আমার লেখা পড়ে কেউ আমাকে ভাবতে পারে সংশয়বাদী হিসেবে। কোন এক লেখায় আমি মন্তব্য করেছিলাম ধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য। সেটা যতটা না আমার মতাদর্শের জন্য তারচেয়ে বেশি হল স্ট্রাটেজীর জন্য। আমি মনে করি বিবর্তনের ধারায় মানুষের মস্তিষ্কের যে পরিবর্তন হয়েছে সেটাই দায়ী ঈশ্বর নামক কল্পিত বস্তুকে তৈরী করার জন্য। এ কারণেই বিজ্ঞানের এত অগ্রগতি সত্বেও মানুষ অলৌকিক কাহিনী বিশাস করতে চায়, সুপার পাওয়ার কল্পনা করে সুখ লাভ করে। আরো একটি বিষয় হতে পারে যে মস্তিষ্ক বাদ দিলে মানুষ আসলে খুব দুর্বল একটি প্রানী। তাঁর নেই হাতীর মত শক্তি, বা চিতার মত গতি বা পাখির মত উড়ার ক্ষমতা। তার সমস্ত শক্তি হচ্ছে এই মস্তিষ্ক। তাই সেই মস্তিষ্ক দিয়েই সে কল্পনা করে যদি তাঁর সমস্ত শক্তি থাকতো কত না সুন্দর হত। এ জন্যই সুপার ম্যানের মত ছবিগুলোতে কাহিনী যতই অবাস্তব হোক বক্স অফিস হিট হবেই। মানুষ আসলে কল্পনা করেই তার সকল অক্ষমতাকে দূর করতে চায়। সেই দুর্বল মানুষের কাছে ঈশ্বর এক মহা শক্তি, তার বেঁচে থাকার প্রেরনা। এ কারণেই বোধ হয় সক্রেটিস, প্লেটোর মত দার্শনিকেরাও ঈশরের মাঝেই সকল সমাধান খুঁজে পেয়েছিল। আর সেখানে সাধারন জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা যে সেই ঈশ্বরের পেছনে ছুটবে তা আর বলতে। তাই ঈশ্বর বিশাসীদের আমি স্বাভাবিক ভাবেই নেই। হাজার যুক্তি দিয়েও সে ঈশ্বরের ভুত তাঁদের মস্তিষ্ক থেকে সরাতে পারবেন না, যদি না নিজে কেউ এটা উপলব্ধি করতে পারে নিজের প্রজ্ঞা দ্বারা। এই ঈশ্বর বিশ্বাস প্রজন্ম হতে প্রজন্মে ধীরে ধীরে কমে যাবে, এবং সান্টা ক্লজের বা রাক্ষস/রাক্ষুসের মত প্রতীকী হয়ে রয়ে যাবে। আজ কয়জন মানুষ বিশ্বাস করে সান্টা ক্লজ/ বা রাক্ষস সত্যি। তারপরেও বহু মানুষ সান্টা ক্লজের কথা চিন্তা করে। কেউ একজন প্রতীকি সান্টা ক্লজ হয় এবং সবাইকে গিফট প্রদান করে। এভাবে একদিন সমাজে প্রতীকী ঈশ্বর থাকবে, শুধু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকতে যে একদা মানুষ ঈশ্বরের কল্পনা করতো, ঈশ্বরে বিশ্বাস করতো।

প্রচলিত ধর্মগ্রন্থগুলোকে আমার কাছে ভাববাদী দর্শনের একটি অংশ হিসেবেই মনে হয়। যে মানুষেরা সেগুলোকে ঈশ্বরের বাণী হিসেবে বিবেচনা করে পরকালের সুখের জন্য তাঁর ইহকাল বিসর্জন দিয়ে যায়, তাঁদের জন্য দুঃখ প্রকাশ ছাড়া কি আরা করা যায়। অবশ্য উল্টো দিকে তাঁরাও আমার বা আমাদের জন্য সমপরিমান দুঃখ প্রকাশ করছে। আমাদের জন্য পরকালে যে নিশ্চিত নরক আছে সেটা চিন্তা করে তাঁরা উল্লাস বোধ করে, কেউ কেউ কষ্টও বোধ করে। এখানেই যে কোন ধর্মান্ধর সাথে যুক্তিবোধ সম্পন্ন মানুষের পার্থক্য। যিনি প্রচলিত ধর্মকে অস্বীকার করেন তিনি সে জন্য কোন ধার্মিকের নরকবাস কামনা করে না, যা ধর্মান্ধ মানুষগুলো বা ধর্মগুলো করে থাকে। এখানেই ধর্মগ্রন্থগুলোর ব্যার্থতা। ধর্মগ্রন্থগুলো আদর্শবাদকে উচ্চে ধারণ করে মানবিকতাকে পদদলিত করেছে। এই কাজ শুধু ভাববাদি দর্শন বা ধর্ম কেবল করেছে বললে ভুল হবে। সেটা যে কোন আদর্শবাদ মতবাদ এই কাজ করতে পারে। যেটা করেছে স্টালিন বা হিটলারের মত লোকেরা। সাম্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বা যে কোন মতবাদকে মানবিকতার উর্ধ্বে ধরে তাঁরা চালিয়ে যায় গনহত্যার মত বিভৎশ্যকর কাজ। ঠিক এ রকম এক গণহত্যা ঘটে ছিল আজ হতে আটত্রিশ বছর আগে আমাদের প্রিয় জন্মভূমিতে। তখন আমাদের অনেকেরই জন্ম হয়নি। দেশ বিভক্তি রক্ষার নাম করে, ধর্ম রক্ষার নাম করে নির্বিচারে পাকিস্তানী বাহিনী এবং দেশীয় কিছু দোশররা চালিয়েছিল এই গনহত্যা। এটা জাতি হিসেবে লজ্জাকর যে আমরা এই গণহত্যাকারীদের বিচার করতে পারিনি। কিন্তু বিচার হবে না তা নয়। এদের বিচার হবেই। আজ হোক, কাল হোক। সময় এদের বিচার করবেই। ইতিহাস এদের বিচার করবেই।

আমি আস্তিক, নাস্তিক, সংশয়বাদী এই বিতর্কে সময় নষ্ট করতে চাই না। এ কারণে সেই বিতর্কে আমি অংশগ্রহন করি না। আমার কাছে ঈশ্বর থাকলেও আমার আদর্শ যা থাকবে ঈশ্বর না থাকলেও তা থাকবে। সেটা হল মানবের কল্যানেই আমার প্রতিটি কর্ম পরিচালিত হবে। এ কারণেই আবারো সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে, আসুন আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কে আমরা যে বিপুল সময় ব্যয় করি তাঁর থেকে কিছু সময় মানবের কল্যানে ব্যয় করি। সচলে সম্প্রতি উইকিযুদ্ধ নামে একটি মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। উইকিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিপিবদ্ধের দ্বারা আমরা পরবর্তী এবং এই প্রজন্মের কাছে আমাদের কথা বলে যেতে পারবো। আপনি যদি চান একটি মুক্তমনা সমাজ গড়ে উঠুক তবে সভ্যতার ইতিহাস, দর্শনের ইতিহাস, ধর্মের ইতিহাস, প্রতিটি দার্শনিকের কথা তুলে ধরুন উইকিপিডিয়ায়। আমি মনে করি উইকির মধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমরা যা চাই সেটা তুলে ধরতে পারি। আমরা যদি বসে থাকি তবে কি হবে? দেখা যাবে যে আমাদের বিপক্ষ শক্তিরা এই দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে এগিয়ে যাবে। আসুন যে যার পক্ষ থেকে উইকিযুদ্ধে নেমে পড়ি। মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য যে যে ক্ষেত্রে জ্ঞান রাখুন তিনি সে সে ক্ষেত্রে কাজে লেগে যেতে পারেন। সবচেয়ে মজা হচ্ছে, এই কাজের জন্য আপনার কাউকে প্রয়োজন হচ্ছে না। নিজেই যে কোন একটি বিষয় বেছে নিয়ে নেমে পড়তে পারেন। তবে সবাই মিলে যদি একত্রে একেকটি বিষয় কাভার করা হয় তবে সেই ক্ষেত্রটি পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে। সেটি আমরা খুব সহজেই করতে পারি মুক্তমনার পক্ষ থেকে। আশা করি মুক্তমনা এই উদ্যোগটি শুরু করবে।

আমরা বিজ্ঞানের একেকটি শাখা শুরু করতে পারি, বা দর্শনের একেকটি কাল ধরতে পারি বা ইতিহাসের একেকটি কাল ধরতে পারি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা সরাসরি ইংরেজী উইকির অনুবাদ করে সেটাকে বাংলা উইকিতে দিয়ে দিতে পারি। বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং দর্শনের ক্ষেত্রে আমাদের কাজ আসলে অনেক কম। শুধু আমাদের কষ্ট করে ইংরেজী হতে অনুবাদ করে বাংলা উইকিতে নিয়ে আসতে হবে। আমরা যেটা করতে পারি, একেক সপ্তাহে ইংরেজী উইকি হতে কিছু বিষয় নির্দিষ্ট করলাম যেগুলো বাংলায় থাকা প্রয়োজন বলে মনে করি। তারপর যে যার সময় মত সেগুলোকে অনুবাদ করে যোগ করতে থাকি। এভাবে কেউ এক লাইন অনুবাদ করলেও অনুবাদ প্রক্রিয়াটি এগুতে পারে। আর যারা বানান বিশারদ উনারা বানান শোধরে দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। আমার নিজের চিন্তা হচ্ছে, গ্রীক দর্শনের ইতিহাস এবং বিভিন্ন দার্শনিকদের জীবনীগুলো ধীরে ধীরে অনুবাদ করে বাংলা উইকিতে দিব। এভাবে সভ্যতার ইতিহাস, মিশরীয় সভ্যতা, ব্যবলীনিয় সভ্যতা, গ্রীক সভ্যতা, হরোপ্পা সভ্যতা, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ, এই বিষয়গুলো চাই অনুবাদ করে বাংলায় নিয়ে আসতে। কেন প্রয়োজন? কারণ আমি যখন এই ইতিহাসগুলো পর্যবেক্ষন করতে পেরেছি, তখনই আমার পক্ষে বুঝা সম্ভব হয়েছে মানুষের মাঝে ধর্মের আবির্ভাব কিভাবে হয়েছে। আমি চাই মানুষ এগুলো পড়ুক। মানুষের জন্য জ্ঞানের ভাণ্ডার খুলে দেওয়া হোক। আর তাহলেই আমরা পাবো এক মুক্তমনা প্রজন্ম।