বাংলাদেশ এবং একজন সংখ্যালঘু রাষ্ট্রপতি

নন্দিনী হোসেন

 

সম্প্রতি আমেরিকার নির্বাচনে বারাক ওবামা নির্বাচিত হওয়ায়, বাংলাদেশী কারো কারো মাথায় সঙ্গত কারণেই একটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে । এই কদিন আগেও যেখানে কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি আমেরিকার মত দেশে কখনো কোন কালো মানুষ সাদা ঘরটিতে সর্বময় কতৃত্ব নিয়ে অধিষ্ঠিত হবেন – সেখানে আজ সত্যি সত্যি তাই ঘটেছে । ইতিহাসের এই পট পরিবর্তনকে কোন বিচারেই হেলাফেলা করে দেখার সুযোগ নেই ।  

যদিও অনেকেই ওবামাকে সম্পূর্ণ কালো সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ হিসেবে মানতে রাজী নন –তারপরও তাঁরা অবশ্যই এটা স্বীকার করবেন, ওবামা বিশুদ্ধ সাদাও নন । সে যাই হোক । কথা হচ্ছে আমাদের দেশে কি কখনও এমনটা সম্ভব? অনেকের মত আমার মাথায়ও এই প্রশ্নটি গত কিছুদিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এ বিষয়ে আশাবাদী হওয়ার কোন কারণ দেখছি না । অন্তত নিকট ভবিষ্যতে তার কোন চিহ্ন তো দূরে থাক- দূর ভবিষ্যতে যে সম্ভব হতে পারে তার সামান্যতম আভাস ও তো নেই । স্বীকার করতে হবে এটা আমাদের জন্য অবশ্যই গর্ব করার মতো কোন বিষয় নয়। দেশটার জন্মলগ্নে  একটা ভালো সম্ভাবনা তৈরী হয়েছিল প্রগতির পথে, আলোর পথে হাঁটার । অথচ অতি অল্প সময়ে নিদারুণ দুঃখজনক ভাবে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। পরিসমাপ্তি ঘটায় পাকিস্থানীদের রেখে যাওয়া প্রেতাত্বারাই। কত সহজেই না আমরা উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করেছিলাম – যার খেসারত আমাদের এখনো দিতে হচ্ছে । আর কতকাল দিতে হবে কে জানে ।

আমরা, বাংলাদেশের মানুষেরা নিজেদের মোটামুটি প্রগতিশীল ভাবতে পছন্দ করি। আমার এখন সন্দেহ হয় এটা আসলে শহুরে মধ্যবিত্তদের বাইরের খোলসমাত্র । এরা নিজেরাও তা জানে। খানিক চায়ের কাপে ঝড় তোলা, গল্পে আড্ডায় বড় বড় কথা বলে গুলতানী মারা – কাজের বেলা সুখী গৃহকোণ আকড়ে পরে থাকা, এই মধ্যবিত্ত এখন যেনো বড় বেশী রকম ম্লান । হয়ত  এমনটা হয়েছে পূজিবাদী সমাজের প্রবল ভোগবাদীতার কল্যাণে । দেশ  জাহান্নামে যাক, কে ক্ষমতায় এলো গেলো, অথবা যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের বাড় বাড়ন্ত কোন কিছুই যেনো এদের গায়ে তাপ-উত্ত্বাপ ছড়ায় না আর ! এমন আশ্চর্য্যরকম নির্জীব সময় বোধ এর আগে আর দেখেনি বাংলাদেশ । একটি দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী এমন নির্জীব হয়ে গেলে, সে দেশের ভবিষ্যত কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয় ।    

অন্যদিকে গ্রামীণ জনপদের মানুষেরা, যারা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করায় অভ্যস্থ ছিল না কোনকালে –তারাও কি আর আগের মতো এতটা সরল আছে? গ্রামে পথে ঘাটে হাটে মাঠে সর্বত্র মাদ্রাসা নামক এক উদ্ভট শিক্ষা ব্যবস্থা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সুকৌশলে । গ্রামীণ এই সরল মানুষগুলোর মগজের ভিতর ঢুকে মোল্লারা ঘূণ পোকার মত খেয়ে চলেছে । নানা নামে দেশের আনাচে কানাচে ইসলামী এনজিও ব্যবসার বিস্তার ঘটিয়ে নিজেদের জালে গরীব মানুষগুলোকে আটকে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে বেশ আটঘাট বেঁধেই । পেট্রোডলারে সয়লাব এদের পকেট । তার থেকে উচ্ছিষ্ট কিছু দিয়ে সহজ সরল মানুষগুলোকে যেকোন কিছু বলে সহজে উত্তেজিত করা সম্ভব । সেটা যদি ধর্মের নামে হয় তাহলে তো কথাই নেই । এমন মোক্ষম সুযোগ মোল্লারা ছাড়বে কেন? এদের সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাদের সন্তানদের বিপথগামী করা হচ্ছে, জংগী  বানানো হচ্ছে। বোঝে না বোঝে এরা জেহাদ ঘোষণা করে কথায় কথায় । অথচ এসব দেখার যেনো কেউ নেই ! আমরা দেখতে পাই দরকার হলেই মাদ্রাসা থেকে শয়ে শয়ে ছাত্রনামধারী তাদের ‘পোষা’ বাহিনী এনে ছেড়ে দেয় মাঠে । নির্দেশ পাওয়ামাত্র ঝাপিয়ে পড়ছে ওরা যেখানে সেখানে, যার তার উপর । এর সামান্য নমুনা তো আমরা দেখলাম এই কিছুদিন আগেই । লালন ভাস্কর্য্য সরানো নিয়ে যা কান্ড হয়ে গেলো এসব বিষয়গুলোকে তুচ্ছ করে দেখার কোন উপায় নেই। যারা বলেন এসব অল্প কিছু মানুষের কাজ, তারা আসলে আসল সত্য আড়াল করেন ।    

জামায়াত যে কৌশলে এগুচ্ছে, তাতে আগামীতে তারাই যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হবেনা তাই বা কে জানে ! এখনি তো অনেক  আলামত ফুটে উঠেছে ! যাই হোক, এবার আমাদের সুশীল (!) সমাজ এবং আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কথায় আসি। বিএনপির কথা এখানে আমি আনবো না, কারণ এদের কাছে আমার কোন প্রত্যাশা নেই। এরা যখন যেমন তখন তেমন । ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য খালেদা জিয়া পারেন না হেন কিছু নেই। তিনি এখন আবার হাস্যকর ভাবে আপোষহীন নেত্রীর ভেক ধরার চেষ্টা করছেন। আমাদের মধ্যে যারা আওয়ামীলীগ এবং এই দলটির নেত্রী হাসিনাকে মনে করেন প্রগতিশী্লতার ধ্বজাধারী –তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন। এই দলের মুখোশ মাঝে মাঝেই খুব নগ্নভাবে খসে পড়ে। ক্ষমতার জন্য কখনও এরা নিজামীদের দ্বারস্ত হয়, কখনো খেলাফত মজলিসের সাথে ফতোয়া চুক্তি করে। আবার সময়ে সময়ে নিজেদের সুবিধানুযায়ী নীরব দর্শক সাজে । বক বক করা  হাসিনার জবানে তখন কুলুপ আঁটা থাকে । ওদিকে নামে বেনামে জামায়াতীরা দেশের মানুষের নার্ভ পরীক্ষা করে দেখছে অহরহ ! কখনও বলে দেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই ! কখনো দেশকে ভাস্কর্য্য শুণ্য করার ঘোষণা দেয় । লালন এর মুর্ত্যি  টেনে হিচড়ে নামায়- দেশের প্রবল প্রতাপশালী সরকার মুখে রা করে না । আমাদের হাসিনাও এক্কেবারে চুপ ! আর আমাদের সুশীল সমাজের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো ।

বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু ব্যক্তি, কিছু প্রতিষ্ঠান মিনমিনে প্রতিবাদ জানায়, তাদের কিইবা সাধ্য আছে! যারা কথা বলার, অন্তত বললে কিছু হবে, তারা চুপ করে, ঝিম মেরে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, সবসময় । ধর্মবাদীদের তান্ডব তাই শনৈ শনৈ বেড়েই চলেছে । ভাবসাব দেখে মনে হয় ভীষন মজা পেয়ে গেছে আমিনী হুজুররা ! হবে নাইবা কেন? দেশের তাবড় তাবড় বুদ্ধিজীবি, সরকার বাহাদুর থেকে শুরু করে মহা পরাক্রমশালী আমাদের নেতা-নেত্রীরা যে হারে আমিনীদের পায়ের কাছে বসে জী হুজুর, জী হুজুর করেন –তাতে সব ব্যাটাকে ক্ষমতা থেকে ঘাড় ধরে নামিয়ে, মাদ্রাসার তালেব এলেম দের নিয়ে নিজেরাই যে এতদিনে রাজ্যপাট চালাতে শুরু করেননি হুজুররা, এই তো তাদের বাপের ভাগ্য ! তবে আরও কদিন পর ভাগ্যে কি আছে বলা যায়না । বটমূলে বসে একদিনের সখের পান্তা খাওয়া বাঙ্গালীয়ানা তখন বাপ বাপ করে পালাবার পথ পাবেনা ! 

 আজকাল নিজামী মুজাহিদদের চকচকে চেহারা মোবারকের জেল্লা এবং বাতচিতের জোষ দেখলে ভীরমি খাই ! এত সাহস এদের বুকে ! কোত্থেকে আসে? এরা আজ ভাস্কর্য ভাঙ্গার  কথা বলছে একদিন শহীদ মিনার ভাংতে গাইতি শাবল নিয়ে হাজির হবে – স্মৃতি  সৌধ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে মানুষকে লেলিয়ে দেবে, ধর্মের নামে ! ধর্ম বলে কথা ! কেউ টু শব্দটি করবেনা। কার এতো সাহস যে জাহান্নামের আগুণে পুড়তে রাজী হবে !  

এদিকে আমাদের  বাম দল গুলোর কথা বলার কিছুই নেই আসলে। কেন যেনো আমার মনে হয় ‘উহারা পথ হারাইয়াছেন’ কি যে তাঁরা চান, হয়তো নিজেরাই জানেন না । অন্যদের আর জানান দেবেন কি !

আমাদের মিডিয়া মোঘলদের কথা একটু অবশ্য বলা দরকার । আমেরিকায় ওবামার জয়ে তারস্বরে বিজয় উল্লাস করতে পারবেন, কিন্তু নিজের দেশের কোন সংখ্যালঘুকে রাষ্ট্রপতি হতে  সমর্থন দেবেন, এতটা আশা না করাই ভালো । আমেরিকায় এবার ওবামা সেখানকার মিডিয়ার যে সাপোর্ট পেয়েছিলেন তা তো অতুলনীয় । আমাদের মিডিয়া এমনটা করবে তা কি ভাবা যায়? প্রিন্ট মিডিয়ায় দুইদলের ধামাধরা ‘সম্মানিত’ সাংবাদিকরা তাদের নেত্রীর বন্দনা গেয়ে যে ভাবে কলম ধরেন- তাতে এদের চেতনার স্তর কোন পর্যায়ে আছে ভাবলে লজ্জাই লাগে । তথাকথিত প্রগতিশীল সাংবাদিকেরাও দেখেছি নারী নীতি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলেন। ধর্মের দোহাই পারেন । যদিও ঠিক আমিনীদের ভাষায় নয়, তাদের ভাষা আরও পরিমার্জিত, আরও মোলায়েম – আসল সুর কিন্তু একই ! চেহারার বিরক্তিকর কুঞ্চন তো আর লুকানো যায় না !

 আর  টিভি চ্যানেলগুলো? আছে কিভাবে সাধারণ মানুষের পকেট কেটে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মহাতারকা বানানোর অছিলায় নিজেদের পকেট ভরার ধান্ধায় ! জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বাদ দিয়ে ছেলেমেয়েরা এখন ক্ষেপে উঠেছে সবাই তারকা হবে ! ভাবি,এতো ‘তারার’ জায়গা কোথায় হবে ! অন্যদিকে আছে আরেক উপাত, পারলে সবাইকে মুসলমান বানিয়ে ছাড়বে যেনো পণ করেছে ! ‘ইসলামী সওয়াল জওয়াব’ এর পশরা সাজিয়ে বসার বহর দেখলে মাথা ঘুরে যায় ! কি সওয়াল জওয়াব নেই তাতে? যেনো এই দেশে আর কোন ধর্মের মানুষ নেই । এরা করবে সংখ্যালঘু কোন মানুষকে রাষ্ট্রপতি? তবেই হয়েছে !         

আমাদের এইসব রাজনীতিক, এইসব শিক্ষক,সাংবাদিক, সুশীল সমাজ(নিজেরা নিজেদের সুশীল নাম দিয়ে জাতে উঠার কি নগ্ন চেষ্টা!)সব পচে যাওয়া, পোকায় খাওয়া, ঘুণে ধরা বাতিল মাল  । হ্যা, তবে স্বপ্ন তো দেখতেই পারি ! নতুন কিছুর জন্য আমাদের তাই দরকার নতুন রক্ত, নতুন জন্ম, নতুন মানুষ ! খোলনলচে পালটে ফেলা নতুন সব……