(১৯৭৫ সালের নভেম্বর ৩-৭ এই অশান্ত পাঁচদিনে ঘটনা ঘটছিলো অত্যন্ত দ্রুততার সাথে । এখানে আমি শুধু ৩ তারিখের ঘটনাগুলি তুলে ধরবো।ঘটনা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেবার ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম।)
রাত ১ টার মধ্যে বঙ্গভবনে মোতায়েন মেজর ইকবালের ১ম বেঙ্গলের সব ট্রুপস প্রত্যাহার করার মাধ্যমে সিজিএস ব্রি. খালেদের নেতৃত্বে অভ্যুথান সূ্চনা। [১] ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহ রাত ১২ টার সঙ্গে সঙ্গেই জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দী করেন ।[২]পরে ক্যাপ্টেন তাজ ( বর্তমান সরকারের প্রতিমন্ত্রী ) গিয়ে জিয়ার বাসার টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করেন ।[৩] অবশ্য এর আগেই জিয়া কর্ণেল(অবঃ) তাহেরের সাথে কথা বলেন । জিয়ার গ্রেফতারে গুরুত্বপূর্ণ ভূ্মিকা ছিল ব্রিগেড মেজর হাফিজের।[৪] রাতের অন্ধকারে ৪৬ ব্রিগেডের ইউনিটগুলো ক্যান্টনমেন্ট ও শহরের বিভিন্নস্থানে কৌশলগত অবস্থান নেয় । ট্যাংক হেডকোয়ার্টার থেকে সম্ভাব্য হামলা মোকাবেলায় স্টাফ রোডের রেলক্রসিং রোড ব্লক করেন লেঃ কর্ণেল গাফফারের নেতৃত্বে একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন ও ২য় বেঙ্গলের দুটি কোম্পানি । বেতার -টিভির নিয়ন্ত্রণ নেয়া হয় । বেতার কার্যক্রম বন্ধ করা হয় । চতুর্থ বেঙ্গল থেকে অপারেশন পরিচালনা করছেন ব্রি. খালেদ । সাথে আছেন কর্ণেল শাফায়াত জামিল , কর্ণেল মালেক , ব্রি. রউফ, ব্রি. নুরুজ্জামান, মেজর হাফিজ, মেজর ইকবাল, মেজর নাসির প্রমুখ ।[৫] এভাবেই শুরু হল এক রক্তপাতহীন নিরব অভ্যুথান ।
মোশতাকের উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানী জেনারেল খলিলকে ইতিমধ্যেই নির্দেশ দেন বিডিআর-এর দু’টো রেজিমেন্ট বঙ্গভবনে পাঠিয়ে দিতে । ফারুককে বলা হয় রেসকোর্সে তার ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের কাছে চলে যেতে। ফারুক সাথে সাথে ট্যাঙ্কগুলি সচল করে। রশিদ আর ওসমানী বঙ্গভবনে থেকে টেলিফোন করছেন খালেদকে। জিয়ার সাথে আলাপের চেষ্টা করে ব্যর্থ ।বঙ্গভবন ও রেসকোর্সের সবগুলি ট্যাঙ্ক ফাইটিং এর জন্য তৈরি । এদিকে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টের কামানগুলিও আক্রমনাত্বক পজিশনে । “লড়বো নয় মরবো” । [৬]
এদিকে রিসালদার মোসলেমের নেতৃত্বে একটা ঘাতকদল প্রবেশ করে কারাগারে | দিবাগত রাত ৪টায় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইজি(প্রিজন) ফোন করেন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকেকে।রাষ্ট্রপতির আদেশ আসে- ওরা যা করতে চায় করতে দিন।[৭]এরপরে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে কারাগারে অন্তরীণ মুক্তিযুদ্ধের চারস্তম্ভ তাজউদ্দিন আহমেদ,আ.হ.ম.কামরুজ্জামান ,সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং মনসুর আলীকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হলো। [৮] অবশ্য,তাজউদ্দিনকে শুধু ব্রাশফায়ারে মারা যায়নি । মৃত্যুর আগে পানি পান করতে চেয়েছিলেন তিনি। [৯] পিঁপাসা মেটানো হয়েছিলো তাঁর হৃদপিন্ডে বেয়নেট চার্জ করে যে হৃদয়ে বাংলাদেশ ছিলো। [১০]
এদিকে খালেদের অভ্যুথানের পক্ষে আকাশে দুইটা মিগ জঙ্গী বিমান ও একটি রাশিয়ান হেলিকপ্টার বঙ্গভবন ও রেসকোর্সের উপর দিয়ে বৃত্তাকারে উড়তে থাকে । এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূ্মিকা পালন করেন স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত ।[১১]
খালেদের সাথে আলাপ ও সমঝোতা করতে ডালিম নুরকে সাথে নিয়ে ফুলার রোডে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের বাসা থেকে খাকি পোষাক বদলে সাধারণ কাপড় পরে রওনা দিল ক্যান্টনমেন্টে ।[১২]
কিছু পরে আলোচনায় সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে খালেদের প্রতিনিধি কর্ণেল মান্নাফ এবং কর্ণেল মালেক (এরশাদের আমলে মন্ত্রী,ঢাকার মেয়র )কে সাথে করে ডালিম-নুর ফিরে এলো বঙ্গভবনে খালেদের দাবিনামা সমেত। খালেদের দাবিনামা ছিলঃ (ক) ট্যাঙ্ক বহরকে নিরস্ত্র করে সেনানিবাসে ফেরত পাঠাতে হবে । (খ) জেনারেল জিয়ার স্থলে একজন সেনাপ্রধান নিয়োগ করতে হবে । (গ) মোশতাক প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন তবে,বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে এবং যে সব দেশসমুহ দুঃসময়ে বাঙ্গালী জাতির বন্ধু হিসেবে এগিয়ে এসেছিলো তাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে । [১৩]
দাবিনামা শোনার পর মোশতাক-ওসমানি ব্যর্থ পদত্যাগ নাটক করে । ডালিম রাগান্বিত হয়ে ওসমানিকে বলে , আপনি ফারুক-রশিদদের আত্মসমর্পন করতে বলুন । [১৪]এভাবে ঘন্টা তিন ধরে দরকষাকষি চলে । দরকষাকষি চলাকালিন বঙ্গভবন ও রেসকোর্সের উপর দিয়ে মিগ জঙ্গী বিমান ও রাশিয়ান হেলিকপ্টারের টহল অব্যাহত থাকে ।
জেনারেল খলিল আইজি পুলিশ মারফত জানতে পারেন জেলে চারনেতা হত্যার কথা । খলিল জানায় মোশতাকের সচিব চাষীকে । চাষী মোশতাকের রুমে ঢুকে । কয়েক মিনিট পর চাষী বেরিয়ে এসে বলেনঃ “উনি জানেন !” জেনারেল খলিল অজ্ঞাত কারণে এই খবরটি আর কাউকে জানাননি |[১৫]
মেজরদের ব্যারাকে ফেরত পাঠানোর কথা শুনে রশিদ মোশতাককে বলে , স্যার আমরা কিছুতেই ওখানে যাবো না । এর চেয়ে বরং আমাদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিন । খালেদকে মোশতাক অনুরোধ করে মেজরদের নিরাপদে দেশত্যাগ করতে দেয়ার জন্য । খালেদ গ্রুপ তাতে সম্মত হয় । এভাবে উভয়পক্ষের সম্মতিতে মেজরদের দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । বিমান বাহিনী প্রধান তোয়াব আর পররাষ্ট্র দপ্তরকে দায়িত্ব দেয়া হয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহনের যেন মেজররা নিরাপদে ব্যাংকক যেতে পারে । [১৬]
বিকেলে সেনাবাহিনীর কিছু সংখ্যক সিপাহি, এনসিও, জেসিও নারায়নগঞ্জে কর্ণেল তাহেরের সাথে দেখা করে তাকে পুরো পরিস্থিতি অবহিত করে । [১৭]
সন্ধা ৮:৪৫ মিনিটে তেজগাও বিমান বন্দরে অপেক্ষারত ফক্কর বিমানে আরোহন করে ১৭ মেজর তাদের স্ত্রী পরিজনসহ ব্যাককের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করে । [১৮] খালেদদের অলক্ষ্যে ক্যান্টনমেন্টেই রয়ে যায় একজন ! (এর কথা বলবো ৭ তারিখে )
এভাবেই সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার হোতারা নিরাপদে দেশত্যাগ করল । জেল হত্যার ঘটনা খালেদ -শাফায়াতরা জানলেন পরেরদিন সকাল দশটায় !![ ১৯]
রেফারেন্সঃ
১। Bangladesh: A Legacy of Blood, by Anthony Mascarenhas, Hodder and Stoughton, 1986
২।একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর , কর্নেল শাফায়াত জামিল ।
৩। ভোরের কাগজ, ৪ নভে ২০০৬.
৪। তিনটি সেনা অভ্যুথান ও কিছু না বলা কথা , লে কর্নেল এম এ হামিদ ।
৫। Anthony Mascarenhas, ibid;লে কর্নেল এম এ হামিদ, প্রাগুক্ত ।
৬।Anthony Mascarenhas, ibid; যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি , লে.কর্নেল (অব) শরিফুল হক ডালিম; লে কর্নেল এম এ হামিদ, প্রাগুক্ত ।
৭।প্রাগুক্ত; লে কর্নেল এম এ হামিদ, প্রাগুক্ত ।
৮। প্রাগুক্ত ; জেল হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায় ।
৯।Anthony Mascarenhas, ibid ।
১০। Anthony Mascarenhas, ibid ; পিয়াল ভাইয়ের ব্লগ ।
১১। Anthony Mascarenhas, ibid ; লে কর্নেল এম এ হামিদ, প্রাগুক্ত ;কর্ণেল শাফায়াত জামিল, প্রাগুক্ত ।
১২। যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি , লে. কর্নেল (অব) শরিফুল হক ডালিম ।
১৩।Anthony Mascarenhas, ibid ;মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বরূপ , মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি ।
১৪। মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি,প্রাগুক্ত ; Anthony Mascarenhas, ibid
১৫। Anthony Mascarenhas, ibid ; লে কর্নেল এম এ হামিদ, প্রাগুক্ত ।
১৬। প্রাগুক্ত ।
১৭।ঝন্ঝাবিক্ষুব্ধ সেই দিনগুলো,লুৎফা তাহের ।
১৮। Anthony Mascarenhas, ibid ; লে কর্নেল এম এ হামিদ, প্রাগুক্ত ।
১৯। কর্নেল শাফায়াত জামিল, প্রাগুক্ত।
আমাদের ইংরেজী ব্লগেও ঘটনাবহুল তেসরা নভেম্বর নিয়ে মীজান রহমানের একটা ভাল লেখা প্রকাশিত হয়েছে। উৎসাহী পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন এখান থেকে।
দুদিন ধরেই ভাবছিলাম ৩রা নভেম্বর এলো অথচ মানিক ভাই এর পাত্তা নেই ব্যাপারটা কি?
অবশেষে উনি এসেছেন আরেকটি চমতকাত তথ্যবহুল এনালাইসিস নিয়ে।
জেল হত্যার জন্য প্রত্যক্ষ ব্রেইন আমার কাছে মনে হয়েছে রশিদ। মোশতাক ছিল শুধু সেবাদাস।
তবে আমার বিবেচনায় খালেদ মোশাররফের অদুরদর্শীতার আরেকটি নজির এটা। ওনার উচিত ছিল জেলে নেতাদের নিরাপত্তার বিশেষ ব্যাবস্থা নেওয়া।
ওই সময়ে ওসমানী সাহেবের ভূমিকা নিয়ে একটি পূর্নাংগ লেখা আশা করি। মুক্তিযুদ্ধের বীর প্রধান সেনাপতিকে কেমন যেন খুনী মেজরদের এডভাইজার বলেই মনে হয়।
@আদিল মাহমুদ,
অজস্র ধন্যবাদ । এই লেখায় আমি আমার নিজস্ব কোন মূ্ল্যায়ন দেই নি । সেসময়ের ঘটনা এবং ঘটনা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কে আমার নিজস্ব মূ্ল্যায়ন রয়েছে ।আলাদা পোষ্টে তা’ জানাব ।
জেনারেল ওসমানি নিয়েও আলাদা লিখব মুক্তিযুদ্ধের আগে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং স্বাধী্ন দেশে তার ভূ্মিকা ও কর্মকান্ড নিয়ে ।
উনি তাই ছিলেন । তিনি বাকশালে যোগ দেননি এবং সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন এটা যেমন ফলাও করে প্রচার করা হয় তেমন করে তিনি যে জুনিয়র খুনি মেজরদের সমর্থিত অবৈধ মোশতাক সরকারের প্রধান সমর্থক এবং উপদেষ্টা ছিলেন তা’ প্রচার পায়না ।
@নুরুজ্জামান মানিক,
ওসমানীকে নিয়ে বড়সড় লেখা লিখে ফেলেন। ওনাকে নিয়ে তেমন লেখা পাই না। শুধুমাত্র বংগবন্ধু শাসনে বিরক্ত ছিলেন বলে তিনি খুনীদের গডফাদারের ভূমিকা নিয়েছিলেন নাকি অন্য কোন কারন ছিল আনার খুব ইচ্ছা।
@আদিল মাহমুদ,
মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তিতে মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের ভুমিকা ও পরিনতি -১
এই সিরিজে আমার হাত দিছি । এখানে ওসমানি , জিয়া, খালেদ,তাহের, মন্জুর সবাই আসবে ।
আপনার লেখাটা দেখে ‘ক্রাচের কর্ণেল’ বইটার কথা মনে পরে গেল। আপনি কি পড়েছেন? কয়েক মাস আগে বইটা পড়ার সময় বারবার মনে হচ্ছিল বইটা কতটা তথ্যনির্ভর তা কেমন করে বুঝবো। আমার হাতে এই মুহূর্তে বইটা নেই, কিন্তু যতদুর মনে পড়ছে আপনি যেভাবে ঘটনার শেষ এপিসোডটা বর্ণণা করেছেন, ক্রাচের কর্ণেলেও একইভাবে বলা হয়েছিল। বইটার বিভিন্ন জায়গা বেশ ‘ইমোশানাল’ মনে হয়েছে, কিন্তু সেটা তো উপন্যাসে দোষের কিছু নয়, সিরাজ শিকদার সম্পর্কে ব্যাখ্যাগুলোও বেশ কিছু জায়গায় সঠিক মনে হয়নি। বইটা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে পারলে ভালো লাগতো।
দুঃখিত বন্যা আপা বইটি আমার পড়া হয়নি তাই মতামত দিতে পারছি না ।