আমরা দেখেছি একটি সমাজের জনসাধারণের পক্ষে অর্থসম্পদজনিত সমস্যার সমাধান মোটেই অসম্ভব নয়। বর্তমানে পশ্চিমের অনেক দেশেই বিভিন্ন ধরনের সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে সেই সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে; কিন্তু সমাজে ধর্মকর্তৃক সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা, মারামারি, সংঘাতের সমাধান আদৌ লক্ষণীয় নয়। এক ধর্ম অন্য ধর্মকেই শুধু ঘৃণা করে না, নিজেদের মধ্যেও প্রচণ্ড ঝগড়া, ফ্যাসাদ, আগ্রাসন, হত্যা, হুমকি, উন্মাদনা সৃষ্টি করে। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান কেউই দাবি করতে পারবে না যে, তাদের মধ্যে ধর্মীয় মতানৈক্য, দলাদলি, মারামারি নেই।

যারা এই সত্যকে অস্বীকার করেন তারা অবশ্যই প্রতারক বা জ্ঞান-পাপী। ধর্মের প্রতি মোহমুক্ত হয়ে তাকালেই দেখা যায়, ধর্মকে যতটা মানবিক হিসেবে প্রচার করা হয়, আসলে তা নয়। ধর্মটা মনুষ্যত্বের নয়, কতিপয় গোষ্ঠীর-গোত্রের। ধর্ম মানুষের মাঝে একতা গড়ে তোলে না, আনে বিদ্বেষ; যা আসলে উগ্র, হিংস্র, জংলী আচরণে পর্যবসিত হয়। কোনো ধর্মই গণমানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখায়নি; শাসকগোষ্ঠীর তাবেদারি করা ছাড়া। ‘মানব মুক্তি’র যে ধর্মীয় ফর্মুলা দেয়া হয়ে থাকে তা কল্পিত, পারলৌকিক, ইহজাগতিক নয়, তাই গরীব মানুষ আরো গরীব হয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, নিয়ম-নীতি, কঠোরভাবে পালন ও অনুসরণ করেও; আর ধনী আরো ধনী হয়—ভণ্ডামির মধ্যে লালিত হয়ে। ধর্মের মূলে কুঠারাঘাত পড়েছে বলেই ধর্মবাদীরা মাঝেমাঝে সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে মিলে-মিশে থাকার কথা ঘোষণা করেন, শান্তিবাদী হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করে্ন, সেটা আসলে মস্ত বড় শুভঙ্করের ফাঁকি; কারণ জগতে ধর্মের নামে, এক ধর্ম অন্য ধর্মের ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে মানব সভ্যতার গোড়া থেকেই অগণিত, অসংখ্য মানুষ খুন করেছে এবং আজও সে ধারা অব্যাহত আছে। হাজার বছর ধরে টিকি, দাড়ি আর ক্রুশের বাড়াবাড়িতে সাধারণ মানুষ নাজেহাল। ফলে ধর্ম আজ মানব-সভ্যতার কলঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কোনো হিন্দু স্বামী মারা গেলে তার বিধবা স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলে ‘সতী’ বানা্তেন, ইংরেজ আমলে আইন করে এ ধর্মীয় বর্বর প্রথাকে রুখতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কেইনের (Kane) ‘ধর্মশাস্ত্রের ইতিহাস’ (আট খণ্ড) গ্রন্থের ‘সতী’ বিষয়ক কয়েকটি অধ্যায়ে বেশ কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন। এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৮১৫ সাল থেকে ১৮১৮ সাল পর্যন্ত মাত্র তিন বছরে নারীর সতীত্ব (?) রক্ষার ধুয়া তুলে কেবলমাত্র বাংলোতেই (যা তখন বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল) ২৩৬৬ জন নারীকে আগুনে পুড়িয়ে সতী বানানো হয়েছিল, যার মধ্যে কলকাতাতেই সতীদাহের সংখ্যা ১৮৪৫। আর ১৮১৫ থেকে ১৮২৮ সাল পর্যন্ত বাংলাতে ৮১৩৫ জন নারীকে আগুনে পুড়িয়ে সতী বানিয়েছিলেন ঠাকুর-পুরহিতগণ। এটা কি গণহত্যা নয়? এ কি জঘন্য-বর্বর ধর্মীয় রীতি নয়? বীভৎস ধর্মীয় রীতিনীতির প্রতি ইঙ্গীত করে Pascal বলেছেন Men never do evil so completely and cheerfully as when they do it from religious conviction. হিন্দু নারীরা কি স্বামীর মৃত্যুর পর স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতায় ওঠে সহমরণে যেতেন? মোটেই তা নয়। ঐতিহাসিকগণ জানিয়েছেন, কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সদ্য বিধবা নারীকে উত্তেজক পানীয় পান করিয়ে কিংবা নেশা জাতীয় দ্রব্য শুঁকিয়ে অজ্ঞান করে কিংবা অর্ধচেতন অবস্থায় স্বামীর চিতায় তুলে দেওয়া হতো। এ বিষয়ে ভারতের অন্যতম মানবতাবাদী লেখক ড. সুকুমারী ভট্টাচার্য তার ‘প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন :

“সদ্যবিধবা নারী নববধূর মতো সাজে, তার শ্রেষ্ঠ পোষাক পরে, সিঁদুর, কাজল, ফুলমালা, চন্দন, আলতায় সুসজ্জিত হয়ে ধীরে ধীরে সে চিতায় ওঠে, তার স্বামীর পা দুটি বুকে আঁকড়ে ধরে কিংবা মৃতদেহকে দুই বাহুতে আলিঙ্গন করে, এইভাবে যতক্ষণ না আগুন জ্বলে সে বিভ্রান্তির সঙ্গে অপেক্ষা করে। যদি শেষ মুহূর্তে বিচলিত হয় এবং নীতিগত, দৃশ্যগতভাবে ছন্দপতন ঘটে তাই শুভাকংখীরা তাকে উত্তেজক পানীয় পান করান। এমন কি পরে যখন আগুনের লেলিহান শিখা অসহনীয় হয়ে ওঠে, পানীয়র নেশা কেটে যায়, তখন যদি সেই বিধবা বিচলিত হয়ে পড়ে, ‘সতী’র মহিমা ক্ষুণ্ন হবার ভয় দেখা দেয় তখন সেই শুভাকাংখীরাই তাকে বাঁশের লাঠি দিয়ে চেপে ধরে যদি সে চিতা থেকে নেমে আসতে চায়, প্রতিবেশী, পুরোহিত, সমাজকর্তা সকলেই অনুষ্ঠানের সাফল্যের জন্য অতিমাত্রায় সাহায্য করতে চায়। তারা গান করে, ঢাক বাজায় এতো উচ্চ জয়ধ্বনি দেয় যে সতী যা কিছু বলতে চায় সবই উচ্চনাদে ঢেকে যায়।” (প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ, পৃষ্ঠা ১৪৭)।

বর্তমানকালের তথাকথিত ‘মডারেট’ হিন্দুরা স্বীকার করতে চাইবেন না, অথবা অনেকেই জানেন না তাদের ধর্মগ্রন্থে ‘স্বামী মারা গেলে বিধবাকে স্বামীর চিতায় আগুনে পুড়ে মরে সতী হওয়ার’ সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। প্রমাণ চাই তো, দেখুন ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১৮নং সূক্তের ৭ নং শ্লোক(১০/১৮/৭) শ্লোকটির ইংরেজি হচ্ছে : Let these women, whose husbands are worthy and are living, enter the house with ghee (applied) as collyrium (to their eyes). Let these wives first step into the pyre, tearless without any affliction and well adorned. অথর্ববেদে রয়েছে, “আমরা মৃতের বধু হবার জন্য জীবিত নারীকে নীত হতে দেখেছি।” (১৮/৩/১,৩)। পরাশর সংহিতায় পাই, “মানুষের শরীরে সাড়ে তিন কোটি লোম থাকে, যে নারী মৃত্যুতেও তার স্বামীকে অনুগমন করে, সে স্বামীর সঙ্গে ৩৩ বৎসরই স্বর্গবাস করে।” (৪:২৮)। দক্ষ সংহিতার ৪:১৮-১৯নং শ্লোকে বলা হয়েছে, A sati who dies on the funeral pyre of her husband enjoys an eternal bliss in heaven. (যে সতী নারী স্বামীর মৃত্যুর পর অগ্নিতে প্রবেশ করে সে স্বর্গে পূজা পায়)। এই দক্ষ সংহিতার পরবর্তী শ্লোকে (৫:১৬০) বলা হয়েছে, “যে নারী স্বামীর চিতায় আত্মোৎসর্গ করে সে তার পিতৃকুল, স্বামীকুল উভয়কেই পবিত্র করে।” যেমন করে সাপুড়ে সাপকে তার গর্ত থেকে টেনে বার করে তেমনভাবে সতী তার স্বামীকে নরক থেকে আকর্ষণ করে এবং সুখে থাকে। ব্রহ্মপুরাণ বলে, “যদি স্বামীর প্রবাসে মৃত্যু হয়ে থাকে তবে স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর পাদুকা বুকে ধরে অগ্নিপ্রবেশ করা।” (প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ, পৃষ্ঠা ১৪০)। মহাভারতের মৌষল পর্বে আমরা দেখি, ভগবান কৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর চার স্ত্রী রুক্কিণী, রোহিণী, ভদ্রা এবং মদিরা তাঁর চিতায় সহমৃতা হয়েছিলেন। এমন কি বসুদেবের আট পত্নীও তাঁর মৃত্যুর পরে সহমরণে গিয়েছিলেন। ব্যাসস্মৃতি বলছে, চিতায় বিধবা নারী তার স্বামীর মৃতদেহে আলিঙ্গন করবেন অথবা তার মস্তকমুণ্ডন করবেন। (২:৫৫)। ষষ্ঠশতকের বরাহমিহির তার বৃহৎসংহিতায় বলেন, “অহো নারীর প্রেম কি সুদৃঢ়, তারা স্বামীর দেহ ক্রোড়ে নিয়ে অগ্নিতে প্রবেশ করে।” (৭৪:২৩)। এ কুযুক্তি শুধু বরাহমিহির কেন, আজকের একুশ শতকের কতিপয় পুরোহিত-ঠাকুর গর্বভরে ঘোষণা করেন, “নারী তার স্বামীর প্রতি ভালোবাসার জন্যই সহমরণে যায়; এ হিন্দু নারীর বৈশিষ্ট্য, ঐতিহ্য, মমত্ব, স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসার দুর্লভ উদাহরণ।” ঠাকুর-পুরহিতের প্রচলিত ভণ্ডামিপূর্ণ বক্তব্যের স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন ড. সুকুমারী ভট্টাচার্য; তিনি বলেন : “বৃহৎসংহিতার যুগ থেকেই সমাজ এই অতিকথা ঘোষণা করে আসছে যে নারী তার স্বামীর প্রতি ভালোবাসার জন্যই সহমরণে যায়। এই মিথ্যার অবসান হওয়া উচিৎ। যদি স্বামীর প্রতি প্রেমে এক নারী আত্মহত্যা করে তবে কেন আজ পর্যন্ত কোনো স্বামী তার স্ত্রীর চিতায় আত্মহত্যা করেনি? এ তো হতে পারে না যে আজ পর্যন্ত কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে ভালোবাসেনি। যদি সতীদাহের ভিত্তি হতো প্রেম, তবে আমরা অবশ্যই কিছু কিছু ঘটনা দেখতে পেতাম যেখানে মৃত স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীও সহমরণে গেছেন। কিন্তু তা হয়নি, এ বিষয়ে কোনো শাস্ত্রীয় বিধিও নেই। সুতরাং মূল ব্যাপার হল স্বামীর স্বার্থে স্ত্রীর সম্পূর্ণ আত্মবিসর্জন; আর সতীদাহ এই আজীবন নাটকেরই পঞ্চমাংকের শেষ দৃশ্য।” (দ্রষ্টব্য : প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ, পৃষ্ঠা ১৪৮) হিন্দু ধর্মের বেদ-গীতা, মনুসংহিতা, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণপাচালি ইত্যাদির মধ্যে এতো জাতপাতের বৈষম্য, বর্ণভেদ, গোত্রবিভেদ, ধর্মভেদ, ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতা, নারীর প্রতি কুসংস্কার, বিরূপ ধারণা, ভয়, ঘৃণা, জংলী আইন-কানুন একই ধর্মাবলম্বী বলে ঘোষণা করেও শূদ্র-বৈশ্যর প্রতি ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের শ্রেণীবিভেদের বিপুল সমাহার আর সরব উপস্থিতি ও চর্চা দেখেই হয়তো উপনিবেশিক ভারতবর্ষে বাংলার রেনেসাঁসের অন্যতম প্রাণপুরুষ বলে পরিচিত হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) ও তাঁর অনুসারীরা Athenium নামক মাসিক পত্রিকায় সোচ্চারে ঘোষণা দিয়েছিলেন, If there is anything that we hate from the bottom of our heart, it is Hinduism.

ইহুদিরা অগণিত খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদেরকে গলা কেটে হত্যা করেছেন, আগুনে পুড়িয়েছে্ন, তা-তো ধর্মগ্রন্থেই লিখিত আছে; খ্রিস্টানরা স্বধর্মাবলম্বী-বিধর্মী অগণিত নারীদের ‘ডাইনি’ ঘোষণা দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের অন্তর্গত তৌরাত শরিফের Exodus -এর ২২:১৮ নং শ্লোকে সরাসরি বলা হয়েছে, Thou shalt not suffer a witch to live (কোনো জাদুকারিণীকে বেঁচে থাকতে দেবে না।) স্প্রেঙ্গার হিসাব দিয়েছেন, তৌরাত শরিফের এই আয়াতের উপর ভিত্তি করে নব্বই লক্ষ ভূতগ্রস্ত ব্যক্তিকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। তিন থেকে চার বছরের শিশুরাও পর্যন্ত খ্রিস্টান মৌলবাদীদের নৃশংস ও বীভৎস কালো হাত থেকে রেহাই পায়নি। (দ্রষ্টব্য-The Malleus Maleficarum (The Witch Hammer) of Heinrich Kramer and James Sprenger.) আসলে কেউ কোনদিন ভূতগ্রস্ত হয়নি, ভূত বলতে কোন জিনিষ কোন কালেই ছিলনা, আজও নেই। কুমারী (!) মাতা মেরির কোলে ছোট্ট, সুন্দর, শুভ্র, নিষ্পাপ যিশুর ছবি দ্বারা যেসব খ্রিস্টান মিশনারিজরা শান্তিবাদী-করুণাময় যিশুর রূপ তুলে ধরতে চান, তাদের গালে চপোটাঘাত করেছেন যিশু নিজেই :“আমি দুনিয়াতে শান্তি দিতে এসেছি এ কথা মনে করো না। আমি শান্তি দিতে আসিনি বরং আমি এসেছি মানুষের বিরুদ্ধে মানুষকে; ছেলেকে বাবার বিরুদ্ধে, মেয়েকে মায়ের বিরুদ্ধে, স্ত্রীকে শাশুড়ীর বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে।” (মথি, ১০:৩৪-৩৫) ব্ল্যাসফেমির (ঈশ্বর নিন্দা) কারণে যে কোনো ব্যক্তিকেই পাথর ছুড়ে হত্যার নির্দেশ দেওয়া আছে এই তৌরাত শরিফের Leviticus (লেবীয়)-এর ২৪:১৬ নং শ্লোকে! বাইবেলের এসব নিষ্ঠুর, আগ্রাসী আয়াতের উপর নির্ভর করে যুগে যুগে কত যে স্বাধীন চিন্তাবিদ, লেখক, মুক্তচিন্তার অধিকারী ব্যক্তিকে নির্যাতন, বন্দীত্ব বরণ, অঙ্গচ্ছেদ, আগুনের ছেঁকা ইত্যাদির শিকার হতে হয়েছে তার কোনো ইয়াত্তা নেই। এমন কি, যে ইহুদিরা একসময় খ্রিস্টানদের উপর গণহত্যা চালিয়েছিল, সেই ইহুদিরাও খ্রিস্টানদের হাতে কম নির্যাতনের শিকার হতে হয়নি। খ্রিস্টানদের অত্যাচার, নির্যাতনের ভয়ে ইহুদিদের যাযাবরের জীবন বেছে নিতে হয়। পঞ্চম শতাব্দীতে পোপ প্রথম লিও বাইবেল সম্পর্কে ভিন্নমতপোষণকারী স্বাধীন চিন্তাবিদদের ধরে এনে মৃত্যুদণ্ড দিতেন। নবম শতাব্দীতে রোমান ক্যাথলিক চার্চ এক লক্ষ ভিন্নমতাবলম্বীকে হত্যা করে; দুই লক্ষ লোককে দেশ থেকে বিতাড়িত করে। ফ্রান্সের আবেলার পীয়রকে (১০৭৯-১১৪২) ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, তাঁর পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা হয়, তার সব রচনা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ফ্লোরেন্সের স্যা ভোনা রোলা (১৪৫২-১৪৯৮) খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলেন, গির্জার সংস্কার দাবি করেছিলেন; এজন্য তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারের মধ্যে যাতা কাঁধে তুলে দিয়ে পৈশাচিক পন্থায় নির্যাতন চালানো হয়। স্পেনের মনীষী মাইকেল সারভেন্টাস খ্রিস্টানদের ‘ট্রিনিটী’ Trinity অস্বীকার করেছিলেন এবং ঈশ্বরের পুত্রের অবিনশ্বরত্বকে অবিশ্বাস করেছিলেন, যার জন্য তাঁকে খোঁটায় বেঁধে শ্বাসরোধ করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। যাজকতন্ত্রের নিন্দা করায় আলেকজান্ডার লেটনকে (১৫৬৮-১৬৪৯) বেত্রাঘাত করা হয়, তাঁর নাক-কান কেটে ফেলা হয়। খ্রিস্টান পোপ নবম গ্রেগরি ১২৩৩ খ্রিস্টাব্দে ধর্মীয়-বিরুদ্ধবাদীদের (বাইবেল সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণকারী) খুঁজে বের করে তাদের ফাঁসিতে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে হত্যার জন্য ‘ইনকুইজিশন’ বা ধর্মীয় বিচার সভার প্রবর্তন করেন। এই ইনকুইজিশনের মাধ্যমে খ্রিস্টধর্মবিরোধী যেকোনো ব্যক্তিকে নির্যাতনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিওরদানো ব্রুনোকে (১৫৪৮-১৬০০) ধর্মান্ধদের হাত থেকে বাঁচতে সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডে পালিয়ে বেড়াতে হয়। অবশেষে তাঁকে গ্রেফতার করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে ধর্মান্ধের দল। বৃদ্ধ গ্যালিলিও গ্যালিলিকে অত্যাচারের শিকার হতে হয়, তাকে গির্জার সামনে নতজানু হয়ে পাদ্রীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। দার্শনিক স্পিনোজাকে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে আমস্টারডামের সিন্যাগগ (ইহুদিদের ধর্মমন্দির) সমাজচ্যুত করে, নির্বাসন দেয়। বার্থৌলোমিউ লির্গেটকে (১৫৭৫-১৬১১) নিজের চিন্তা প্রচারের অভিযোগে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়; ১৬১৮ সালে স্যার ওয়াল্টার রাওয়ালকেও ধর্মবিরোধিতার কারণে হত্যা করা হয়। জানা যায়, তাকে শিরোচ্ছেদ করার পর তাঁর মাথাকে মমি করে তাঁর স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তুলুজে লুচিলিও ভানিনিকে ১৬১৯ সালে ‘নাস্তিকতার’ অপরাধে জিহ্বা ছিড়ে ফেলা হয়, পরে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। মুহাম্মদ (দঃ) ও তাঁর অনুসারীগণ খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ওপর সীমাহীন জুলুম অত্যাচার চালিয়ে, তাদের ভিটে-বাড়ি থেকে উৎখাত করে, নির্যাতন চালিয়ে, তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে, ধর্মান্তরিত করে, তাঁদের শিশু, নারী-পুরুষ, সহায়-সম্পত্তিসহ গোটা দেশ দখল করে নিয়েছিলেন; ইসলামি ইতিহাস এর গর্বিত সাক্ষী। খ্রিস্টান ধর্মের মতো ইসলামও ধর্মত্যাগী কিংবা নিরীশ্বরবাদীদের শাস্তি হিসেবে যুগ যুগ ধরে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে আসছে। এমন কি রোমান ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক ‘ইনকুইজিশন’ প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই ইসলামি রাষ্ট্রে এই ধরনের ব্যবস্থা বহুল প্রচলিত ছিল। নবী মুহাম্মদ নিজেই ‘মুরতাদ’-‘কাফের’ এবং তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে ভীষণ কঠোর ছিলেন এবং এ ধরনের প্রচুর লোককে তিনি কঠোর হস্তে দমন করেছেন কিংবা প্রাণদণ্ড দিয়েছেন। নবী মুহাম্মদের আদেশ ছিল, কোনো লোক ধর্মদ্রোহী বা ধর্মান্তরিত হলে শাস্তি হিসেবে কখনো আল্লাহর শাস্তি ‘আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করবে না’, তবে তরবারি দিয়ে হত্যা করতে পারো। হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করছেন-

Allah’s Apostle sent us in a mission and said, “If you find so-and-so and so-and-so, burn both of them with fire.” When we intended to depart, Allah’s Apostle said, “I have ordered you to burn so-and-so, and it is none but Allah Who punishes with fire, so, if you find them, kill them.”(সহিহ বোখারি শরিফ, ভলিউম ৪, বুক ৫২,নম্বর ২৫৯)

কিন্তু অন্য হাদিসে প্রমান আছে,হযরত আলি কয়েকজন লোক ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে পুনরায় তাদের ধর্মে ফিরে গেলে, তাদেরকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিলেন।

ইকরিমা থেকে বর্ণীত, হজরত ইবনে আব্বাসের (রাঃ) কাছে যখন সংবাদ পৌছিল যে হজরত আলী (রাঃ) কয়েকজন মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন,ইবনে আব্বাস বললেন- আলীর জায়গায় আমি হলে অবশ্য তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে মারতাম না,তবে নিশ্চয়ই হত্যা করতাম যেহেতু নবীজীনির্দেশ দিয়েছেন ধর্মত্যাগীদেরকে হত্যা করতে। (সহিহ বোখারি শরিফ, ভলিউম ৪, বুক ৫২, নম্বর ২৬০)

অন্য একটি হাদিসে আছে-

একজন ইহুদি লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, কিছুদিন পর সে আবার ইহুদি ধর্মে ফিরে যায়; এ খবর শুনে নবী মুহাম্মদ হজরত মুয়াদ বিন জবলকে নির্দেশ প্রদান করেন ঐ লোকটিকে হত্যা করতে। মুয়াদ বিন জবল ঐ লোকটিকে হত্যা করতে গেলে সাহাবী আবু মুসা (রাঃ) ‘ধর্মদ্রোহী’ লোকটিকে গ্রেফতার করে হাতে-পায়ে বেড়ি পড়িয়ে নিয়ে আসেন; এরপর মুয়াদ বিন জবল ঐ লোকটিকে হত্যা করেন। (দ্রষ্টব্য : সহি বোখারি, ভলিউম ৯, বুক ৮৪, নম্বর ৫৮ এবং ভলিউম ৯,বুক ৮৯, নম্বর ২৭১)।

৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসী খলিফা মেহদি ইবন মনসুর সর্বপ্রথম ‘মিহনা’(Mihna) নামের একটি ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন; যার কাজ ছিল খোঁজে খোঁজে মুরতাদ, কাফেরদেরকে শাস্তি দেওয়া। বর্তমানযুগে সারা বিশ্বে ‘ইসলাম’ নানা কারণেই আলোচনার বিষয়; স্বীকার করতে হবে ৯/১১-এর পর এ আলোচনার গতি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসলামকে নতুন যুগের আলোয় পুনর্মূল্যায়ণ করা হচ্ছে। কালোপযোগী করার লক্ষ্যে সময়ের পরিবর্তনে যুগে যুগে ইহুদি, হিন্দু , খ্রিস্টান ধর্মসমূহে, কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে। মেয়েশিশু হত্যা, ডাইনি হত্যা, সতীদাহ প্রথা, বিধবা প্রথা, আজ আর নেই। গির্জায় নারী নেত্রীত্ব, সমকামী বিবাহ আজ আইনতঃ বৈধ। এমনকি আধুনিক বিজ্ঞানের সামনে মাথানত করে ধর্মযাজকেরা তাদের ধর্মগ্রন্থের ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন এবং ক্ষমা চেয়েছেন তাদের পুর্বসূরীগণকর্তৃক অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যার জন্যে। খ্রিস্টান জগতের ধর্মগুরু পোপ দ্বিতীয় জন পল বিগত দু’হাজার বছরে খ্রিস্টান জনগণ, শান্তি, প্রেম, মানবাধিকারের বিরুদ্ধে যেসব পাপ করেছেন, তার জন্য ঈশ্বরের মার্জনা ভিক্ষা করেছেন। কিন্তু ইসলাম ঠিক তার বিপরীত; অমানবিক, সন্ত্রাসী আদি অবস্থানে আজও অনড় অটল। জেহাদের মাধ্যমে বিধর্মীদের-অবিশ্বাসীদের হত্যা করে গোটা বিশ্বটাকে ‘দারুল-ইসলাম’ বানানোর প্রচেষ্টাকে ইসলামি বিশ্ব খুবই মর্যাদার সঙ্গে দেখে। ইসলাম অস্বীকার করে বিজ্ঞানের ধারা প্রমাণিত সত্যকে, সংস্কার-পরিবর্তন ইসলামে ক্ষমার অযোগ্য মহাপাপ।

বাংলাদেশের অত্যন্ত সুপরিচিত মনীষী, নির্ভিক নিরীশ্বরবাদী বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ তাঁর ‘গণতন্ত্র, সংস্কৃতি, স্বাতন্ত্র ও বিচিত্র-ভাবনা’ গ্রন্থে বলেছিলেন : “মানুষের অবচেতন-অস্পষ্ট জীবন চেতনার মূলে রয়েছে ভয়-বিস্ময়, ভক্তি-ভরসা ও কল্পনা। এতে বলতে গেলে জ্ঞান-বুদ্ধি যুক্তির ঠাঁই সংকীর্ণ ও নিতান্ত সামান্য।” বিধাতা, গড, আল্লাহ্ ভগবান বা ঈশ্বরকে চেনার জন্য আমাদের বাংলাদেশেরই ড. আহমদ শরীফের ‘গণতন্ত্র, সংস্কৃতি, স্বাতন্ত্র্য ও বিচিত্র-ভাবনা’, আরজ আলী মাতুব্বরের ‘সত্যের সন্ধানে’, মোস্তফা মীরের ‘উল্লেখ্য’, ড. হুমায়ুন আজাদের ‘আমার অবিশ্বাস’, মাহমুদ শামসুল হকের ‘নারী কোষ’,শফিকুর রহমানের ‘পার্থিব জগৎ’ ও ‘হিউম্যানিজম’—এই ক’টি বই-ই যথেষ্ট। উপরোল্লিখিত লেখকদের যুক্তি, তত্ত্ব-তথ্যবহুল লেখা বা তাদের কোনো প্রশ্নের উত্তর, তাদের দার্শনিক জিজ্ঞাসার সমাধান, ধর্মে-বিশ্বাসীরা কোনোদিন দিতে পারেন নি, বিভ্রান্তি ছড়ানো ছাড়া। ধর্ম মানুষকে-সমাজকে-জাতিকে পেছনের দিকে টানে। যে কোনো ধর্মাবলম্বীর ধার্মিক হওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো-স্বধর্মকে Superior শ্রেষ্ট আর অন্য ধর্মকে Inferior নিকৃষ্ট মনে করা। কোরান শরিফের ১০৯ নম্বর সুরা ‘কাফেরুনে’র শেষ আয়াত ‘লাকুম দ্বী-নুকুম ওয়ালিয়াদ্বীন’ অর্থাৎ তোমার ধর্ম তোমার,আমার ধর্ম আমার, আর বাইবেলের Love thy neighbours (প্রতিবেশীকে ভালোবাসো), হিন্দুদের ‘অতিথি নারায়ণ’-এর মতো কাল্পনিক অসাড় মিথ্যা শ্লোক-বাণী প্রত্যেক ধর্মগ্রন্থেই কম-বেশি আছে। কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই চর্চাও নেই। ভারতে হিন্দু মৌলবাদীরা প্রত্যেক বছরই মুসলিম, খ্রিস্টানদের পাইকারিহারে হত্যা করছে, তাদের উপাসনালয় ভেঙে-গুড়িয়ে দিচ্ছে, বাংলাদেশে মুসলিমরা হিন্দুদের, আহমদিয়াদের কিংবা পাহাড়ী আদিবাসীদের উপর যেভাবে অত্যাচার, হত্যা, ধর্ষণ, পরিকল্পিত গুম-সন্ত্রাস পরিচালনা করছে। বাংলাদেশে আহমদিয়াদের সমস্ত ধর্মীয় প্রকাশনা বিএনপি-জামাতের চার দলীয় জোট সরকার ২০০৪ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, পাকিস্তানে মুসলিমরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী খ্রিস্টানদের উপর যেসব সংঘবদ্ধ আক্রমণ পরিচালনা করছে, সেটা ডিঙিয়ে এখন শিয়া-সুন্নি-আহমদিয়া দ্বন্দ্ব, একে অপরের উপাসনালয়ে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে নিজেদের ঈমানের পরীক্ষা দিচ্ছে। তা দেখে যে কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক-বিবেক, জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের তথাকথিত পবিত্র ধর্মগুলোর শান্তিময় বাণীর উপর আস্থা রাখা অত্যন্ত কষ্টকর ও দুঃসাধ্য বটে।

চলবে-

৩য় পর্ব-

১ম পর্ব-