিয়ে বললো, ‘সাতাঁর পারো না দিদি? তুমি না জাল ফেলাইতে জানো? ওর বাপে জাল তুইল্যা আনছে কাল রাতে। হেয় কিন্তু এই বেয়ান বেলাতেই কেউ নামনের আগেই রোজ ওই বিলে ডুব দিয়া আসে। গাঙ্গের পূব পাড়ে হে ডুব দেয়। অহনি গুমের তা উইডগ্যা ডুব দিতে যাইবো। পারবা না দিদি? আমারে আর আমার পোলাডারে দুইজনরেই বাঁচাইতে?’ জমিলা জালটা হাতে তুলে নিয়েছে ততক্ষণে। আর কথা না বলে বের হয়ে এসেছে সোহাগদের বাড়ী থেকে। হাতে ধরা সেই জাল। সোহাগের মায়ের কথা বুঝতে তার সময় লাগেনি। বিস্ময় হয়েছিলো শুধু।
শুধু একটা কথাই বারবার মাথায় ঘুরছে। বাঁচাতে হবে, বাঁচাতে হবে। একটা শব্দই থেকে থেকে মনে আসছে ‘জলদেবী, জলদেবী, জলদেবী।।
বেলা ন’টা। জমিলা চুল আচড়াতে আচড়াতে বারান্দায় এসে দাড়িঁয়েছে। একটু দূরে গাঙ্গের ধারে বিশাল জটলা দেখা যাচ্ছে। স্বামী আজমল সাহেব তাকে দেখেই বললো, ‘দ্যাখলা জমিলা তোমারে কইছিলাম না এক দিন ওই জালে মরব কেউ। ‘দ্যাখসো সোহাগের বাপে কেমন নাইতে গিয়া পা জড়াইয়া ডুইবগ্যা মরলো। হায়রে মরন ফাঁদ! সোহাগের মায়ের কান্না হনতে পাও? সোহাগও কানতেয়াসে।পোলাডায় নাকি কইসে হ্যার বাপে জাল তুইলগ্যা আনছিলো কাল রাতে। কি জানি কি কয়? হ্যার বউ ক্যাল মানুষরে জিগায় হে যেই খানে নাইতে গেসে ওইখানেই জাল বানসে ক্যান?’ আজমল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘আহারে পোলাডার যে কি হইবে?’
জমিলা ভাবলেশহীন হয়ে বললো, ‘এই কাহই ডা নিমু না। ক্যাল চুল আটকায়, ডাহায় আমারে সুন্দর একটা কাহই কিন্যা দিবা, ঠিক আছ? আজমল সাহেব ইঙ্গিত বুঝেছে। তার স্ত্রী মত পাল্টেছে, সেও তার সাথে ঢাকা যেতে মনস্থ করেছে। তিনি খুশী মেশানো হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন।
দরজা দিয়ে ঘরের ভেতরে তাকিয়ে দেখলেন জমিলা কাপড় চোপড় টিনের ট্রাঙ্কে ভরে নিয়েছে , সামনে ই ছড়ানো ছোট ছোট সার্ট দেখে ভুরু তুলে তাকালেন জমিলার দিকে। জমিলা আড় মোড়া ভেঙ্গে ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে মৃদু স্বরে বললো, ‘সোহাগ মোগো লগে ডাহায় যাইবে’।
অত্যান্ত সুখ পাঠ্য একটা গল্প । খুব সুন্দর প্রেক্ষাপট । বর্ননা নিখুঁত । ভালো লাগলো গল্পটা পড়ে ।
পড়ে ভালো লাগল।ধন্যবাদ।
ম্যাডাম, অপরাধী মনের মনস্তত্ত্ব নিয়ে শুধু আমিই গল্প লিখি না। আপনাকেও দেখছি একই ব্যারামে ধরেছে এখন।
গল্প সুন্দর হয়েছে। মনের কোন কোণায় আরো বসত করা কিছু থাকলে সেগুলোকেও কলমের ডগা দিয়ে গলে বেরিয়ে দিতে দিন আর ধরে ধরে সেগুলোকে লটকে দিন মুক্তমনায়। এতে আস্পর্ধার কিছু নেই।
সোহাগ চরিত্রটা আমার খুব খুব চেনা একটা চরিত্র। শুধু মমতাময়ী কোন মামানীকে চিনতাম না এই যা। চিনলে বোধহয় ভালই হতো।
কেয়া, আপনার গল্পগুলো পড়তে ভয় লাগে, মন খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয়। তারপরেও সাহস করে পড়ে ফেললাম। গল্প কবিতা একটু কমই বুঝি, তবে গল্পটা পড়তে ভালো লাগলো । পড়ে মন খারাপ হল, না ভালো হল ঠিক বুঝলাম না। তবে সোহাগের বাপ মরে যাওয়ায় যে দুঃখ লাগলো না এটুকু বলতে পারি।
ধন্যবাদ বন্যা, গল্পটা পড়েছেন বলে। আমি প্রানান্ত চেষ্টা করি মন খারাপ না করার গল্প বলতে কিন্তু লেখা শেষ হলে দেখি ছোপ ছোপ দুঃখ কোথা থেকে যেনো হামলে পড়েছে। দেখি, এবারে উল্টো কিছু করে। মন্তব্যের জন্যে আবারো ধন্যবাদ।
@কেয়া রোজারিও,
আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত!
কি নিস্পাপ ও চমৎকার প্রশ্ন!
ভাল লাগলো।
আশরাফ আহমেদ, লেখাটা পড়েছেন তাই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
ছক, গাঁথুনি, আঞ্চলিক ভাষার ব্যাবহার, সবকিছু মিলিয়ে এই গল্পটা অনবদ্য। পাঠকের মনে একটা সার্থক ছোটগল্প যে শিহরণ জাগায় তা জাগাতে লেখক পরিপূর্ণভাবে সফল হয়েছেন।
ধন্যবাদ ডঃ ইরতিশাদ, গল্পটা মনের কোন কোনায় যেনো বসত গেড়েঁ বসে ছিলো, গতকাল ছুটির দিন বুঝে কলমের ডগা দিয়ে গলে বেরিয়ে পড়লো আর আমিও অমনি ওটাকে ধরে মুক্ত-মনায় লটকে দিয়েছি। আস্পর্ধাও আমার!!