সুজন সন্ধ্যায়
ক্যাথেরীনা রোজারিও কেয়া
গল্পটা ওদের তিনজনকে নিয়ে। রনো, লতা আর উজ্জ্বল। সে দিনটা ছিল কাজের দিন। অফিস থেকে ফিরে সবে চায়ের কাপ হাতে উজ্জ্বল বসেছে টিভির সামনে, অমনি ফোনটা বেজে উঠলো। উজ্জ্বলের স্ত্রী মৃদুলা ফোন ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে উজ্জ্বলের সাথে কথা বলতে চাইলো মেয়েলী একটা কণ্ঠ। উজ্জল ফোন ধরতেই এক রাশ রিনিঝিনি কন্ঠে লতা বলল- জানো তো তোমাদের শহরে ঘুরতে আসছি, মা কে নিয়ে। সময় করে ঘোরাবে তো মশাই? উজ্জ্বলের ভেতরে তোলপাড় চলছে। ওপাশের কথার তোড়ের সাথে তাল মিলিয়ে ওর সারা শরীরে রক্তের ছোটাছুটি। নিজেকে সামলাতে ফোনের রিসিভার কান থেকে খানিক দূরে রাখলো। পরক্ষণেই মনে হোল মৃদুলা ধারে কাছেই আছে, তাড়াতাড়ি রিসিভারটা কানে চেপে বললো- বেশ তো নিলাম না হয় তোমার জন্যে একদিন ছুটি। আচ্ছা করে ঘোরা যাবে। লতা আবেগ মিশিয়ে বললো- কাজে কামাই দিচ্ছো আমার জন্যে? উজ্জ্বল মুখে বললো -ছুটি পাওনা ছিল, মার যাবার আগে নিয়ে নিলাম এই আর কি। মনে মনে বললো – তোমার জন্যে নয় – ছুটি নিচ্ছি আমার নিজের জন্যে।
কত বছর হবে ? সাত বছর? সাত বছর পর লতার কন্ঠ শুনলো অপ্রত্যাশিতভাবেই। দিনক্ষণ জেনে নিলো ওদের আসবার উজ্জ্বল। ফোন নামিয়ে ফ্রিজ খুলে এক গ্লাস জল ঢাললো, আসলে সময় নিচ্ছে, এই মুহুর্তে মৃদুলার সামনে যেতে কেমন জেনো লাগছে। আচ্ছা ওর চেহারায় কি কিছু ফুটে উঠেছে ? ঠান্ডা জলে গলা ভিজ়িয়ে খুব নির্লিপ্ত মুখ করে টিভির সামনে এসে বসলো। মৃদুলা একবার ভুরুটা খানিক তুলে ওর দিকে চাইলো –অর্থাৎ জানতে চাইছে- কি ব্যাপার? উজ্জ্বল ইচ্ছে করে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে।
রাতে খাবার টেবিলে উজ্জ্বল খুব হালকা ভাবেই বললো- লতা ওর মাকে নিয়ে আগামী সপ্তাহে আসছে। শুক্রবার আমাদের এখানে আসবে বললো। মৃদুলা জানতে চাইল রাতে রাধবো না দুপুরে? দুপুরে- জবাবটা শুনেই মৃদুলা মনে মনে হাসলো। এই উজ্জলকেই ছুটি নিতে বললে কেমন বিরক্ত হয়। উজ্জ্বল বেশ চড়া গলায় বলে চলেছে লতার মা তাদের কেমন আত্মীয়, কত বছর ধরে চেনে, মৃদুলা ডালের বাটিতে চামচ দিয়ে নেড়ে দিল, নীচ থেকে ঘন ডালটা উঠে এলো, যেমন করে উজ্জ্বলের থিতিয়ে যাওয়া স্মৃতি উঠে আসছে ধীরে ধীরে। মৃদুলা জানে উজ্জলের কাছে লতার মা মুখ্য নয়। লতা যে স্মৃতিতে উজ্জ্বলকে জড়িয়ে আছে উজ্জ্বলের আনমনা চেহারা দেখে তা বেশ বোঝাই যাচ্ছে।
মৃদুলা প্রতিবাদহীন মানুষ। মেনে নিয়েছে সংসারের অনেক কিছুই প্রতিকারহীনভাবে। নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ওর কিছুই প্রকাশিত হয় না , না দুঃখ না আনন্দ না ক্ষোভ। তবুও না দেখা লতাকে হিংসে হচ্ছে কেনো?
আজ বিষ্যুদবার। সকাল থেকেই মেঘলা চারদিক। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুলা বুঝতে পারে স্বামী তার মনে মনে ফুলের এক একটা পাপড়ি ছিড়ছে আর বলছে কাল বৃষ্টি হবে? হবে না? ও আসবে তো? আসবে না? মৃদুলা মনে মনে হেসেছে – কাল কাল বৈশাখী হলেও কিছুই ঠেকে থাকবে না। মাথার ভেতর ও সাজিয়ে নিয়েছে কি কি রান্না হবে। কোনটার পর কোনটা। সন্ধ্যে নামতেই কাজো শুরু করেছে, কাল সকালে বেশী কিছু করতে চায় না। উজ্জলের চাপা উত্তেজনা টের পাচ্ছে মৃদুলা। তবু যে নির্লিপ্ততার আবরন মৃদুলা ধারন করে তাতে কৌতুহল চিড় ধরাতে পারছে না।
রাতে খাবারের পাঠ চুকতেই হাপ ছেড়ে বাঁচলো যেন উজ্জ্বল। একটা বই নিয়ে সটান বিছানায় শুয়ে পড়ল। আজ আর মৃদুলার মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছে না।
ওদিকে মৃদুলা রেঁধে চলেছে, ঘড়ির কাটা রাত দশ, এগারোটা করে বারোটায় যখন পৌঁছোলো তখন চুলোটা নিবিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
পরের দিন বেলা দশটা বাজতেই নিজেকে ফিটফাট করে নিলো উজ্জ্বল। সাড়ে বারোটায় কলিং বেলের আওয়াজ পাওয়া গেলো। উজ্জ্বল দরজাটা খুলেই অস্বাভাবিক গলায় বলল এসো এসো লতা ভেতরে এসো।
অতি আধুনিক কাপড়ে বেশ দর্শনীয় লতা – অন্তত এক নজরে তাই মনে হল। পরিচয় পর্বের শেষে মৃদুলা নিজেকে সরিয়ে আনল খাবার গরম করি, কেমন ? বলে। পাশের ঘরে লতা আর উজ্জ্বলের কন্ঠস্বরের উচ্ছ্বাস ক্রমাগত বাড়ছেই। উজ্জলের দীর্ঘাঙ্গী মেয়েদের প্রতি আকর্ষন আগেও লক্ষ্য করেছে মৃদুলা। ওর এলবাম জুড়ে অপরিচিত মেয়েদের ছবি মৃদুলাকে উৎকন্ঠিত করেনি, বিষাদক্লিষ্টও নয়। ওর বিয়ে হয়েছে বছর চারেক, সম্পর্কের চড়াই উতরাই পেরিয়ে মৃদুলার এই নির্লিপ্ততা।
অঘটনটা ঘটলো তখনি যখন লতা ওর খোলাচুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলল “আচ্ছা রনো নামের কাউকে চেনো নাকি ? জানা শোনা আছে?” ওর সাথে বছর দেড়েক আগে ইন্টারনেট এ পরিচয় আমার। চেনো নাকি উজ্জ্বল? তোমাদের এ শহরেই থাকে। উজ্জ্বল ভুরু কুঁচকে চিনি বলেই সন্দেহের কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো ”ওকে কি শুধুই-মেলের মাধম্যেই চেন?” এই কন্ঠে সে শুধু মৃদুলাকেই প্রশ্ন করে। বিয়ের পর থেকে কোন অ–বলা কথা শোনার জন্যেই প্রশ্ন করেছে বার বার।। আসলে মৃদুলার নির্লপ্ততার কারণ খুজতে চায় উজ্জ্বল। ওর ধারণা বিবাহ পূর্ব কোন বেদনার স্মৃতি বোধ করি মৃদুলাকে নির্লিপ্ত করেছে। বিষয়টা যে মৃদুলাও বোঝে না, তা নয়। তবু মুখ ফুটে বলা হয়নি, উজ্জ্বল তোমার চরিত্রের এই দিকটার কারনেই তোমার বিষয়ে সব আকর্ষণ আমি হারিয়ে ফেলেছি। এটা মৃদুলার অভিমান নয়, অপমানের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার কৌশল। ও মেনে নিতে পারে না ওর স্বামী এতখানি পলকা চরিত্রের হবে। জীবনের কাছে তেমন কোন দাবী ছিল না মৃদুলার। জীবনের কৃপণতা তাকে ব্যথিত করে।
খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে ফেলেছে মৃদুলা। উজ্জ্বল ব্যস্ত হয়ে পড়লো লতার খাবার তদারকিতে। মৃদুলা লক্ষ্য করছে মাঝে মাঝেই ওরা গলা নামিয়ে কি যেন বলছে আর চাপা হাসিতে মুখ ভরিয়ে রেখেছে। আর মাঝে মাঝে হিংসের চোরা দৃষ্টি দিচ্ছে লতা মৃদুলার দিকে, হয়ত ওর ভরা সংসার লতার কষ্ট বাড়াচ্ছে।
খাওয়ার পর্ব সারতেই ফোন বেজে উঠলো, উজ্জ্বল ফোনটা বাড়িয়ে দিলো লতার দিকে, বোধ হয় কলার আই ডি তে নাম দেখেই। লতার কন্ঠ আনন্দে টইটুম্বর। “ কি হে কেমন শাস্তি দিলাম। দেখ ত? তোমার বাড়ীর কাছাকাছি এসে গেছি। এখন তো এসে দেখা করতেই হবে আমার সঙ্গে- কি বল? ক্রমাগত কথা বলছে লতা। মৃদুলা চট করে উজ্জ্বলের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে নিল – উজ্জ্বলের চেহারায় হিংসে ছায়া ফেলছে, সাথে বিরক্তিও। ফোন নামিয়ে লতা বলল- উফ! বাব্বা – বলে কি এখনি আসছি। ভাবলাম তোমাদের বাসা আমি কি করে আসতে বলি? তোমাদের অনুমতি চাইতো? কোন কথাই শুনলো না। বললো কি নাকি দূর সম্পর্কের আত্মীয় তোমাদের? বললো ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই আসবে রনো, শুনছো উজ্জ্বল? উজ্জ্বল চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল শুনেছি। সাথে সাথে অস্পষ্ট কন্ঠ স্বরে – রনো গত মাসে বিয়ে করেছে জানোতো লতা? ইচ্ছে করে আঘাত করার জন্যে বলা কথাটা। আর কেউ না বুঝুক মৃদুলা বুঝলো ঠিকই। লতা যেন আচমকা বোবা হয়ে গেল। সামলে নিয়ে কেটে কেটে বললো, বাহ! জানি নাতো? নতুন খবর বটে।” মৃদুলা সরে এসেছে ও ঘর থেকে, মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে মায়াই হচ্ছে এখন।
মৃদুলার বেশ মনে আছে এই রনোকে কয়েক মাস আগে এ বাসায় আসতে বলেছিল দূর সম্পর্কের আত্মীয় আর এই বিদেশে দূরের সম্পর্কের আপন ভেবে। নির্দিষ্ট দিনে রনো আসেনি, পরের দিন মৃদুলা কল করায় বলেছিল – “এই রে এক্কেবারে ভুলে গিয়েছি।” সেই রনোই লতার ফোন পেয়ে ছুটে আসছে। ব্যাপারটা মন্দ লাগছে না মৃদুলার।
কলিং বেল বাজতেই উজ্জ্বল উঠে দরজাটা খুললো। রনো ঘরে ঢুকতেই উজ্জ্বল ঝুঁকে পড়ে কার্পেট থেকে অদৃশ্য কোন ময়লা তোলার চেষ্টা করতে লাগল। মুখে মেকি একটা হাসি ঝুলিয়ে উজ্জ্বল বলল আরে এসো এসো। যাক লতার জন্যে হলেও এলে এ বাসায়। তা বিবাহিত জীবন কেমন লাগছে? “ শেষের প্রশ্নটা লতাকে শুনিয়ে করা। রনো প্রশ্নটা করার সাথে সাথে জবাব দিল, ও তো দেশে, আমি তো এখনো ব্যাচেলর।, উত্তরটাও লতাকে শোনাবার জন্যেই।
লতা মেতে উঠলো রনোর সাথে কথায় আর উজ্জ্বল বিমর্ষ হয়ে টেলিভিশনের রিমোট টেপাটেপিতে ব্যস্ত হয়ে থাকল। মৃদুলা ওদের চায়ের ব্যবস্থা করতে করতে শুনলো, উজ্জ্বল বলছে “সূর্য ডুবতে প্রায় ঘন্টা দেড়েক বাকি আছে। লতা, চলো বীচে বেড়িয়ে আসি। লতা নেচে উঠলো। রনো সঙ্গ ছাড়তে চাইলো না। বললো, হ্যা চল না। উজ্জ্বলের চোখে আবার বিরক্তি, ভেবেছিল রনো বলবে না, সম্ভব না।
উজ্জ্বল মৃদুলার দিকে চাইলো। অর্থাৎ তৈরী হয়ে নাও। এর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন সে মনে করে না। উজ্জ্বল ধরেই নিয়েছে মৃদুলা যাবেই। মৃদুলা তৈরী হয়ে এলো। লতার মা এতক্ষণে লম্বা ঘুম দিয়ে উঠেছেন। হাত মুখে জল দিয়ে এসে দাড়ালেন বসার ঘরে। উজ্জ্বলের হাসি হাসি চেহারা আবার ফিরে এসেছে। গাড়ির কাছে এসে উজ্জ্বল বললো রনো তুমি তোমার গাড়ীতে করে এসো। লতা তুমি তো তোমারটা চালাচ্ছো। আমি আর নিলাম না। বরং তোমার পাশে বসে ডিরেকশন দেই কি বল? রনো কিছু বললো না। উজ্জ্বল যেন ক্রন্দণরত বাচ্চার হাতে উদ্বৃত্ত ভাঙ্গা ললিপপের কাঠি গুজে দিতে দিতে বলল “ মৃদুলা তোমার সাথে যাক রনো। একা একা ড্রাইভ করতে খারাপ লাগবে না? লতার মাকে বললো” আপনিও যান না ওদের সঙ্গে, গল্প করতে করতে পৌঁছে যাবেন। মৃদুলা মনে মনে হাসলো- ক’মাস আগে রনোকে যখন ওর বাসায় আসতে বলেছিল উজ্জ্বল ব্যাপারটা সহজ ভাবে নেয় নি। কেন নেমন্তন্ন? কে কল করে ছিল? মৃদুলা না রনো? প্রায়ই কথা হয়? কত ক্ষণ কথা হয়েছিলো– কত প্রশ্ন উজ্জ্বলের আর আজ সে কি ভীষণ উদার।
মৃদুলার সব মিলিয়ে খারাপ লাগছে না, শুধু দুঃখ লাগছে লতার মায়ের জন্যে। বেচারী কেমন যেন না বোঝার ভান করে জুবুথুবু হয়ে বসে আছেন। ওরা অল্প সময়েই পৌঁছে গেল গন্তব্যে।
মৃদুলা বললো, আমি গাড়ীতে বসে থাকি। তোমরা ঘুরে এসো। লতার মাও একই কথা বললেন। রনো বিড়বিড় করে কি যেন বলে নেমে গেল। উজ্জ্বল কথাটা শুনলো কিন্তু উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলো না। ওরা তিনজন বালির উপর দিয়ে হেটে যাচ্ছে। মরা রোদ্দুরে ওদের ছায়া লম্বা থেকে আরো লম্বা হচ্ছে। হাটতে হাটতে মিলিয়ে গেল ওরা। মৃদুলা আচ করেছে ওদের দুজনেরই লতার ব্যপারে আকর্ষণ ছিল। লতারও তাই, কিন্তু কারোই মুখ ফুটে বলা হয়নি। আর না বলা এই সময়টাতে রনো আর উজ্জ্বল গুছিয়ে নিয়েছে জীবন। হঠাৎ করে বুনো হাওয়ার মতো লতার উপস্থিতি ওদের নস্টালজিক করছে। লতার মা এর কাছে শোনা, ক্লান্ত লতাও শেকড় গাড়ার কথা ভাবছে। তাই এ শহরে আসা। পুরনো সম্পর্ক ঝাঁলিয়ে নিতে আসা, কিন্তু ওতো জানতো না যে জল গড়িয়ে গেছে অনেক দূরে।
ঝুপঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে আসছে চারদিকে। সন্ধ্যেরএই সময়টাতে কোন কারণ ছাড়াই মৃদুলার মনটা খারাপ থাকে। কোথাও কোন কিছু ফেলে আসার মতো একটা চাপা কষ্ট ওকে ভোগায়। ভেবে দেখেছে ওর কোন কষ্টই নেই যা ওকে আক্রান্ত করতে পারে- তবু বিষন্ন লাগে। ও এই কষ্টটার নাম দিয়েছে সন্ধ্যা রোগ। এ সময়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মন বিবাগী হয়। মৃদুলা কথা না বলে গাড়ী থেকে নেমে এলো। এলোমেলো পায়ে এগিয়ে গেল সমুদ্রের দিকে। না কোথাও ওদের তিনজনকে দেখা যাচ্ছে না। গাড়ীর থেকে নামার সময়ে মৃদুলা দেখেছে লতার মা আবার ঘুমোচ্ছেন। সমুদ্র পাড়ের নোনা হাওয়ায় মাদকতা আছে, নেশায় মাতা মদির হাওয়া। মৃদুলা ভাবলো তিনি না মাত্র একটা ঘুম দিয়ে এসেছেন? হঠাৎ করে এই মাতৃসুলভ মহিলাকে খুব আপন মনে হচ্ছে ওর। আজকে তিনিই ওর সাথে কথা বলেছেন, খেয়েছে কিনা জানতে চেয়েছেন, রান্না ভাল হয়েছে বলেছেন। বলেছেন পরনের শাড়ীটা সুন্দর। দীর্ঘশ্বাস চেপে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিনি মৃদুলার সংসার দেখেছেন। ভেবেছেন এমন একটা সংসার তার মেয়ের হতে পারতো। মৃদুলা ভাবছে লতার অনুপস্থিতি অথবা দুজন যুবকের সঙ্গে সময় কাটানো এনাকে উৎকণ্ঠিত করছে না কেন? ভাবলো সব এড়াতে চাইছেন বুঝি তিনি। জ পলায়তি স্ব জিবুতি- যে পালায় সে বাঁচে। কজন পারে পালাতে?
বেশ খানিক ক্ষণ পর মরা ছায়ায় পাশাপাশি হেটে ওরা তিন জন গাড়ীর কাছে ফিরে এসেছে, ওদের শরীরের ছায়া ওদের দীর্ঘশ্বাসের চেয়েও দীর্ঘ মনে হয়। চোখে কাতরতা।
রনো গাড়ীর দরজা খুলেই ড্রাইভিং সীটে বসতে বসতে বলল “আসি।” ততক্ষণে লতার মা চলে এসে বসেছেন মেয়ের গাড়ীতে। লতা ঝুঁকে পরে গলা নামিয়ে কিছু বলতেই রনো হাসতে হাসতে গাড়ীতে স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।
উজ্জ্বল আবার পথ দেখাতে লতার পাশে এসে বসলো। পথে পাথর জমা স্তব্ধতাকে সাথী করে লতার গাড়ী উজ্জ্বলের বাসার সামনে এসে দাড়ালো। লতা সরাসরি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে শুধু বা দিকে মাথাটা হেলালো। যার অর্থ অনেক কিছুই হতে পারে- হতে পারে যাই? শেষ? আবার দেখা হবে তো? অন্ধকারেও ওর চোখ জ্বলজ্বল করছে। ওর চোখে জল নয় তো?
উজ্জ্বল আর দাড়ালো না। দরজা খুলে ঘরে ঢুকেই সরাসরি বাথরুমে চলে গেল।
রাস্তার আলোগুলো খুব মরা লাগছে আজ। রনোর খুব বড় জ্বর থেকে উঠলে যেমন অবসাদ লাগে তেমন লাগছে। ঘরে এসেই ঠান্ডা জলে স্নান করল ও। দেশে এখন কটা বাজে? ওর স্ত্রী দেশে এখন কি করছে? কাঁপা কাঁপা হাতে টেলিফোনটা কাছে টেনে নিল। বড্ড প্রয়জন ওর এখন লতাকে ভোলা, বড্ড প্রয়োজন ওর এখন দেশে কথা বলা।
হাতে মুখে জলের ঝাঁপটা দিয়ে উজ্জ্বল বেরিয়ে এসেছে বাথরুম থেকে। এসে দেখল সদর দরজাটা হা করে খোলা। এক রাশ বিরক্তি দলা পাকিয়ে উঠলো। মৃদুলা আটকাতে ভুলে গেছে। চার দিকে চেয়ে দেখল কোথাও দেখা যাচ্ছে না মৃদুলাকে। না শোবার ঘরে, না রান্না ঘর, না বসবার ঘরে।
গেল কোথায় মেয়েটা? এমনি ঘোরের মধ্যে ছিল যে স্মৃতির পথে পেছনে হেটে গিয়ে কিছুতেই মনে করতে পারছে না উজ্জ্বল যে মৃদুলা গাড়ীতে ছিল কি না। ওতো পেছনের সীটে তাকায়নি। আচ্ছা মৃদুলা কি তার সাথে গাড়ী থেকে নেমেছিল? পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকেছিল? নাকি লতার গাড়ীতেই ওঠে নি? এমন তো হবার কথা নয়, বিনা বাক্যে সে সবইতো করতে থাকে। নাকি ও রনোর গাড়ীতেই রয়ে গেছে? পেছনের সীটে ঘুমিয়ে পড়েছিল? এখন চায়ের পেয়ালা হাতে রনোর সামনে বসে আছে? রনোকে কল করতে গিয়ে ভাবলো – কি ভাববে রনো ? দায়িত্বহীন? লতা কেন খেয়াল করল না। ও বেচারী নিজেইতো ঘোরে ছিল। কি করবে উজ্জ্বল এখন? লতাকে কল করলে লতা ভাববে অমনযোগী স্বামী, নাকি হিংসেয় জ্বলবে যে, ভুলো মন স্বামী বউকে মরিয়া হয়ে খুঁজছে?
হঠাৎ সজোরে একটা ধাক্কা মেরে কথাটা মনে হল উজ্জলের – ওদের অনুপস্থিতে মৃদুলা নেমে পড়েছিল রনোর গাড়ী থেকে। ওদের অবজ্ঞার কারণে লতার গাড়ীতে উঠেছে কি না সেটা ওরা তিনজন কেউই খেয়াল করেনি, কিন্তু লতার মাতো দেখেছেন মৃদুলা পাশে নেই, না এ গাড়ীতে, না ও গাড়ীতে। কোন প্রশ্ন করেনি কেন? কিছুই মিলছে না। ওরা পাঁচজন সুজন ছিল সন্ধ্যায়, যদিও প্রত্যেকে প্রত্যেককে হিংসের চোখে দেখেছে, কিন্তু এতটা কি সম্ভব?
অবসাদ উজ্জ্বলের সারা মন ছেয়ে দিয়েছে। এত কিছুর পরও উজ্জ্বলের মন কোথায় যেন হারাচ্ছে। মনে হচ্ছে লতা বসে আছে ওর পাশে গাড়ীতে। লতার চুল উড়ে এসেছে উজ্জ্বলের চোখে মুখে ঠুকরে খাচ্ছে। লতার ভুরু আর ঠোটের কোনা বিভিন্ন ভঙ্গিতে স্মৃতি রচনা করেই চলেছে। আচ্ছা লতা কি শীঘ্রি বিয়ে করবে? কাকে করবে? অজানা এই মানুষটাকে ভীষণ হিংসে হচ্ছে উজ্জ্বলের।
@নিবেদিতা,
গল্পের মজাটা কিন্তু ওখানেই। ধরুন আজ মৃদুলা যদি সত্যি সত্যি সমুদ্র পাড় থেকে ঘরে না ফিরে রণোর সামনে চায়ের পেয়ালা হাতে বসে থাকে তাহলে মৃদুলাই কিন্তু রনো আর ওর স্ত্রীর জীবনে আরেকজন লতাই হবে।
গল্পটা শুরু করেছিলাম তিনজনের বলে কারণ উজ্জ্বলরা তো ওর কপটতা লুকোয় না, উজ্জ্বলভাবেই তা প্রকাশিত। রনোরা রণ যুদ্ধের কৌশল খোঁজে, লতারা আকশি যেন বেয়ে উপরে উঠে আর মৃদুলারা মৃদুভাবেই চিহ্ন রেখে যায়।
তাই চারজনের গল্প নয় এটা কখনোই। সম্পর্কগুলো আপাত কাছের কিচন্তু হিংসের বীজ বোনা এক একজনের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে। যেমন মায়ের ভূমিকাও পলায়নবৃত্তিক।
@গীতা দাস,
আমি কিন্তু চাইলেই মৃদুলাকে ঘরে এনে রেল লাইনের ইস্পাত কঠিন, শীতল সমান্তরাল দুটো পাতের মত এক বিছানায় অন্য ভূবনের বাসিন্দা হয়ে উজ্জ্বলের পাশে শুইয়ে রাখতে পারতাম। ইচ্ছে করেই হয়তো মৃদুলাকে হারিয়ে যেতে দিয়েছি উত্তরণের ইঙ্গিত করে। ডঃ ইরতিশাদের মত আশা করে যে এই উত্তরণ ম্রিদুলাকে পাতার দিকে টানতে পারবে। আসলে কোন বৃত্ত ভাঙতে যাওয়ার প্রথম ধাপ কিন্তু নির্মোহ হওয়া, বিচ্ছিন্ন হতে না পারলে দূর থেকে নিজের অবস্থানকে দেখা যায় না, বৃত্ত ভাঙ্গার স্পৃহাও জাগে না।
আগন্তুকের কথার খেই ধরে বলি – আসলেই হয়তো বৃত্তবদ্ধ মানুষ কেউ কেউ সামাজিক ইঙ্গিতে অনেক ইচ্ছেরই প্রকাশ ঘটায় না, চক্রের ব্যতয় ঘটায় না। কেউ হয়তো এটাকে স্বধীনতা না ভেবে স্বেচ্ছাচারীতা ভাবে, কেউ এই বৃত্তের বা সংযমের তোয়াক্কা করে না। তাই উজ্জ্বল উজ্জ্বলই থাকে, রনো রনোই থাকে আর মৃদুলা লতা হয়ে উঠতে পারলেও তা হয় না।
@ কেশব অধিকারী
কেশব অধিকারির সঙ্গে সহমত , সাথে ধন্যবাদ জানাছছি এই অপরিপক্ক লেখাটা খুটিয়ে পরেছেন বলে। আমি কোন সিধানতে আসতে চাইনি, গল্পে বলি নি কোনটা ঠিক কোনটা নয়, শুধু চেয়েছিলাম কিছু বোধের অবতাড়না করতে, হিংসের কথা বলেছি, দমিয়ে রাখার কথা বলেছি, বলেছি স্বার্থপরতার কথা, বলেছি নির্বোধের মত মেনে নেবার কথা। আমি চেয়েছিলাম এটাকে কেন্দ্র করে একটা আলচোনা শুরু হোক।অনেকেই ভাবছেন এটা ব্যাক্তিগত কোন ঘটনা, ভালো লাগছে একটা গল্প কে কেন্দ্র করে কতধরনের মতামত ঊঠে আসছে তা দেখতে। কতো চমৎকার সোসাল মটিভেশনাল কথা আলোচনায় আসছে।
লেখাটা ছাপানোর জন্যে, পড়ার জন্যে, মন্তব্য করার জন্যে আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
ক্যাথেরীনা রোজারিও কেয়া
আমি একটু ভিন্ন দৃষ্টিদিয়ে বিষয়টাকে দেখতে চাই। প্রথমেই বলে নেয়া ভালো যে আদীম সমাজের যেমন আমরা আর এখন বাসিন্দা নই, ঠিক তেমনি আধুনীক যুগে এসে অতীতের মূল্যবোধকে আঁকরে ধরে তাকে দুধ-কলায় প্রতিপালিতের দ্বারা সামাজিক বিবর্তনীয় অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা কি সমীচিন? তাহলে একটু খোলসা করা যাক। প্রাক যুগে প্রাচীন সমাজে নারীর উপরে পুরুষের ভোগের অধিকার ছিলো। সমর্থ পুরুষ-ই এই অধিকার একচেটিয়া ভাবে পেয়েএসেছে গোষ্ঠীর মধ্যে কিংবা বাইরে তার ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতাপের ওপরে ভিত্তিকরে। হালে সমাজ দর্শন, ধর্ম, ইত্যাদি মূল্যবোধের বিকাশে (?) বিবাহ নামের এক ধরনের কদাকার আইনের বিধিবিধান সমাজের উপরে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। সমাজের বিত্তশালীদের জন্যে, সমাজের সমাজপতিদের জন্যে কিংবা অসম্ভব ক্ষমতাধরদের জন্যে এই বিধিবিধানের কানাকড়ি মূল্যনেই! আদিতেও ছিলোনা এখনো নেই। ঐ যে একটু আগে বললাম, “সমাজ দর্শন, ধর্ম, ইত্যাদি মূল্যবোধের বিকাশ” বললাম বটে, কিন্তু এর নিগূড়ার্থে তাৎপর্যগত ব্যবধান আছে। খেয়াল করে দেখুন, ক্ষমতাবান পুরুষেরা কিন্তু এই সব সামাজিক ধ্যান-ধারনায় নারীকে পণ্যের চেয়ে বেশী কিছু গন্য করেনি। একটি ব্যাপার এর মধ্যে দিয়ে হয়েছে এই যে, এক ক্ষমতাবান পুরুষের অধিকৃত নারী অপর ক্ষমতাবানের দ্বারা সহসা ছিনতাইএর মাত্রা রোহিত করা হয়েছে। অথবা ঘুড়িয়ে বললে বলা যায়, পুরুষ এমন এক ব্যবস্থায় গিয়েছে যে, তার অধিকৃত নারী যেনো সহসা অপর পুরুষের দ্বারা আকৃষ্ট হলেও বেড়িয়ে যেতে না পারে খাঁচা থেকে। বিয়েটা হলো শেকল নারীর জন্যে। আর বউ হলো শেকল পড়া ছল! আধুনীক নারী,. পুরুষ প্রবর্তিত এই ব্যবস্থা অত্যন্ত সাবলীল ভাবে এবং বিনা প্রতিবাদে গ্রহন করে নিয়েছে যথা সম্ভব শ্রদ্ধায়! আর তাই আজকের উপরোক্ত গল্পের অবতরণা! নইলে,
এমনটি হবে কেনো? উজ্জ্বল বিয়ে করে সংসার করছে, লতা সেটি জানে। উজ্জ্বলের সাথে লতার অতীত যাই হোক না কেনো, লতা উজ্জ্বলকে ফোন করে এভাবে বেড়াতে আসতে পারেনা। কারন-
. হয় লতা উজ্জ্বলের সংসারে আগুন জ্বালতে চেয়েছে (এটি তার হতাশা থেকে উদ্গত হতে পারে)।
. নাহয়, লতা উজ্জ্বলকে বিগত দিন গুলোতে ব্যবহার করে এসেছে, এবং এখনো পুরোনো সখ্যতার জের ধরে বেড়াতে আসতে চাইছে, পূর্বাপর বিবেচনা না করেই।
. লতার ঝলমল উছ্ছ্বলতায় বোকা উজ্জ্বল অতীতে মজেছিলো এবং এখনো অর্থহীন আশা! যদি একটু ছুঁয়ে দেখতে পারে! অর্থাৎ উজ্জ্বল এখানে লতার কাছে সমর্থ পুরুষ নয়! লতা হয়তো যোগ্যতমের সন্ধানে রয়েছে এখনো! লতার কাছে এখানে রনো এবং উজ্জ্বলে তেমন কোন প্রভেদ নেই! সম্ভবতঃ লতা যুগের যোগ্যতম নারী! এদিকে মৃদুলা, উজ্জ্বল এবং রনো যুগের আপেক্ষাকৃত যথাক্রমে অযোগ্য নারী ও পুরুষ!
দেখুন মৃদুলা কতোটা নিজেকে পরাজিত করেছে পুরুষতান্ত্রিকতার কাছে,
যেনো অফিসের বড়ো বসের কাছে তথ্য জানতে চাইছে, কর্তব্য ঠিক কচরতে হবে তো! আর উজ্জ্বল, এক অথর্ব পুরুষ ততোধিক অযোগ্য এক নারীর সামনে করছে বীরত্বের আস্ফালন!
অথবা,
অথবা,
এটি কি যোগ্যতমের অধিষ্ঠান নয়? এখানে লতাই শ্রেষ্ঠ! কারন যোগ্যেরা উঠে আসবেই আর অযোগ্যেরা বিলীন হবে এই ভাবে নিরবে নিভৃতে!
দেখুন ভোগ বিলাসী পুরুষের টনটনে লড়াই বোধ! নারীর মন-দেহের উপরে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই! দেশ, সম্প্রদায়, মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার, আদর্শ, দর্শন কিংবা সংস্কৃতির জন্যে লড়াই নয়!
এখানে “হয়তো” কথাটি যোগ করে লেখিকা সংশয় বাড়িয়েছেন। যদি লেখিকার সংশয় ঠিক হয় তবে লতাকেও
আর যথাযথ যোগ্যতার মানদন্ডে রাখা যাবে না! কারন তাহলে তার কুটীল মনোবৃত্তিই প্রস্ফুটিত হবে! তবে যেহেতু এটি সংশয়াচ্ছন্ন তাই আপাততঃ লতা মুক্ত।
পুরো গল্পে যে অসমতা, যা দিয়ে একটা ক্লাইমেক্স সৃষ্টি করা হয়েছে তাকে তো ব্যলেন্স করতে হবে! তো সেই পাল্লার যে স্ট্যান্ড, যে কিনা অসমতাকে ফুটিয়ে তুলবে আবার পাল্লাকে দোলাবেও। সেই কাজটি করেছেন লতার মা!
তাই পাঠক লেখিকার অনবদ্য দোলায় আয়েশে দোদুল্যমান! বলুনতো গল্পের কে নায়ক কে নায়িকা? আমার মনে হচ্ছে লেখিকা তু লে ধরেছেন এযুগের অসীম সাহসী এক নায়িকা প্রধান গল্প নারীর নির্বুদ্ধিতা আর পুরুষের পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে একরাশ এবং অনিঃশেষ ঘৃনা ছড়িয়ে। দেখুন মৃদুলার ভাবনা…..
এই বাঁচা পালিয়ে বাঁচা নয়, সংগ্রাম করে নিজেকে নিজেকে যোগ্যতম বলে অধিষ্ঠিত করা! তা যদি না হতো তাহলে তো লতা তার মায়ের মতো করেই ভাবতে পারতো, ডুবে যেতে পারতো অন্ধকারের অতলে হতাশায়!
এই তাকানোর অনেক অর্থ মনে হয়নি আমার কাছে, মনে হয়েছে এক নির্বোধের প্রতি করুণার দৃষ্টি! আর চোখের জল! সন্দেহ আছে লেখিকার। তবে আমার নেই, ও হলো বিজয়ের আনন্দাশ্রু!
আর শেষের ৪টি প্যরায় দেখুন পুরুষ কিকরে দাসী করে রেখেছে নারীকে! আর পুরুষের চৈতন্যের উদয় কি কোন কালে হবে?
তাই নারীকেই বদলাতে হবে। ওসব ছাই পাশ সামাজিকতার, আবহমান কালের অমানবিক প্রথা, বিশ্বাস, নির্ভরতার জায়গায় সংগ্রাম কে জায়গা করে নিতে হবে নারীকে। পুরুষকেও যোগ দিতে হবে সেই সংগ্রামে নারীর পাশেই। মানবিক মূল্যবোধ আর যুক্তিনির্ভর পশুত্ত্ব অর্থাৎ লজিক্যাল আ্যনিমেলিজমই মনে হয় আমাদের আরাধ্য হওয়া উচিৎ। আ্যনিমেলিজম এখানে ইচ্ছে করেই বলা, জানিনা সঠিক হলো কিনা। আমার বক্তব্যের অর্থের সঠিক প্রকাশের নিমিত্তে।
গল্প কবিতা পড়া হয়না একদম। নিরামিষ ধরনের হয়ে যাচ্ছি (আগেও যে খুব একটা পদের কিছু ছিলাম তা নয় অবশ্য)। গল্পটা পড়লাম। তবে বুঝলাম কিনা বলা মুশকিল। আসলে নিজেকে কিছু বোঝাতে চাইলাম কিনা তাও একটা বড় প্রশ্ন।
কেয়া শুরুই করেছেন একটা ভুল লাইন দিয়ে –
না গল্পটা তিনজনের নয়। চারজনের (লতার মাকে ধরলে পাঁচ)। লিস্ট থেকে বাদ পড়েছে মৃদুলা। এবং প্রথমেই। কাজেই মৃদুলার প্রতি স্বামীর অমনোযোগ এবং অবহেলাকে খুব একটা দোষ দেয়া যায় না – সয়ং গল্পকারই নিজের সৃষ্ট চরিত্রের উপস্থিতি ভুলে গেছে, কি আর করি! অবশ্য এটা লেখকের একটা চালাকিও হতে পারে। পাঠকদের ধাঁধায় ফেলে পরীক্ষা – দেখি কেউ ধরতে পারে কিনা। সেটা যদি উদ্দেশ্য হয় – তবে আমি সসম্মানে পাশ!
তবে গল্পটা ভাল। ছোটগল্প ঠিক এমনই হওয়া উচিৎ বোধ হয়। রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্পের একটা সংজ্ঞা দিয়েছিলেন না – শেষ হইয়াও হইলো না শেষ – সেরকম!
সামাজিক সম্পর্কের জটিলতার অস্তিত্ব অস্বীকার না করেও একটা কথা বলি – আমার ইদানিং মানসিক প্যানপ্যানানি মার্কা গল্প কবিতা অসহ্য লাগে। আরে ব্যাটা একসাথে থাকতে ইচ্ছা না হলে এত জোর করে মৃদুলা চপলা সুজলা শ্যামলা সেজে থাকার দরকারটা কি? এখনকার দুনিয়ায় অপশনের কোন অভাব নাই। থাকলে ঠিক মত থাক, নাইলে ভেগে যা বাপু। এমন তো না যে স্বামীর দয়ায় চলতে হয় – লেখা পড়া শেখা আধুনিক মেয়ে সব মেনে নিয়ে কেন শুধু প্যান প্যান করবে? থেকে থেকে মশার মত পাখা ঝাপ্টিয়ে প্যানপ্যান করে নিজেও অশান্তিতে থাকবি, আমাদের অশান্তি দিবি – অযথা।
@অভিজিৎদা,
“থাকলে ঠিক মত থাক, নাইলে ভেগে যা বাপু।”
ঠিক মত থাকাটা কি উভয়পক্ষের জন্য প্রযোজ্য নয়?
ব্যপারটা এখনো এমন যে নারীরা ‘থাকে’ আর পুরুষরা ‘রাখে’ !
ঠিকই বলেছেন,অযথা অশান্তি কেন,অত জোরের কি আছে,তারচে’ যার যার রাস্তা মাপা ভাল। 🙂
@নিবেদিতা,
হ্যা, উভয় পক্ষের জন্যই। সম্পর্কে থাকলে আসলে ঠিকমত থাকা উচিৎ – এটা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। তারপরেও যে জটিলতা আসে না তা নয়। এই জটিলতার বিশ্লেষণই তো ভাল গল্পকারের কাজ। সেই কাজটিই করেছেন কেয়া।
কেয়ার গল্পটা আবারো পড়লাম। কাল তারাহুড়ো করে মন্তব্য করার জন্য খারাপই লাগছে। বেশি চাঁছা ছোলা হয়ে গেছে আমার মন্তব্যটা (আগেই স্বীকার করেছি ভাল সাহিত্য বোঝার মত ধী-শক্তি বোধ হয় আমার নেই – ইদানিং আরো নিরামিষ হয়ে গেছি, কাজেই আমার মন্তব্যকে এত গুরুত্ব দিয়ে নেয়ার দরকার নেই 🙂 )। আসলে এটা যে কেয়ার প্রথম গল্প – মনেই ছিলো না আমার। আর তাছাড়া –
মৃদুলা ডালের বাটিতে চামচ দিয়ে নেড়ে দিল, নীচ থেকে ঘন ডালটা উঠে এলো, যেমন করে উজ্জ্বলের থিতিয়ে যাওয়া স্মৃতি উঠে আসছে ধীরে ধীরে।’ – এধরণের অসাধারণ উপমা যে গল্পে আছে – সে গল্প যে কোন মূল্যে ভাল হতে বাধ্য। এ ধরণের উপমা আমি খুব কম গল্পেই পেয়েছি। কেয়াকে ধন্যবাদ – আবারো।
@অভিজিৎদা,
খারাপ লাগার কিছু নেই।আপনি তো গল্পটার মান নিয়ে কিছু বলেননি।গল্পের পটভূমিতে মৃদুলা সত্যিই মৃদুলা।কাজেই তার মধ্যে নারীর যে অসহায়ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়,সেই সনাতনী ব্যাপারটা পুরোপুরিই ছিল।সমকালীন পাশ্চাত্যের প্রেক্ষাপটে ব্যাপারটা আসলেও প্যানপ্যানানী।তবে লেখক বোধহয় পাশ্চাত্যের পটভূমিতে এখনো সনাতনী মনোভাবের বাঙালি মেয়েদের দুর্দশার ছবি আঁকতে চেয়েছেন।মৃদুলার একটি অতীত প্রেম থাকলে পরিস্থিতিটা আরো ঘোরালো হত এবং তখন গল্পটা হয়তো অন্যদিকে মোড় নিত।
@নিবেদিতা,
আরেকটা ব্যাপার –
না আমার জন্য অন্ততঃ তা নয়। দুইজনেই ‘থাকে’। রাখা রাখির কোন ব্যাপার নেই। সে জন্যই তো বলেছি – থাকলে ভাল করে থাক না বাপু। এই কথাটা নারী-পুরুষ – সবার জন্যই।
@অভিজিৎদা,
হ্যা,রাখারাখির কোনো ব্যাপার নেই,থাকা উচিৎ না,আমার জন্যও তাই।
(মানে তাই ভেবে রেখেছি আর কি! 🙂 )
“এই কথাটা নারী-পুরুষ – সবার জন্যই। ”
কিন্তু সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে এখনো তো সেরকম পরিস্থিতি তৈরী হয়নি।
লেখাটি পড়তে গিয়ে অগোচরেই কখনো লতা আবার কখনো মৃদুলার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়েছি!অদ্ভুত বিষন্নতায় মন ভরে গেল…
@নিবেদিতা,
কেন? লতা আর মৃদুলাদের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে লাভটা কি হলো? বিষন্নতায় মন ভরলো, তারপর? তারপর বাংলা সিনেমার গল্পের বইয়ের নায়িকার মতো নাকের জলে চোখের জলে হাত-মুখ ভিজিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দেখানো হবে নারী কতো অসহায়, আর দর্শক পাঠকেরা বলবে- আহা, বেচারী নারী। ব্যস, এতেই নারী বেজায় খুশী, এখানে নারীর নারীত্ব, নারীর স্বার্থকতা কোথায়? প্রেমপত্রে নারী আর কতোদিন লিখবে- ইতি ‘তোমার চরণ দাসী’?
সেচ্ছা দাসী?
অসুবিধা কি? তা তো আগেই জানতে, তুমি নম্রতা দিয়ে প্রমান করেছ, ওর কাজে তোমার সম্মতি আছে।
এমন নারী যেন পৃথিবীতে আর একটাও না জন্মায়। অশ্রু দিয়ে লেখা গান শুনতে আর ভাল লাগেনা। ঘর থেকে, সংসার থেকে, জীবন থেকে পালিয়ে শতবার মরার চেয়ে বীরাঙ্গনার মতো একবার মরা শ্রেয়। চোখের জল দিয়ে অধিকার আদায় করা যায়না, একথা নারীকেই বুঝতে হবে। মৃদুলাদের স্পষ্ট ভাষায় বলতে হবে তাদের এই অবস্থার জন্যে কে দায়ী।
গল্পের শিরোনামে প্রধান নায়িকা মৃদুলার কেন ঠাঁই হলোনা, তাও এক বিস্ময় বটে।
@আকাশ মালিক,
“গল্পের শিরোনামে প্রধান নায়িকা মৃদুলার কেন ঠাঁই হলোনা, তাও এক বিস্ময় বটে।”
একমত ।
“ব্যস, এতেই নারী বেজায় খুশী, এখানে নারীর নারীত্ব, নারীর স্বার্থকতা কোথায়?”
কোনো স্বার্থকতা নেই।এমন নারীত্বে বিশ্বাসী নই।
বিষন্নতায় মন ভরে যায় কিন্তু তার পরের ধাপ আঁচলে চোখ মোছা নয়।
বদলে যাবে দৃশ্যপট,আমিই বদলে দিব,যেদিন আরো অনেক ‘আমি’ আমার সাথে যুক্ত হবে।অপেক্ষায় আছি।
‘মৃদুলা ডালের বাটিতে চামচ দিয়ে নেড়ে দিল, নীচ থেকে ঘন ডালটা উঠে এলো, যেমন করে উজ্জ্বলের থিতিয়ে যাওয়া স্মৃতি উঠে আসছে ধীরে ধীরে।’
চমৎকার উদাহরণ।
সুজন সন্ধ্যায় মৃদুলারা হারিয়ে যায় । রনো আর উজ্জ্বলরা ঘরে ফিরে । একজন বউএর মধ্যে নিজেকে প্রেমিকাকে খুঁজে ও অন্যজন প্রেমিকার মধ্যেই বুঁদ হয়ে থাকে। শুধুই মৃদুলারা নিঁখোজ হয়। অনেক মৃদুলারা ঘরেও নিঁখোজের মতো থাকে। এর সংখ্যা অগণিত।
ধন্যবাদ কেয়াকে চমৎকার ছোট গল্পটি উপহার দেয়ার জন্যে।
@গীতা দাস,
সবাই কিন্তু মৃদুলার মতো নিখোঁজ হয়ে থাকেন না, যেমন থাকেন নি আপনার ‘উজান বেয়ে ফেরা’র পাতা। তবে অনেকেই থাকেন। মৃদুলাদের সংখ্যাই হয়তো বেশি, দুঃখজনক হলেও। পাতাদের দল ভারী হোক, মুক্ত মানুষের সংখ্যা বাড়বে।
কেয়া, গল্পটা খুব ভালো লাগলো। আরো লিখুন।
গীতা, এই সুযোগে বলি, আপনার গল্পটাও খুব ভালো লেগেছে।
সুজন সন্ধ্যায় মৃদুলারা হারিয়ে যায় । রনো আর উজ্জ্বলরা ঘরে ফিরে । একজন বউএর মধ্যে নিজেকে প্রেমিকাকে খুঁজে ও অন্যজন প্রেমিকার মধ্যেই বুঁদ হয়ে থাকে। শুধুই মৃদুলারা নিঁখোজ হয়। অনেক মৃদুলারা ঘরেও নিঁখোজের মতো থাকে। এর সংখ্যা অগণিত।
ধন্যবাদ কেয়াকে চমৎকার ছোট গল্পটি উপহার দেয়ার জন্যে।
সুন্দর ছবি এঁকেছেন।কপট মানুষের বাস্তব ছবি।প্রায় প্রত্যেক পুরুষই স্ত্রীকে নিয়ে এমন কমপ্লেক্স এ ভোগে কিন্তু নিজের বেলায় সব সই।এ জঘন্য কপটতা অসহ্য কিন্তু বাস্তব।আসলে নারী-পুরুষ উভয়ই বহুচারী।সামাজিকতার বন্ধন তাদেরকে বাধ্য করে একচারী হতে।কিন্তু আদিম প্রবৃত্তি মজ্জায় মিশে আছে।তবে সামাজিকতার চাপে নারী যদি তার বহুগামী প্রবৃত্তিকে জয় করতে পারে তবে পুরুষ কেন পারবে না?কেন সে পারে না ক্ষমতার রক্তলোলুপ শ্ব-দন্ত ভেঙ্গে ফেলতে,রিরংসাকে জয় করতে।আর বহুগামিতাকে প্রশ্র্য দিতে হলে কেন এই সংসারের অভিনয়?অনেক দেশেই তো এখন যৌনাচার নিয়ে রাখ-ঢাক নেই।অবশ্য তার ভালো দিকই বেশি।রক্ষণশীলতা উজ্জ্বল বা রনোর মত ভণ্ডদের ভদ্র সাজার মুখোস দিয়ে দেয়।
আমাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিলেন।হয়তো যখন বয়েস হবে তখন অন্যরকম ভাবে ভাববো।আমি শুধু আমার তারুণ্যের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলাম। :-))