পাতার কাছে বতর্মানটাই গুরুত্বপূর্ণ। বতর্মান সময়টুকু — ক্ষণটুকু – ব্যক্তিটি, জায়গাটুকু,যা করছিল সেই কাজটা তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। তাই সে কারো সাথে কথা বলার সময় মুঠো ফোনে কোন ডাক আসলেও তা গ্রহণ করে না। কথোপকথন হয়তো তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তবু সে ইয়েস বা সবুজ বাটনে টিপ না দিয়ে কখনো লাল বাটনে টিপ দিয়ে লাইন কেটে দেয় কখনো বা বাজতে বাজতে মিস কল হয়ে থাকে। পরে নিজে পয়সা খরচ করে কথা বলে। এ নিয়ে স্বামীর অনুযোগের শেষ নেই। অনর্থক পয়সা খরচ। বন্ধু-বান্ধবরা বিরক্ত সময় মতো যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটে বলে — যোগাযোগ ব্যাহত হয় বলে। কিন্তু পাতা এ বিষয়ে অনড়। এ তার একান্তই নিজস্ব ব্যাপার।
তবে তার ছেলেমেয়ের মায়ের কোন বিষয়েই কোন অভিযোগ নেই। দু’জনেই এখন দেশের বাইরে। ছেলে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্পকালীন সময়ের জন্যে চাকরি নিয়ে গেছে। আর মেয়ে পড়ছে।

বর্তমানকে গুরুত্ব দেয়ার এ জীবন দর্শন শিখতে পাতার ছাব্বিশ বছর লেগেছে।
কোন মিটিং এ বসলে সবার আগে মুঠো ফোনটা নীরব রাখতে কখনোই ভুলে না। শুধু নীরব রাখা নয় — ব্যাগে ভরে রাখেন। সভা শেষে নাম্বার দেখে দেখে কল ব্যাক করেন। নিজে সভার দায়িত্বে থাকলে তা অন্যদেরও মনে করিয়ে দেয়। তবে ইদানিং কোন কোন সভায় বসে মুঠো ফোন নীরব রাখা অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবুও দুয়েক জনেরটা বিভিন্ন সুরে কেঁদে উঠে। চমৎকার চমৎকার বেজে উঠাটাই সভায় বাজলে মনে হয় কেঁদে উঠেছে। অনেকেই প্রিয় গানের সুরে ফোন বাজান। অন্য প্রান্ত থেকেও অনেকে বিভিন্ন গান শুনেন।

কিন্তু আজ নীরব রাখা ফোনটি ব্যাগ থেকে বার বার বের করে দেখছেন। পাতা কী কোন খবরের অপেক্ষায়! মাঝে একবার বাইরে গিয়ে কার সাথে যেন কথাও বলে আসলেন। তার চরিত্রের এ ব্যতিক্রমী আচরণ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও কেঊ কিছু বলছে না। সবচেয়ে চৌকশ হিসেবে অলিখিতভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কর্মী লোপা সভা শেষে তা জিজ্ঞেস করবে বলে ভাবছে। সভার শুরুতে নতুন কর্মীটির সাথে পরিচিত হতে গিয়ে পাতা বললেন —
নসনদি।
কোথায় বাড়ি বললেন?
এবার বোধ হলো। আঞ্চলিকতা এড়িয়ে বললেন – নরসিংদী।
ইদানিং তিনি এতো স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছেন কেন তা নিজেই বুঝতে পারছেন না।
নরসিংদীর মানুষ নিজের ঠিকানা বলতে গেলে নরসিংদী বলতে পারে না। বলে নসনদি। বিষয়টি পাতা জানেন বলেই সচেতনভাবে নিজের ঠিকানা বলেন। আজ ভুলটা হলো।
ভুল কী?
জনমানুষ তো নসনদিই বলে। তিনি কী জনমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন একজন হয়ে গেছেন! ইচ্ছে করেই কী তা হয়েছেন!

পরিচয় পবে নিজ জেলার নাম বলার রেওয়াজ। তা বলতে গিয়েই নসনদি বলা। অন্য সময় হলে রসিকতা করে কাটিয়ে দিতেন। এ ধরণের অসচেতনতাকে কাটাতে তিনি বরাবরই প্রত্তুপন্নমতি। কৌশল করে বলতেন – নরসিংদীর মানুষের মতোই বললাম।
কিন্তু আজ তা করলেন না। শুদ্ধ করে বললেন। একে কী শুদ্ধ করা বলে! ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না।

কয়দিন যাবৎ সব কিছুতেই অমনোযোগী, কোন প্রশ্নের উত্তরে তিনি অসংলগ্ন। কখনো কখনো অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারনা করছেন। অবশ্য অপ্রাসঙ্গিকতা অন্যের কাছে মনে হলেও পাতার কাছে তা প্রাসঙ্গিকই।

এমনিতেও পাতা একটু অন্য রকমই। যেমন সবাই সাধারণত আয়োজন থাকলে খাওয়ার শেষে মিষ্টি খায়। তা পায়েস বা রসগোল্লা যেটাই হোক। তিনি সব ভালো যার শেষ ভালো বা আগে তিতা পরে মিঠা ভালো কিংবা মিষ্টি খেলে ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যায় এ সবের যে কোন একটি তত্ত্বকেও গুরুত্ত্ব না দিয়ে খাবারের পরে মিষ্টি খান না। হয় খাবারের বেশ আগেই মিষ্টি খেয়ে নেন নিজের বাসায়। অথবা খাবারের অনেক পরে খান। নিমন্ত্রণে গেলে ফিন্নি জাতীয় কিছু খেয়ে পাতে রাখা একটু ঝাল খেয়ে জিহ্বাটাকে ঝালিয়ে নেন। মিষ্টি দিয়ে শেষ করেন না। কখনো তা করলে অস্বস্থি হয়। মানুষের সাথে সম্পর্কও তো মিষ্টিভাবে চলে না। মিষ্টিভাবে কী শেষও হয় ! হয় না। যেমন তার স্বামীর সাথে হয়নি। তবে কেউ মরে গেলে ভাব দেখানো হয় যে কত না ভালো সম্পর্ক ছিল।

স্বামীর সাথেও সম্পর্কটা মিষ্টিভাবে শেষ করতে পারল না। সারা বছর সম্পর্কটা মিষ্টি রাখার ভাণ করে গেছেন। শেষ পযন্ত পারেনি। ইচ্ছে করেই সম্পর্কটা আর টানেননি। টানলে মিথ্যাটাই প্রতিষ্ঠা হতো। এ মিথ্যা দিয়ে সামাজিক রীতিকে টিকিয়ে রাখা উচিত নয়। এ ঔচিত্যবোধ নিয়ে যে পাতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!
স্বামীটি নিজের আরাম আয়েস ছাড়া আর কিছু বুঝে না।

গত ছাব্বিশ বছরের জমা করা ক্ষোভের প্রতিবাদ ও গত পাঁচ মাসের ভাবনার ফসল আজকের সিদ্ধান্ত। ‘জীবনানন্দকে দু’দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’। কিন্তু পাতাকে কে দেবে শান্তি? নারীর জন্যে কেউ লিখেনি যদিও নারীকে নিয়ে প্রচুর এবং প্রচুর লেখালেখি হয়। স্বস্থি পাবে কোথায়! ‘কোথায় গেলে পাব তারে বল কোন ঠিকানায়?’ নারীর শান্তি খোঁজার স্থান, সময় ও ব্যক্তি মনোনয়নেও অনেক দিক বিবেচনা করতে হয়। কে করে? শুধু নারী নিজে নয়— চারপাশের সবাই।

ছেলেমেয়ে ফোনে জানিয়েছে যে পাতার সিদ্ধান্তে তারা বিব্রত ও দুঃখিত, তবে লজ্জিত নয়। আজন্ম বাবার আচার-আচরণের শিকার তো তারাও কম হয়নি। শুধু শুধু মায়ের উপর দোষ চাপিয়ে দেয় কেমন করে। তাই হয়তো লজ্জিত নয়। হলেও কিছু করার ছিল না।

জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন ছিল। পাতার কোন বন বৃক্ষ বা বন দেবতা নেই, নেই সেই কবে ভার্জিনিয়া উলফ এর বলে যাওয়া নিজস্ব একটি ঘর। রাতে পড়তে পড়তে ঘুমানোর অভ্যেসটা বিয়ের পর বাধ্য হয়ে ছাড়তে হয়েছিল। এখন আর পারছে না। বই চোখের সামনে না ধরলে ঘুমই আসে না। আর বাতি জ্বললেই স্বামীটির মেজাজ তিরিক্ষী হয়ে উঠে। অথচ স্বামীটির ঘুম না আসলে বসার ঘরে জোরে টেলিভিশন ছাড়ে। অথবা অধিক রাত পযন্ত রেডিও টু ডে বা রেডিও ফূর্তি শুনে। সে ফূর্তিতে পাতার ঘুমের ব্যাঘাত হল কী না সেটি বলেও বিবেচনায় আনানো যায় না।

পাতা নিজের একখানা ঘর করেছে। একান্তই নিজস্ব। সেখানে ছেলে ছাড়া আর কোন পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই। পুরুষের পা পরলেই তা অপবিত্র হয়ে যাবে।

তেপ্পান্ন বছর বয়সী পাতাকে নিজস্ব ঘর খুঁজতে হল। একদম আলাদা একটা বাসা। নিজস্ব একটি ঘর। এক হাজার স্কয়ার ফিটের ডাইনিং টেবিলের জন্যে খোলা জায়গাসহ দুটো কক্ষ। একট বারান্দাও আছে। কাপড় শুকানো ছাড়াও বিকেলে বসে চা খাওয়ার জন্যে চমৎকার হবে। বার বার স্বামী ফোন করছে তার এ সিদ্ধান্ত বদলাতে। তেমন কোন ঝগড়া নয়। মনোমালিন্য নয়। খিটিমিটি করা ছাড়া কখনো পাতার গায়ে হাত তুলেনি তার স্বামী। তা ছাড়া স্বামীটি ঘর ছাড়ার মতো কোন ব্যবহার করেছে বলে তো মনেই করতে পারছে না।

আর ছাব্বিশ বছরে পাতার কাছে ঘরে না থাকার মতো ব্যবহারের তালিকা বড় বেশি দীর্ঘ।

প্রতিদিনের মতো গত রাতেও টেবিলে খাবার দিয়েছে। খাবারের পর থালা বাটি চামচ সিঙ্কে নিয়ে রেখেছে। শীলাকে খেয়ে নিতে বলেছে। শীলা খাওয়ার শেষে বাসন-কোষন ধুতে ধুতে অন্যদিনের মতো অবশিষ্ট খাবার পাতাই কোনটা ছোট ছোট বাটিতে কোনটা বা বক্সে ভরে ফ্রিজে ঢুকিয়েছে। পরদিন সকালে রুটির সাথে সবজি রান্নার কথাও বলেছে।
সব শেষ করে নিজের কাপড়-চোপড় বড় সুটকেসে ভরেছে। আসলে ভাঁজ করে নয়। আলমারী থেকে নিয়ে শুধু পুরেছে। স্বামী বসার ঘরে ক্রিকেট খেলা দেখায় ব্যস্ত বলে খেয়াল করেনি।

আগেই চালের পঞ্চাশ কেজির প্লাস্টিকের বস্তা ধুয়া ছিল। ঐটায় আপাতত রান্না করার মতো ডেকচি কড়াই, বাটি ঢুকাতে গিয়ে একটা ষ্টিলের বাটি মেঝেতে পরে শব্দ হওয়াতে স্বামী বিরক্ত প্রকাশ করে বলল — আস্তে, কীসের এত শব্দ। রবি শাস্রীর কমেন্টসটা বুঝতে পারলাম না। আরেকটা শব্দও যেন না হয়।

পাতা উত্তর দেয়নি। কিন্তু আবারও আরেকটা চামচ পরে গেলে স্বামী উঠে আসে। মারার ভঙ্গিতে কাছে আসলেও বরাবরের মতো আজকেও ডান হাতের আঙ্গুলগুলো কচলে মুখে শাসায় – হচ্ছেটা কী? কানে যায় না? বললাম যে আস্তে । আর এত রাতে এত গাট্রি বোঁচকা বাধা হচ্ছে কেন? এ বাসায় আর থাকার উপায় নেই।

পাতা কন্ঠে কোন রকম আবেগ না এনে বলল — তোমার ভালভাবে থাকার উপায় করে দিয়ে যাচ্ছি। কাল থেকে আমি আলাদা বাসায় থাকব।
স্বামী পাত্তা না দিয়ে বলল — সে তো কাল সকালে। এখন শান্তিতে খেলা দেখতে দাও।
পাতা যথারীতি গুছগাছ করে ঘুমুতে গেছে পরিচিত বিছানায়। তবে বেশ অপরিচিত লাগছে। স্বামীও মধ্যরাত পযন্ত খেলা দেখে এসে ঘুমিয়েছে। ইন্ডিয়া অষ্টেলিয়ার সাথে হেরে গেছে বলে মন খারাপ । শুতে এসে উচ্চবাচ্য করেনি।

পুরুষেরা পয়সা হলে বা অপ্রত্যাশিত উন্নতি করে ফেললে আর এক নারীতে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। অপ্রত্যাশিত বলতে যার যার পযায় থেকে। তবে পাতা তার স্বামীর অন্য কোন নারীতে আসক্তির কোন ইঙ্গিত কখনোই পায়নি। চাকরিতে আহামরি কোন উন্নতিও অবশ্য হয়নি। গতানুগতিকভাবে এগিয়ে গেছে।

আর মেয়েরা পেশায় নিজের উন্নতিতে ঘরেও দায়িত্বশীল হয়। পাতা যথেষ্ঠ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েই আসছিল। নিজের পরিশ্রমে বেসরকারী চাকরিতে উপরের দিকে উঠলেও সংসারের দায়িত্বে কখনো ঘাটতি রাখেনি। আত্মীয়-স্বজনরা ও তার দায়িত্বশীলতায় খুশি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। স্বামীর মতে পাতা শেষ রক্ষা করতে পারেনি। আর পাতা মনে করে শেষ রক্ষার দায় তার নয় এবং শেষ রক্ষার সংজ্ঞা নিয়েও স্বামীর সাথে পাতার দ্বিমত রয়েছে।

সকালে স্বামী ঘুমে থাকতেই পাতা বাসা ছেড়েছে। শীলা কান্নাকাটি করে পাতার সাথে চলে এসেছে। কাজ করলে পাতার বাসায় করবে। পাতার বদমেজাজী স্বামীর বাসায় নয়। পরে গিয়ে কাপড়-চোপড় আনবে। স্বামীর ঘুমের ব্যাঘাত করেনি। অন্যদিন অফিসে যাবার সময় দরজার তালা যেমন ভেতর দিকে চাপ দিয়ে লাগিয়ে দিয়ে যায় আজও তাই করল।
এখন বাসার ঠিকানা ছেলেমেয়েকে দেয়া আছে। যখন খুশি আসবে। তবে স্বামীটিকে দেয়নি। তার এ বাসায় আসার অনুমতি নেই। স্বামীটি পাতাকে বার বার ফোন দিচ্ছে।

পাতার সিদ্ধান্ত তার এ বাসায় কোন পুরষ ঢুকা নিষেধ।
এইমাত্র ছেলের ফোনের উত্তর দিতে বাইরে গিয়েছিল। ছেলে বাবার হয়ে একবার বলল – আমি কী পুরুষ নই ? নাকি নিজের ছেলে বলে!

পাতার দৃঢ় উত্তর— তুই আমার ছেলে বলে না, সন্তান বলে আসবি। তোরা ভাইবোন আমার কাছে সমান। এছাড়া আর কোন পুরুষ নয়। অন্য পুরুষ তো দূরে থাক, তোর মামারা পযন্ত নয়।
কেন? মামারা আবার কী করল? তোমাকে তো মামারা সবাই ভালবাসে।

মামাদের জন্যেই তো আমরা—মায়েরা বাবার বাড়ির ঘর হারাই। দরজায় পার্পল রঙে লিখে রেখেছি —-

‘পুরুষের প্রবেশ নিষেধ’।