চোরের মা’র বড় গলা
দিলরুবা সুলতানা মাহের
উপরের প্রবাদ বাক্যটির আরেকটি প্রকরণ আছে- “চুরির চুরি, আবার সিনাজুরি”। প্রবাদগুলির অর্থ ভাঙতে খুব একটা জ্ঞানবুদ্ধির দরকার হয় না, গ্রামের প্রতিটি লোকই এর অর্থ বুঝতে সক্ষম।
২০০১ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে ম্যাডাম জিয়া ও তার পারিষদবর্গ বিরামহীনভাবে প্রচার চালান যে দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। কথিত এই জোয়ারের গোটাকয়েক নমুনা পেশ করা যাক। ক্ষমতাসীন হওয়ার মাস কয়েকের মাথায় জনপ্রিয় একুশে টিভি বন্ধ হয়ে গেল সত্য, চালু হলো ফালুর এনটিবি আরটিভি, মির্জা আব্বাসের বৈশাখী, খোকা বাবুদের বাংলাভিশন, মামুনের চ্যানেল ওয়ান। একটির বদলে পাঁচটি, উন্নয়ন ছাড়া আর কী? পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল আদমজি বন্ধ করা হলো, এতে করে নাকি উন্নয়নের নুতন অধ্যায়ের সূচনা হয়। সুতরাং একের পর এক কলকারখানা বন্ধ করে দিয়ে উন্নয়ন নিশ্চিত করা হলো। বাজারে প্রতিদিন নিত্যপণ্যের দামের উন্নয়ন ঘটতে থাকলো, অর্থমন্ত্রী বললেন- জনগণের ইনকামের উন্নয়ন ঘটেছে, তাই এই মূল্যবৃদ্ধি। তিনি আরও বিধান দিলেন- ‘ভাতের বদলে কফি খাও’। সন্ত্রাস শিল্পেরও যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটলো; এতটাই উন্নয়ন হলো যে আলতাফ হোসেন আর কুলিয়ে উঠতে পারলেন না, শুরু হলো বিখ্যাত বাবুর শাহী যুগ। চালু হলো ক্লিনহার্ট, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার ইত্যাদি নানাবিধ প্যাটেন্ট ব্যবস্থা। প্রশাসনেও চরম উন্নয়নের ছোয়া লাগল। বিসিএস, পুলিশ, নির্বাচনী কর্মকর্তা ইত্যাদি পদে শিবির ও ছাত্রদলের ছেলেরা পাইকারী হারে নিয়োগ পেল, এমনকি হাইকোর্টের বিচারক পদে এমন লোক নিয়োগ পেল যার এমনকি উকালতির সার্টিফিকেটটি পর্যন্ত নেই। সর্বপ্লাবী জোয়ারের ধাক্কা হতে ইতিহাস বইও রেহাই পেল না। স্বয়ং জিয়াউর রহমান যে ইতিহাস রচনা করিয়েছিলেন, তার সুযোগ্য সহধর্মিনী সেগুলিকে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে নুতন ইতিহাস রচনা করলেন। মুজিব নামক একজন লোক ছিল, সে কথাটিও অস্বীকার করা হলো। জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ওসমানী- কেউ আর রইলেন না, একমেবদ্বিতীয়ম হয়ে টিকে রইলেন শুধুমাত্র একজন সেক্টর কমান্ডার, জিয়াউর রহমান। নিজামি, আমিনি, সাঈদীদের কল্যানে জঙ্গীবাদেরও যথেষ্ট উন্নতি ঘটলো; আত্মপ্রকাশ করলেন শায়খ, রহমান বাংলাভাই, খালিদ সাইফুল্লাদের মতো মহাপুরুষরা। দূর্ণীতি শিল্পই বা এই জোয়ারের বাইরে থাকে কেন? হাওয়া ভবন তৈরী করে দুই রাজপুত্র এই শিল্পের প্রসারে যতœবান হলেন, তাদের অক্লান্ত চেষ্টায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি চার চারবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের শিরোপা অর্জন করতে সমর্থ হলো। পঞ্চম বার এই শিরোপা অল্পের জন্যে ফস্কে গেল, কারণ ইতিমধ্যে একটি আফ্রিকান দেশ দূর্ণীতিতে যথেষ্ট উন্নতি করে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল। কি আর করা। বিদ্যুৎ উৎপাদন এক ছটাক না বাড়লেও শুধু খাম্বা বিক্রি করেই রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নতি হলো অর্থাৎ খরচ হলো। কে না জানে যে খরচই উন্নয়ন, উন্নয়ন মানেই খরচ। উন্নয়নের জোয়ারের সবচেয়ে ক্লাসিক উদাহরণ বোধ হয় কানসাট ও শনির আখড়ার গণ-জোয়ার কিংবা খোদ্ রাজধানীর বুকে শামুন্নাহার হলের ছাত্রীদের ক্রন্দন-জোয়ার, পাঠক-পাঠিকাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে সে কথা !
এমনি একটা রমরমা অবস্থা, রাজপুত্রদের সেলামী না দিয়ে যেখানে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পানিটুকু পর্য্যন্ত সাগরে প্রবাহিত হওয়ার পারমিশন পায় না, তখন হাসিনা নামক এক দুর্মুখ নেত্রী এই জোয়ারের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে এগিয়ে আসলেন। হাসিনার অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রাণীমা সিংহীর মতো গর্জে উঠলেন, শহীদ জিয়ার ছেলেদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার! মরহুম শেখ মুজিবের ছেলে হলে কথা ছিল, তারা এমনকি একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়েও ষ্টেট ব্যাঙ্কের দুর্ভেদ্য ভল্ট ভেঙে ডাকাতি করতে পারে, কিন্তু এ যে শহীদ জিয়ার ছেলে। সুতরাং দূর্মুখ মিথ্যা রটনাকারী হাসিনাকে গ্রেনেড খেয়ে মরতে হলো (তিনি বেঁচে আছেন, এ নেহায়েতই কাকতালীয় ঘটনা। জাতীয়তাবাদী কোড অনুসারে তার এতদিনে ডিসপোজড অফ হয়ে যাওয়ার কথা যেমনটি হয়েছেন হুমায়ুন আজাদ)।
পরস্পর বিপরীতমুখী এই প্রচারস্রোতের কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা তা বুঝে উঠা খুবই দূরহ; বিশেষ করে স্বল্পজ্ঞানসম্পন্ন পাবলিকের পক্ষে। পেটে ভাত নাই, ক্ষীনজীবি মগজের পক্ষে এত ভারী ভারী কথার সত্যাসত্য নির্ণয় করা কি সোজা কথা? অবশেষে হাটে হাড়ি ভাঙতে এগিয়ে এলো মার্কিন আদালত। “ফরেন করাপ্টস প্র্যাক্টিস আইন” অনুযায়ী সেখানকার একটি আদালতে জার্মানীর সিমেন্স কোম্পানীর বিরুদ্ধে এই মর্মে একটি মামলা হয় যে সিমেন্স বাংলাদেশের ২নং রাজপুত্রসহ কতিপয় প্রভাবশালী মন্ত্রীকে ঘুষ দিয়েছে। ঘুষের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে মার্কিন ব্যাঙ্ক থেকে- ডলারে। সাক্ষ্যপ্রমানে সিমেন্সের দোষ প্রমানিত হয়। উপায়ান্তর না দেখে দোষ স্বীকার করে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করে সিমেন্স, হলফনামার মাধ্যমে অপরাধ স্বীকার করে নেয়। আদালত সিমেন্সকে ১৬০ কোটি ডলার জরিমানা করে, দূর্ণীতির ইতিহাসে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জরিমানার ঘটনা এটি। আদালত আরও রায় দেয়- জাতিসংঘের “মিউচুয়াল লিগাল এ্যাসিষ্ট্যান্টস এগ্রিমেন্ট” আইন অনুযায়ী লেনদেকৃত অর্থ (২০ কোটি ডলার) যেন মার্কিন ব্যাঙ্কে ফেরৎ আনা হয়। আদালতের রায় বাস্তবায়ন করা মার্কিন সরকারের জন্যে বাধ্যতামূলক। সুতরাং সেদেশের জাষ্টিস ডিপার্টমেন্ট এবং এফবিআই’এর একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সরকারের সহযোগীতা চেয়ে বাংলাদেশ সফর করছে এখন। কারণ টাকাগুলি রক্ষিত আছে বাংলাদেশী নাগরিকদের বৈদেশিক একাউন্টে যার মধ্যে প্রধানতম ব্যক্তিটি হচ্ছেন বাংলাদেশের ছোট রাজকুমার কোকো। বাংলাদেশ সরকার এবং একাউন্ট হোল্ডারদের সহযোগীতা ছাড়া আদালতের রায় বাস্তবায়ন করা বা পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার করা অসম্ভব।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, হাসিনা এতদিন ধরে যে কথা নিয়ে চিল্লাচিল্লি করে গলা ফাটাচ্ছিল তার কথাই ঠিক। মার্কিন আদালত হাসিনার কথায় চলে না, এমনকি জর্জ বুশের কথায়ও না। এমতবস্থায় আর কোন দেশ হলে খালেদা জিয়া হয়তো দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতেন, বলতেন- অপরিণত বয়স্ক ছেলেরা একটা ভুল করে ফেলেছে, ভুল তো মানুষেই করে- ফেরেশতারা করে না। সুতরাং দেশবাসী যেন এই অপরাধকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু হাজার হলেও তিনি আপোষহীন নেত্রী, মাথা নোয়ানো সাজে না। তিনি ভাঙা রেকর্ড বাজিয়েই চলছেন- এসব কিছুই জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করার গভীর চক্রান্ত, একটি বিশেষ মহলের কারসাজি, আসলে তার ছেলেরা ফুলের মতো পবিত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি ফুলের মতো পবিত্রই হয়, তাহলে কেন তিনি চ্যালেঞ্জ করে বলছেন না যে সিঙ্গাপুরের জব্দকৃত একাউন্টটি কোকোর নয়, কোকোর সইয়ে ঐ একাউন্ট পরিচালিত হতো না কিংবা সিমেন্স বা চায়না হারবার ঐ একাউন্টে কোন অর্থ রেমিট করেনি। এসব করে তিনি কিন্তু এই কথাই প্রমান করছেন যে- তারেক-কোকো, ফালু-মামুন, পিন্টু-লাল্টুরা গত পাঁচ বছরে যতোসব দূর্ণীতি করেছে- তার পেছনে ম্যাডামের পূর্ণ সমর্থন ছিল। সমর্থন ছিল বলেই আন্তর্জাতিকভাবে প্রমানিত একটি অপরাধকে তিনি আড়াল করতে চাইছেন। সমর্থন ছিল বলেই একুশে আগষ্ট গ্রেনেড হামলার মতো একটি জঘন্য ঘটনার অভিযুক্ত আসামীকে দলের মনোনয়ন দেন। অর্থাৎ জোট আমলে যতো অপকর্ম হয়েছে- তিনিই হচ্ছেন তার সবকিছুর আসল গড মাদার।
কথায় আছে- ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। জনগণ কী চায় সে রায় তারা দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিয়েছে। হাসিনা সরকার এই রায়ের মর্য্যাদা কতটুকু রাখে তাই এখন দেখার বিষয় শুধু। কোন অজ্ঞাত কারণে তারা যদি জনগণের ন্যস্ত বিশ্বাসের সাথে বেঈমানী করে, তবে সেদিন খুব একটা দূরে নয় যেদিন আবারও তারা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
লেবানন, বৈরুত
তারিখ- ১৩ই জানুয়ারী, ২০০৯।
Leave A Comment