প্রথম পর্ব

ছুটির দিনগুলোয় বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছিলাম। কোকসাই কোরিও কাইকান এর নীচতলার বড় হলঘরটিতে সপ্তাহান্তে বিভিন্ন ধরণের আয়োজন থাকতো বিদেশী ছাত্র আর তাদের পরিবারের জন্যে। ইকেবানা, জাপানীজ কথ্য ভাষা শেখানো, ওরিগামী, নাচ, গান, জাপানীজ বিডিং( গয়না বানানো-এটি একটি দারুণ শিল্প, খুব ভালোবেসে শিখেছিলাম আমি),রান্না এসবের ওপর কোর্স হতো। অনেকসময় নাটকও হতো, তবে সেইসব নাটকে বিদেশীদের অভিনয় করার প্রশ্ন ওঠেনা এমনই কঠিন ফর্ম্যাল ভাষা ব্যবহৃত হতো।
এরকমই এক ইকেবানা ক্লাস এ আমার পাশে এনে নবাগ্তা তাসনিম কে বসিয়ে দেয়া হলো একদিন। কি, না তাদের ধারণা হয়েছে আমরা একই ধরণের সংস্কৃতি রিপ্রেজেন্ট করি, মনে হয় ভাষাও একই(হুম!)সুতরাং, আমি ওকে আগের ক্লাসগুলো বুঝিয়ে দিতে পারব। আমি ওকে বলি,” কোন ধারণা আছে তোমার কি করতে হবে তা নিয়ে?

-হা, পাতার মধ্যে মাঝে মাঝে ফুল গুঁজে দিতে হবে, কৃত্রিম শিল্প!

-কিছুটা, তবে আইডিয়াটা কিন্তু প্রকৃতি থেকে নেয়া। আমি বলি।

আমি ওকে ইকেবানার জ্যামিতিক বিষয়গুলো বোঝাবার চেষ্টা করি। ছেলেবেলায় ঠাকুমাকে দেখতাম পিতলের ঘটে আম পাতার পল্লব গুঁজে দিয়ে সঠিক ফুলটি খুঁজে বেড়াতেন, ফুলটির আকৃতি, রঙ খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইকেবানায় ঠিক সেই ব্যাপারটি অন্যভাবে উপস্থাপিত হতে দেখে আমি বিস্মিত! আমি ওকে বলে ফেললাম পূজোর থালায় ফুল সাজাবার বিষয়টি।

-তুমি কি ইন্ডিয়া গিয়েছো কখনো?
-হ্যা, আমি পড়েছি ওখানে। কেন বলতো?
-তুমি তো হিন্দুদের অনেক বিষয় জানো, তাই।
-তোমার কথা বুঝলাম না আমি। আমি বলি; ভারতে তো শুধু হিন্দুরাই থাকে না, তোমাদের দেশের থেকে বেশী মুসলমানও থাকে।
– জানি, কিন্তু তারা কিভাবে সেখানে আছে সেটাই বড় কথা। শুনেছি,৭১ এর পরেও অনেক হিন্দু থেকে গেছে বাংলাদেশে; সত্য, তাই না?
-থাকবে না কেন?
-আমার ধারণা ছিল, তারা তাদের দেশে চলে গেছে।

আমি বিস্মিত হই না। আমার রাগ হওয়ার কথা ছিল, রাগ হয় না। এবার আমি ঠিক বুঝতে পারি যে, এর সাথে তর্ক করা উচিৎ হবে না আমার। এ -তো একজন পাকিস্তানী আমাকে বলছে হিন্দুদের তাদের দেশে চলে যাবার কথা, যখন যাদের আমি বন্ধু বলে জানি, তারা এমন কথা বলে-, আমার মধ্যে কি রকম অনুভূতি হয় অথবা দিনের পর দিন আমি সেইরকম অনুভূতি কত বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি তা তো আমি তাদের বা এই তাসনিমকে বোঝাতে পারব না ।অথবা বলা ভাল বোঝাতে যাব না। দেশ বলতে কি বোঝায়, দেশ একজন মানুষের কোথায় জুড়ে থাকে তা অন্যকে বোঝানো শক্ত। আমি সেই তর্কে যাই না। মনের মধ্যে প্রচুর বিতৃষ্ণা গেঁথে আমি তাসনিমের সাথে ফুল নিয়ে কথা বলি।

ফিরে যাওয়ার আগে আমরা সবাই নিজের নিজের বানানো ইকেবানা সাথে করে নিয়ে যাই। এই ধরণের বিনাখরচের স্কুলগুলো সাধারণতঃ চালায় অবসরপ্রাপ্ত জাপানীজ মহিলারা। তাদের একটি করুণ একাকী সময় থেকে বেড়িয়ে আসার একটি ভালো উপায়।একট আমি তাদের একজনকে ধরে বললাম,” তোমার কি করে ধারণা হলো আমি আর তাসনিম একই রকমের? আমাদের গায়ের রঙ দেখে নাকি?’

তাকিতা সান হেসে বলেন,’ নাহ, তোমাদের বাংলাদেশের অনেককে তো ওর সাথে একই ভাষায় কথা বলতে দেখেছি! আমি ভাবলাম…’

-আমি মনে মনে ভাবি, ‘বটেই তো!’

ফিরে যাওয়ার পথে তাসনিম আবার আমাকে সিড়িতে ধরেঃ

-‘তোমার সাথে একদিন জমিয়ে গল্প করা যাবে…আমরা পা-কিস্তানে বলতে গেলে কিছুই জানিনা হিন্দুদের ব্যপারে, ওদের মধ্যেও নিশ্চয় ভালো মানুষ আছে…তাই না?’
(চলবে)