সভ্যতা শুরুর আগে
মূল রচনা – জ্যারেড ডায়মন্ড
অনুবাদ – শিক্ষানবিস
অনুবাদকের কথা
“ধর্মের প্রয়োজনীয়তা কি ফুরিয়ে গেছে?” নামে একটা ব্লগ অনেকদিন আগেই লিখেছিলাম। ঐ ব্লগের মন্তব্যে হিমু (সচলায়তনে লিখেন) প্রথম জ্যারেড ডায়মন্ডের সন্ধান দেন। এর আগে জ্যারেড ডায়মন্ডের বই কখনও পড়িনি। হিমুর কাছ থেকে জানার পরই ইস্নিপ্স থেকে ডাউনলোড করে “গান্স, জার্মস অ্যান্ড স্টিল” (পুলিৎজার পুরষ্কার বিজয়ী) বইটি পড়া শুরু করি। ঈদের ছুটিতে বাসায় বসে বসে একটা অধ্যায় অনুবাদও করে ফেলি। ইন্টারনেট কানেকশন ছিল না। এক দিক দিয়ে ভালই হয়েছিল। নেট না থাকলে লেখালেখি হয় বেশী।
জ্যারেড ডায়মন্ডের এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়টা খুব মজার। মাত্র ২০ পৃষ্ঠার মধ্যে সেই ৭ লক্ষ বছর আগে থেকে শুরু করে ১৩,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত মানুষের পুরো ইতিহাসটা বলে দিয়েছেন। আমি মনে করি, শুধু এইটুকু পড়লে বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের ক্রমবিকাশের চিত্রটা যে কারও কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। তাই এই অধ্যায়টাই অনুবাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আশাকরি ৩-৪ কিস্তিতে শেষ হয়ে যাবে।
আরেকটা বিষয় বলে নেয়া প্রয়োজন। জ্যারেড ডায়মন্ডের মাথায় এই বই লেখার চিন্তা এসেছিল পাপুয়া নিউ গিনির রাজনীতিবিদ ইয়ালির একটি প্রশ্ন থেকে। ইয়ালি তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় আমরা এতো অনগ্রসর কেন?” প্রশ্নটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই মধ্যযুগেও নিউ গিনির মানুষেরা পশু শিকারের মাধ্যমে আদিম মানুষের মত জীবন যাপন করতো। অথচ আফ্রিকা, ইউরেশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার পর এই অঞ্চলেই প্রথম মানুষের বিকাশ ঘটেছিল। কি কারণে এখানকার মানুষ উন্নত হতে পারলো না? বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও বর্ণবাদীরা মনে করতো, তাদের বুদ্ধি কম। কিন্তু ডায়মন্ড বলেছেন, নিউ গিনির সাধারণ মানুষের বুদ্ধিমত্তা আমেরিকার মানুষের চেয়ে কোন অংশেই কম না। এমনকি কিছু কিছু দিক দিয়ে তারা আমেরিকানদের চেয়ে উন্নত। তাহলে কেন এই অবনতি? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই জ্যারেড ডায়মন্ড তার বইটি লিখেছেন। তিনি মনে করেন, এটা রচনার মাধ্যমে ইয়ালির সেই পুরনো প্রশ্নের উত্তর কিছুটা হলেও দিতে পেরেছেন।
২০০৯ সালে বর্ষব্যাপী ডারউইন উৎসব উদযাপিত হচ্ছে। কারণ এ বছরের ১২ই ফেব্রুয়ারি চার্লস ডারউইনের ২০০তম জন্মবার্ষিকী ও তার “প্রজাতির উদ্ভব” গ্রন্থের ১৫০তম প্রকাশবার্ষিকী। ডারউইন দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যেই লেখাটি মুক্তমনায় প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। জ্যারেড ডায়মন্ডের এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে মানব বিবর্তনের একটা অংশ খুব সুন্দরভাবে আলোচিত হয়েছে। একইসাথে এতে মানুষের বিবর্তনের পক্ষে জীবাশ্মবিজ্ঞানে যত প্রমাণ পাওয়া গেছে তা সংক্ষিপ্তভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে। তাই এটা সাধারণ্যে বিবর্তনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরীতে অবদান রাখবে বলে আশা করি।
মূল গ্রন্থ: Guns, Germs and Steel: The Fates of Human Societies
অধ্যায় ১: Up to the starting line
প্রথম অধ্যায়: সভ্যতা শুরুর আগে
বিভিন্ন মহাদেশে ঐতিহাসিক উন্নতি সমান তালে ঘটেনি। মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ১১,০০০ অব্দকে মহাদেশগুলোর এই ঐতিহাসিক উন্নয়নের তুলনা করার জন্য উপযুক্ত বছর হিসেবে বেছে নেয়া যায়। এই সময় থেকেই বিশ্বের কিছু অংশে গ্রামীণ জীবনের উদ্ভব ঘটে, আমেরিকায় প্রথমবারের মত মানব বসতি স্থাপিত হয়, প্লাইস্টোসিন ও শেষ বরফ যুগের সমাপ্তি ঘটে এবং ভূতত্ত্ববিদরা যে যুগকে “সাম্প্রতিক যুগ” বলে অভিহিত করেন সে যুগের সূচনা ঘটে। এই বছরের আনুমানিক কয়েক হাজার বছরের মধ্যে বিশ্বের কিছু অংশে উদ্ভিদ ও প্রাণীর লালন-পালন শুরু হয়। অর্থাৎ তখন থেকে আমরা গৃহপালিত উদ্ভিদ ও প্রাণী পেতে শুরু করি। এমন কি হতে পারে, সেই ১১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দেই কিছু মহাদেশ অন্য মহাদেশের তুলনায় এগিয়ে ছিল? সেক্ষেত্রে প্রশ্ন করতে হয়, শুরুতেই কি কেউ অন্যদের তুলনায় বেশী সুবিধা ভোগ করেছিল?
যদি তা-ই হয়, তবে এই প্রাথমিক সুবিধাই হয়ত গত ১৩,০০০ বছরে বহুগুণে বর্ধিত হয়ে বর্তমান বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে। সেক্ষেত্রে এই প্রাথমিক সুবিধা বিশ্লেষণ করেই ইয়ালি’র প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব। তাই এই অধ্যায়ে কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে বিভিন্ন মহাদেশে মানুষের বিস্তার ও অগ্রগতির ইতিহাস বর্ণনা করা হবে। অর্থাৎ একটি প্রজাতি হিসেবে আধুনিক মানুষের উদ্ভব থেকে শুরু করে ১৩,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র ইতিহাস খতিয়ে দেখা হবে। মাত্র ২০ পৃষ্ঠায় এই বিশাল ঐতিহাসিক অভিযাত্রাকে ফুটিয়ে তোলাই এ অধ্যায়ের উদ্দেশ্য। স্বভাবতই আমি খুব বিস্তারিত বর্ণনায় যাব না, ইতিহাসের যে অংশগুলোকে এই বইয়ের জন্য সবচেয়ে উপযোগী মনে করব কেবল সেগুলোই উল্লেখ করব।
বর্তমানে “গ্রেট এইপ” এর যে তিনটি প্রজাতি টিকে আছে তারাই আমাদের সবচেয়ে নিকট আত্মীয়। এই প্রজাতি তিনটি হচ্ছে: গরিলা, সাধারণ শিম্পাঞ্জি এবং পিগমি শিম্পাঞ্জি (“বনোবো” নামেও পরিচিত)। এদের আফ্রিকায় আবদ্ধ হয়ে থাকা এবং আফ্রিকা থেকে উদ্ধারকৃত বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম নমুনা থেকে বোঝা যায়, মানব বিবর্তনের একেবারে প্রাথমিক ধাপগুলো এই আফ্রিকাতেই সম্পন্ন হয়েছিল। প্রাণীদের ইতিহাস থেকে মানুষের ইতিহাসকে আলাদা করা যায় ৭ মিলিয়ন (আনুমানিক ৫-৯ মিলিয়ন) বছর পূর্ব থেকে। এই সময়েই আফ্রিকার এইপ জনগোষ্ঠী বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি বিবর্তিত হয়ে আধুনিক গরিলায় পরিণত হয়, অন্য একটি বিবর্তিত হয়ে পরিণত হয় আধুনিক শিম্পাঞ্জিতে, আর তৃতীয় একটি জনগোষ্ঠী থেকে মানুষের উদ্ভব ঘটে। গরিলার বিবর্তন রেখা মানুষ ও শিম্পের বিবর্তন রেখার খানিকটা পূর্ব থেকে শুরু হয়।
জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিবর্তনের যে রেখা আমাদের জন্ম দিয়েছে আনুমানিক ৪ মিলিয়ন বছর পূর্বে তা বিশেষ অগ্রগতি লাভ করে। এ সময় মানব বিবর্তনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। সেই প্রাক-মানবের দেহ ও মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে আনুমানিক ২.৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে। এই প্রাক-মানবদের সাধারণভাবে Australopithecus africanus, Homo habilis ও Homo erectus বলা হয়। এদের একটি ক্রমান্বয়ে অন্যটিতে বিবর্তিত হয়েছে। এভাবে মোটামুটি ১.৭ মিলিয়ন বছর পূর্বে হোমো ইরেক্টাসের উদ্ভব ঘটে। হোমো ইরেক্টাস দেহের আকারের দিক দিয়ে আধুনিক মানুষের কাছাকাছি হলেও তাদের মস্তিষ্কের আকার ছিল আধুনিক মানুষের মাত্র অর্ধেক। মোটামুটি ২.৫ মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে পাথরের উপকরণের ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু সেগুলো ছিল ঝুরঝুরে বা খণ্ড-বিখণ্ড পাথর, তার উপর আবার অশোধিত। প্রাণিবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে চিন্তা করলে হোমো ইরেক্টাস এইপদের তুলনায় অনেক উন্নত ছিল, কিন্তু তার পরও আধুনিক মানুষের তুলনায় ছিল অনেক অনুন্নত।
আমাদের উদ্ভব হয়েছে ৭ মিলিয়ন বছর পূর্বে। এর পর ৫-৬ মিলিয়ন বছর ধরে আমাদের বিবর্তনের পুরোটাই হয়েছে আফ্রিকাতে। সে সময় আফ্রিকার বাইরে মানুষ বা তার আদি পুরুষদের কোন অস্তিত্বই ছিল না। মানুষের প্রথম যে পূর্বপুরুষ আফ্রিকা ছেড়ে বাইরের জগতে পা দিয়েছিল তারা হল হোমো ইরেক্টাস। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাভা দ্বীপে প্রাপ্ত জীবাশ্মের মাধ্যমে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। আফ্রিকা থেকে অভিবাসিত এই মানবদের তাই জাভা মানব বলা হয়।
প্রাচীনতম জাভা জীবাশ্মের বয়স প্রায় ১ মিলিয়ন বছর, এটা অবশ্য জাভা মানব নয়, মানবী। কিন্তু বর্তমানে কিছু বিজ্ঞানী বলছেন, এদের বয়স ১.৮ মিলিয়ন বছর। সূক্ষ্ণভাবে বললে বলতে হয়, জাভায় পাওয়া জীবাশ্মগুলোর নামই প্রকৃতপক্ষে হোমো ইরেক্টাস দেয়া উচিত। আর আফ্রিকার হোমো ইরেক্টাসেরা অন্য কোন নাম পেতে পারে। বর্তমানে ইউরোপে প্রাপ্ত প্রাচীনতম মানব জীবাশ্মের বয়স ০.৫ মিলিয়ন (৫ লক্ষ) বছর। অবশ্য অনেকে এর চেয়ে প্রাচীন জীবাশ্ম প্রাপ্তির দাবী করেন। প্রতিষ্ঠিত দাবী মেনে নিলে বলতে হয়, এশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনের পর ইউরোপে উপনিবেশ স্থাপন তেমন কঠিন ছিল না। কারণ, ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে কোন বিশাল বাঁধা নেই। দুই ভূমিকে তাই একত্রে ইউরেশিয়া বলা হয়।
এসব আলোচনা থেকে একটি ইস্যু উঠে আসে, এই বইয়ের পুরোটা জুড়ে যে ইস্যু ভূমিকা রাখবে। ইস্যুটি হচ্ছে, যখনই কেউ “আদিমতম এক্স” আবিষ্কারের দাবী করেছেন তখনই অন্য বিজ্ঞানীরা এর চেয়েও প্রাচীন এক্স আবিষ্কারের মাধ্যমে এই দাবীকে ভুল প্রমাণ করাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। এখানে এক্স বলতে ইউরোপের প্রাচীনতম মানব জীবাশ্ম, মেক্সিকোর প্রাচীনতম গৃহে উৎপাদিত শস্য কিংবা অন্য যেকোন স্থানের প্রাচীন যেকোন কিছুকে বোঝাতে পারে। বাস্তবে কিন্তু এমন কোন প্রাচীনতম এক্স অবশ্যই থাকার কথা যা অন্য সব দাবীকে খণ্ডন করতে পারবে। কিন্তু আমরা পরবর্তীতে দেখব, প্রতি বছরই প্রাচীনতম এক্সকে ভুল প্রমাণের দাবী নিয়ে অসংখ্য নতুন নতুন আবিষ্কারের উদ্ভব ঘটে। এই আবিষ্কারগুলো পূর্বেকার সব দাবীকে মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা করে। তাই এমন জটিল প্রশ্নের সমাধান করতে জীবাশ্মবিদদের প্রায় এক যুগের মত সময় লেগে যায়, এর পরই তারা কোন সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে সক্ষম হন।
প্রায় ৫ লক্ষ বছর পূর্বে মানুষের জীবাশ্ম হোমো ইরেক্টাস কঙ্কাল থেকে কিছু দিক দিয়ে পৃথক হতে শুরু করেছে। যেমন মানুষের কঙ্কালে অপেক্ষাকৃত বড়, গোলাকার ও কম কৌণিক আকৃতির করোটির উদ্ভব ঘটেছে। সে সময় আফ্রিকা ও ইউরোপের করোটিগুলোর আকার-আকৃতি একই ছিল এবং তাদের সাথে আধুনিক মানুষের সাদৃশ্যই বেশী ছিল। এ কারণে হোমো ইরেক্টাসের বদলে তাদেরকে আমাদের প্রজাতি তথা হোমো স্যাপিয়েন্সের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই বিভাজন অবশ্য খুব একটা যৌক্তিক নয়, কারণ হোমো ইরেক্টাসই তো আসলে হোমো স্যাপিয়েন্সে বিবর্তিত হয়েছে। যাহোক, এই আদি হোমো স্যাপিয়েন্সও কঙ্কালের খুটিনাটি কিছু দিক দিয়ে আমাদের থেকে আলাদা এবং তাদের মস্তিষ্কের আকারও আমাদের তুলনায় অনেক ছোট। আর স্বভাব ও ব্যবহৃত উপকরণের দিক দিয়ে তারা একেবারে অন্যরকম ছিল। হোমো স্যাপিয়েন্সরা যেসব পাথরের উপকরণ ব্যবহার করতো সেগুলো ছিল অশোধিত, আধুনিক পাথরের যন্ত্রপাতি নির্মনাণকারী মানুষ যেমন ইয়ালির দাদার দাদারা হয়ত ৫ লাখ বছর আগের এসব পাথরের উপকরণকে অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করতো। ৫ লাখ বছর আগের এই মানুষেদের সংস্কৃতিতে অন্য যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির উদ্ভব ঘটেছিল তা হল আগুনের ব্যবহার। তারা যে আগুনের ব্যবহার জানতো এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আদি হোমো স্যাপিয়েন্সদের কাছ থেকে আমরা কঙ্কালের অবশেষ আর অশোধিত পাথরের উপকরণ ছাড়া আর কিছুই পাইনি, কোন শিল্প, হাড়ের যন্ত্রপাতি বা অন্য কোন কিছুই পাওয়া যায়নি। সে সময়ও অস্ট্রেলিয়াতে কোন মানুষ ছিল না। কারণ খুবই সাধারণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে সেখানে যাওয়ার জন্য নৌকা ছাড়া কোন বিকল্প ছিল না। আর সমগ্র আমেরিকায় তো মানুষ থাকার প্রশ্নই উঠে না। কারণ, আমেরিকায় যাওয়ার জন্য প্রথমে ইউরেশিয়ার যে অংশ আমেরিকার কাছে সে অংশে (সাইবেরিয়া) উপনিবেশ স্থাপনের প্রয়োজন ছিল। তার সাথে সম্ভবত নৌকা বানানোর কৌশল জানারও প্রয়োজন ছিল। কিন্তু, সাইবেরিয়ার শীতল পরিবেশে বেঁচে থাকা এবং নৌকা বানিয়ে আমেরিকার পথে পাড়ি জমানো এই আদিম হোমো স্যাপিয়েন্সদের আওতার বাইরে ছিল। অবশ্য নৌকা বানানোর কৌশল জানার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ, ধারণা করা হয় আলাস্কা থেকে সাইবেরিয়াকে পৃথক করে রাখা বেরিং প্রণালী বরফ যুগে মাটির সেতুতে পরিণত হয়েছিল। বরফ যুগে সমুদ্রের পানির স্তর ব্যাপক উঠানামা করে, সে সময় বেরিং প্রণালীর সব পানি নেমে গিয়ে ভূমিকে উন্মুক্ত করে দেয়াটা তাই খুবই স্বাভাবিক।
৫ লক্ষ বছর পূর্বে আফ্রিকা ও ইউরেশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের মানুষেরা কঙ্কালের খুটিনাটি গঠনের দিক দিয়ে একে অপরের থেকে পৃথক হতে শুরু করে, আবার তারা উভয়ে পূর্ব এশিয়ার মানুষদের থেকেও আলাদা হতে শুরু করে। ১৩০,০০০ বছর পূর্ব থেকে ৪০,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার জনগোষ্ঠীর কঙ্কাল বিভিন্ন গড়ন লাভ করে। এদেরকে একত্রে নিয়ানডার্থাল ও কখনও কখনও Homo neanderthalensis নামে অভিহিত করা হয়। অনেক কার্টুন ও ব্যাঙ্গ রচনায় তাদেরকে এইপদের মত আকৃতিবিশিষ্ট হিংস্র গুহাবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, অথচ তাদের মস্তিষ্কের আকার আমাদের চেয়েও কিছুটা বড় ছিল। তার উপর তারাই প্রথম মানুষ যারা মৃতদের সমাধিস্থ করতো এবং অসুস্থদের সেবা করতো বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। অবশ্য তাদের ব্যবহৃত পাথরের হাতিয়ার আধুনিক নিউ গিনির আদিবাসীদের পলিশ করা পাথরের উপকরণের তুলনায় অশোধিতই ছিল। তাছাড়া নিয়ানডার্থালরা পাথর দিয়ে বিভিন্ন ধরণের হাতিয়ার তৈরী করতে পারতো না, যার একটি থেকে অন্যটিকে পৃথক করা যায়।
আফ্রিকায় নিয়ানডার্থালদের সমসাময়িক যে গুটিকয়েক কঙ্কাল পাওয়া গেছে সেগুলোর সাথে নিয়ানডার্থালদের তুলনায় আধুনিক মানুষের কঙ্কালের মিল বেশী। পূর্ব এশিয়া থেকে সে সময়কার আরও কম কঙ্কাল উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তার পরও যেগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো থেকে বোঝা যায় তারা আফ্রিকান ও নিয়ানডার্থালদের তুলনায় পৃথক ছিল। সে সময়কার জীবনধারা সম্পর্কে জানার একমাত্র উপায় আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের কিছু স্থান থেকে পাওয়া পাথরের হাতিয়ার ও শিকারের হাড়। এগুলো ঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ১০০,০০০ বছর পূর্বে এই আফ্রিকানদের কঙ্কাল নিয়ানডার্থালদের তুলনায় উন্নত হলেও তাদের পাথরের হাতিয়ারের আকার-আকৃতি অশোধিতই ছিল। তাদের তৈরী উপকরণগুলোতেও নির্দিষ্ট আকৃতি দেখা যায় না, যা দিয়ে একটি থেকে অন্যটিকে পৃথক করা সম্ভব। তারা কোনরকম শিল্প সংরক্ষণেও আগ্রহী ছিল না। তাদের শিকার করা পশুগুলোর হাড় থেকে বোঝা যায়, শিকারের ক্ষেত্রেও তারা খুব বেশী পটু ছিল না। সহজে ধরা যায় এমন পশুদেরই তারা শিকার করতো। মহিষ বা শুকরের মত ভয়ংকর প্রাণী শিকার তারা তখনও শুরু করেনি। এমনকি তারা মাছও ধরতে পারতো না। তাদের সমুদ্রোপকূলবর্তী উপনিবেশগুলোতে তেমন কোন মাছের হাড় বা মাছ ধরার বড়শি পাওয়া যায়নি। তাই এই আফ্রিকান ও নিয়ানডার্থালদের আধুনিক মানুষের চেয়ে বেশ অনুন্নত হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
আনুমানিক ৫০,০০০ বছর পূর্বে মানব ইতিহাসের ব্যাপক অগ্রগতির সন্ধান মিলে। একে আমি “গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড” হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। এই অগ্রগতির প্রথম সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় পূর্ব আফ্রিকার স্থানগুলোতে। এখানেই প্রথম নির্দিষ্ট আকৃতিবিশিষ্ট পাথরের হাতিয়ার ও সংরক্ষিত অলংকারের (অস্ট্রিচের বহিরাবরণ দিয়ে তৈরী গুটিকা) দেখা মিলে। এর কিছু সময়ের মধ্যেই নিকট-প্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ইউরোপে এ ধরণের উন্নতির আভাস পাওয়া যায়। আনুমানিক ৪০,০০০ বছর পূর্বে দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপেও এ ধরণের উন্নয়ন ঘটে। এখানে সম্পূর্ণ আধুনিক মানুষের কঙ্কালের সাথে বিপুল পরিমাণ হাতিয়ার পাওয়া গেছে। এই মানুষদের নাম ক্রো-ম্যাগনন। এর পর থেকে জীবাশ্মবিজ্ঞান গবেষণার স্থানগুলোতে জড়ো করা নমুনা দিন দিন কেবল বিস্ময়কর হতে থাকে। বিপুল পরিমাণ নমুনার বিশ্লেষণ থেকে আমরা নিশ্চিত বুঝতে পারি যে, আমরা জৈবিক গঠন ও স্বভাব, উভয় দিক দিয়ে সম্পূর্ণ আধুনিক মানুষদের নিয়েই কাজ করছি।
ক্রো-ম্যাগননদের আবর্জনার স্তূপে পাথরের যন্ত্রপাতির পাশাপাশি হাড়ের উপকরণও পাওয়া যায়। হাড় দিয়ে যে অনেক ভাল আকৃতির যন্ত্রপাতি তৈরী করা যায় এটা আগের যুগের কোন মানুষ বুঝে উঠতে পারেনি। ক্রো-ম্যাগননরা হাড় দিয়ে মাছ ধরার বড়শি তৈরী করে। এছাড়া তারা হরেক রকমের উপকরণ তৈরী করে। এগুলোর মধ্যে গুটিকতক আমরা আধুনিক যুগেও ব্যবহার করি। যেমন, সুই, চামড়া ছেদা করার জন্য ব্যবহৃত আরা, খননের জন্য ব্যবহৃত উপকরণ ইত্যাদি। একটিমাত্র টুকরো দিয়ে তৈরী যন্ত্রের পাশাপাশি তারা একাধিক টুকরো দিয়েও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরী করে। ক্রো-ম্যাগনন জীবাশ্ম প্রাপ্তির স্থানগুলোতে পাওয়া একাধিক টুকরোবিশিষ্ট উপকরণগুলোর মধ্যে রয়েছে হারপুন, বর্শা নিক্ষেপক এবং এভাবে একসময় তীর-ধনুক। এই তীর-ধনুকই কিন্তু আধুনিক যুগের রাইফেল ও অন্যান্য নিক্ষপযোগ্য অস্ত্রের পূর্বপুরুষ। তীর-ধনুকের মত অস্ত্রগুলোর মাধ্যমে নিরাপদ দূরত্বে থেকে শিকার করা সম্ভব হয়। ফলে ক্রো-ম্যাগননরা অপেক্ষাকৃত ভয়ংকর ও চতুর জন্তু শিকার শুরু করে। যেমন, গণ্ডার ও হাতি। এর পাশাপাশি লম্বা রশি, জাল, সুতা ও ফাঁদ উদ্ভাবনের কারণে মাছ ও পাখি শিকার শুরু হয়। আর আমাদের নিত্যদিনের খাবারে দুটি নতুন পদ যোগ হয়। সে যুগের বাড়িঘর ও সেলাই করা কাপড়ের অবশেষ থেকে বোঝা যায়, তারা শীতল পরিবেশে বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করেছিল। আর অলংকার ও যত্নের সাথে সমাধিস্থ করা কঙ্কালের অবশেষ থেকে বোঝা যায়, তাদের মধ্যে সে সময়ই নৈসর্গ্যিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার জন্ম হচ্ছিল।
ক্রো-ম্যাগননদের ব্যবহার্য যা কিছু পাওয়া গেছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তাদের শিল্পকর্ম। এর মধ্যে আছে তাদের বিস্ময়কর গুহাচিত্র, মূর্তি ও বাদ্যযন্ত্র। এই উপকরণগুলোকে আমরা আজও শিল্পের উৎকৃষ্ট উপাদান হিসেবে সম্মান করি। যে কেউ Lascaux গুহায় ক্রো-ম্যাগননদের আঁকা জীবন্ত ষাঁড় ও ঘোড়ার ছবিগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন, এগুলো যারা একেছে তারা মন ও কঙ্কাল উভয় দিক দিয়ে বর্তমান মানুষের মতই আধুনিক।
আজ থেকে ১০০,০০০ বছর পূর্ব থেকে শুরু করে পরবর্তী ৫০,০০০ বছর মানুষের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যে অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, এ নিয়ে আর কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই “গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড” আমাদের সামনে দুটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছে যেগুলোর উত্তর এখনও সঠিকভাবে দেয়া যায়নি। একটি প্রশ্ন এই অগ্রগতির কারণ নিয়ে, আর অন্যটি অগ্রগতি কোন ভৌগলিক স্থানে হয়েছে তা নিয়ে। এই অগ্রগতির কারণ বিষয়ে আমি আমার “দ্য থার্ড শিম্পাঞ্জি” বইয়ে লিখেছিলাম, কণ্ঠ বাক্সের পরিপূর্ণতা লাভ এবং এর মাধ্যমে আধুনিক ভাষার জৈবিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার উপর মানুষের সৃজনশীলতা অনেকাংশে নির্ভর করে, তাই একেই গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ডের কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। অনেকেই অবশ্য বলেছেন, মস্তিষ্কের আকার পরিবর্তিত না হয়ে বরং মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীন সংগঠন পরিবর্তিত হওয়ার কারণে আধুনিক ভাষার সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে।
ছবি: বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আদিম মানুষদের উপনিবেশ স্থাপনের মানচিত্র (সাথে প্রথম মানুষ আগমনের সময় দেয়া আছে)
এবার গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ডের স্থান সম্বন্ধে ভাবা যাক। এই অগ্রগতি কি কোন নির্দিষ্ট স্থানে কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে ঘটেছিল এবং পরবর্তীতে এই অগ্রগামী মানুষেরা তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পরে সেখানকার অনগ্রসর মানুষদের প্রতিস্থাপিত করেছিল? নাকি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে একইসাথে এই অগ্রগতি ঘটেছিল আর বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে বসবাসকারী মানুষেরা সে স্থানে অগ্রগতি অজর্নকারী মানুষদেরই উত্তরপুরুষ? ১০০,০০০ বছর পূর্বে আফ্রিকাতে বসবাসকারী মানুষের করোটির জীবাশ্ম নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, প্রথম ধারণাটাই সঠিক। অর্থাৎ মানুষের গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড কেবল আফ্রিকাতেই ঘটেছিল। প্রথম দিকে করা আণবিক গবেষণার (তথাকথিত “মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ”) মাধ্যমেও মানুষের উৎপত্তি ও গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড আফ্রিকাতেই ঘটেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। অবশ্য এই গবেষণার ফলাফল নিয়ে বর্তমানে সংশয় দেখা দিয়েছে। অপরদিকে কয়েক শত হাজার বছর পূর্বে চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় বসবাসকারী মানুষের করোটি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এর সাথে সে অঞ্চলে বর্তমানে বসবাসকারী মানুষের করোটির মিল আছে। ভৌত নৃবিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখতে পেয়েছেন, ইন্দোনেশিয়ায় পাওয়া আদিম করোটির কিছু বৈশিষ্ট্য অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের করোটিতেও উপস্থিত আছে। চীনে পাওয়া করোটির জীবাশ্মের কিছু বৈশিষ্ট্যও আধুনিক চীনাদের মধ্যে উপস্থিত আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই দাবী প্রমাণিত হলে, আধুনিক মানুষের সমান্তরাল বিবর্তন ও একইসাথে একাধিক অঞ্চলে তাদের উৎপত্তির তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠা পাবে। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোন “এডেনের উদ্যান”-এ মানুষের উৎপত্তি ও বিকাশের ধারণাটিও পরিত্যাক্ত হবে। এ নিয়ে এখনও কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি।
ইউরোপের ক্ষেত্রে কিন্তু একটি নির্দিষ্ট স্থানে মানুষের উৎপত্তি, সেখান থেকে পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থানে উপনিবেশ স্থাপন এবং এই অগ্রগামীদের দ্বারা অন্যান্য মানুষের প্রতিস্থাপনের বিষয়টিই সত্য। এই প্রকল্পের অনেক শক্তিশালী প্রমাণ আছে। এ হিসেবে ৪০,০০০ বছর পূর্বে ক্রো-ম্যাগননরা আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আসে। তাদের কঙ্কাল, ব্যবহৃত অস্ত্র ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যাদি সে সময় ইউরোপে বসবাসকারী গোষ্ঠীগুলোর তুলনায় উন্নত ছিল। ক্রো-ম্যাগননদের আগমনের মাত্র কয়েক হাজার বছরের মধ্যে ইউরোপ থেকে নিয়ানডার্থালরা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। অথচ এই নিয়ানডার্থালরাই কয়েক শত হাজার বছর ধরে সমগ্র ইউরোপ অধিকার করে ছিল। আগমন ও বিলুপ্তির এই ধারাবাহিকতা থেকে বোঝা যায়, ক্রো-ম্যাগননরা তাদের অপেক্ষাকৃত উন্নত প্রযুক্তি, ভাষার দক্ষতা ও মস্তিষ্কের মাধ্যমে কোন না কোনভাবে নিয়ানডার্থালদের মাঝে মারণ রোগের সংক্রমণ ঘটিয়েছে, তাদের মেরে ফেলেছে অথবা তাদেরকে প্রতিস্থাপিত করেছে। এমনকি ক্রো-ম্যাগনন ও নিয়ানডার্থালদের মাঝে সংকরায়নের কোন প্রমাণ নেই বললেই চলে।
গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ডের সময় আমাদের পূর্বপুরুষরা আরেকটি বড় ধরণের ঔপনিবেশিক বিস্তৃতি শুরু করেছে। ইউরেশিয়ার পর এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ঔপনিবেশিক অভিযাত্রা। এই ঔপনিবেশিক বিস্তৃতি ঘটেছে নিউ গিনি ও অস্ট্রেলিয়াতে, সে সময় এ দুটি একসাথে যুক্ত থেকে একটিমাত্র মহাদেশ গঠন করে ছিল। তেজস্ক্রিয় কার্বনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের অনেকগুলো স্থানে পাওয়া জীবাশ্মের বয়স ৪০,০০০ থেকে ৩০,০০০ বছর বলে প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ, অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনিতে সে সময়ই প্রথম মানুষ পা রেখেছিল। এরও আগে সেখানে মানুষের উপস্থিতির কিছু দাবী আছে, কিন্তু সেগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। এই মহাদেশে প্রথম মানুষ আসার পর খুব দ্রুতই তারা সমগ্র মহাদেশ অধিকার করে নিয়েছে, এর পরিবেশের সাথে নিজেদের অভিযোজিত করে নিয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা নিউ গিনির ক্রান্তীয় বৃষ্টিপ্রধান বন ও উঁচু পর্বতমালা থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার শুষ্ক কেন্দ্রীয় অঞ্চল ও সিক্ত দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে বসতি স্থাপন করে ফেলেছে।
বরফ যুগের সময় মহাসাগরের অনেক পানি হিমবাহের মাঝে আটকা পড়ে যাওয়ায় সমুদ্রের পানির স্তর বর্তমানের তুলনায় কয়েক শত ফুট নিচে নেমে যায়। এর ফলে বর্তমান এশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা, বোর্নিও, জাভা ও বালি দ্বীপের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী অগভীর সমুদ্রটি শুষ্ক ভূমিতে পরিণত হয়। বেরিং প্রণালী ও ইংলিশ চ্যানেলের মত অগভীর প্রণালীগুলোও সে সময় জলশূন্য হয়ে পড়েছিল। তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূমির প্রান্তসীমা ছিল বর্তমানের তুলনায় আরও ৭০০ মাইল পূর্বে। বালি ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অবস্থিত ইন্দোনেশিয়ার কেন্দ্রীয় দ্বীপগুলো তখনও পানি দ্বারা বেষ্টিত ছিল। কারণ এদের চারদিকে অবস্থিত প্রণালীগুলো ছিল বেশ গভীর। এ কারণে এশিয়ার মূলভূমি থেকে অস্ট্রেলিয়া বা নিউ গিনিতে যেতে হলে তখনও অন্তত আটটি প্রণালী পার হতে হতো, এর মধ্যে সবচেয়ে প্রশস্তটির প্রস্থ ছিল অন্তত ৫০ মাইল। এই প্রণালীগুলো দ্বারা পৃথক হয়ে থাকা দ্বীপগুলোর একটি থেকে অন্যটি দেখা যেত। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিশাল দ্বীপ তখনও অদৃশ্য ছিল। অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে নিকটে অবস্থিত ইন্দোনেশীয় দ্বীপ তিমোর ও তানিমবার থেকেও অস্ট্রেলিয়া দেখা যেতো না। তাই সে সময় অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনি দখল করাকে এক বিশাল সফলতা হিসেবে আখ্যায়িত করতে হবে। কারণ এর জন্য তাদের নৌ-চালনার বিদ্যা আয়ত্ত করতে হয়েছিল। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মানুষ নৌকা চালাতে শিখেছে মাত্র ১৩,০০০ বছর পূর্বে। ৪০,০০০ বছর পূর্ব থেকে ১৩,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অন্য কোন মানুষই এই বিদ্যা আয়ত্ত করতে পারেনি।
প্রথমে জীবাশ্মবিদরা ধারণা করেছিলেন, অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনি আবিষ্কার সম্ভবত দুর্ঘটনার মাধ্যমে হয়েছে। ইন্দোনেশীয় দ্বীপে বসবাসকারী কিছু মানুষ হয়ত ভেলায় করে মাছ ধরার সময় দুর্ঘটনায় পতিত হয় এবং সমুদ্রে ভেসে ভেসে অস্ট্রেলিয়ার দিকে চলে যায়। এই মতের আরও চূড়ান্ত রূপে বিশ্বাসীরা তো মনে করেন, এ অঞ্চলে প্রথম উপনিবেশ স্থাপন করেছিল কেবল একজন গর্ভবতী নারী যার গর্ভে ছিল একটি ছেলে সন্তানের ফিটাস। কিন্তু এ ধরণের আকস্মিক উপনিবেশ তত্ত্বে বিশ্বাস স্থাপনকারীরা কিছু আধুনিক আবিষ্কার দেখে বিস্মিত হচ্ছেন। সম্প্রতি জানা গেছে নিউ গিনিতে উপনিবেশ স্থাপনের পরপরই অর্থাৎ আনুমানিক ৩৫,০০০ বছর আগে নিউ গিনির পূর্বে অবস্থিত দ্বীপগুলোতেও মানুষ বসতি স্থাপন করেছে। এই দ্বীপগুলোর মধ্যে আছে বিসমার্ক দ্বীপপুঞ্জের নিউ ব্রিটেন ও নিউ আয়ারল্যান্ড এবং সোলোমন দ্বীপপুঞ্জের বুকা। বুকা-কে এর পশ্চিম দিকে অবস্থিত সবচেয়ে কাছের দ্বীপ থেকেও দেখা যায় না। এখানে পৌঁছতে হলে অন্তত ১০০ কিলোমিটার প্রশস্ত সমুদ্র পেরোতে হয়। এ থেকে মনে হয়, অস্ট্রেলীয় ও নিউ গিনীয়রা সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবেই দৃশ্যমান দ্বীপগুলোতে নৌকা দিয়ে যাতায়াত করতো। অদৃশ্য দ্বীপগুলো সম্বন্ধে তারা জানতো না, কিন্তু তাদের নৌ-চালনাবিদ্যা এতোটাই সমৃদ্ধ ছিল যে অনিচ্ছাকৃতভাবে তারা সে পর্যন্ত চলে যেতো পারতো। এভাবেই অনেক দূরের আপাত অদৃশ্য দ্বীপগুলোতে তারা উপনিবেশ স্থাপন করেছে।
অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনিতে মানুষের বসতি স্থাপনের সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত যাকে মানুষের দ্বারা সংঘটিত প্রথম গণ-বিলুপ্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। তাই বলা যায়, প্রথম নৌ-চালনাবিদ্যা আয়ত্তকরণ এবং ইউরেশিয়ার পর প্রথম কোন মহাদেশে উপনিবেশ স্থাপনের পাশাপাশি এর মাধ্যমে মানুষ আরেকটি বিষয় প্রথমবারের মত ঘটিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির বৃহৎ আকৃতির প্রাণী প্রজাতিগুলো সম্ভবত মানুষের কারণেই বিলুপ্ত হয়েছে। বর্তমানে আমরা আফ্রিকাকে বড় স্তন্যপায়ীদের মহাদেশ বলে আখ্যায়িত করি। ইউরেশিয়াতেও বেশ কিছু বড় আকৃতির স্তন্যপায়ী দেখা যায় যদিও আফ্রিকার সেরেন্গেটি সমভূমির স্তন্যপায়ীদের তুলনায় তারা নগণ্য। এক্ষেত্রে এশিয়ার গণ্ডার, হাতি ও বাঘ এবং ইউরোপের চমরি গাই, ভালুক ও সিংহের (বর্তমানে সিংহ খুব বেশী নেই) নাম করা যায়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির দিকে লক্ষ্য করুন, সেখানে এ ধরণের কোন বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী নেই। প্রকৃতপক্ষে সেখানে ১০০ পাউন্ড ভরবিশিষ্ট ক্যাঙ্গারুর চেয়ে বড় কোন স্তন্যপায়ীই নেই। অথচ অনেক আগে অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনিতে বড় বড় স্তন্যপায়ী প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল। যেমন, বড় ক্যাঙ্গারু, ডাইপ্রোটোডন্ট নামে পরিচিত গণ্ডার আকৃতির মার্সুপিয়াল (আকারে প্রায় গরুর সমান) এবং এক প্রজাতির মার্সুপিয়াল চিতা বাঘ। এছাড়া এ অঞ্চলে ৪০০ পাউন্ড ভরবিশিষ্ট অস্ট্রিচের মত পাখি ছিল যারা উড়তে পারতো না। ছিল কিছু আকর্ষণীয় ও বিশাল সরীসৃপ; যেমন, এক টন ভরের টিকটিকি, বিশার আকারের অজগর সাপ এবং মাটিতে বসবাসকারী কুমির।
অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির মেগাফনা নামে পরিচিত সেই দানবদের কেউই আজ নেই। মানুষের আবির্ভাবের পরই তারা বিলুপ্ত হয়েছে। ঠিক কোন সময়ে তারা বিলুপ্ত হয়েছে এ নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার কিছু হাজার হাজার বছর বয়সী জীবাশ্মবিজ্ঞান গবেষণা স্থানে অনেক আগের প্রাণীদের হাড়ের প্রচুর অবশেষ পাওয়া গেছে। এগুলো খুব যত্নের সাথে উত্তোলন করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন, এ ধরণের বিশাল আকারের প্রাণীদের হাড়ের এমন কোন অবশেষ নেই যার বয়স ৩৫,০০০ বছরের কম। অর্থাৎ গত ৩৫,০০০ বছরে এদের কারও অস্তিত্বই ছিল না। এ থেকে বোঝা যায়, সম্ভবত মানুষ আসার পরই এই মেগাফনার বিলুপ্তি ঘটেছে।
মানুষের আবির্ভাবের সাথে বৃহৎ প্রজাতির বিলুপ্তির সময়ের এই মিল দেখে একটি প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক, কি কারণে এই বিলুপ্তি ঘটেছিল? একটি অবশ্যম্ভাবী উত্তর হচ্ছে, তারা নিশ্চয়ই মানুষের হাতে নিহত হয়েছে কিংবা মানুষের পরোক্ষ অংশগ্রহণে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে গেছে। এখানে আমাদের আবার মনে রাখতে হবে, অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনিতে মানব শিকারীরা আসার আগে কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে সেখানকার বড় বড় প্রাণীগুলো সঠিকভাবেই বিবর্তিত হচ্ছিল। আমরা এটাও জানি, গালাপাগোস ও অ্যান্টার্কটিকার পাখি ও স্তন্যপায়ীরা একেবারে আধুনিক যুগে এসে মানুষের দেখা পেয়েছে। মানুষের উপস্থিতি ছাড়াই তারা দীর্ঘদিন যাবৎ বিবর্তিত হয়ে আসছে। বর্তমানে তাদেরকে বেশ পোষ্য বলে মনে হয়। অথচ সংরক্ষণবাদীরা খুব দ্রুত প্রাণী সংরক্ষণের নীতিমালা প্রয়োগ না করলে এই প্রাণীগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যেতো। আধুনিক কালে আবিষ্কৃত অন্যান্য যে দ্বীপগুলোতে যথাসময়ে এ ধরণের সংরক্ষণ নীতি প্রয়োগ করা হয়নি সেখানে বিলুপ্তি ঘটেছে। মরিশাস দ্বীপের ডোডো এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ডোডোকে বর্তমানে বিলুপ্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। মহাসাগরের যে দ্বীপগুলোতে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালিত হয়েছে তার সবগুলোতেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে বিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে। মানুষেরা এই দ্বীপগুলোতে প্রথমবারের মত উপনিবেশ স্থাপনের পরপরই সেখানকার কিছু প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেমন নিউজিল্যান্ডের moas, মাদাগাস্কারের বিরাট আকৃতির লেমুর, হাওয়াইয়ের বিশালকায় রাজহংসী যারা উড়তে পারতো না। আধুনিককালে যেমন মানুষ মরিশাসে গিয়ে সেখানকার ডোডোদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, ঠিক তেমনিভাবেই হয়ত প্রাচীনকালে মানুষ নিউজিল্যান্ড বা মাদাগাস্কারে গিয়ে সেখানকার বড় প্রাণীগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল।
তাই অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির বড় স্তন্যপায়ীদের বিলুপ্তি বিষয়ক একটা প্রকল্প বলছে, ৪০,০০০ বছর পূর্বে মানব শিকারীদের আগমনের কারণে তাদের ভাগ্যে এই একই ঘটনা ঘটেছিল। অথচ আফ্রিকা ও ইউরেশিয়ার অধিকাংশ বড় বড় স্তন্যপায়ীই কিন্তু এখন পর্যন্ত টিকে আছে। এর কারণ সম্ভবত এই যে, তারা কয়েক শত হাজার বা মিলিয়ন বছর ধরে প্রাক-মানবদের সাথে একই সাথে বিবর্তিত হয়েছে। এভাবে মানুষকে ভয় পাওয়ার প্রবণতা গড়ে তোলার জন্য তারা যথেষ্ট সময় পেয়েছে, কারণ আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে সে সময় শিকারের তেমন ভাল কোন উপকরণ ছিল না। অন্যদিকে বর্তমানের ডোডো বা প্রগৈতিহাসিক কালে অস্ট্রেলিয়া, নিউ গিনি বা নিউজিল্যান্ডের বড় প্রাণীরা সে সুযোগটা পায়নি। তারা হঠাৎ করেই মানুষের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে, বিবর্তনের মাধ্যমে তারা কোনরকম প্রস্তুতি নিতে পারেনি। আর এ মানুষদের হাতে শিকারের বেশ উন্নত উপকরণ ছিল, তাদের দক্ষতাও ছিল বেশী।
অবশ্য অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনিতে মানুষের মাধ্যমে স্তন্যপায়ীদের মৃত্যুর এ প্রকল্পকেও চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। সমালোচকরা একটি বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সেটা হচ্ছে: এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির বিলুপ্ত প্রাণীগুলোর এমন কোন হাড় পাওয়া যায়নি যাতে মানুষ কর্তৃক হত্যার যথেষ্ট প্রমাণ আছে, এমনকি তারা মানুষের সাথে কিছুকাল হলেও একত্রে বাস করছে এমন কোন প্রমাণও পাওয়া যায়নি। যারা মানুষের মাধ্যমে তাদের বিলুপ্তির প্রকল্পকে সমর্থন করে তারা এই চ্যালেঞ্জের উত্তরে বলছে: বিলুপ্তির ঘটনাটা যদি খুব দ্রুত এবং অনেক কাল আগে সংঘটিত হয় তাহলে হত্যার স্থানগুলো খুঁজে পাওয়ার আশা করা ঠিক না, এই বিলুপ্তিগুলো কিন্তু সেরকমই; ৪০,০০০ বছর আগে ঘটে যাওয়া খুব দ্রুত বিলুপ্তি। সমালোচকরা এরও জবাব দিয়েছেন। তাদের বিরোধী প্রকল্পটি হচ্ছে: অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ সে সময় এমনিতেই শুষ্ক ছিল, তার উপর কোন ক্ষরার কারণে জলবায়ুতে যে বিশাল পরিবর্তন এসেছে তার কারণেই হয়ত প্রাণীগুলো মারা গেছে। এভাবে বিতর্ক চলছেই।
ব্যক্তিগতভাবে আমি এই ভেবে কোন কিনারা করতে পারিনি যে, মানুষের আগমনের আগে কয়েক মিলিয়ন বছরের অসংখ্য খরায় অস্ট্রেলিয়ার যে প্রাণীদের কিছু হয়নি তারা কেন মানুষের আগমনের ঠিক পরের খরাতেই একযোগে মৃত্যুবরণ করার সিদ্ধান্ত নেবে। এই অঞ্চলে প্রথম মানুষের আগমন ও এখানকার বড় বড় স্তন্যপায়ীদের মৃত্যুর ঘটনা দুটি কিন্তু এতোটাই সমকালিক। আর শুধু যে অস্ট্রেলিয়ার শুষ্ক মধ্যাঞ্চলের প্রাণীরাই বিলুপ্ত হয়েছে তা তো নয়, নিউ গিনি ও দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার সিক্ত অঞ্চলেও তো একই ঘটনা ঘটেছে। মরুভূমি থেকে শুরু করে শীতল বৃষ্টিপ্রবণ বনাঞ্চল বা ক্রান্তীয় বৃষ্টিপ্রবণ বন, সকল স্থানের বড় বড় স্তন্যপায়ীরাই বিলুপ্তির শিকার হয়েছে। এর কোন ব্যতিক্রম নেই। তাই মানুষই তাদের বিলুপ্তির কারণ, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত মনে হয়। হয় মানুষ সরাসরি তাদের হত্যা করেছে নয়তো আগুনের ব্যবহার ও সম্পূর্ণ নতুন আবাসন গড়ে তোলার কারণে পরিবেশে যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে তার কারণে তারা সবাই মারা গেছে। মানুষের দ্বারা মৃত্যু বা জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বিলুপ্তি, যে প্রকল্পই সত্য হোক না কেন, এই বিলুপ্তি যে পরবর্তীতে মানব ইতিহাসে বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছে এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই অঞ্চলের বড় বড় সব বন্য প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে যাদের অনেকে পরবর্তীতে মানুষের পোষও মানতে পারতো। অর্থাৎ গৃহপালিত হতে পারতো এমন জন্তুরাও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এ কারণেই, সমগ্র অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির অধিবাসীদের একটিও গৃহপালিত জন্তু ছিল না। এখানে অবশ্যই অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় জন্তুদের কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির স্থানীয় কোন জন্তুকে সেখানকার মানুষেরা গৃহপালিত করতে পারেনি।
এই বিলুপ্তির ঘটনা বিবেচনা করে বলা যায়, গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড শুরু হওয়ার পরই মানুষ অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনিতে উপনিবেশ স্থাপন করেছে। এর পরপরই মানুষ উপনিবেশ স্থাপনের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় অগ্রগতি অর্জন করেছে, তারা ইউরেশিয়ার শীতলতম অঞ্চলগুলোতে বসতি স্থাপন করতে শুরু করেছে। নিয়ানডার্থালরা হিমবাহের সময় সংগ্রাম করে টিকে থাকতে গিয়ে শীতল পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারা উত্তর জার্মানি ও কিয়েভ পার হয়ে আর উত্তরে যায়নি। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কারণ, নিয়ানডার্থলরা সুঁই, সেলাই করা কাপড়, উষ্ণ বাড়িঘর ও শীতলতম জলবায়ুতে বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে পারেনি। আধুনিক মানুষের মধ্যে যারা এই প্রযুক্তিগুলো আয়ত্ত করতে পেরেছিল তারাই আনুমানিক ২০,০০০ বছর পূর্বে সাইবেরিয়া অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করে। এর চেয়েও প্রাচীন কিছু দাবী অবশ্য রয়েছে। আমরা এই সময়কেই ধরে নিচ্ছি। সাইবেরিয়ায় মানুষের আগমনের কারণেই সম্ভবত সেখানকার পশমসমৃদ্ধ ম্যামথ ও গণ্ডার বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনিতে বসবাস শুরু করার মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীর পাঁচটি বাসযোগ্য মহাদেশের তিনটিতেই উপনিবেশ স্থাপন করে ফেলেছিল। (এই বইয়ে আমি এশিয়া ও ইউরোপকে একটিমাত্র মহাদেশ হিসেবে উল্লেখ করেছি যার নাম ইউরেশিয়া। আর অ্যান্টার্কটিকাকেও বাদ দিয়েছি। কারণ এই উনবিংশ শতকের পূর্বে কেউ সেখানে যেতে পারেনি এবং সেখানে কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানব উপনিবেশ স্থাপন সম্ভবও হয়নি) তার মানে আমাদের কেবল দুটি মহাদেশ বাকি রইল, উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা। এই মহাদেশ দুটিতে মানুষ অবশ্যই সবশেষে এসেছিল। কারণ খুবই স্বাভাবিক, মহাসাগর পেরিয়ে এগুলোতে যেতে হলে নৌচালনা জানা থাকার দরকার ছিল (স্বয়ং ইন্দোনেশিয়াতেও ৪০,০০০ বছর পূর্বের আগে যার কোন অস্তিত্ব ছিল না, আর ইউরোপে তো আরও অনেক পরেও এই প্রযুক্তি মানুষের হাতে আসেনি), আবার বেরিং ভূ-সেতু পেরিয়ে সেখানে যেতে হলে সাইবেরিয়া অধিকার করার প্রয়োজন ছিল (যা কেবল ২০,০০০ বছর পূর্বে সম্ভব হয়েছে)। কিন্তু, ৩৫,০০০ বছর পূর্ব থেকে শুরু করে ১৪,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ঠিক কখন মানুষ আমরিকাতে উপনিবেশ স্থাপন করেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আমেরিকা মহাদেশে পাওয়া মানুষের প্রাচীনতম জীবাশ্মের বয়স ১৪,০০০ বছর, আলাস্কার কয়েকটি স্থানে এগুলো পাওয়া গেছে। আর কানাডীয় সীমান্তের দক্ষিণে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আরও অনেকগুলো স্থান থেকে পাওয়া জীবাশ্মের বয়স ১৩,০০০ বছর। মেক্সিকোতেও খ্রিস্টপূর্ব ১১,০০০ অব্দের কিছু জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। নিউ মেক্সিকোর ক্লভিসের যে স্থানগুলোতে সে সময়ের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে সেগুলোকে ক্লভিস স্থান বলা হয়। বড় বড় পাথর কেটে তৈরী বর্শার তীক্ষ্ণ ফলা এখানকার জীবাশ্মগুলোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আমরা এ পর্যন্ত কয়েক শত ক্লভিস স্থানের সন্ধান পেয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নাঞ্চলের ৪৮টি অঙ্গরাজ্যের সবগুলোতেই এগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এরা মেক্সিকো পর্যন্ত বিস্তৃত। উত্তর আমেরিকার পর সমগ্র আমেরিকা মহাদেশে প্রাচীনতম মানব বসতির পরবর্তী প্রমাণ পাওয়া গেছে আমাজোনিয়া ও পাতাগোনিয়াতে। উত্তর আমেরিকায় বসতি স্থাপনের পরপরই মানুষ এখানে এসেছিল। এসব তথ্য থেকে বোঝা যায়, ক্লভিস স্থানগুলোই ছিল আমেরিকায় মানুষের প্রথম উপনিবেশ। পরবর্তীতে এই স্থানের মানুষেরাই খুব দ্রুত বর্ধিত হতে থাকে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই উত্তর ও দক্ষিণ মহাদেশ অধিকার করে নেয়।
একটা প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে প্রথমে অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। প্রশ্নটা হল: ক্লভিসে বসবাসকারী মানুষের উত্তরপুরুষেরা মাত্র এক হাজার বছরের মধ্যে কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সীমান্তের ৮,০০০ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত পাতাগোনিয়াতে পৌঁছুলো? কিন্তু গড় করলে এটা স্বাভাবিকই মনে হয়। হিসাব থেকে দেখা যায় তাদের বছর প্রতি উপনিবেশ বৃদ্ধির হার মাত্র ৮ মাইল। অর্থাৎ প্রতি বছর তাদের উপনিবেশের এলাকা ৮ মাইল করে বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি সাধারণ শিকারী-সংগ্রাহক সমাজের লোকেরা প্রতিদিন খাদ্যের সন্ধানে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করে তার মাধ্যমেই বছরে ৮ মাইল নতুন এলাকা অধিকার করে নেয়া সম্ভব। এর জন্য অতিরিক্ত প্রয়াসের কোন প্রয়োজনও পড়ে না।
অনেকে এটা ভেবেও বিস্মিত হতে পারেন যে, আমেরিকার অধিবাসীরা সংখ্যায় খুব দ্রুত বেড়ে যাওয়ার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই আরও দক্ষিণে পাতাগোনিয়ার দিকে যাবার ব্যাপারে মনস্থির করে। কিন্তু কেউ যখন সেই অধিবাসীদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে ভাববেন তখন এই দ্রুত বংশবৃদ্ধিও তার কাছে তেমন বিস্ময়কর লাগবে না। যদি সে সময়ের শিকারী-সংগ্রাহকদের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ মাইলে ১ জন ধরে নেই (যা আধুনিক শিকারী-সংগ্রাহকদের জন্য বেশ বড় সংখ্যা), তাহলে সমগ্র আমেরিকায় সর্বোচ্চ ১০ মিলিয়ন শিকারী-সংগ্রাহক মানুষ থাকতে পারতো। কিন্তু প্রথম যে দলটি আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে তাতে লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ১০০ এবং তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল বছরে শতকরা ১.১। এভাবে বাড়তে থাকলে মাত্র ১,০০০ বছরের মধ্যে তাদের লোকসংখ্যা বেড়ে ১০ মিলিয়ন হয়ে যেতে পারে। আর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বছরে ১.১% হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক। কারণ, এই আধুনিক কালেও দেখা গেছে মানুষ যখন সম্পূর্ণ নতুন ও অব্যবহৃত কোন দ্বীপে যায় তখন সেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৩.৪% হতে পারে। এইচএমএস বাউন্টির বিদ্রোহীরা তাদের তাহিতীয় স্ত্রীদের নিয়ে যখন পিটকেয়ার্নস আইল্যান্ডে গিয়ে উঠেছিল তখন এরকম ঘটনাই ঘটেছিল।
শিকারী মানুষের জীবাশ্মপূর্ণ ক্লভিস স্থানের সংখ্যা অনেক। এই অতিপ্রাচুর্য আমাদেরকে অধুনা আবিষ্কৃত নিউজিল্যান্ডের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নিউজিল্যান্ডে মাউরি জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের জীবাশ্ম একইসাথে অনেকগুলো স্থানে পাওয়া গেছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া-নিউ গিনি এবং ইউরোপের বেশ কিছু স্থানেও এরকম অতিপ্রাচুর্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। অবশ্য এই উপনিবেশগুলোর বয়স আমেরিকার তুলনায় অনেক বেশী। বিশ্বজুড়ে শিকারী-সংগ্রাহক স্থানের এই অতিপ্রাচুর্য আমাদের বলে দিচ্ছে, ক্লভিস স্থানগুলোতে মানুষের দ্রুত বংশবৃদ্ধি ও ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি মোটেও অস্বাভাবিক নয়। বিশ্বের অন্যান্য অব্যবহৃত দ্বীপ অধিকার করার পরও একই ঘটনা ঘটেছিল।
এবারে সময়ের কথায় আসা যাক। ক্লভিস স্থানগুলোতে মানুষ হঠাৎ ১১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দেই বসবাস শুরু করলো কেন, এর আগে অর্থাৎ ১৬,০০০ বা ২১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কেন এমনটি ঘটেনি? এক্ষেত্রে আমাদের সাইবেরিয়ার শীতলতা ও কানাডার বরফের কথা মাথায় রাখতে হবে। সাইবেরিয়া সবসময়ই খুব ঠাণ্ডা ছিল, আর প্লাইস্টোসিন যুগের অধিকাংশ সময়ই কানাডার পুরো অঞ্চলটা বিশাল বিশাল বরফের চাইয়ে আবৃত ছিল। তাই কানাডা অতিক্রম করা একরকম অসম্ভবই ছিল। আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি, ৪০,০০০ বছর পূর্বে ইউরোপে উপনিবেশ স্থাপনের পূর্বে মানুষের কাছে তীব্র শীতে টিকে থাকার মত প্রযুক্তি ছিল না এবং ২০,০০০ বছর পূর্বেই কেবল মানুষ সাইবেরিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন শুরু করেছে। এভাবেই একসময় সাইবেরিয়ার অধিবাসীরা নৌকায় চড়ে বেরিং প্রণালী পাড়ি দিয়ে (এখনও এই অঞ্চল দুটির মধ্যে দূরত্ব মাত্র ৫০ মাইল) আলাস্কায় পৌঁছেছে বা হিমবাহের সময় যখন বেরিং প্রণালী ভূ-সেতুতে পরিণত হয়েছে তখন পায়ে হেটে এই দূরত্ব অতিক্রম করেছে। প্রায় ১,০০০ বছর ধরে বেরিং ভূ-সেতুর অস্তিত্ব ছিল এবং সে সময়ের এর প্রস্থ ছিল সর্বোচ্চ ১,০০০ মাইল। এই পুরো সেতু মুক্ত তুন্দ্রা দ্বারা আবৃত ছিল। শীতল পরিবেশে বাস করার যোগ্যতা অর্জনকারী মানুষের পক্ষে এখান দিয়ে অতিক্রম করাটা খুব কঠিন ছিল না। আনুমানিক ১৪,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সমুদ্রতলের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে এই বিশাল ভূ-সেতু আবার পানির নিচে তলিয়ে যায়। আদি সাইবেরীয়রা পায়ে হেটে বা নৌকো দিয়ে যেভাবেই আলাস্কায় পৌঁছাক, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে ১২,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দেই আলাস্কায় প্রথম মানুষের পা পড়েছে। আলাস্কার জীবাশ্মের বয়স গণনা করে এমনটিই জানা গেছে।
এর পরপরই কানাডার উত্তর-দক্ষিণ বরাবর একটি বরফমুক্ত পথ তৈরী হয়ে যায়। কানাডীয় বরফের চাইয়ের মধ্যে এই পথ ছিল মানুষের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এর মাধ্যমেই আলাস্কার অধিবাসীদের কেউ কেউ প্রথমবারের মত কানাডার বুক চিরে যাত্রা করে এবং গ্রেট প্লেইন্সে এসে পৌঁছায়, আধুনিক কানাডীয় শহর এডমন্টন এখানেই অবস্থিত। এভাবে আধুনিক মানুষ পাতাগোনিয়া ও আলাস্কার মধ্যে শেষ বড় বাঁধাটিও অতিক্রম করে। এডমন্টনে বসতি স্থাপনকারীরা সম্ভবত এখানে অফুরন্ত সম্ভাবনার দেখা পেয়েছিল। এই সম্ভাবনার দেশেই তারা প্রভূত সমৃদ্ধি অর্জন করে, সংখ্যায় অনেক বেড়ে যায় এবং ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে যেতে থাকে। এভাবেই একসময় সমগ্র গোলার্ধটি দখল করে নেয়।
ক্লভিস স্থানগুলো আমাদের আরেকটি বিষয়ে আশ্বস্ত করেছে। কানাডার বরফঘেরা সমভূমির দক্ষিণে মানুষের প্রথম উপস্থিতির সময়কালের সাথে এটা মিলে গেছে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির মত আমেরিকাও বড় বড় স্তন্যপায়ীতে পরিপূর্ণ ছিল। বর্তমানে আফ্রিকার সেরেন্গেটি সমভূমিকে যেমন দেখায়, আজ থেকে প্রায় ১৫,০০০ বছর আগে আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলকেও তেমন দেখাতো। হাতির পাল, চিতা আর সিংহের তাড়া খেয়ে পলায়মান ঘোড়ার দল, উটের বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত কয়েকটি প্রজাতি, সাথে স্থলচারী স্লথ, সব মিলিয়ে প্রাচুর্যময় ছিল সে দিনগুলো। কিন্তু এখানেও অস্ট্রেলিয়া আর নিউ গিনির মত কাহিনী ঘটেছিলো। অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। দুই ঘটনার মধ্যে কেবল সময়ের পার্থক্য ছিল। অস্ট্রেলিয়া আর নিউ গিনির বিলুপ্তির ঘটনা যেখানে ৩০,০০০ বছর আগের সেখানে আমেরিকায় বিলুপ্তির ঘটনা ১৭,০০০ থেকে ১২,০০০ বছর আগের। আমেরিকায় বিলুপ্ত স্তন্যপায়ীদের প্রচুর জীবাশ্ম উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এই জীবাশ্মগুলোর বয়স নির্ণয়ের মাধ্যমে জানা গেছে, বিলুপ্তির ঘটনাটা আনুমানিক ১১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। যে দুটি প্রজাতির বিলুপ্তির সময়কাল সবচেয়ে ভালোভাবে জানা গেছে সে দুটি হচ্ছে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের শ্যাস্টা অঞ্চলের স্লথ আর হ্যারিংটন পর্বতমালার ছাগল। ১১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু করে এক বা দুই শত বছরের মধ্যে এই দুই প্রজাতির সব প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। কাকতাল বা স্বাভাবিক যা-ই বলি না কেন, বিলুপ্তির এই সময় ক্লভিস অঞ্চলের শিকারী মানুষদের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে প্রবেশের সময়ের সাথে প্রায় মিলে যায়।
ম্যামথদের অসংখ্য কঙ্কালের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এই জীবাশ্মগুলোর পাঁজরের মাঝখানে ক্লভিস শিকারীদের ব্যবহার করা বর্শার অগ্রভাগ পাওয়া গেছে। এর থেকেও বোঝা যায়, মানুষের আগমন ও স্তন্যপায়ীদের বিলুপ্তির এই সমকালীনতা নিছক কাকতালীয় ঘটনা নয়। সে সময় শিকারীরা দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করেছিলো। পথে তাদের সাথে এমন অনেক প্রাণীর দেখা হয় যারা আগে কখনও মানুষ দেখেনি। এই প্রাণীগুলোকে সম্ভবত শিকারীরা সহজে শিকার করতে পেরেছিলো। এই শিকারের কারণেই হয়তো তারা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। অবশ্য এই বিলুপ্তি নিয়ে আরেকটা তত্ত্ব আছে। এই তত্ত্বে বলা হচ্ছে, শেষ বরফ যুগের সময় জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে না পেরে আমেরিকার বড় বড় স্তন্যপায়ীগুলো বিলুপ্ত হয়েছিলো। শেষ বরফ যুগও কিন্তু ১১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ঘটনা। এসব কারণে আধুনিক জীবাশ্মবিদদের ব্যাখ্যা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি সেই একই কারণে আমেরিকার বড় বড় স্তন্যপায়ী বিলুপ্তির জলবায়ুগত ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারি না, যে কারণে অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির প্রাণীদের বিলুপ্তির ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারিনি। এর আগেও কিন্তু ২২টি বরফ যুগ এসেছিলো। তার প্রতিটির সাথে মোকাবেলা করে এসে আমেরিকার সব স্তন্যপায়ীরা কেন ২৩ নম্বর বরফ যুগের শেষের সময়টাকেই পটল তোলার উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেবে? আপাত নিরীহ মানুষেরা এসেছিলো বলেই কি ২৩ নম্বর বরফ যুগে সবাই এভাবে সরে দাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো? মনে হয় না। তাছাড়া, তারা সব স্থান থেকেই একসাথে বিলুপ্ত হয়ে গেলো কেন? উল্লেখ্য শেষ বরফ যুগের শেষের দিকে যে স্থানগুলোতে বসতি বিকশিত হচ্ছিলো আর যেগুলোতে বসতি সংকুচিত হয়ে পড়ছিলো তার সবগুলো থেকেই স্তন্যপায়ীরা উধাও হয়ে যায়। এসব দেখে আমার মনে হয়, স্তন্যপায়ীদের বিলুপ্তির জন্য ক্লভিস শিকারীরাই দায়ী। অবশ্য এ নিয়ে বিতর্ক চলছেই। যে তত্ত্বই সত্য হোক এ নিয়ে কোন সংশয় নেই যে, স্তন্যপায়ীদের যে প্রজাতিগুলো পরবর্তীতে মানুষের পোষ্য হতে পারতো তারা সবাই একসাথে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো সেই বরফ যুগের শেষ দিকে।
আরেকটা প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এখনও সংশয় আছে। প্রশ্নটা হলো, ক্লভিস শিকারীরাই কি আমেরিকার প্রথম অধিবাসী? একটা বিষয় সব সময়ই ঘটে, কেউ কোন কিছুকে প্রথম বলে সাব্যস্ত করলে সবাই এর চেয়েও প্রাচীন কোন দলীল উদ্ঘাটনের কাজে লেগে যান। এক্ষেত্রেও আমেরিকায় প্রাক-ক্লভিস স্থানের অনুসন্ধান চলছে জোড়েশোড়ে। প্রতি বছরই এই গবেষণাগুলো থেকে কিছু দাবী উঠে আসে। এই দাবীগুলোর অধিকাংশকেই প্রথম প্রকাশের সময় খুব সত্যি মনে হয়। কিন্তু তখনই ব্যাখ্যার সমস্যা এসে হাজির হয়। প্রশ্ন করা হয়, সে স্থানে পাওয়া হতিয়ারগুলো কি আসলেই মানুষের তৈরী নাকি সেগুলো নিছক বিভিন্ন আকৃতির প্রাকৃতিক পাথর? তেজস্ক্রিয় কার্বন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে যে বয়স নির্ণয় করা হয়েছে তা কি সম্পূর্ণ সঠিক? তেজস্ক্রিয়-কার্বন ডেটিংয়ের যে অসংখ্য সমস্যা আছে তার কোনটি দ্বারাই কি এটা আক্রান্ত নয়? বয়স যদি আসলেই সঠিক হয়, তাহলে প্রশ্ন আসে, এগুলোর সাথে মানুষের তৈরী জিনিসপত্রের কি আসলেই কোন সম্পর্ক আছে? নাকি মাত্র ৯,০০০ বছর আগে মানুষের হাতে নির্মীত কোন পাথরের হাতিয়ারের পাশে পড়ে থাকা কোন ১৫,০০০ বছর বয়সী কয়লার টুকরা পরীক্ষা করে আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি?
এই সমস্যাগুলোর স্বরূপ বোঝানোর জন্য একটা প্রাক-ক্লভিস স্থান খুঁজে পাওয়ার দাবীর উদাহরণ দেয়া যাক। এমন একটা উদাহরণ যা হরহামেশাই ব্যবহৃত হয়। “পেদ্রো ফুরাদা” নামে ব্রাজিলের এক পাথরের আশ্রয়স্থলে জীবাশ্মবিদরা এমন কিছু গুহাচিত্র পেয়েছেন যেগুলো নিঃসন্দেহে মানুষের হাতে আঁকা। এছাড়া সে স্থানের একটি খাড়া পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল পাথরের স্তূপের মধ্যে এমন কিছু পাথর পাওয়া গেছে যেগুলোকে অশোধিত হাতিয়ার বলে মনে হয়। পাশাপাশি সেখানে পুড়ে যাওয়া কাঠ-কয়লার জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। তেজস্ক্রিয়-কার্বন পদ্ধতিতে এই কয়লার বয়স নির্ণয় করা হয়েছে। বয়স পাওয়া গেছে ৩৫,০০০ বছর। পেদ্রো ফুরাদার এতো শত চমকপ্রদ তথ্য নিয়ে যে গবেষণাপত্র লেখা হয়েছিলো তা “নেচার” এর মতো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সবাই একে বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়েছে।
কিন্তু সেখানকার খাড়া পাহাড়ের পাদদেশে যে তথাকথিত অশোধিত হাতিয়ার পাওয়া গেছে তা যে মানুষেরই তৈরী, সেটা স্পষ্ট করে বলা যায় না। ক্লভিস অঞ্চলের হাতিয়ার বা ক্রো-ম্যাগননদের অশোধিত হাতিয়ার নিয়ে কিন্তু এ ধরণের কোন সংশয় নেই। প্রাকৃতিকভাবেও এমন অশোধিত হাতিয়ার আকৃতির পাথর গঠিত হতে পারে। হাজার হাজার বছর ধরে খাড়া পাহাড়ের উপর থেকে হাজার হজার পাথর গড়িয়ে পড়ছে, এর মধ্যে অনেকগুলোই নিচের শক্ত পাথরগুলোর সাথে লেগে ভেঙে যাচ্ছে। এই ভেঙে যাওয়া পাথরগুলোর মধ্যে মানুষের হাতে তৈরী অশোধিত হাতিয়ারের মতো গড়ন তৈরী হওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক না। পশ্চিম ইউরোপ বা আমাজোনিয়ার মত অন্যান্য স্থানের ক্ষেত্রে জীবাশ্মবিদরা গুহাচিত্র অংকনে ব্যবহৃত সত্যিকারের কণাগুলোর বয়স নির্ণয় করেছিলেন। কিন্তু পেদ্রো ফুরাদার ক্ষেত্রে এরকম কিছু করা হয়নি। পেদ্রো ফুরাদা ও আশপাশের বনাঞ্চলে মাঝেমধ্যেই আগুন লেগে যায়। এই আগুনে বিপুল পরিমাণ কাঠ-কয়লা উৎপাদিত হয় এবং বাতাসের তোড়ে এরা উড়ে গিয়ে গুহার ভিতর জমা হয়। একেই আমরা গুহাবাসীদের জ্বালানি ভেবে ভুল করি। পেদ্রো ফুরাদায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত গুহাচিত্রের সাথে ৩৫,০০০ বছর আগের কাঠ-কয়লার কোন সম্পর্কই স্থাপন করা যায়নি। পেদ্রো ফুরাদা যারা খনন করেছিলেন তারা তাদের সেই পুরনো দাবী নিয়ে এখনও বসে আছেন। সেই খননের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন না, কিন্তু প্রাক-ক্লভিস স্থান খুঁজে পাওয়া ব্যাপারে আগ্রহী এমন একদল গবেষক সম্প্রতি পেদ্রো ফুরাদা থেকে ঘুরে এসেছেন। তাদের কাছেও এ দাবীকে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।
উত্তর আমেরিকায় বর্তমানে প্রাক-ক্লভিস স্থান হিসেবে যেটাকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে তা হলো পেনসিলভ্যানিয়ার মিডোক্রফ্ট (meadowcroft) এর পাথুরে আশ্রয়স্থল। অবশ্য এটা পুরো প্রমাণিত না। এই স্থানে মানুষের সাথে সম্পর্কিত কিছু জিনিসের বয়স পাওয়া গেছে ১৬,০০০ বছর। মিডোক্রফ্টে খননের মাধ্যমে যে মানুষের ব্যবহৃত অনেক উপকরণ পাওয়া গেছে, এ ব্যাপারে কোন জীবাশ্মবিদের মনেই দ্বিধা নেই। কিন্তু তেজস্ক্রিয়-কার্বন পদ্ধতিতে নির্ণেয় বয়সের কোন অর্থ করা যাচ্ছে না। কারণ এই উপকরণের সাথে কোন না কোনভাবে সম্পর্কিত প্রাণী বা উদ্ভিদ প্রজাতিগুলো কিন্তু আধুনিক পেনসিলভ্যানিয়ার মৃদু জলবায়ুতে বাস করে। আজ থেকে ১৬,০০০ বছর আগের তুষারযুগে এদের থাকবার কথা নয়। তাই অনেকে সন্দেহ করতেই পারেন, এখানে ১৬,০০০ বছর আগের যে কাঠ-কয়লার নমুনা পাওয়া গেছে তা আসলে ১৬,০০০ বছর আগের মানুষের হাতে তৈরী হয়নি। বরং ক্লভিস থেকে আসা মানুষের হাতে তৈরী কাঠ-কয়লার মধ্যে পুরাতন কাঠ-কয়লার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। দুইয়ে মিলে আজকের এই নমুনা গঠন করেছে। এবার দক্ষিণ আমেরিকার কথায় আসা যাক। দক্ষিণ আমেরিকায় প্রাক-ক্লভিস স্থান হিসেবে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে আছে চিলির “Monte Verde“। দাবী করা হয়েছে, এখানে অন্তত ১৫,০০০ বছর আগে মানুষের উপস্থিতি ছিল। অনেক জীবাশ্মবিদই এটা নিয়ে আশাবাদী। কিন্তু আগে যেভাবে হতাশ হতে হয়েছে তাতে সবাইকে আরেকবার সতর্ক করে দিতেই হচ্ছে।
আমেরিকার অন্য কোন স্থানে যদি ক্লভিসেরও আগে মানুষ থেকে থাকে, তাহলে সেট প্রমাণ করা এতো কঠিন হয়ে যাচ্ছে কেন? জীবাশ্মবিদরা আমেরিকায় এমন কয়েক’শ স্থান খনন করেছেন যেগুলোতে মানব বসতির বয়স ২০০০ থেকে ১১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। এগুলো নিয়ে কোন সন্দেহও নেই। এই স্থানগুলোর মধ্যে আছে উত্তর আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে কয়েক ডজন ক্লভিস অঞ্চল, অ্যাপালেশিয়ানের পাথুরে আশ্রয়স্থল এবং ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলের মানব বসতিগুলো। এই সবগুলো স্থানেই একটা নির্দিষ্ট স্তরের পর আর কোন মানব জীবাশ্ম পাওয়া যায়নি। এই নির্দিষ্ট স্তরের পরেও জীবাশ্মবিদরা খননকাজ চালিয়ে গেছেন। কিন্তু সেখানে কেবল প্রাচীন প্রাণীদের জীবাশ্মই পাওয়া গেছে, কোন মানব জীবাশ্মের দেখা মেলেনি। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, আমেরিকায় প্রাক-ক্লভিস স্থানের প্রমাণ অত্যন্ত দুর্বল। সে তুলনায় ইউরোপে প্রাক-ক্লভিস মানুষের অস্তিত্বের প্রমাণ অনেক অনেক জোড়ালো। আমেরিকার ক্লভিসে ১১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের যে সময়ে মানব বসতির সূচনা ঘটেছে তারও অনেক অনেক আগে থেকে মানুষ ইউরোপে বাস করে আসছে। ইউরোপের গুলোর প্রমাণ পাওয়া গেলে আমেরিকার প্রাক-ক্লভিসদের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না কেন? তাছাড়া অস্ট্রেলিয়া ও পাপুয়া নিউ গিনিতে তো জীবাশ্মবিদের সংখ্যা আমেরিকার প্রায় এক দশমাংশ। এই গুটিকতক জীবাশ্মবিদ মিলেই তো ৩০-৪০ হাজার বছর আগের মানব জীবাশ্মের সন্ধান পেয়ে গেছেন। আমেরিকার এতো বিজ্ঞানী মিলে সেটা পারছেন না কেন?
আদি মানবেরা নিশ্চয়ই মাঝের বিশাল এলাকা ফাঁকি দিয়ে হেলিকপ্টারে চড়ে আলাস্কা থেকে মিডোক্রফ্ট বা Monte Verde তে চলে যায়নি! প্রাক-ক্লভিসের সমর্থকেরা বলেন, ক্লভিসে আসা প্রথম মানুষেরা নাকি খুব ধীরে ধীরে বংশবিস্তার করেছে, প্রথম কয়েক হাজার বছর নাকি তাদের ঘনত্ব এতোই কম ছিলো যে জীবাশ্মবিদদের চোখে তা ঠিকমতো ধরাই পড়ে না। অথচ পৃথিবীর অন্য কোন স্থানের ক্ষেত্রে কিন্তু এমনটি ঘটেনি। এই প্রস্তাবনা আমার কাছে হেলিকপ্টারে চড়ে মিডোক্রফ্ট বা Monte Verde চলে যাওয়ার থেকেও অবাস্তব মনে হয়। সুতরাং মিডোক্রফ্ট বা Monte Verde তে আরও আগে মানুষ ছিল, এই প্রস্তাব পুনরায় উত্থাপন করাও এর থেকে ভালো। আমার কথা হচ্ছে, আমেরিকায় যদি ক্লভিসের আগেই মানুষ থেকে থাকে তাহলে এতোদিনে অনেক স্থানেই তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়ে যাবার কথা ছিলো। অথচ এ প্রশ্নে জীবাশ্মবিদেরা আগের মতই বিভক্ত হয়ে আছেন।
যে প্রস্তাবনাই সত্য হোক, আমেরিকার প্রাক-ইতিহাসের পরবর্তী অধ্যায়টা কিন্তু একই থেকে যাবে। হয় ১১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মানুষ প্রথম আমেরিকায় এসেছিলো এবং খুব দ্রুত সমগ্র মহাদেশটা অধিকার করে নিয়েছিলো। নয়তো এ অঞ্চলে মানুষের প্রথম উপনিবেশ আরও আগে (অধিকাংশই ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ বছর আগের কথা বলেন, কেউ কেউ বলেন ৩০,০০০ বছর আগের কথা; আর সুস্থ মস্তিষ্কে খুব কম বিজ্ঞানীই এর চেয়ে প্রাচীন দাবী উত্থাপন করেন) স্থাপিত হয়েছিলো; কিন্তু সেই প্রাক-ক্লভিস উপনিবেশ স্থাপনকারীরা সংখ্যায় কম ছিলো এং ১১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে তাদের খুব বেশী বিকাশও ঘটেনি। যেটাই মেনে নেই না কেন, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, পাঁচটি মহাদেশের মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মানুষের প্রাক-ইতিহাসই সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত।
আমেরিকায় উপনিবেশের পর একটা বড় মাইলফলক অতিক্রান্ত হলো। মহাদেশগুলোর অধিকাংশ বাসযোগ্য এলাকা, বাসযোগ্য দ্বীপ এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে নিউ গিনির পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় সবগুলো মহাসাগরীয় দ্বীপে মানব বসতি স্থাপিত হলো। পৃথিবীর যে দ্বীপগুলো তখন পরিত্যক্ত ছিলো সেগুলোতে কিন্তু এই আধুনিক যুগের আগে মানুষ বসবাস শুরু করতে পারেনি। যেমন: ক্রিট, সাইপ্রাস, কর্সিকা এবং সার্ডিনিয়ার মতো ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপগুলোতে মানুষ বসবাস শুরু করেছে ৮৫০০ থেকে ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে; ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে মানব বসতি শুরু হয়েছে ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে; পলিনেশীয় ও মাইক্রোনেশীয় দ্বীপগুলোতে ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝে; মাদাগাস্কারে ৩০০ থেকে ৮০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে এবং আইসল্যান্ডে এই নবম শতাব্দীতে মানুষের পা পড়েছে। আমেরিকার আদিবাসীরা (সম্ভবত আধুনিক ইনুইটদের পূর্বপুরুষেরা) ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই হাই আর্কটিকের পুরো এলাকায় বসতি স্থাপন করে ফেলেছিলো। এর ফলে সে সময় আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরের দূরবর্তী দ্বীপ এবং অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর বাকি সব জায়গাতেই মানুষ ছড়িয়ে পড়েছিলো। গত ৭০০ বছরে ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা এসব দ্বীপই চষে বেরিয়েছেন। ভাবখানা এমন যেন, আদ্যিকালের মানুষেরা আধুনিক ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের জন্যই স্থানগুলো পতিত রেখে দিয়েছিলো।
পরবর্তী ইতিহাস রচনায় বিভিন্ন মহাদেশে বিভিন্ন সময়ে মানুষের উপনিবেশ স্থাপনের কি কোন প্রভাব ছিল? থাকলে সেই প্রভাবগুলো কি? ধরুন, একজন জীবাশ্মবিদ টাইম মেশিনের মাধ্যমে অতীতে যাওয়ার সুযোগ লাভ করলেন, তিনি ১১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পৃথিবীতে গিয়ে ভ্রমণে বেরুলেন। সেই সময়ে তিনি কি ভবিষ্যৎবাণী করতে পারতেন, পৃথিবীর কোন মহাদেশের মানুষেরা কখন বন্দুক, জীবাণু আর ইস্পাতের অধিকারী হবে? তিনি কি ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ইতিহাসের ধারা সম্পর্কে কিছু বলতে পারতেন, বর্তমানে পৃথিবীর কি অবস্থা হবে দূরদৃষ্টির মাধ্যমে তা উপলব্ধি করতে পারতেন?
আমাদের এই জীবাশ্মবিদ হেড স্টার্টের বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবে থাকবেন। সেদিক থেকে চিন্তা করলে কিন্তু আফ্রিকার বিশাল সুযোগ ছিল। প্রথমেই আফ্রিকা অনেক এগিয়ে ছিল। প্রায় ৫ মিলিয়ন বছর ধরে কেবল আফ্রিকাতেই প্রাক-মানবেরা বিকশিত হয়েছে। অন্য কোথাও কোন মানুষ ছিল না। আর যদি ধরে নেই, আজ থেকে ১০০,০০০ বছর পূর্বে কেবল আফ্রিকাতেই আধুনিক মানুষের উৎপত্তি ঘটেছে তাহলে তো বলতে হয়, আফ্রিকার কাছে অন্য কোন মহাদেশের পাত্তাই ছিল না। আফ্রিকা একটা বিশুদ্ধ হেড স্টার্ট দিতে পেরেছিলো। তার উপর মানব জিনের বৈচিত্র্য আফ্রিকাতেই সবচেয়ে বেশী। বিচিত্র সব মানুষ মিলে বিচিত্র সব উদ্ভাবন করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। সে হিসেবে আফ্রিকাতেই তো উদ্ভাবনের বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশী হওয়ার কথা।
কিন্তু তখনই হয়তো আমাদের জীবাশ্মবিদ বুঝতে পারবেন: এই বইয়ের জন্য “হেড স্টার্ট” বলতে আসলে কি বোঝায়? আমরা মানুষের পদচিহ্নকে আক্ষরিক অর্থে হেড স্টার্টের পরিমাপক হিসেবে ধরে নিতে পারি না। হেড স্টার্ট দ্বারা যদি আপনি কোন মহাদেশে মানুষের প্রথম আগমনের পর পুরো মহাদেশে তাদের ছড়িয়ে পরার জন্য প্রয়োজনীয় সময়কে বোঝান তাহলে বলতে হয়, সময়টা খুব বড় না। উদাহরণস্বরূপ, একটা সম্পূর্ণ নতুন বিশ্বকে মানুষে মানুষে ভরিয়ে তুলতে ১,০০০ বছরের বেশী সময় লাগে না। আর যদি হেড স্টার্ট বলতে আপনি কোন নতুন পরিবেশে সম্পূর্ণ অভিযোজিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সময়কে বোঝান তাহলে বলি, কিছু কিছু প্রতিকূল পরিবেশের ক্ষেত্রে এই সময়টা বেশ দীর্ঘ। যেমন, উত্তর আমেরিকার বাকি পুরোটা দখল করে নেয়ার পরও হাই আর্কটিক অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করতে ৯,০০০ বছর লেগেছে। কিন্তু পরবর্তীতে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে অভিযোজিত হওয়ার জন্য মানুষের এতো সময় লাগেনি। কারণ তখন নব নব উদ্ভাবনের মাধ্যমে অভিযোজন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা সম্ভব হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মাউরি গোষ্ঠীর মানুষের পূর্বপুরুষেরা প্রথম নিউজিল্যান্ডে পৌঁছার পর পুরো অঞ্চলে যত পাথরের উৎসস্থল আছে সেগুলো আবিষ্কার করতে এক শতাব্দী লেগেছে, তারপর সেখানকার সব মোয়া-কে (পৃথিবীর সবচেয়ে বন্ধুর অঞ্চলে বসবাসকারী মোয়া প্রজাতির শেষ প্রাণীগুলোকে) মেরে ফেলতে আরও কয়েক শতাব্দী সময় লেগেছে; এরপর মাত্র কয়েক শতাব্দী লেগেছে উপকূলে বসবাসকারী শিকারী-সংগ্রাহক সমাজ থেকে কৃষিকাজের মাধ্যমে খাদ্য সঞ্চয়ী সমাজে উন্নীত হতে।
এসব বোঝার পর আমাদের এই জীবাশ্মবিদ হয়ত সিদ্ধান্তে পৌঁছুবেন যে, আফ্রিকানরা কয়েক মিলিয়ন বছরের যে হেড স্টার্ট নিয়েছিলো, আমেরিকানরা মাত্র এক হাজার বছরের মধ্যেই সে পরিমাণ উন্নতি করে ফেলেছিলো। কারণ আদি আমেরিকানরা আফ্রিকানদের সব প্রযুক্তি নিয়েই আমেরিকায় এসেছিলো। এরপর হয়তো আমেরিকার বিশাল এলাকা (আফ্রিকার তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ বেশী) এবং সেখানকার বিপুল বৈচিত্র্যময় পরিবেশ আদি আমেরিকানদেরকে আফ্রিকানদের তুলনায় বেশী সুবিধা করে দিয়েছিলো।
জীবাশ্মবিদ এরপর হয়তো ইউরেশিয়ার দিকে ফিরে তাকাবেন এবং অনেকট এরকম কারণ দিয়ে হেড স্টার্টের বিষয়টা ব্যাখ্যা করবেন: ইউরেশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাদেশ। আফ্রিকার পরেই এই মহাদেশে মানুষ সবচেয়ে বেশী সময় ধরে বাস করছিলো। প্রায় এক মিলিয়ন বছর পূর্বে ইউরেশিয়ায় মানুষ উপনিবেশ স্থাপন করে। এর আগে আফ্রিকায় যারা বাস করছিলো তাদেরকে গুরুত্বের সাথে বিচার না করলেও চলে। কারণ সেই প্রাক-মানবদের মস্তিষ্ক ছিল অতি আদিম প্রকৃতির, উন্নতির স্কেলে তারা পাত্তা পায় না। জীবাশ্মবিদ হয়ত এরপর আপার প্যালিওলিথিক যুগে অর্থাৎ ২০,০০০ বছর পূর্ব থেকে ১২,০০০ বছর পূর্বের মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের দিকে নজর দেবেন। এ সময়ের মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষেরা বিখ্যাত সব শিল্পকর্ম শুরু করে, পাশাপাশি আরও উন্নত পাথরের হাতিয়ার নির্মাণ শুরু করে। এসব দেখে টাইম ট্রাভেলার জীবাশ্মবিদ মনে করতেই পারেন, ইউরোপীয়রা তখনই আফ্রিকানদের থেকে একটা হেড স্টার্ট নিতে শুরু করেছে।
সবশেষে এই জীবাশ্মবিদ হয়তো অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির দিকে নজর দেবেন। এর আয়তন খুব কম, প্রকৃতপক্ষে এটা পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট মহাদেশ। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করে থাকবেন যে, এখানে খুব কম মানুষই বাস করতে পারে, এটা অন্যান্য মহাদেশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন এবং এর স্বল্প আয়তনের অনেকটাই মরুভূমিতে ঢাকা। এটাও খেয়াল করে থাকবেন যে আফ্রিকা ও ইউরেশিয়ার পরেই মানুষ এই মহাদেশে পা রেখেছে। এই সবকিছু বিবেচনা করে হয়তো জীবাশ্মবিদ অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির ধীর অগ্রগতির একটা ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে পারবেন।
কিন্তু আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির অধিবাসীরাই প্রথম নৌচালনা আয়ত্ত করেছিলো। ইউরোপে ক্রো-ম্যাগননরা যে সময়ে গুহাচিত্র অংকন শুরু করেছিলো এখানকার মানুষেরাও প্রায় একই সময়ে গুহাচিত্র অংকন শুরু করেছিলো। জোনাথন কিংডম ও টিম ফ্ল্যানারি বলেছেন, এশিয়ার মূল ভূমি সংলগ্ন দ্বীপগুলো থেকে নৌ পথে অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনিতে গিয়ে উপনিবেশ স্থাপনের আগেই সেই মানুষেরা নতুন পরিবেশে দ্রুত অভিযোজন করতে পারতো। কারণ অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনিতে যাওয়ার আগেই তাদেরকে মধ্য ইন্দোনেশিয়ার বিচিত্র পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছিলো। আর ইন্দোনেশিয়ার এই উপকূলবর্তী অঞ্চলে পৃথিবীর অন্যতম উৎকৃষ্ট সামুদ্রিক সম্পদ ছিল, ছিল প্রবাল প্রাচীর আর বিশাল বিশাল সব ম্যানগ্রোভ বন। এই সবকিছুর সাথেই তারা পরিচিত হয়ে উঠেছিল। উপনিবেশ স্থাপনকারীরা ইন্দোনেশিয়ার এক দ্বীপ থেকে যাত্রা শুরু করে মাঝের প্রণালীটা পেরিয়ে পরের দ্বীপে পৌঁছুতো। সেই দ্বীপের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়ার পর আবার যাত্রা শুরু হতো। এভাবেই তারা বিস্তৃত হচ্ছিল। এই সময়টাকে তাই জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ইতিহাসে একটা স্বর্ণযুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এমনও হতে পারে যে, সে সময়কার ঔপনিবেশিক চক্র, অভিযোজন এবং জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণেই গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ডের সূচনা ঘটেছিলো এবং এখান থেকেই তা ইউরেশিয়া ও আফ্রিকায় বিস্তৃত হয়েছিল। অর্থাৎ এই নবযুগের পত্তন ইন্দোনেশিয়াতেও ঘটে থাকতে পারে। এটা সত্যি হলে কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির মানুষেরাও একটা বিরাট হেড স্টার্ট দিতে পেরেছিল। গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ডের অনেক পরেও এই হেড স্টার্ট সেখানকার মানুষের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করে যাওয়ার কথা।
তাই কোন পর্যবেক্ষককে যদি আমরা টাইম মেশিনে করে ১১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাঠিয়ে দেই, তাহলে সে সময়ের পরিস্থিতি বিচার করে কোন মহাদেশের মানুষ ভবিষ্যতে উন্নতি করবে তা সে সঠিক করে বলতে পারতো না। এর চেয়ে বরং কোন নির্দিষ্ট মহাদেশে মানব সমাজের অগ্রগতি নিবিঢ়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারতো। এখনকার জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে আমরা বুঝতেই পারছি ইউরেশিয়া উন্নতি করেছে। কিন্তু তাদের এই দ্রুত উন্নতির কারণ ১১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যাওয়া জীবাশ্মবিদ যতটা সরল বলে মনে করছেন মোটেই ততটা সরল না। এই বইয়ের বাকি অংশে সেই আসল কারণগুলোই খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে।
ভ।ল ল।গল