“অবাক পৃথিবী; অবাক করলে তুমি!
জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশ-ভূমি।”

যে কবি জন্মেই অনুভব করে যে তাঁর স্বদেশের মাটি ক্ষুব্ধ ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত, জনগন স্তব্ধ এবং নিপীড়িন ও বৈষম্যের শিকার, হাতে পায়ে উপলব্ধি করেন পরাধীনতার বেড়ি এবং রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত; সে কবি মানুষকে শুধুই পরাধীন মানুষ হিসেবেই দেখবেন। দেখবেন শোষিত জনতা মুরগীর মতো শোষক শ্রেণীর খাবারের টেবিলে অথবা শাসক গোষ্ঠী তাদের পোড়াচ্ছে সিগারেটের মতো কিংবা তারা দলিত হচ্ছে সিঁড়ির মতো। তাঁর মানুষকে নারী পুরুষ হিসেবে বিভাজনের সুযোগ কই? ব্যক্তির একান্তই রোমান্টিক সত্ত্বা বিকশিত হতে যে বাতাবরণ প্রয়োজন তা কী সুকান্ত ভট্টাচায্য পাননি! আর তাই নারীর সরব উপস্থিতি অনুভব করতে পারেননি যা তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য কবিরা পেরেছিলেন! তাঁর কবিতা কি নারী বিবর্জিত! একান্ত ব্যক্তিগত আবেগীয় প্রকাশ কী নির্বাসন দিয়েছিলেন সচেতনভাবে? তাই কী লিখেছিলেন – “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।“

সুকান্ত ভট্টাচায্য তাঁর বন্ধু অরুণাচলকে লেখা পত্রগুচ্ছে তাঁর প্রেমিকার উল্লেখে ভরপুর। প্রেমিকার নামোল্লেখ না করেও তাকে ঘিরেই চিঠির ভাষা ও বিষয় আবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু ‘গীতিগুচ্ছ’ ছাড়া তাঁর কাব্যে সে প্রেমিকা সম্পূর্ণই অনুপস্থিত।

সুকান্ত ভট্টাচায্যের কাব্যের সাহিত্যিক মূল্য নিয়ে আমার আলোচনা নয়। তাঁর কবিতায় রূপকল্প, চিত্রকল্প, রূপক, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অর্থব্যঞ্জনা বা ধ্বনিমাধূ্য্য নিয়ে আমার চিন্তা চেতনায় কোন স্পন্দন নেই। তাঁর কাব্যে নারী চরিত্র চিত্রণ, নারীর ভূমিকা ও উপস্থিতি, সর্বোপরি নারী প্রসঙ্গ নিয়েই আমার লেখা আবর্তিত হবে। সুকান্তের কাব্যে আবেগের আতিশয্য নেই। নেই কল্পণার ফানুস। নিরেট বাস্তবতাকে কাব্যিক রূপ দিয়েছেন। আর এ রূপদানে নারীর অস্তিত্ব কিন্তু বিস্মিত হননি। ফিরে ফিরে এসেছে নারীর প্রসঙ্গ, তবে প্রকটভাবে নয়।

এ প্রসঙ্গে তাঁর বন্ধু অরুণাচল বসুর লেখা “—এর আড়ালে বালুর তলায় স্রোতোধারার মতো প্রায় চাপা পড়ে থেকেছে তার সেই অপরূপ সৌন্দয্য-কোমল, স্বপ্ন-মুগ্ধ মনটি। তবু পৃথিবীর রূপ-রস-সৌরভে বিমোহিত তার ‘আশ্চয্য নতুন চোখে’র চাহনি একেবারে লুকিয়ে থাকার নয়। একটু কান পেতে, চোখ মেলে, ছুঁয়ে দেখলেই এই দিকটিও আমাদের আচমকা আনন্দের মধুর সৌরভে ভরিয়ে দেবে।“

সুকান্ত ভট্টাচায্যের বন্ধু নিশ্চয়ই বন্ধুর একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির অংশীদার ছিলেন। তাই অরুণাচল বসুর লেখার রেখা ধরে তাঁর কাব্য সমগ্র ঘাঁটলে, ঘুটলে ও খুঁটলে বিক্ষুব্ধ কবির হৃদয়ে ব্যক্তি প্রেমের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।

সাধারণভাবে কবিতা মানেই প্রেম, প্রকৃতি ও নারী নিয়ে অনুশীলন। কিন্তু সুকান্ত ভট্টাচায্যের কবিতা মানেই শোষণ, শাসন, স্বাধীনতা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, পরাধীনতা এসব শব্দের ও ব্যাখ্যার সমাবেশ হিসেবেই বহুল আলোচিত।
যে কবি “ রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ কবিতায় লিখেন –
‘আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি,
প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়,
—————————————
আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাতে’

যাঁর জীবনের ব্রত ‘দানবের সাথে আজ সংগ্রামের তরে। ‘সে কবি কী করে বসন্ত আর রোমাঞ্চের প্রাকৃতিক স্বাদ পাবেন? তবে কী সুকান্তকে বসন্ত বা রোমাঞ্চ একেবারেই স্পর্শ করেনি? কোন নারীর সৌন্দয্য তাঁর মনের গহীনকে আবেগে আপ্লুত করেনি? এর সন্ধান করতে তাঁর কাব্যের ময়না তদন্তের প্রতিবেদন প্রয়োজন।

বিপ্লব, বিদ্রোহ ও বিক্ষোভের ভিড়ে কি কবির কোমল প্রাণ কঠিন হয়ে গিয়েছিল? তাই কি নারী প্রেম নির্বাসিত তার কাব্য জগৎ থেকে? টর্চের আলোর রশ্মি ফেলতে হবে কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে। নারী প্রসঙ্গ তো জীবন ও জগতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সে তো সর্বত্র বিরাজমান থাকার কথা।
সুকান্ত “ এ বিশ্বকে এ – শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি “ বলে অঙ্গীকার করেছিলেন। তিনি কী তখন ভেবেছিলেন যে মেয়ে শিশু আর ছেলে শিশুর সুযোগ ও অধিকার আজকের পৃথিবীতে এক নয়! ভাবলে কী পংক্তিতে পরিবর্তন অবধারিত ছিল?

তিনি ‘আঠারো বছর বয়স’ এর জয়গান গেয়েছেন, কিন্তু ভেবেছেন কী পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্র এক দড়িতে আঠারো বছরের নারী ও পুরুষের গতি রোধ করে না। নারীর গতিরোধক আইন ও রীতি-নীতি পৃথক উপকরণে তৈরী এবং তা কঠিন,কখনো বা নিষ্ঠুর সামাজিক অনুশীলনে আক্রান্ত।

স্বাধীন ও মুক্ত জীবনের আকাঙ্ক্ষী কবি সুকান্ত ভট্টাচায্য কী কখনো তাঁর মানস প্রিয়ার জন্যে পংক্তি রচনা করেননি বা কবিতায় এর ছায়া পড়েনি! কবিতার কোন পংক্তির জন্যে শব্দ খুঁজতে গিয়েও কী কোন নারীর আঁচলের বাতাসে আবেশিত হননি! ডুবুরীর মতো তাঁর কবিতার অতল গহনে খুঁজতে হবে বৈ কি!

‘আগামী’ কবিতায় ভবিষ্যতকে, আগামীকে আবাহন করেছেন নাকি এর প্রচ্ছদে কোন নারীকে উজার করে দেবার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন!
‘সেদিন ছায়ায় এসঃ হানো যদি কঠিন কুঠারে,
তবুও তোমায় আমি হাতছানি দেব বারে বারে;
ফল দেব, ফুল দেব, দেব আমি পাখিরও কূজন
একই মাটিতে পুষ্ট তোমাদের আপনার জন।‘

ফুল, ফল ও পাখির কুজন তো যুদ্ধের জন্যে নয়, নয় বিপ্লবের জন্যে। নিজেকে উজার করে দেবার এই যে অঙ্গীকার তা কিন্তু রক্তপাতহীন ত্যাগ। এ ত্যাগে প্রেম আছে হেম আছে — আছে প্রেমিকার জন্যে নিবিড়তম আবেগ ও উচ্ছ্বাস।

‘কলম’ কবিতায় কলমকে বিদ্রোহ ও ধর্মঘট করতে আহ্বান করলেও এতে সাহিত্য ও ইতিহাসের মতো কোন এক প্রিয়ারও যে ক্ষতি হবে তা কবি ভুলেননি। কলমের কর্ম বিরতিতে দূর দেশের প্রিয়ার ব্যথাতুর মুখখানি কবির মনে উঁকি দিয়েছে বলেই লিখেছেন –
“উদ্বেগ-আকুল হোক, প্রিয়া যত দূর দেশে
কলম! বিদ্রোহ আজ,ধর্মঘট হোক অবশেষে;

বিদ্রোহ আর ধর্মঘট ডাকার জন্যে উৎসাহিত করার আগের লাইনটি তাই হৃদয়ের চিনচিনে কালি দিয়ে প্রিয়ার বিরহী ব্যথাতুর মুখের রেখা এঁকেছেন। তাঁর কাব্যে নারী প্রেম নেই বা তিনি নারী শব্দের সংস্পর্শ এড়িয়ে গেছেন তা যে নয় এর প্রমাণ উপরের কবিতাংশ।

কবির বিদ্রোহের,বিক্ষোভের, সিংহনাদের আর দেশলাই কাঠির মতো জ্বলে ওঠার কারণ ‘বোধন’ কবিতায় –
“প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা, ভেঙ্গেছিস ঘরবাড়ি,
সে কথা কি আমি জীবনে মরণে কখনো ভুলিতে পারি?”

স্বচ্ছ,স্পষ্ট ও সরল সহজ স্বগোক্তি। তাঁর কাব্যে ও সংগ্রামে নারীর ভূমিকা ও উপস্থিতির উজ্জ্বল সাক্ষ্য উপরের লাইন দু’টি। যে প্রিয়ার স্মৃতি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্ধুদ্ধ করে সে কিন্তু ফাঁকে কবিতায়ও নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করে নেয়। কাজেই সুকান্ত ভট্টাচায্য যুদ্ধ,শোষণ, দুর্ভিক্ষ, ধর্মঘট, বিদ্রোহ, হতাশা আর সংগ্রামের কবিতা লিখলেও পরতে পরতে নারীর অবস্থানকেও তুলে ধরেছেন চিরাচরিত নিযার্তনের শিকার চরিত্র হিসেবে। যুগে যুগে সব যুদ্ধে আক্রমণের শিকার হয় নারী এবং সুকান্তের কবিতায়ও এ চিত্রের ব্যতিক্রম ঘটেনি।

রানারের ‘জীবনের স্বপ্নের মত’ কবিরও স্বপ্ন প্রিয়া দূরে সরে যায়। তিনি দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার দায় ও দায়িত্ব নিজেই মাথা পেতে নিয়েছেন। কর্তব্যবোধের কাছে তাঁর ব্যক্তি জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা তুচ্ছ। তেমনি ‘রানার’ কবিতায় নারীর উপস্থিতি ও আবেদন কর্তব্যবোধের কাছে অবহেলায় ভূলুণ্ঠিত এবং দুবির্নীত নিষ্ঠার কাছে সুক্ষ্ম আবেগ পরাজিত।

‘অনেক দুঃখে,বহু বেদনায়, অভিমানে,অনুরাগে,
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।“

হেমন্ত ঋতু সুকান্তকে জীবনানন্দ দাশের মতো আবেশিত করতে পারেনি। পূর্ণিমার চাঁদ যাঁর কাছে ঝলসানো রুটি তাঁর কাছে হেমন্ত তো শুধু ধানের মুঠি মুঠি ছড়া নিয়ে আসে না। কবির জীবন অভিজ্ঞতায় নারী্র নবান্ন উৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত থাকার মতো পযার্প্ত তথ্যাদি নেই। গত হেমন্তেই বাংলার চিরায়ত ফসলের চিত্র আঁকার জন্যে প্রচলিত রঙ সুকান্ত তাঁর তুলিতে লাগাতে পারেননি। তাই সুকান্ত ‘এই নবান্নে’ কবিতায় তাঁর উপলব্ধির বাংলার চিরায়ত সমাজে ও পরিবারে নারীর অবস্থান তুলে ধরেছেন।
‘গত হেমন্তে মরে গেছে ভাই, ছেড়ে গেছে বোন,
পথে-প্রান্তরে খামারে মরেছে যত পরিজন;’

ভাইয়ের বাঁধন মরণে বিচ্ছিন্ন হলেও বোনের সম্পর্ক ছিঁড়ে যায় ইহজাগতিক অভাবের তাড়নায়। নারী ঘর ছেড়ে গেলেই সমাজ পরিবার থেকে তার বন্ধন ছিঁড়ে ফেলে। নর ঘরে পড়ে মরলেও নারী মরার আগে শরীরের শেষ মাংসপিন্ডটুকু ব্যবহার করে সংগ্রাম চালিয়ে যায়। সুকান্ত ভট্রাচার্য্য ইঙ্গিতে নারীর ঘর ছাড়ার ইতিহাস বলেছেন যা নারীর অবস্থান সম্পর্কে তাঁর সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পরিচয় বহন করে। তাঁর কাব্যে নারী এসেছে প্রিয়া রূপে, বোন রূপে,জীবন সংগ্রামে যোদ্ধা রূপে, স্ত্রী রূপে ও সহযোদ্ধা রূপে, কখনো এসেছে শাশ্বত রুপ নিয়ে, কখনো বা নিযার্তনের শিকার হয়ে।