বাসুনকে, মা
পর্ব ৪৪
বাসুন,
ঢাকা থেকে তোর ছোটখালা শাহিন অনেক আগে একটা কবিতার ক্যাসেট পাঠিয়েছিলো। ক্যাসেটের নাম ”মনে পড়ে রুবি রায়” আমার প্রিয় কবিতা। শিমুল মোস্তাফার ভরাট গলায় আবৃত্তি বাজছে, কবিতাটা শুনিছে দীর্ঘদিন, উচ্চারণ শব্দ, ভালোবাসা নিঃশ্বাস আর অনুভূতি আমার ফেলে আসা সময়ের সাথে জড়িয়ে আছে। আমি ঘরেই আছি সোনা, শুন্য ঘরে, সেই নিরিবিলি দুপুর তুই স্কুলে।
আজকের দিনটার কথা শেষ লাইনে বলবো, তার আগে বলবো হাজারো স্মৃতিতে ভরা এই জীবনের কথা, প্রতিমুহুর্তে সময় চলে যায় আর স্মৃতির ভলিউম বাড়তে থাকে। একদিন এমনি করেই এই শহরে এসেছিলাম আমি, সেদিনও আমার মনে ভালোবাসা ছিলো, প্রেম ছিলো, আকাংখা ছিলো জীবনকে জয় করে নেবার, তাই অপেক্ষা করেছি, নিজেকে নিজেই বলেছি না এখন না, এখন না। তাহলে কখন বাবু? কবে সময় হবে আমার? কবে প্রান ভরে ভালোবাসতে পারবো? অপেক্ষাতো গোটা জীবনকে পার করিয়ে দিলো। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই কারণেই ভিন্ন হয়। আমি যখন ব্শ্বিবিদ্যালয়ে পড়তাম তখন বাবা মায়ের কঠিন শাসন ছিলো, খুব ভালো করে জানতাম, কারো হাত ধরে বেড়িয়ে গেলেই মা/বাবা মানবেন না, কিছুতেই না। তাই যে বয়সে তোরা অবাধ ঘুরবি বা এখন অনেকেই ঘুরছে সেই বয়সে আমি সহ আমার সময়ের অনেকেই বলেছে, না এখন না, আরো অপেক্ষা, অনেক অপেক্ষা। এরপর তোর বাবার সাথে সংসার শুরু হলো, অনেক জটিলতা/ ভালো/মন্দ লাগা থাকলেও মুর্হুতেই কিন্তু সেই জাল ছিড়তে পারিনি আমি, সমাজ/সংসার বাবা/মা সবাইকে প্রমাণ করতে হয়েছে, না আমি আর পারছি না, তারপরেই শুধু জীবন আমার পক্ষে রায় দিয়েছে। আরো সময় বয়ে গেছে জীবন থেকে। এর পরে শুরু হয়েছে চাকরি জীবন বাবু। ঢাকা থেকে কাজের জন্য আমাকে যেতে হয়েছে একদম সাধারণ মানুষের ভিতর, তাই ঢাকাতে বসে যে শুটিকয়েক মেয়ে আধুনিকতার ফাঁকা আওয়াজ তোলে, গাবতলী ক্রস করার সাথে সাথেই সেই বাংলাদেশ তাই হারিয়ে যায়। কমিউনিকেশন বাড়লেই কি সংস্কৃতি আর অভ্যাস বদলে যায়? তাহলে তো আজকের বাংলাদেশে কোন নারী নির্যাতনই থাকা উচিত না । তাই বলছি সোনা, তখনো সময়গুলো আমার জন্য বৈরী ছিলো যদিও আমি ঢাকাতেই থাকতাম। সাধারন মানুষের সাথে মিটিং/সেমিনার/আলোচনাতে বসতে হতো আমাকে আর সেই মানুষইআমার ব্যত্তিগত বিযয়ে প্রশ্ন করতো, দিনের পর দিন আমি এভাবেই কাজ করেছি , বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ড্রইংরুম থেকে বেড়িয়ে আনাচে কানাচে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি, কতটুকু বদলালে একটি দেশ সত্যিকার অর্থে উন্নত হয় তারাই জানেন যারা দেশকে শুধু ঢাকা শহর দিয়ে বিবেচনা করেন না। আমি সেখানেও মুক্তি পাইনি, সেই সময়ও আমার নিজেকেই প্রবোধ দিতে হয়েছে, বলতে হয়েছে না, এখনো সময় আসেনি, তোমাকে আরো ধৈর্ষ ধরতে হবে। তুই বড় হতে থাকলি, তোর উত্তাপ আর ওমে আমার জীবন থেকে আরো সময় পেরিয়ে গেলো সোনা। শত প্রতিকুলতা আর মানুষের প্রশ্নবানকে সাথে নিয়ে বয়ে গেছে আমার সময়। মনে পড়ে বাবু, তোর বাবাকে ছেড়ে আসার পড়ে বাংলাদেশের এক বিখ্যাত বুিদ্ধজীবি বলেছিলেন, ‘লুনা তুমি যখন তোমার স্বামীর সাথে ছিলো তাও একটা সাটোর্প ছিলো, ধরে নাও সেটা ছিলো তোমার কড়াই আর জীবন তোমার কাছে আগুন। এখন তুমি সরাসরি আগুনের ভিতর পড়লে’। কথাটার ভিতর দিয়ে লোকটা সারা বাংলাদেশকে আমার সমনে তুলে ধরলেন।
এরপর তোকে নিয়ে এলাম এক নতুন দেশে, বিচিত্র রকম কষ্ট/দুঃখ/না পাওয়া আর হতাশা আমাকে মুহুর্তেই জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু পথ চলা তো থামাতে পারিনি সোনা। তোর মুখে ভাত তুলে দেবার ভাবনা, জীবনকে একটু সহজ করার উপায় আমাকে ব্যক্তিগত সব আনন্দ/ ভালোলাগা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে প্রতিমুহুর্ত। সেই পুরাতন কথা আমি নিজেকে বলেছি, যা বলেছি গত ২০ বছর, না এখন না, আরো অপেক্ষা াকরতে হবে লুনা। পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাধীন দেশ, যেখানে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থেই যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, এই দেশেই কলেজে পড়ার সময় দেখেছি রিসিপশন টেবিলে কনডম রাখা থাকে, ছেলে মেয়েদেরকে ১৪ বছরের পর থেকেই ব্যক্তিগত জীবন সেখানো হয়, সেই দেশেই সবাই যখন উইক্এন্ড এ লং ড্রাইভে গেছে আমি তখন তোর কথা ভেবে দুটো ডলারের কথা ভেবে বাসায় থেকেছি। সেদিনও কিন্তু বাবু আমি কবিতা শুনতে পারিনি, কারন জীবনের কঠিন বাস্তবতা আমার পথ আগলে দাড়িয়েছিলো মাত্র কিছুদিন আগেও।
আমার জীবন থেকে আরো সময় বয়ে গেছে সোনা, বয়স বেড়েছে, মনটাও না পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে অনেকটাই। আজ আমার সুদিন এসেছে বাবু। আমি কানাডিয়ান পাসপোর্ট হাতে বাড়ি ফিরছিলাম মাত্র দুঘন্টা আগে, তুষারে ভরে আছে শহর। আমি নিশ্চিন্ত মনে ফিরেছি বাড়ি, আমার সাজানো এপার্টমেন্ট, আমার পারমানেন্ট জব, আজকে সেই কবিতা ছেড়েছি বাবু, আমার প্রিয় কবিতা বাজছে সারা ঘরময় ‘মনে পড়ে রুবি বায় কবিতায় তোমাকে একদিন কত করে ডেকেছি’ সব ডাককে উপেক্ষা করা এই জীবন বাবু, আজকে শুধু স্মৃতির পাখিরা আমার নির্জন ঘরে, নিঃশব্দ সময়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে ডেকে যায় সোনা।
তোর মা,
১২ ই ডিসেম্বর, ২০০৮।
Leave A Comment