বোকার স্বর্গ

আকাশ মালিক

(পর্ব ৪)

ইসলাম ধর্মের সব থেকে সম্মানিত পবিত্র কেতাব কোরান শরিফ। ইসলামিক থিওলজি মতে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে নবী মুহাম্মদের কাছে নাজিল হওয়া কেতাব সম্পর্কে মুসলমানদের ‘সম্মান ও পবিত্রতার’ ধারণাকে প্রাচ্য গবেষক আলফ্রেড গিয়োম অল্প কথায় বর্ণনা করেছেন এভাবে :

It is the holy of holies. It must never rest beneath other books, but always on top,
one must never drink or smoke when it is being read aloud, and it must be
listened to in silence. It is a talisman against disease and disaster.

আসুন সেই গ্রন্থখানি নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। “নিশ্চয়ই এ কোরান বিশ্বাসীদের জন্য একটি সঠিক নির্দেশনামা, আর যারা ভাল কাজ করে,তাদের জন্য ঘোষণা করে পরকালে মহাপুরস্কার।” (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ১০) এখানে ‘বিশ্বাস’ বলতে কী বুঝানো হয়েছে? অন্য ধর্মগ্রন্থানুসারীরা যারা ভাল কাজ করেন এবং বিশ্বাস করে্ন তাদের ধর্মগ্রন্থ সত্য, তাদের নবী সত্য,তারা কি এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত লোক? বিশ্বাসী কি তাদেরকেই বলা হয়েছে যারা মুহাম্মদের (দঃ) দলভুক্ত? মহাপুরস্কারের লোভ কি দেখানো হয়েছে, মানুষকে নিজ দলভুক্ত করে সঙ্গবদ্ধ করার লক্ষ্যে? সুরা বনি ইসরাইলের ১১নং আয়াতে বলা হয়েছে : “তাদের জন্য সতর্কবাণী যারা পরকালে বিশ্বাস করে না, আর তাদের জন্য তৈরি করে রেখেছি ভয়ঙ্কর শাস্তি।” ভয়ঙ্কর শাস্তির ভয় দেখানোর মানেটা কি? জগতের কিছু মানুষ পরকালে বিশ্বাস না করুক, মুহাম্মদ (দঃ) ও আল্লাহকে অমান্য করুক, সেটা তো আল্লাহরই কাম্য। মানুষ সৃষ্টির আগেই আল্লাহ নরক সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর নরক সৃষ্টির কারণই কি প্রমাণ করেনা যে, তিনি নিশ্চয়ই চান না, সকল মানুষ বেহেস্তি হউক? সুরা বাকারার ৯৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “আমি নিশ্চয়ই তোমার কাছে সুস্পষ্ট কোরানের আয়াতসমূহ পাঠিয়েছি (যাতে রয়েছে ইহুদি ও তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত বিবরণ) অবাধ্যরা ব্যতীত কেউ এগুলো অস্বীকার করে না”। কোরানের আয়তসমূহে যারা বিশ্বাস করে না তারাই অবাধ্য, দুর্বৃত্ত? বুঝা গেল—ভাল মানুষ হওয়ার শর্তই হলো কোরানে ঈমান আনতে হবে, মুহাম্মদের দলে আসতে হবে, অন্যথায় সকল সততা, সকল মহৎ কাজ, সবই ব্যর্থ। এই আয়াতের মাধ্যমে সমগ্র মানব জাতিকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে; যারা কোরানের আয়াতসমূহে বিশ্বাস করেন তারা মুহাম্মদের বেহেস্তি দল, আর যারা বিশ্বাস করে্ন না তারা অবাধ্য, দুর্বৃত্ত নরকে শাস্তি প্রাপ্যের দল। কোরান মানবতা শিক্ষা দেওয়ার, নাকি শত্রু চিহ্নিত করার বই? কোরানে যে সকল জাতি বা সম্প্রদায়ের কথা (ইহুদি ও খ্রিস্টান) বারবার বলা হয়েছে তারা তো নির্দিষ্ট একটি এলাকার মানুষ, এই বই সারা পৃথিবীর মানুষের জন্যে নির্দেশক হয় কী ভাবে? মানুষ জানবে কী ভাবে যে, কোরান নামের এক খানা বই আল্লাহ দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন যা জগতের সকল মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে মানতে হবে, না মানলে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে তারা নরকবাসী হবে? কোরান যখন লেখা হয় তখন আরব ছাড়া কি দুনিয়ায় আর কোন জাতি, ধর্ম বা সম্প্রদায় ছিলনা?

মদিনায় যাওয়ার পর মুহাম্মদ যখন দেখলেন কিছু লোককে কোনোভাবেই বিশ্বাস করানো সম্ভব হচ্ছে না যে, তিনি ‘নবী’ ও তাঁর ‘কোরান’ একখানি ধর্মগ্রন্থ, তিনি আল্লাহ’র নামে লেখালেন- “ইহুদি ও খ্রিস্টানগণ কখনই তোমার ওপর সন্তুষ্ট হবে না যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্ম মেনে নাও। তাদেরকে বলো, আল্লাহর হেদায়েতই (ইসলামি আদর্শ) একমাত্র হেদায়েত, আর তোমার কাছে যা নাজেল হয়েছে তার পরেও তুমি যদি ইহুদি বা খ্রিস্টানদের ধর্ম অনুসরণ করো, তাহলে তোমাকে সাহায্য বা রক্ষা করার কেউ থাকবে না।” (সুরা বাকারা, আয়াত ১২০) আল্লাহর কি সন্দেহ হয়েছিল যে, মুহাম্মদ অন্যধর্ম মেনে নিতে পারেন? সুরা বাকারার ১৪৫নং আয়াতে আল্লাহ আরও বলেন; “আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে (ইহুদি, খ্রিস্টান), তাদের কাছে যদিও তুমি সকল আয়াত (প্রমাণ-নিদর্শন) নিয়ে আসো, তবুও তারা তোমার পথ মানবে না, আর তুমিও তাদের পথ অনুসরণ করতে পারো না। আবার তাদের কেউ কেউ পরস্পরের অনুসারী নয়। আর তোমার কাছে জ্ঞানের যা কিছু এসেছে তারপরেও তুমি যদি তাদের পথ অনুসরণ করো তাহলে নিশ্চয়ই হবে জালিমদের অন্তর্ভুক্ত।” এই আয়াতের ইংরেজি করা হয়েছে এভাবে : And even if you were to bring to the people of the Scripture (Jews and Christians) all the Ayat (proofs, evidences, verses, lessons, sings, revelations etc.), they would not follow your Qiblah (prayer direction), nor are you going to follow their Qiblah (prayer direction). And they will not follow each other’s Qiblah (prayer direction). Verily, if you follow their desires after that which you have received of knowledge (from Allah), then indeed you will be one of the Zalimun (polytheists, wrong-doers etc)

আল্লাহর কি সন্দেহ হয়েছিল মুহাম্মদ (দঃ) তাঁর অবাধ্য হয়ে যাচ্ছেন যে তাকে বলতে হলো, “তুমি যদি তাদের পথ অনুসরণ করো তাহলে নিশ্চয়ই তুমিও হবে জালিমদের অন্তর্ভুক্ত?” সুরা বাকারার ১৯১নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তাদেরকে হত্যা করো যেখানেই তাদের দেখা পাও, আর তাদেরকে তাড়িয়ে দাও যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে তাড়িয়েছিল, আর উৎপীড়ন হত্যার চেয়ে নিকৃষ্ট। আর মাসজিদুল হারাম মক্কার আশেপাশে তাদেরকে হত্যা করো না যদি না তারা তোমাদেরকে সেখানে হত্যা করে, কিন্তু যদি তারা তোমাদেরকে সেখানে আক্রমণ করে, তোমরা তাদেরকে খুন করো। এটাই অবিশ্বাসীদের প্রাপ্য।” এটা একজন সৃষ্টি কর্তার বাক্য হলো? আল্লাহ নিজে খুন না করে মানুষ দিয়ে মানুষ খুন করান কেন? এই আয়াতে আল্লাহ অথবা মুহাম্মদ (দঃ) যাদেরকে খুন করার কথা বলছেন এবং খুন করেছেন, এদের অবিশ্বাসী দাবি করা হলেও তারা তো আসলেই নাস্তিক-নিরীশ্বরবাদী বা অবিশ্বাসী ছিলেন না;তাদের বেশিরভাগই ছিলেন ইহুদি, খ্রিস্টান অথবা অন্য বহু-ঈশ্বরবাদী, সর্বপ্রাণবাদী ধর্মাবলম্বী। এখানে বলা হয়েছে- ‘কিন্তু যদি তারা তোমাদেরকে সেখানে আক্রমণ করে’ এই লাইনটা নিয়ে কথার চাতুরী বা মারপ্যাচ হতে পারে। আক্রমণটা কে আগে করলো, কেন করলো আর তা ডিফেন্সিভ না অফেন্সিভ ছিল তা জানবো কী করে? ওটা নির্ভর করে ঘটনা বা ইতিহাস লিখেছেন কারা। ইরাক বা আফগানিস্থান আক্রমণ করে আমেরিকা যদি বলে সেটা আত্মরক্ষার যুদ্ধ ছিল তা কি গ্রহণযোগ্য হবে? কোন দেশ দখল করার অজুহাতে আমেরিকা তো বলবেই যে, সে দেশ তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি ছিল। সে আক্রমন করবে কখনও বিপন্ন গনতন্ত্র উদ্ধারের নামে , কখনো ভুলুন্টিত মানবাধিকার পুনঃ প্রতিষ্ঠার নামে, কখনও ডব্লিউ এম ডি বা নিউক্লিয়ার অস্ত্রভান্ডার ধ্বংসের নামে আবার কখনও ধর্মীয় সন্ত্রাস নির্মূলের নামে। মুহাম্মদ তার মদিনার জীবনে যত যুদ্ধ করেছেন , সকল যুদ্ধই কি ডিফেন্সিভ বা আত্মরক্ষামূলক ছিল? আমরা এ বিষয়ের উপর পরে আরো বিস্তারিত আলোচনা করবো।

কোরান একদিকে বলে-‘লা ইকরাহা ফিদ্দীন’ অর্থাৎ, ধর্মে জবরদস্তি নেই, অপরদিকে আবার বলে : “যুদ্ধ তোমাদের জন্যে ফরজ (বাধ্যতামূলক) করা হলো যদিও তোমরা তা পছন্দ করো না।” (সুরা বাকারা, আয়াত ২১৬)। এই আয়াত থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, মানুষ (আরবের তৎকালীন জনসাধারণ, এমন কি নতুন যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তারা যুদ্ধ পছন্দ করতেন না, অথচ কোরান উৎসাহ দিচ্ছে যুদ্ধের।

কোরানে আমরা আরো দেখতে পাই, “আর মুশরিক নারীকে বিয়ে করো না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ঈমান এনেছে, অবশ্যই একজন ক্রীতদাসী ঈমানদার নারী একজন স্বাধীন নারীর চেয়ে উত্তম,যদিও সে তোমাদেরকে মোহিত করে। আর (তোমাদের মহিলাগণকে) বিয়ে দিও না মুশরিকদের সাথে, যে পর্যন্ত না তারা ঈমান আনে, নিশ্চয়ই একজন ঈমানদার গোলাম, স্বাধীন মুশরিকের চেয়ে ভাল যদিও সে তোমাদেরকে তাজ্জব করে দেয়।” (সুরা বাকারা, আয়াত ২২১) জাতিভেদ বা সাম্প্রদায়ীকতা শিক্ষার এর চেয়ে আর কী উত্তম সবক হতে পারে?

হাদিস শরিফে হজরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করছেন, “আল্লাহর রসুল (দঃ) বলেছেন, ইহুদি-খ্রিস্টানরা তাদের পাকা সাদা চুলে রঙ দেয় না, সুতরাং তোমরা তার উল্টোটা করবে অর্থাৎ তোমাদের পাকা সাদা চুলে ও দাড়িতে রঙ দেবে।” (দ্রষ্টব্য : সহি বোখারি শরিফ, ভলিউম ৪, বুক ৫৬, নম্বর ৬৬৮) স্রষ্টা কীভাবে তার সৃষ্টিকে ঘৃণা, অপমান, হিংসা, বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা শিক্ষা দিতে পারে? এই শিক্ষা দিয়ে মানবকল্যাণ সাধন বা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা হয় কীভাবে? সম্পূর্ণ বইখানি রাজনৈতিক স্বার্থে রচিত। তাহলে স্বর্গ, মহাপুরস্কার, নরক, ভয়ঙ্কর শাস্তি,তকদির, ফেরেস্তা, শয়তান এগুলো কি মিথ্যা? হ্যাঁ, এগুলো হলো সাধারণ মানুষের দৃষ্টি এড়ানোর লক্ষ্যে সম্পূর্ণরূপে গোপন রাজনৈতিক স্বার্থের ওপর মিথ্যার আবরণ। এ বইখানি পড়ে, এ ধর্মে পূর্ণবিশ্বাস স্থাপন করে কোনো মুসলমান, অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষকে, জগতের কোনো অমুসলিমকে ভালোবাসতে পারেনা। অনেকেই হয়তো বলবেন, মুসলমানদের মধ্যে কি সহনশীল, মহৎহৃদয়ের ব্যক্তি নেই? অবশ্যই আছেন এবং অনেক আছেন। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে তাদের নন-মসুলিমদের প্রতি সহনশীলতা, প্রেম-ভালোবাসা, মৈত্রী ইত্যাদি তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে কিংবা ছোটবেলা থেকে নন-মুসলিমদের সাথে পাশাপাশি থাকার কারণে, সামাজিকীকরণের সময় নিজেদের মধ্যে কাণ্ডজ্ঞান, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় নিয়ম-নীতি সম্পর্কে বোধ-বুদ্ধি-ধারণা-নীতি-নৈতিকতা সৃষ্টির ফলে আর ধর্মগ্রন্থের তথাকথিত ঐশ্বরিক নির্দেশ থেকে কিছুটা উদাসীন থাকার কারণে। তবে অবশ্যই ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে উৎসাহিত হয়ে নয়। বইখানি পড়ে, জেনে, বুঝে যারা বলেন ইসলাম মানবতার ধর্ম, বিশ্ব-শান্তির ধর্ম, কোরান সাম্য-মৈত্রীর বাণী বহন করে, তাঁরা অবশ্যই ভান করেন, মিথ্যা বলেন, প্রতারণা করেন, অথবা সম্পূর্ণ না-জেনে বোকার স্বর্গে বাস করে নিজের মনগড়া ভালো-ভালো কথাগুলোকে ইসলামের কথা বলে চালিয়ে দেন।

কোরান না হয় অন্য ধর্মের ও ধর্মগ্রন্থের নিন্দা, সমালোচনা করলো, তাদের সত্যতা অস্বীকার করলো। কিন্তু স্ব-ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এতো মতভেদ, মারামারি, খুনোখুনি কেন? এই যে শিয়া-সুন্নি, আহমদিয়া, ওয়াহাবি, হানিফি,হাম্বলি, মালিকি ইত্যাদি স্বগোত্রে, স্বজাতিতে, স্বধর্মে এই মতভেদ মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনির কারণ কি ধর্মগ্রন্থ বোঝার ভুল, ধর্মগ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যা, অপব্যাখ্যা, নাকি এর কারণ স্বয়ং ধর্মগ্রন্থের রচয়িতাগণ, ধর্ম প্রবর্তকগণ? মুসলমানদের দাবি মতো ‘পৃথিবীর শেষ ধর্ম ইসলাম’ তার পূর্ববর্তী সবগুলো ধর্মকে বাতিল ঘোষণা করেছে। কোরান স্পষ্টভাষায় বলে দিয়েছে, আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম হলো ইসলাম (৩:১৯); এবং মুসলমানরা বেহেস্তে যাবে আর অমুসলিমরা যাবে দোযখে (২:৩৯)। সুতরাং যে ধর্মগুলো আল্লাহকর্তৃক বাতিল, পরিত্যক্ত,ভ্রান্তিপূর্ণ, বর্জনীয়, অগ্রহণযোগ্য, অচল হয়ে গেছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করার কোনো যুক্তি নেই। নূতনের প্রতিই মানুষ আগ্রহী হয়, নূতনকেই গ্রহণ করে-বর্জন করে; নূতনকে নিয়েই হয় গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা,আলোচনা-সমালোচনা। কিন্তু লক্ষণীয় যে, কেউ ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কোরান নিয়ে সামান্য যৌক্তিক আলোচনা-সমালোচনা করলেই তাঁকে কথায় কথায় ইসলাম-ব্যাশার, ইসলাম-বিদ্বেষী, কাফের, মুরতাদ, অথবা ফ্যানাটিক,ইহুদি-নাসারাদের দালাল ঘোষণা করা হয়। আসলে তাঁরা ইসলাম সম্পর্কে সত্যকে গ্রহণ করতে ভয় পান, নয়তো সত্যকে ঘৃণা করেন। আজকাল পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু লোক উদারতার সাথে দাবি করেন, ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কোরান স্বকালের সামাজিক পরিবেশ, ইতিহাস ও বাস্তবতার নিরিখে সমাজ পরিবর্তন বা সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্যে লিখিত। আবার কিছু লোক, আল্লাহ ও আল্লাহর মনোনীত রসুল ও তাঁর লিখিত ধর্মগ্রন্থকে সুকৌশলে নিষ্কলঙ্ক, নির্ভুল প্রমাণ করে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন এবং সকল কলঙ্ক ধর্মানুসারীদের ওপর চাপিয়ে দেন। তাঁরা এ কাজটি করার জন্যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীপ্রচারক মুহাম্মদ ও তার লেখা গ্রন্থ কোরানকে জগতের তাবৎ মুসলমান থেকে পৃথক করে নিয়েছেন। তারা নিজেদেরকে ‘কোরান অনলি’ অনুসারী বলে দাবী করেন। বাকী ইসলামকে তার নাম দিয়েছে ‘মৌলবাদী’ বা ‘রাজনৈতিক ইসলাম’। অর্থাৎ পৃথিবীতে ইসলামের নামে যত যুদ্ধ-বিগ্রহ, অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি, অমঙ্গল,অকল্যাণ হয়েছে এবং হচ্ছে, তার সবগুলো হয় কোরানের অপব্যাখ্যাকারী ঐ মৌলবাদী ও রাজনৈতিক ইসলামের দ্বারা। আল্লাহ, মুহাম্মদ (দঃ) ও তাঁদের কোরান সর্বদাই নমস্য, নিষ্কলঙ্ক, নির্ভুল, নির্ভেজাল। তাঁদের ভাষায়—হযরত আয়েশা (রা.), হযরত আবুবকর, হযরত ওমর, হযরত ওসমান, হযরত আলি, মোয়াবিয়া, ইমাম আবুহানিফাসহ আজকের পৃথিবীর আলেম, উলামা, মশায়েখ, হাফিজ, মোহাদ্দিস সবাই মৌলবাদী ও রাজনৈতিক ইসলামের সমর্থক। এ হলো আল্লাহ, মুহাম্মদ (দঃ), ও কোরানকে সত্য ও নির্ভুল প্রমাণ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। ইসলামের মৌলবাদ ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যতীত কোরান রচনার ও প্রয়োগের উদ্দেশ্য হবে নিষ্ফল অর্থহীন। আদ্যপান্থ স্ববিরোধী বক্তব্যে ভরপুর কোরান স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আসছে যুগ-যুগ ধরে।

আজকাল প্রকৃত ইসলাম, মসজিদ, মক্তব, মাদ্রাসায় আর নেই। কোরান-হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যাকারী ও মুহাম্মদ (দঃ)-কে প্রকৃতভাবে চেনার মতো কোনো আলেম, মৌলানা, হাফেজ, ক্বারী, মোহাদ্দিস, মুফাস্সিরিন মনে হচ্ছে এ জগতে অবশিষ্ট নেই। কোরান, আল্লাহ ও মুহাম্মদ (দঃ)-কে হেফাজত করার পবিত্র দায়িত্ব নিয়েছেন ‘মডার্ন ইসলামিষ্ট’ নামের স্কুল কলেজ পড়ুয়া তথাকথিত শিক্ষিত মুসলমান। ইসলাম নিয়ে তাদের আবার একেকজনের একেক মত,একেক ব্যাখ্যা। তাঁদের মডার্ন ইসলামের অস্তিত্ব শুধুমাত্র কাগজে-কলমে, পত্রিকার পাতা আর ইন্টারনেটের ওয়েব ব্লগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সমাজে এর কোনো অস্তিত্ব বা বাস্তব প্রতিফলন নেই। বাস্তবে আমরা দেখি মুসলমানকে সামাল দিতে (ইংল্যান্ডের ইস্ট লন্ডন) মসজিদের ভেতর পুলিশের কুকুর, বাংলাদেশের বায়তুল মোকাররম মসজিদে লাথালাথি, জুতাজুতি। এই হাতা-হাতি লাথা-লাথি জুতাজুতি ১৫শো বছর আগেও ছিল, আজও আছে। ১৫শো বছর আগে ইসলামের হাতে ছিল তীর-বর্শা, তলোয়ার, আর এখন বন্দুক, বোমা গ্রেনেড। আমাদের বাংলাদেশে অর্ধশত ইসলামি দলের নাম শুনে অবাক হওয়ার কী আছে? পনেরশত বছর আগেই তো মুহাম্মদ বলে গেছেন, “কেয়ামতের দিন উম্মতে মুহাম্মদী তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে, তন্মধ্যে মাত্র একদল হবে বেহেস্তি। (দ্রষ্টব্য : আবু দাঊদ শরিফ, বুক ৩, নম্বর ৪৫৮০)। আর এই ঘোষণার পর সকলেই যে নিজেদেরকে জান্নাতি দলের দাবি করবে এবং জাহান্নামি বাকি বাহাত্তর দলের সাথে খুন-খারাবি, ঝগড়া-ফ্যাসাদে লিপ্ত থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। আমরা এখন ধারণা করতে পারি, অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন মুহাম্মদ নিশ্চয়ই আঁচ করতে পেরেছিলেন ‘স্ববিরোধী’ বক্তব্যে ভরপুর কোরান ও কোরানের অনুসারীদের ভবিষ্যৎ। তাই বলেছিলেন—মতবিরোধ, মতানৈক্য আমার উম্মতের জন্যে আশীর্বাদ! নবী চেয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জামাতা আলি (রাঃ) ইসলামের প্রথম খলিফা হবেন; কিন্তু তাঁর আশাপূর্ণ হয়নি। হয়েছিলেন তাঁর সর্বকণিষ্ঠ এবং প্রিয় পত্নী আয়েশার পিতা হযরত আবু বকর (রাঃ)। জানা যায়, নবী মুহাম্মদ জীবিত থাকতে একবার মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী ‘গাদির আল-খুম’ নামক একটি ঝরণার (কেউ কেউ বলে কূপ) কাছে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন : “ আমি যাদের নেতা আমার আলিও তাদের নেতা।” এই ঘোষণার দিনটি স্মরণে রেখে এখনো শিয়ারা আনন্দোৎসবের আয়োজন করে থাকে। (দ্রষ্টব্য : আরব জাতির ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৪৬০, ৪৭২)। মুহাম্মদের মৃত্যুর সাথে-সাথেই ক্ষমতা দখল নিয়ে লড়াই, ফ্যাসাদ,প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। মুহাম্মদ (দঃ) নিজেই মুসলমানদের জন্যে প্রথম বিষবৃক্ষ রোপন করে গেছেন। মুহাম্মদের রচিত কোরান-হাদিস তার প্রিয় স্ত্রী আয়েশা ও জামাতা আলির জন্যে মঙ্গল বয়ে আনতে পারেনি। মোয়াবিয়া ও আলির (রাঃ) মধ্যকার শত্রুতা নিরসন করতে পারেনি; পারেনি হাসান, হোসেনকে মোয়াবিয়ার পুত্র এজিদের হাত থেকে রক্ষা করতে। ওহাবি, শিয়া, সুন্নি, শরিয়ত, মারিফত, তরিকত, হানিফি, মালিকি, হাম্বলি, শাফিই, জামাতি, জমিয়তি, কাদিয়ানি, হিজবুত, জে এম বি সবকিছুই মুহাম্মদ (দঃ) ও তাঁর কোরান-হাদিসের সৃষ্টি। একই বিষ-বৃক্ষের বহু শাখা-প্রশাখামাত্র।

চলবে-

১ম পর্ব-

২য় পর্ব-

৩য় পর্ব