নতজানু বোধের কাছে
ক্যাথেরীনা রোজারিও কেয়া
একটা বয়সে বোধ হয় বাবা মায়ের সাথে উত্তাল জীবনের কথাও ছেলেমেয়েরা আলাপ করতে পারে। আমি সেই বসে পৌঁছে গেছি বলে নির্দ্বিধায় বাবা মাকে বলছিলাম এক সন্ধ্যের গল্প। আমরা তিন বন্ধু মিলে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী হলে রাত কাটাতে রওনা হলাম ঢাকা থেকে। বিশাল একটা বাস কীট পতঙ্গের মত গাদাগাদি করে আমাদের বয়ে নিয়ে জাহাঙ্গীর নগর কাম্প্যাসে পৌঁছল।
প্রসঙ্গত বলে রাখি আমাদের সঙ্গে ওই হলে থাকা একজনের পরিচয় ছিল বলে তাকেই সাইনবোর্ড করে রাতে থাকার ছাড়পত্র পেয়ে গেলাম আমরা।
বিকেল যখন মরা রোদ্দুরকে বিদায় দিচ্ছে আমরা তখন হাঁটতে শুরু করেছি কোন এক তিন তাল গাছ তলায় পৌঁছোব বলে। শুনলাম, ওই তিন তাল গাছ তলায় কফি বিক্রি হয়। কফি মূখ্য নয়, কেমন যেন আকর্ষন অনুভব করলাম সমতল মাঠে জোট বাঁধা তবুও একাকী দাঁড়িয়ে থাকা গাছ তিনটের প্রতি। যখন পৌঁছুলাম তখন খেয়াল করিনি কোন পথে হেঁটেছি।। গাছগুলো ত্রিভুজ প্রেমের মত হিংসায় অথচ পারস্পরিক নির্ভরতায় দাড়িঁয়ে আছে সটান। কফিটা আহামরি কিছু নয়, ভারতীয় কোন একটা খুব প্রচলিত ব্রান্ড। ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছি অমনি ঝুপ করে অন্ধকার নেমে পড়ল চারিদিকে। আমরা তিন জন দিক জ্ঞান হারালাম সেই অন্ধকারে। এর পর নিরুদ্দেশ কোথায় চলেছি কিছুই জানি না। কিছুতেই, কোনভাবেই কোন রাস্তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কোন ভবনের কাছেই নিয়ে যাচ্ছে না। কেমন যেন গোলক ধাঁধায় পড়ে গেছি। হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন ৮/১০ বছরের একটি ছেলে উপস্থিত হল সাথে একটি মোষ নিয়ে। ব্যাকুল হয়ে বললাম – আমরা পথ হারিয়েছি, গন্তব্য মহিলা হল। ছেলেটি কথা না বলে ইঙ্গিতে ওকে অনুসরণ করতে বলল আমাদেরকে। যে যাত্রা কুয়াশা, শিশিরে পা ভিজিয়ে শুরু হয় তাকে ভোরের আলো দেখতেই হয় -সে বিশ্বাস নিয়ে আমরা ওকে অনুসরণ করলাম। কারো মুখে কথা নেই। আমরা বন্ধুরা হাতে হাত বেঁধে হাঁটছি।। ছেলেটি খানিকক্ষণ পর ঘুরে তাকাল, দেখলাম জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন গুলোর আলো দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে। আমরা গন্তব্য খুঁজে পেয়ে আনন্দিত হলাম।
গল্পটা যখন বাবাকে, মাকে বলছিলাম -গলায় ছম ছম ভয় জড়িয়ে বললাম, জানো বাবা, জানো মা ছেলেটি কোথায় যে চলে গেল আমাদের পথ দেখিয়েই-জানি না। তাকিয়ে দেখি ও নেই- ওর মোষটাকেও আর দেখা যাচ্ছে না কোথাও। মনে হচ্ছিল আমাদের পথ দেখাতেই ও এসেছিল, কেউ বোধ হয় ওকে আমাদের জন্য পাঠিয়েছিল।
এমনি অলৌকিক কোন ঘটনার ইঙ্গিত দিয়ে গল্পটা শেষ করলাম।
খানিক বাদেই অবশ্য আত্মগ্লানি হল। ছেলেটি আসলে উবে যায়নি কোথাও, উবে গিয়েছিল আমার কৃতজ্ঞতাবোধ। নদী পেরোলে নাইয়া যেমন অপাংক্তেয় হয়ে যায়, ছেলেটিও আমাদের কাছে তাই-ই ছিল। আজ প্রায় বিশ বছর পরে ঘটনাটা বলতে গিয়ে সাংঘাতিক আত্মপীড়ন হলো। হয়তো এভাবেই আমরা নিজের কৃজ্ঞতাবোধ, দায়িত্ববোধ এড়িয়ে যাই আর প্রথাগত ভাবে বলি ‘ঈশ্বরের ইচ্ছায় এমন হল, ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্য করেন, ঈশ্বর আমায় পথ দেখানোর জন্যই ওকে পাঠিয়েছিলেন’। অলৌকিক স্বর্গীয় এমনি কত খোলসে নিজের দুর্বলতাকে ঢাকার চেষ্টা করি। আক্ষেপ হচ্ছে আত্মগ্লানি হচ্ছে সেদিনের কথা ভেবে আর ছোট হচ্ছি নিজের কাছেই এই ভেবে যেকেমন করে ব্যবহার করছি অলৌকিক পরলৌকিজাতীয় শব্দ গুলো, ধারণা গুলো শুধু নিজের সুবিধের জন্যে।
ভাবলাম পাঠকের সাথে সহভাগিতা করি অনেক আগের সেই ঘটনাটা, কেননা মুক্ত বুদ্ধি আর মুক্ত মনের চর্চা তো সহজ কাজ নয়।
গবেষণা এবং পরবর্তীতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন ডঃ ক্যাথেরীনা রোজারিও। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি শেষে বর্তমানে ফ্লোরিডা সরকারের শিক্ষা বিভাগে কর্মরত রয়েছেন। আশির দশকের বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম সাহসী সংগঠক ও কর্মী ছিলেন। টিএসসি কেন্দ্রিক আবৃত্তির সংগঠন স্বরশ্রুতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তার একক আবৃত্তির সিডি ‘একজন অনিমেষ আজো জেগে আছে’ প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা থেকে ২০০৭ সালে।
আপনার লেখা একেবারে হ্দয় ছুঁয়ে যায়। অনেক মুক্তমনাকে দেখেছি টেলিপাতি বা অলৌকিক বিষয় এখনও চিন্তা থেকে বাদ দিতে পারে নি । তাহলে সেখানে সাধারন চিন্তাশীল মানুষের দোষ দিয়ে লাভ কি ?
ভালো থাকুন।
মামুন।
Keya
Apnar lekha porte suru korlam JU e jabar kotha sune, kitu lekhata mone hoy porar agey shes hoea gelo.Jodio sothik onuvuti khub olppotey prokhas kora jay.suvecha.
luna
Hello Catherina,
Never thought to find an old pal after visiting Mukto-Mona for the first time.
Mahfuz, Ex-SUST Lecturer, [email protected]
কেয়ার এই লেখাটাও পড়তে মজা লাগলো – ভাষার ব্যাবহার সুন্দর, ঝরঝরে।
অতুলনীয়!
স্মৃতির কাছে জবাবদিহি করা কারাগারের বন্দী পিতাকে দুর থেকে দেখাকরার মত কষ্টকর..