তখন  ও এখন

গীতা দাস

(৬)

 

ছোটবেলায় আমরা সবাই জনমানুষ ছিলাম। স্কুলে লেখাপড়া  নিয়ে অন্তঃত শ্রেণী বৈষম্য ছিল না। গ্রামের মাঝির মেয়ে, কৃষকের মেয়ে, চাকরিজীবীর মেয়ে, ব্যবসায়ীর মেয়ে — ছোট বড় চাকরি বা ব্যবসা নির্বিশেষে একই স্কুলে পড়তাম — একই সাথে খেলতাম। এখন পার্থক্য অনেক। স্কুলের নাম মর্যাদার পরিচায়ক। পড়ুয়া ছেলেমেয়ে এবং মা বাবা — সবাই অহংকারের সাথেই নামী দামী স্কুলের নাম উচ্চারণ করে। শুধু মেধা নয় — অর্থ , আর্থিক  সামর্থ বুঝে স্কুল কলেজে ভর্তি।

 

আমাদের নরসিংদী পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে বা মহিলা কলেজে আমরা চালের বড় আড়ৎদারের মেয়ে, বাইরে ছোট চালের খুচরা বিক্রেতার মেয়ে, মুদির দোকানদারের মেয়ে, স্থানীয় সাংসদের মেয়ে থেকে সরকারি অফিসের কেরাণীর মেয়ে সবাই এক সাথে লেখাপড়া করেছি। 

 

তখন সাংসদের পরিবার ঢাকা কেন্দ্রিক ছিল না। মফস্বঃলেও রকমারি স্কুল কলেজ ছিল না।

 

রাজনৈতিক অবরোধের জন্যে চলো চলো / ঢাকা চলো শ্লোগান ও কার্যক্রম শুনেছিলাম। অর্থাৎ ঢাকা যাওয়া শাসকদের অবরোধের জন্যে।

 

এখন থাকো থাকো / ঢাকায় থাকো চর্চা চলছে। এমনি চর্চা যে সরকারি সুযোগ ও সম্পদ স্থায়ীভাবে ভোগের কৌশল তৈরিতে ব্যস্ত ক্ষমতাবানরা। রাষ্ট্রীয় কাঠামো স্থায়ীভাবে দখলের অপপ্রয়াসে জড়িত।

 

তাছাড়া,  অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের  আর প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের প্রায় সব কর্মকর্তার ছেলেমেয়ে  প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে না — পড়ে কিন্ডার গার্টেনে।

 

 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা প্রায়শঃই বাংলা ইংরেজী কারিকুলামের সংমিশ্রণে  উপজেলা পর্যায়ে বেংলিশ স্কুল তৈরি করে  —- যেখানে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার ও উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাদের ছেলেমেয়েরাও পড়ে। কয়েকজন ডেপুটি কমিশনার ঢাকায় অবস্থিত বিয়াম স্কুলের আদলে জেলা পর্যায়ে স্কুল প্রতিষ্ঠায় তৎপর। ফলে সরকারি স্কুলের মান্নোনয়নের বিষয়টি তাদের মনোযোগ হারায় ও  দায়িত্বও অবহেলিত হয়। অথচ তাদের ছেলেমেয়েরা স্থানীয় স্কুলে পড়লে তাদের দাপটেই লেখাপড়ার ছাঁচ বদলে যেত বলে আমার বিশ্বাস।

 

ছোটবেলায় দেখা জীবনবোধ ও জীবন যাপন আর আজকের জীবনবোধ ও জীবন যাপনে ভিন্নতা ও বৈপরীত্য আমাকে পোড়ায়। এখন আমার বলয়ের আশেপাশের মানুষ জনকে দেখি নিজেকে প্রকাশে উদগ্রীব এবং তথাকথিত প্রগতিশীল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর — অপতৎপর যেমনঃ আমার একজন পরিচিত লোকের গল্প  দুঃখিত, গল্প নয় — সত্যিকারের কাহিনী

 

কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাওয়া নিয়ে সুযোগ পেলেই উনি কথা বলেন বাজারজাতকরণের সীমাবদ্ধতা, পরিবহন ব্যবস্থার  অপ্রতুলতা, মধ্যসত্ত্বভোগীদের মুনাফা ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে উনার তত্ত্ব কথার অনেক অর্থ অনেক সময় বুঝি নাউনার সাথে একদিন অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে এক গ্রামাঞ্চলে গেছি দুধ কিনবেন দাম ৫০ টাকা কেজি চাইতেই উনার নাক কপালেএত গ্রামের ভিতরেও দুধের এত দাম! ঢাকায় মিল্কভিটাই তো ৪৫ টাকা করেতাহলে আর এতদূর থেকে এ দুধ নিয়ে কী লাভ !

 

গো খাদ্যের হিসেব কষে দেখাইনি —- মনে করিয়ে দেইনি যে আপনিও যে মধ্যসত্ত্বভোগীদের মত মুনাফা চাইছেন নিদেন পক্ষে উৎপাদনকারীকে তার ন্যায্য দাম দেয়ার যখন সুযোগ পেয়েছেন তখন দিয়ে ধন্য হোন

 

এতদিন ভেবেছি আমি উনার অর্থনীতি বিষয়ক তত্ত্ব কথার অনেক অর্থ অনেক সময় বুঝি না আজ বুঝেছি আসলে উনি বুঝাতে পারেন না    

 

অথচ ছোটবেলায় দেখেছি নিজে আচরি ধর্ম অন্যেরে শিখাও এর চর্চা।

 

 মা ছোটবেলা বিবেকানন্দ থেকে কোটেসন নিয়ে শেখাতেন

জীবে প্রেম করে যেইজন

সেইজন সেবিছে ঈশ্বর

 

অতিথি রুপে নরই নারায়ণ। নরের সেবা মানে মানুষের সেবা করলেই ঈশ্বরের সেবা করা হয়।  নর শব্দটি দিয়ে উভয় লিঙ্গই বুঝাতেন। কোন ভিক্ষুক ভিক্ষে করতে এসে ভাত চেয়ে আমার মায়ের কাছ থেকে না খেয়ে গেছে —এমন অভিজ্ঞতা আমার নেই। ছোট খাট ফেরিওয়ালারাও আমার মায়ের অতিথি হত।

 

অনেক সময় নিজের জন্যে আবার ভাত রান্না করে তবে খেয়েছেন। এ রান্না কিন্তু লাড়কির চুলা ধরিয়ে রান্না করা। একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি খরচ করে ধপাধপ গ্যাসের চুলা জ্বেলে রান্না নয়।  তাছাড়া আমার বাবার অবস্থা অস্বচ্ছল না হলেও আমরা জমিদার ছিলাম না। জমির চালে ভাত হত না। আক্ষরিক অর্থে অনেক জমির মালিক নয় তবে মনের জমিন অনেক বড় ছিল আমার মা বাবার।  গ্রামের অনেক মেয়ের বিয়েতে বাবার বরাদ্দ থাকত কী দেবে। না —– যৌতুক নয়, প্রয়োজনীয় —– কিছু। যেমন,  বিয়ের শাড়ি ধূতি ও  পিঁড়ি। হিন্দু বিয়ের কিছু অবধারিত সামগ্রী।  আবার অন্য কারো পরীক্ষার ফিস। বই কেনার টাকা। হাজীপুর ইউনিয়নের বদরপুর গ্রামের খুকী আপার আই এ পরীক্ষার ফিস বাবা দিয়েছিলেন বলে খুকী আপা আমার বাবাকে বাবা বলে ডাকতেন।

 

তবে ছোটবেলায় আজকালকের মত এত ভিক্ষুক দেখা যেত না। মানূষের আর্থিক সামর্থ এখনকার চেয়ে উন্নত না হলেও ভিক্ষাবৃত্তিতে কম লোক ছিল। দিনের বেলা বৈষ্ণব বৈষ্ণবী, দুএকজন কানা খোড়া এবং গাজীর পট আসতেন। এরা সবাই চাল নিতেন। রাতের বেলা আসত মুশকিল আসান এবং পয়সা নিত। হাতে পিতলের দুটো ডাণ্ডাওয়ালা একটা জিনিস নিয়ে আসত। একটা ডাণ্ডায় বোম্বাই কুপি জ্বালিয়ে আসত। আরেকটি ডাণ্ডায় কালি করা থাকত। মুখে দাড়ি।  পয়সা দিলেই একটা করে কালির টিপ দিয়ে দিতেন দিয়াশলাই এর কাঠি দিয়ে। মুশকিল আসান পয়সা হাতে নিত না। কুপির সলতে  ও কালির ডাণ্ডার যেখান থেকে উঠে এসেছে ঐ খানটায়ই ছিল পয়সা রাখার জায়গা। আমরা ওইখানেই পয়সা দিতাম। আমাদের ধারণা ছিল ঐখানটায় পয়সা দিলে সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে আর পয়সা মুশকিল আসান রুপী ঐ লোকটি নয় — কোন অলৌকিক শক্তি পাবে। 

 

এখনও জনগণ রাজনৈতিক নেতাদের মুশকিল আসান ভাবে। যদিও তারা বরাবর জনগণের জন্যে মুশকিল সৃষ্টি করেই আসছে।

 

গীতা দাস

 ৭ মাঘ, ১৪১৫/ ২০ জানুয়ারী , ২০০

[email protected]