ভাবছি দর্শন শাস্ত্রের প্রচলিত কিছু শব্দার্থ বিশ্লেষণ করে গুটি কয় হাল্কা ধরনের পোস্ট দেব সামনে। আমি দেখছি মুক্তমনায় লেখেন অথচ দর্শনের প্রান্তিক কিছু ব্যাপারে খুব অস্পষ্ট ধারনা রাখেন আমাদের অনেকেই। অনেকেই জানেন না আদি কারণ সম্বন্ধে, অক্কামের ক্ষুর কিংবা প্যাস্কালের ওয়েজার সম্বন্ধে, কিংবা গুলিয়ে ফেলেন নাস্তিকতাও একটি ধর্ম কিনা এ বিষয়ে। আমি এর আগে মেসবাহউদ্দিন জওহের নামে এক ভদ্রলোকের সাথে বিতর্ক করতে গিয়ে এগুলো নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু লিখেছিলাম। ভাবছি ছোট আকারে দু চারটি লেখায় বিষয়গুলো আবারো তুলে আনবো। মুক্তমনা ব্লগে বিষয়গুলোর আলাদা উপস্থিতি দাবী করে বলে আমার ধারণা।

:line:

আমি দেখেছি অনেকেই বুঝে হোক, না বুঝে হোক, এই ব্যাপারটি মাঝে মধ্যে এভাবেই আউরে দেন যে, আস্তিক্যবাদের মত নাস্তিক্যবাদও একধরনের বিশ্বাস। আস্তিকরা যেমন ‘ঈশ্বর আছে’ এই মতবাদে বিশ্বাস করে, তেমন নাস্তিকরা বিশ্বাস করে ‘ঈশ্বর নেই’ – এই মতবাদে। দুটোই নাকি বিশ্বাস। যেমন, এই ব্লগে শামীম সাহেব রায়হানকে উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন

‘নাস্তিক মানেই বিশ্বাসী। তারা বিশ্বাস করে যে “ঈশ্বর নেই”। কিন্তু “ঈশ্বর নেই” এটি প্রমানিত সত্য নয়। শুধু যুক্তি দিয়েই বুঝানো সম্ভন “ঈশ্বর নেই” বিবৃতিটি আসলে ফাকিবাজি। ‘

নাস্তিক মানেই বিশ্বাসী, কিংবা নাস্তিকতাবাদও একটি বিশ্বাস – এগুলো ঢালাওভাবে আউরে দিয়ে নাস্তিক্যবাদকেও এক ধরনের ‘ধর্ম’ হিসেবে হাজির করার চেষ্টাটি আমি বহু মহলেই দেখেছি। নাস্তিকদের এভাবে সংজ্ঞায়ন সঠিক কি ভুল, তা বুঝবার আগে ‘নাস্তিক’ শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থটি আমাদের জানা প্রয়োজন। ‘নাস্তিক’ শব্দটি ভাংগলে দাঁড়ায়, নাস্তিক + কন বা নাস্তি+ক। ‘নাস্তি’ শব্দের অর্থ হল নাই, অবিদ্যমান। ‘নাস্তি’ শব্দটি মূল সংস্কৃত হতে বাংলায় এসে ‘ক’ বা ‘কন’ প্রত্যয় যোগে নাস্তিক হয়েছে যা তৎসম শব্দ হিসেবে গৃহীত। ন আস্তিক = নাস্তিক – যা ন ঞ তৎপুরুষ সমাসে সিদ্ধ এবং আস্তিকের বিপরীত শব্দ। আরো সহজ করে বাংলায় বললে বলা যায়, না + আস্তিক = নাস্তিক। খুবই পরিস্কার যে, সঙ্গত কারণেই আস্তিকের আগে ‘না’ প্রত্যয় যোগ করে নাস্তিক শব্দটি তৈরী করা হয়েছে। আস্তিকরা যে ঈশ্বর/আল্লাহ/খোদা ইত্যাদি পরম সত্ত্বায় বিশ্বাস করে এ তো সবারই জানা। কাজেই নাস্তিক হচ্ছে তারাই, যারা এই ধরণের বিশ্বাস হতে মুক্ত। তাই সংজ্ঞানুযায়ী নাস্তিকতা কোন বিশ্বাস নয়, বরং ‘বিশ্বাস হতে মুক্তি’ বা ‘বিশ্বাসহীনতা’। ইংরেজীতে নাস্তিকতার প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘Atheist’। সেখানেও আমরা দেখছি theist শব্দটির আগে ‘a’ প্রিফিক্সটি জুড়ে দিয়ে Atheist শব্দটি তৈরী করা হয়েছে। নাস্তিকতা এবং মুক্তচিন্তার উপর বহুল প্রচারিত গবেষণাধর্মী একটি ওয়েব সাইটে শব্দটির সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে এভাবে –

Atheism is characterized by an absence of belief in the existence of gods. This absence of belief generally comes about either through deliberate choice, or from an inherent inability to believe religious teachings which seem literally incredible. It is not a lack of belief born out of simple ignorance of religious teachings.

সহজেই অনুমেয় যে, ‘absence of belief’ শব্দমালা চয়ন করা হয়েছে ‘বিশ্বাস হীনতা’কে তুলে ধরতেই, উলটোটি বোঝাতে নয়। Gordon Stein তাঁর বিখ্যাত ‘An Anthology of Atheism and Rationalism’ বইয়ে নাস্তিকতার (Atheism) সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে বলেন,

‘When we examine the components of the word ‘atheism,’ we can see this distinction more clearly. The word is made up of ‘a-‘ and ‘-theism.’ Theism, we will all agree, is a belief in a God or gods. The prefix ‘a-‘ can mean ‘not’ (or ‘no’ )  or ‘without’. If it means ‘not,’ then we have as an atheist someone who is not a theist (i.e., someone who does not have a belief in a God or gods). If it means ‘without,’ then an atheist is someone without theism, or without a belief in God’. (Atheism and Rationalism, p. 3. Prometheus, 1980)

আমরা যদি atheist শব্দটির আরো গভীরে যাই তবে দেখব যে, এটি আসলে উদ্ভুত হয়েছে গ্রীক শব্দ ‘a’ এবং ‘theos’ হতে। গ্রীক ভাষায় ‘theos’ বলতে বোঝায় ঈশ্বরকে, আর ‘a’ বলতে বোঝায় অবিশ্বাস বা বিশ্বাসহীনতাকে। সেজন্যই Michael Martin তাঁর ‘Atheism: A Philosophical Justification’ বইয়ে বলেন, ‘According to its Greek roots, then, atheism is a negative view, characterized by the absence of belief in God.’ (Atheism: A Philosophical Justification”, p. 463.,Temple University Press, 1990) ।

আসলে নাস্তিকদের  বিশ্বসী দলভুক্ত করার ব্যাপারটি খুবই অবিবেচনাপ্রসুত। ব্যাপারটাকে আরেকটু পরিস্কার করা যাক। ধরা যাক, এক মুক্ত-মনা যুক্তিবাদী ব্যক্তি ভুতে বিশ্বাস করেন না। তবে কি সেজন্য তিনি ‘না-ভুতে’ বিশ্বাসী হয়ে গেলেন? শামীম সাহেবদের যুক্তি অনুযায়ী তাই হবার কথা। এভাবে দেখলে, প্রতিটি অপ-বিশ্বাস বিরোধিতাই তাহলে উলটোভাবে ‘বিশ্বাস’ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, তা সে ভুতই হোক, পঙ্খিরাজ ঘোড়াই হোক, অথবা ঘোড়ার ডিমই হোক। যিনি পঙ্খিরাজ ঘোড়া বা চাঁদের চড়কা-বুড়ীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, তিনি আসলে তাঁর সংশয় এবং অবিশ্বাস থেকেই তা করেন না, তার ‘না-বিশ্বাসে’ বিশ্বাসী হবার কারণে নয়। যদি ওই ব্যক্তিটিকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন ওগুলোতে তিনি বিশাস করেন না, তিনি হয়ত জবাবে বলবেন, ওগুলোতে বিশ্বাস করার মত যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নি বলে। কিংবা হয়ত বলতে পারেন, এখন পর্যন্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ওগুলো সত্ত্বার বাস্তব অস্তিত্ব কেউ প্রমাণ করতে পারেন নি, তাই ওসবে বিশ্বাস করার প্রশ্ন ওঠে না। এটি পরিস্কার যে, এই বক্তব্য থেকে তার মনের সংশয় আর অবিশ্বাসের ছবিটিই আমাদের সামনে মুর্ত হয়ে ওঠে, বিশ্বাসপ্রবণতাটি নয়। ঈশ্বরে অবিশ্বাসের ব্যাপারটিও কিন্তু তেমনি। নাস্তিকেরা তাদের সংশয় আর অবিশ্বাস থেকেই ‘নাস্তিক’ হন, ‘না-ঈশ্বরে’ বিশ্বাস থেকে নয়। সে জন্যই মুক্ত-মনা Dan Barker তাঁর বিখ্যাত ‘Losing Faith in Faith: From Preacher to Atheist’ গ্রন্থে পরিস্কার করেই বলেছেন – ‘Basic atheism is not a belief. It is the lack of belief.’ (পৃঃ ৯৯)। আসলে সত্যি বলতে কি, ‘বিশ্বাস’ ব্যাপারটিই দাড়িয়ে আছে একটি ‘অপ-বিশ্বাসমূলক’ প্রক্রিয়ার উপর। আমি একবার একজনের সাথে বিতর্কের সময় ড. হুমায়ুন আজাদের সাক্ষাৎকার থেকে একটি প্রাসঙ্গিক উক্তি উদ্ধৃত করেছিলাম। উক্তিটি এখানেও খুব প্রাসঙ্গিক। ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,

‘যে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই, যার কোন অস্তিত্ব নেই যা প্রমাণ করা যায় না, তাতেমানুষকে বিশ্বাস করতে হয়। মানুষ ভুতে বিশ্বাস করে, পরীতে বিশ্বাস করে বা ভগবানে, ঈশ্বরে বা আল্লায় বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাস সত্য নয়, এগুলোর কোন বাস্তব রূপ নেই। মানুষ বলে না, আমি গ্লাসে বিশ্বস করি বা পানিতে বিশ্বাস করি, মেঘে বিশ্বাস করি। যেগুলো নেই সেগুলোই মানুষ বিশ্বাস করে। বিশ্বাস একটি অপবিশ্বাসমূলক ক্রিয়া। যা সত্য, তাতে বিশ্বাস করতে হয় না; যা মিথ্যে তাতে বিশ্বাস করতে হয়। তাই মানুষের সব বিশ্বাস ভুল বা ভ্রান্ত, তা অপবিশ্বাস।’

নাস্তিকেরা সঙ্গত কারণেই এই সমস্ত প্রথাগত অপবিশ্বাসের বাইরে। “ঈশ্বর নেই” বিবৃতিটি যদি শামীম সাহেবের কথামত ‘ফাঁকিবাজি’ হয়, তবে অশ্বত্থামা, ট্যাশ গরু, বকচ্ছপ, থর জিউস, জলপরী, ফ্লাইং স্পেগেটি মন্সটার – এগুলো নেই বলাও একধরণের ‘ফাঁকিবাজি’। নয়?

যা হোক শেষ করি ধর্মকারী সাইটে বর্ণিত একজন নিধর্মীর কিছু অমৃত বচন উল্লেখ করে –

নাস্তিক্যবাদকে ধর্মের সঙ্গে যারা তুলনা করে থাকে, তাদের বলতে ইচ্ছে করে:

১. নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে “অফ” বাটনকে টিভি চ্যানেল বলতে হয়।
২. নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে টাককে বলতে হয় চুলের রং।
৩. নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে স্ট্যাম্প না জমানোকে হবি বলতে হয়।
৪. নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে বাগান না করাও একটি শখ, ক্রিকেট না খেলাও একটি ক্রীড়া, কোকেইন সেবন না করাও একটি নেশা।

এই চমৎকার উপমাগুলোর পাশাপাশি আমিও অনুরূপ কয়েকটি উল্লেখ করে তালিকার শ্রীবৃদ্ধি করি –

নাস্তিকতাও একটি বিশ্বাস হলে বোবা লোককে ‘ভাষাবিদ’ হিসেবে ডাকতে হয়।

নাস্তিকতাও একটি বিশ্বাস হলে দন্তহীন ব্যক্তিকে ‘দাঁতাল’ আখ্যা দিতে হয়।

নাস্তিকতাও একটি বিশ্বাস হলে উপোস থাকাকেও এক ধরনের ‘খাদ্যগ্রহণ’ বলতে হয়।

নাস্তিকতা একটি বিশ্বাস কিংবা ধর্ম হলে চাকরী না করাটাও একটি পেশা।

নাস্তিকতা একটি ধর্ম হলে বই না পড়াকেও বলতে হয় ‘পাঠাভ্যাস’।

নাস্তিকতা বিশ্বাস হলে পোষাক খুলে ফেলাটাও এক ধরনের পোষাক পরিধান।

নাস্তিকতা ধর্ম হলে চশমা না পরাটাও এক ধরনের সানগ্লাসের ফ্যাশান।

নাস্তিকতা একটি বিশ্বাস হলে চিরকৌমার্যও বিবেচিত হওয়া উচিৎ এক ধরনের ‘বিবাহ’ হিসেবে।

নাস্তিকতা একটি বিশ্বাস হলে নির্লোভী থাকার চেষ্টাকেও এক ধরনের ‘লোভ’ বলতে হয়।

নাস্তিকতা একটি ধর্ম হলে নিরোগ স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়াটাও এক ধরনের রোগ!

পাঠকেরা কি বলেন? 😀