ডারউইন দিবস প্রবন্ধমালাঃ প্রাকৃতিক নির্বাচনের পরীক্ষা
শিক্ষানবিস
মূল প্রবন্ধ – Testing Natural Selection
লেখক – H. Allen Orr
সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান, জানুয়ারি ২০০৯
বিজ্ঞানের অনেক আবিষ্কারই সময়ের প্রয়োজন বুঝেনি, এসেছে প্রয়োজনের অনেক পরে। জটিলতা, দুর্বোধ্যতা, সূক্ষ্ণতা ইত্যাদি অনেক কিছুকেই এর জন্য দায়ী করা যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্যে এর কোনটিই ছিল না। তারপরও অন্যান্য অনেক বিপ্লবের তুলনায় এটি বেশ দেরিতে শুরু হয়েছে। এই ১৮৫৮ সালে চার্লস ডারউইন ও আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে প্রথম লিখেছেন, আর বিপ্লব সৃষ্টিকারী “অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস” প্রকাশিত হয়েছে মাত্র ১৮৫৯ সালে। সব দেখে তাই মনে হয়, অতিরিক্ত সরল হওয়ার কারণেই এটি বুঝতে আমাদের এতো দেরি হয়েছে। কিছু নির্দিষ্ট পরিবেশের সাথে কিছু নির্দিষ্ট জীবই খাপ খাইয়ে নিতে পারে। অভিযোজনের দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা এই জীবগুলোর বংশধরের সংখ্যা তুলনামূলক বেশী হয়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর তাই তারা উক্ত পরিবেশে আধিপত্য বিস্তার করে। অন্যভাবে বলা যায়, পরিস্থিতির সাথে যারা সবচেয়ে বেশী খাপ খাইয়ে নিতে পারে, পরিবেশ নিজেই তাদেরকে “নির্বাচিত” করে। সময়ের স্রোতে পরিবেশের শর্ত পরিবর্তিত হয়, আরোপিত এই নতুন শর্তগুলোর সাথে যারা মানিয়ে নিতে পারে তারাই দিন দিন আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে, বাকিরা পিছিয়ে পড়ে। ডারউইনবাদ কিন্তু জীববিজ্ঞানের কোন জটিল রহস্যের সমাধান করার মাধ্যমে বিপ্লবের জন্ম দেয়নি। প্রকৃতির মৌলিক যুক্তিটি যে একেবারে সাধারণ হতে পারে, সেটা বোঝানোর মাধ্যমেই সে বিপ্লবের সূচনা ঘটিয়েছে।
তত্ত্বটি খুব সরল, অথচ তার গ্রহণযোগ্যতার ইতিহাস খুব জটিল। জটিল বলছি এইজন্যে যে, মানুষ সহজে এটা মেনে নিতে পারেনি, যার ফলে অনেক অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রজাতি বিবর্তিত হয়, এটা জীববিজ্ঞানীরা সহজেই মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিশাল ভূমিকার বিষয়টি প্রথমদিকে কেউই মেনে নেয়নি। অনেকদিন এই অবস্থা বিরাজমান ছিল। প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাবর্জনীন গ্রহণযোগ্যতা এসেছে এই বিংশ শতকে।
প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে আজ আর কোন দ্বিধা নেই। এটা প্রমাণ করার মত যথেষ্ট উপাত্ত এখন আমদের হাতে আছে। কিন্তু এ নিয়ে গবেষণা কখনই থেমে থাকবে না। কারণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়াটি কাজ করে সেটাই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে। এর দুটি কারণ হতে পারে: গবেষণার জন্য বর্তমানে অনেক সূক্ষ্ণ যন্ত্রপাতি উদ্ভাবিত হয়েছে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের জিনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাটি নতুন নতুন অনেক পরীক্ষার জন্ম দিয়েছে। এখন এই প্রক্রিয়া জীববিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রকে যতটা প্রভাবিত করছে আর দুই দশক আগেও সেটা ভাবা যেত না। প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে বতর্মানে যেসব গবেষণা হচ্ছে সেগুলোর সাধারণত তিনটি প্রধান লক্ষ্য থাকে: এটা কত ঘন ঘন ঘটে, প্রাকৃতিক নির্বাচন যে অভিযোজন ঘটায় তার কারণে জিনের মধ্যে কি কি পরিবতর্ন ঘটে এবং বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান সমস্যা তথা নতুন প্রজাতির উৎপত্তিতে এটা ঠিক কতটুকু ভূমিকা রাখে সেগুলো বের করা।
প্রাকৃতিক নির্বাচন: সাধারণ ধারণা
প্রাকৃতিক নির্বাচন বোঝার জন্য প্রথমেই আমাদেরকে এমন একটি প্রজাতি নিতে হবে যাদের আয়ুষ্কাল খুব কম, কারণ সেক্ষেত্রে তাদের অনেকগুলো প্রজন্ম পর্যবেক্ষণ করা যাবে। কিছু ব্যাক্টেরিয়া আছে যারা প্রতি আধা ঘণ্টায় নতুন প্রজন্মের জন্ম দিতে পারে। তাহলে এই ব্যাক্টেরিয়াকেই উদাহরণ হিসেবে নেয়া যাক। প্রথমেই এই ব্যাক্টেরিয়ার এমন দুটি পপুলেশন নেই যাদের জিনের গঠন ভিন্ন। দুই পপুলেশনেই ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা সমান হতে হবে। আরও একটি শর্তের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে: দুই পপুলেশনের ব্যাক্টেরিয়ার বংশধরেরাই যেন বিশুদ্ধ হয়; অর্থাৎ প্রথম ধরণের ব্যাক্টেরিয়ারা কেবল প্রথম ধরণের ব্যাক্টেরিয়াই জন্ম দেবে আর দ্বিতীয় ধরণেরগুলো কেবল দ্বিতীয় ধরণের ব্যাক্টেরিয়া জন্ম দেবে, কোন মিশ্র ব্যাক্টেরিয়ার জন্ম হবে না। এখন ধরা যাক পরিবেশে পরিবতর্ন আসল। এমন এক এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হল, প্রথম ধরণের ব্যাক্টেরিয়াগুলো যার সাথে মানিয়ে নিতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয় ধরণের গুলো পারে না। এই নতুন পরিবেশে তাই প্রথম ধরণের গুলো বেশী উপযোগী, তারা বেশি সুবিধা পাবে এবং অপেক্ষাকৃত বেশি সন্তান-সন্ততির জন্ম দেবে।
এখান থেকেই বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানে “ফিটনেস” ধারণাটি এসেছে। একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে কোন পপুলেশনের বেঁচে থাকা এবং বংশবিস্তারের সম্ভাব্যতাকেই ফিটনেস বলা হয়। প্রকৃতিতে আমরা এই ফিটনেসেরই খেলা দেখি। তবে অবশ্যই ব্যাপারটা এত সরল না। ফিটনেস অবশ্যই কাজ করে, কিন্তু সেটা এমন নয় যে- তুমি ফিট না তাই তোমাকে মরতে হবে। এর সাথে অনেক খুটিনাটি জড়িয়ে আছে এবং এটা অনেক সময়েরও ব্যাপার।
বিবর্তনবাদী জিনবিজ্ঞানীরা এই ফিটনেস সম্পর্কে আরও অনেক খুটিনাটি তথ্য আবিষ্কার করতে পেরেছেন। এই আবিষ্কার বুঝতে হলে প্রথমেই পরিব্যক্তি (mutation) কাকে বলে তা জেনে নেয়া প্রয়োজন। ডিএনএ-র ভেতরে মূলত চারটি ক্ষার (এদের সংক্ষিপ্ত রূপ A, G, C এবং T) দিয়ে গঠিত এক ধরণের তন্তু থাকে যার নাম নিউক্লিউটাইড। এরাই জীবদেহের জিনোমের ভাষা তৈরী করে। নিউক্লিউটাইডের ক্রমবিন্যাসে দৈব পরিবর্তন ঘটাকেই পরিব্যক্তি বলে। সহজ কথায় বলা যায়, ডিএনএ-র জিনোম ভাষার একটি বর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যাওয়াকেই পরিব্যক্তি বলে। পরিব্যক্তি ঘটার সম্ভাব্যতা কত তাও আমরা জানি: প্রতি প্রজন্মের প্রতিটি জননকোষের ১ বিলিয়ন নিউক্লিউটাইডের মধ্যে মাত্র একটিতে পরিব্যক্তি ঘটতে পারে। অধিকাংশ দৈব পরিব্যক্তিই ফিটনেসের জন্য খুব ক্ষতিকর। এটাই স্বাভাবিক, যে পরিবর্তন নিয়ন্ত্রিত নয় অর্থাৎ দৈব তার কারণে গঠনমূলক কিছু না হওয়াই স্বাভাবিক। ঠিক যেমন, একটি কম্পিউটার কোডে টাইপো কেবল ক্ষতিই করে।
তাই বলা যায়, অভিযোজনমূলক বিবর্তন দুই ধাপে ঘটে- একটি ধাপের চালিকাশক্তি থাকে পরিব্যক্তি, আর অন্য ধাপের চালিকাশক্তি থাকে নির্বাচন। প্রতি প্রজন্মেই পরিব্যক্তির মাধ্যমে নতুন জিন বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিক নির্বাচন এই নতুন জিনগুলোকে পরীক্ষা করে। এভাবে খারাপ (তুলনামূলক আনফিট) জিনগুলোর পরবর্তীতে আসার সম্ভাবনা কমে যায় এবং ভাল (অপেক্ষাকৃত ফিট) জিনগুলোর আসার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। (অবশ্য একটি পপুলেশন তার মধ্যে সব ধরণের জিনই রেখে দিতে পারে এবং পরে সময়-সুযোগ মত সেগুলো ব্যবহার করতে পারে। এরকম হলেই আসলে পপুলেশনের জন্য বেশী ভাল হয়। একটু আগে দেয়া ব্যাক্টেরিয়ার উদাহরণটাই এখানে টানা যায়। প্রথম ধরণের ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যে এন্টিবায়োটিক থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে জিনটি ছিল সেটা কিন্তু তার আগে কাজে লাগেনি। কারণ, এর আগে সে এন্টিবায়োটিক-মুক্ত পরিবেশে ছিল। কিন্তু নতুন পরিবেশে সেই জিনটিই তার কাজে লেগে গেছে- ভাগ্যিস সে সেটা জমা করে রেখেছিল।)
পপুলেশন জিনবিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক নির্বাচনের এই প্রভাবটিকে গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করে আমাদের আরও চমকে দিয়েছেন। তারা অংক কষে দেখিয়েছেন, একটি পপুলেশনের মধ্যে যে যত ফিট তার বেড়ে উঠা ও বংশবিস্তারের সম্ভাবনাও তত বেশী; এমনকি তারা এই বৃদ্ধির হারও বের করেছেন। কিন্তু যে জিনিসটি স্বয়ং জিনবিজ্ঞানীদেরকেও চমকে দিয়েছে, তা হল প্রাকৃতিক নির্বাচনের শকুনের মত চোখ। সত্যি কথা, প্রাকৃতিক নির্বাচনের পর্যবেক্ষণ শক্তি এতই বেশী যে সে বিভিন্ন ধরণের জিনের ফিটনেসে অতি সূক্ষ্ণ পার্থক্যও ধরে ফেলে। সে ১০ লক্ষ জীবের একটি পপুলেশনের ফিটনেসে ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ পরিবর্তনও চিহ্নিত করতে পারে।
ছবি : মিউটেশন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন
ছবি : প্রাকৃতিক বিবর্তন এবং জেনেটিক ড্রিফট
প্রাকৃতিক নির্বাচনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা একটি সম্পূর্ণ প্রজাতি থেকে শুরু করে জিন পর্যন্ত প্রতিটি জীববৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটেই সমানভাবে কাজ করতে পারে। প্রতিটি প্রেক্ষাপটেই তার কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। ডারউইন থেকে শুরু করে সব জীববিজ্ঞানী একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির বিভিন্ন জীবের মধ্যে ফিটনেসের পার্থক্য নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু টিকে থাকার সংগ্রামে একের সাথে অন্যের পার্থক্য, পুনর্জনন এবং আরও অনেক বিষয়ের উপরই প্রাকৃতিক নির্বাচনের কাজ করতে পারার কথা, মূলনীতি থেকে অন্তত তা-ই বোঝা যায়। উদাহরণ হিসেবে দুটি প্রজাতি নেয়া যায় যাদের একটির বাসযোগ্য এলাকা ছোট এবং অন্যটির বাসযোগ্য এলাকা অনেক বড়। হিসেব মতে, বড় এলাকার প্রজাতির টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশী। কারণ ছোট ছোট কয়েকটি এলাকায় তারা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও অসুবিধা নেই, অন্য এলাকা দিয়ে পুষিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু ছোট এলাকার প্রজাতি একবার বিলুপ্ত হলেই শেষ। এ থেকে তাই ধারণা করে নেয়া যায়, সময়ের সাথে সাথে বড় এলাকার প্রজাতি সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে।
এই যুক্তি এমনিতে শুনতে বেশ মানানসই মনে হয়। আর এত উঁচু স্তরেও প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করতে পারে বলে বিবর্তনবাদীরা মনে করেন। কিন্তু অধিকাংশ জীববিজ্ঞানীরাই মনে করেন, প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রধানত একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন জীব বা জিনের ধরণের উপর বেশী কাজ করে। এর একটি কারণ হতে পারে, একটি জীবের আয়ুষ্কাল সমগ্র প্রজাতিটির আয়ুষ্কালের চেয়ে অনেক কম। যার ফলে, জীবেদের উপর প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাব প্রজাতির তুলনায় অনেক বেশী।
প্রাকৃতিক নির্বাচন কতটা স্বাভাবিক?
এ বিষয়ে যে প্রশ্নটি আমাদের মনে সবচেয়ে বেশী জাগে সেটার উত্তর দেয়াই সবচেয়ে কঠিন। প্রশ্নটা হল: একটি পপুলেশনের সামগ্রিক জিন গড়নের পরিবর্তনে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভূমিকা কতটুকু? জীবদেহের অধিকাংশ ভৌত বৈশিষ্ট্যের বিবর্তনই প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে হয়। ঠোঁট, বাইসেপ ও মস্তিষ্কের মত বড় বড় অঙ্গগুলোর বিবর্তন প্রাকৃতিক নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু আণবিক স্কেলে সংঘটিত বিভিন্ন পরিবর্তনে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভূমিকা কতটুকু তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। গত কয়েক লক্ষ্য বছরে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় ডিএনএ-র মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ কি প্রাকৃতিক নির্বাচনই নাকি আরও কারণ আছে সেটা এখন ভেবে দেখার বিষয়।
১৯৬০ এর আগে জীববিজ্ঞানীরা মনে করত, সব পরিবর্তনের কারণই প্রাকৃতিক নির্বাচন। কিন্তু জাপানী গবেষক মোতু কিমুরার নেতৃত্বে একদল পপুলেশন জিনবিজ্ঞানী এই ধারণার বিরোধিতা করেন। তারা বলেছিলেন, আণবিক বিবর্তনের প্রধান কারণ ইতিবাচক প্রাকৃতিক নির্বাচন (যারা বেশী ফিট পরিবেশ তাদেরকে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করে) হতে পারে না। এর বিপরীতে তাদের ব্যাখ্যাটা ছিল এরকম- জিনের সবগুলো পরিব্যক্তির মধ্যে যেগুলো টিকে থাকে সেগুলো নির্বাচনের দিক দিয়ে নিরপেক্ষ। অর্থাৎ তারা ফিটনেস বিবেচনা করে টিকে থাকে না। ক্ষতিকর পরিব্যখ্তি সম্পর্কে তারা বলেছিলেন, এগুলো হরহামেশাই ঘটে কিন্তু বর্ধিষ্ণু পপুলেশনের মধ্যে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। সুবিধা করতে পারলে তো আরা পপুলেশনটি বর্ধিষ্ণু হতো না। এই নতুন ব্যাখ্যায় বিবর্তনের যে চিত্রটি পাওয়া যায় তা এরকম: আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য পরিবেশে নিরপেক্ষ পরিব্যক্তির প্রভাব বোঝা যায় না। সবার অন্তরালেই এরা প্রভাব বিস্তার করতে থাকে এবং অনেক সময়ের ব্যবধানে জিনের গড়নে বিশাল কোন পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই প্রক্রিয়ার নাম “দৈব জিনতাত্ত্বিক বিচ্যুতি” (random genetic drift)। একে আণবিক বিবর্তনের নিরপেক্ষ তত্ত্বের প্রাণ বলা যায়।
১৯৮০-র দশকের মধ্যে অনেক বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানীই নিরপেক্ষ তত্ত্বটি মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলছিল না, সব প্রমাণই ছিল পরোক্ষ। দুটি ক্ষেত্রে বিরাট উন্নতির কারণে প্রমাণের সমস্যা মিটে গেছে। প্রথমত, পপুলেশন জিনবিজ্ঞানীরা জিনোমের অভিযোজিত পরিবর্তন থেকে নিরপেক্ষ পরিবর্তন আলাদা করার জন্য বিশেষ ধরণের পরিসাংখ্যিক পরীক্ষণ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। দ্বিতীয়ত, নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক প্রজাতির অসংখ্য জিনোমের তথ্য ধারণ করা সম্ভব হয়েছে, এই ধারণকৃত তথ্যগুলোর মাধ্যমেই আবার পরিসাংখ্যিক পরীক্ষাগুলো করা যাচ্ছে। এভাবে প্রাপ্ত নতুন উপাত্তগুলো আমাদের বলছে, প্রাকৃতিক নির্বাচনকে নিরপেক্ষ তাত্ত্বিকেরা যত তুচ্ছ মনে করছেন এটা আসলে ততটা তুচ্ছ না।
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, ডেভিস-এর একটি গবেষক দল (ডেভিড জে বিগান ও চার্লস এইচ ল্যাংলি-র নেতৃত্বে) ড্রসোফিলা গণের দুটি প্রজাতি নিয়ে কিছু তুলনামূলক পরীক্ষা করেছে। তারা প্রতি প্রজাতি থেকে ৬,০০০ টি করে জিন নিয়েছিলেন, এরপর পরীক্ষা করে দেখেছিলেন সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার পর এদের কোন কোন জিনগুলোতে পরিবর্তন এসেছে। পরিসাংখ্যিক পরীক্ষার মাধ্যমে তারা দেখলেন, শতকরা ১৯ ভাগ জিনের পরিবর্তনে নিরপেক্ষ বিবর্তনের কোন ভূমিকা নেই। অর্থাৎ পাঁচ ভাগের এক ভাগ জিনের বিবর্তন প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে ঘটেছে। (এই পরিসাংখ্যিক পদ্ধতি বেশ রক্ষণশীল ছিল, প্রকৃত অনুপাত তাই আরও বড় হতে পারে।) তাই নিরপেক্ষ বিবর্তনকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। বাকি ৮১% পরিবর্তন তো দৈব বিচ্যুতি প্রক্রিয়াও ঘটে থাকতে পারে। এ সম্বন্ধেনিশ্চিত করে কিছু বলা না গেলেও এটা বলা যায় যে, বিবর্তনে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এরকম আরও অনেক পরীক্ষা করেও দেখা গেছে, প্রাকৃতিক নির্বাচন বিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রাখে, এমনকি ডিএনএ-র নিউক্লিউটাইডে পরিবর্তনের জন্যও প্রাকৃতিক নির্বাচনকে দায়ী করা যায়।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের জিনতত্ত্ব
প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে বিজ্ঞানীরা হিমশিম খাচ্ছেন। ঠোঁট বা মস্তিষ্কের মত বড় বড় ভৌত বৈশিষ্ট্যগুলো যে প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত এ নিয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু এর প্রক্রিয়াও আমরা পুরোপুরি জানি না। কিন্তু সম্প্রতি এই প্রক্রিয়া সমস্যার সমাধানে জিনতত্ত্ব এগিয়ে এসেছে। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, জিনতত্ত্ব প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। প্রমাণ পাওয়ার পর বিজ্ঞানীরা এখন নির্বাচন বিষয়ক কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন। যেমন, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যশে যখন কোন নতুন পরিবেশে একটি জীবের অভিযোজন ঘটে তখন তার গুটিকয়েক জিন বদলে যায় নাকি অণেকগুলো বদলে যায়? এই বদলে যাওয়া জিনগুলো কি চিহ্নিত করা সম্ভব? একটি পরিবেশে অভিযোজনের সময় যে জিনগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে অন্য স্থানে বা অন্য সময়ে সেই একই পরিবেশ তৈরী হলে কি ঠিক সেই জিনগুলোই পরিবর্তিত হবে নাকি এক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু হবে?
এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া বেশ কঠিন। হতে পারে, একটি উপকারী পরিব্যক্তির জন্য ফিটনেস সামান্য বাড়লো, এতই সামান্য যে সহজে বোঝা যায় না। সেক্ষেত্রে বিবর্তন হবে খুব ধীরে, আমরা বুঝতেই পারব না। কিন্তু জীববিজ্ঞানীরা একটি বিশেষ উপায়ে এই সমস্যার সমাধান করেছেন। তারা দ্রুত বংশবিস্তারকারী জীবের কয়েকটি পপুলেশন নিয়ে তাদের একেকটিকে একেক পরিবেশে স্থাপন করেছেন। এই পরিবেশগুলোর মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশী হওয়ায় বিবর্তন ত্বরান্বিত হয়েছে। এক্ষেত্রে পরিব্যক্তি যে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে তাহলে তো কথাই নেই। অণুজীব নিয়ে আরও কিছু পরীক্ষা হয়েছে। যেমন, বিজ্ঞানীরা একেবারে অভিন্ন কিছু অণুজীবকে একটি সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে অভিযোজন করতে দিয়েছেন। তাদের সবার ডিএনএ ক্রম যেহেতু অভিন্ন সেহেতু, পরিব্যক্তির মাধ্যমে আসা নতুন ডিএনএ ক্রমগুলোর উপরই কেবল প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করবে। এরপর পর্যবেক্ষকরা সময়ের সাথে কিভাবে ফিটনেস পরিবর্তিত হচ্ছে তার লেখ তৈরী করতে পারবেন, নতুন পরিবেশে পুনর্জননের হারই ফিটনেসের পরিমাপক।
বিবর্তনের সবচেয়ে ভাল পরীক্ষাগুলো করা হয়েছে ব্যাক্টেরিওফাজ দিয়ে। এরা এত ছোট যে ভাইরাস যে স্বয়ং ব্যাক্টেরিয়াই এদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। এদের জিনোমও খুব সংক্ষিপ্ত। বিজ্ঞানীরা প্রথমেই তার পুরো জিনোম রেকর্ড করেন, পরীক্ষা শেষে আবার রেকর্ড করেন। আর পরীক্ষা চলাকালীন সময়েও যতবার ইচ্ছা রেকর্ড করা সম্ভব। এর ফলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের খুব সূক্ষ্ণ প্রভাবগুলোও বোঝা যায়।
ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস, অস্টিন-এর K. Kichler Holder এবং জেম্স জে বুল এরকম একটি পরীক্ষা করেছেন। তাদের পরীক্ষার সাবজেক্ট ছিল ব্যাক্টেরিওফাজের দুটি পরস্পর সম্পর্কিত প্রজাতি: ফাইএক্স১৭৪ ও জি৪। এই দুই ভাইরাসই Escherichia Coli বাক্টেরিয়াকে আক্রান্ত করে। তারা প্রজচাতি দুটোকে উচ্চ তাপমাত্রার পরিবেশে অবিযোজিত হতে দেন। নতুন উষ্ণ পরিবেশে দুই প্রজাতির ফিটনেসই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। আর দুই প্রজাতির ক্ষেত্রেই বিবর্তনের প্রক্রিয়াটা ছিল একরকম:পরীক্ষার শুরুতে ফিটনেস দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং শেষটায় এসে প্রায় স্থির হয়ে যায়। এমনকি হোল্ডার ও বুল এই অভিযোজনের জন্য দায়ী ডিএনএ পরিব্যক্তিগুলোও চিহ্নিত করেছিলেন।
বন-বাদাড়ে প্রাকৃতিক নির্বাচন
পরীক্ষণমূলক বিবর্তনবাদের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল, এর মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভূমিকা আমাদের কাছে দিন দিন আরও স্পষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এই সবগুলো পরীক্ষাই গবেষণাগারে বসে করতে হয়, কারণ বনে-বাদাড়ে জীব-জন্তু ধরে তাদের সম্পূর্ণ জিনোম ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। তবে অনেকে আশা করছেন, অচিরেই পরীক্ষা পদ্ধতি নতুন মোড় নেবে। এর মাধ্যমে আরও প্রাকৃতিক তথা আরও স্বাভাবিক পরিবেশে প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে গবেষণা রা যাবে। তবে এর জন্য আমাদেরকে অবশ্যই একটি নতুন উপায় বের করতে হবে।
এর জন্য বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানীরা প্রথমেই এমন প্রজাতিগুলোকে নির্দেশ করেন যারা অনেক আগে থেকেই বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। তাদের মধ্যে অভিযোজনের কারণে যত পরিবর্তন এসেছে তার সবই অনন্য বিধায় সেগুলো নিয়ে পরীক্ষা করে ভাল ফল পাওয়া যায়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাওয়া এই প্রজাতিগুলোর জিনোম তথ্য ধারণ করাই বিজ্ঞানীদের পরবর্তী কাজ। উদাহরণ হিসেবে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির Douglas W. Schemske এবং ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের এইচ ডি ব্র্যাডশ-র গবেষণার কথা বলা যায়। তারা মাংকিফ্লাওয়ারের দুটি প্রজাতিতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাব বিশ্লেষণ করেছেন। প্রজাতি দুটো খুব কাছাকাছি হলেও একটিতে (Mimulus lewisii) পরাগায়ণ ঘটে ভ্রমরের মাধ্যমে এবং অন্যটিতে (M. cardinalis) পরাগায়ণ ঘটে হামিংবার্ডের মাধ্যমে। অন্যান্য প্রজাতি থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, Mimulus গণের পাখিদের পরাগায়ণ মৌমাছির পরাগায়ণ থেকে বিবর্তিত হয়েছে।
পরাগায়ণে সাহায্যকারীর প্রকৃতি অনুযায়ী প্রজাতি দুটোতে কিছু পার্থক্য দেখা যায়। যেমন, M. lewisii-র ফুলের রং গোলাপী, কিন্তু M. cardinalis এর ফুলের রং লাল। Schemske ও ব্র্যাডশ প্রজাতি দুটোর সংকর করে দেখিয়েছেন, মিশ্র প্রজন্মগুলোতে ফুলের রঙে যে পরিবর্তন আসে তা একটিমাত্র জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জিনটির নাম ইয়েলো আপার (YUP)। এই আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে তারা দুই ধরণের সংকর তৈরী করেন যাদের একটিতে YUP জিন আসে M. cardinalis থেকে এবং বাকি সবগুলো জিন আসে M. lewisii থেকে। এই ধরণের সংকরে ফুলের রং হয় কমলা। দ্বিতীয় ধরণের সংকর প্রথমটির বিপরীত, অর্থাৎ এর YUP জিন এসেছে M. lewisii থেকে এবং বাকি সবগুলো এসেছে M. cardinalis থেকে। এই সংকরে ফুলের রং গিয়ে দাড়ায় গোলাপীতে।
এরপর তারা সংকর উদ্ভিদগুলোকে বনাঞ্চলে রোপণ করেন, আর পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন সংকরগুলো পরাগরেণু বহনকারীর উপর YUP জিনের ব্যাপক প্রভাব আছে। সাধারণ M. lewisii উদ্ভিদের কাছে যত হামিংবার্ড আসতো M. cardinalis থেকে YUP জিন পাওয়া সংকর M. lewisii উদ্ভিদগুলোর কাছে তার তুলনায় ৬৮ গুণ বেশী হামিংবার্ড আসে। আর সাধারণ M. cardinalis উদ্ভিদের কাছে যত হামিংবার্ড আসতো M. lewisii থেকে YUP জিন পাওয়া সংকর M. cardinalis উদ্ভিদগুলোর কাছে তার তুলনায় ৭৪ গুণ বেশী ভ্রমর আসে। এরপর আর কোন সন্দেহই রইল না যে, M. cardinalis ও M. lewisii এর পরাগায়ণে যে বিবর্তন ঘটেছে তার মূল চালিকাশক্তি YUP জিন। এই পরীক্ষা থেকেই প্রমাণিত হল, আপাতদৃষ্টিতে একেবারে সাধারণ জিনতাত্ত্বিক পরিবর্তনও প্রাকৃতিক নির্বাচনের চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করতে পারে।
প্রজাতির উৎপত্তি
প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উৎপত্তি হয়- এটাই ছিল প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্পর্কে ডারউইনের সবচেয়ে বলিষ্ঠ দাবী। তার বইয়ের নামই রেখেছিলেন “অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস” (প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে)। কিন্তু আসলেই কি এমনটি হয়? একটিমাত্র বংশধারা ভেঙে পৃথক পৃথক দুটি ধারা তৈরীতে প্রাকৃতিক নির্বাচন কতটা ভূমিকা রাখে? এই প্রশ্নগুলোই বর্তমানে বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞান গবেষণার প্রধান বিষয়।
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে হলে প্রথমেই জীববিজ্ঞানীরা “প্রজাতি” বলতে কি বুঝেন তা জেনে নিতে হবে। ডারউইনের প্রজাতির ধারণা এখন খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয়। এর বদলে সাধারণ জীববৈজ্ঞানিক প্রজাতির ধারণাটিই এক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়েছে। এই ধারণার সারকথা হচ্ছে, এক প্রজাতির সাথে অন্য প্রজাতির পুনর্জনন সম্ভব না- যারা নিজেদের মধ্যে পুনর্জননে সক্ষম তাদেরকেই একটি প্রজাতি বলা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, একটি প্রজাতির মধ্যে এমন কিছু জিনতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য থাকে যার কারণে সে অন্য প্রজাতির সাথে জিন বিনিময় করতে পারে না। অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন জিনতাত্ত্বিক ধারা থাকে।
একটি প্রজাতি ভেঙে একাধিক প্রজাতি হওয়ার অর্থই তাদের মধ্যে পুনর্জনন অসম্ভব হয়ে পড়া। এটা হওয়ার আগে তাদেরকে অবশ্যই ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হতে হবে। এক স্থানে বসবাসকারী এক প্রজাতির কিছু জীব যদি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অন্য একটি স্থানে চলে যায় তবেই তাদের মধ্যে পুনর্জননকেন্দ্রিক বিভাজন তৈরী হওয়া শুরু হবে, অন্যথায় না। আর এই বিভাজনই কালক্রমে ভিন্ন প্রজাতির জন্ম দিতে পারে। ডারউইন গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপে ফিঞ্চের বিভিন্ন প্রজাতি দেখেছিলেন। এরা কিন্তু প্রজাতি হিসেবে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার আগেই ভৌগলিকভাবে বিভক্ত হয়েছিল।
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নতুন প্রজাতি উৎপত্তির প্রথম ধাপ একই প্রজাতির এক অংশের সাথে অন্য অংশের পুনর্জনন অসম্ভব হয়ে পড়া। এর পর প্রজাতি সৃষ্টির প্রক্রিয়া বিভিন্নভাবে এগোতে পারে। যেমন, একই প্রজাতি মনে করে পুরুষ জীবটি হয়ত নতুন প্রজাতির কোন স্ত্রী জীবের সাথে যৌন জননে অংশ নিতে চাইবে আর স্ত্রীটি তাতে অসম্মতি জানাবে। অবশ্য এক্ষেত্রে আগেই প্রজাতি দুটিকে ভৌগলিক সংস্পর্শে আসতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, Pieris occidentalis প্রজাতির স্ত্রী প্রজাপতিরা কখনই P. protodice প্রজাতির পুরুষ প্রজাপতির সাথে যৌন জননে অংশ নেবে না। প্রজাতি দুটো খুব কাছাকাছি, কিন্তু কিছু পার্থক্য আছে, দুই প্রজাতির পুরুষ প্রজাপতিদের পাখার গঠন ভিন্ন। এই ভিন্ন পাখার গঠন দেখেই বোধহয় স্ত্রী প্রজাপতিরা যৌন সঙ্গী নির্বাচন করে। আর এমন দুই প্রজাতির দুটি প্রাণী যদি হঠাৎ মিলিত হয়েই যায়, তাহলে যে নতুন বংশধরের জন্ম হবে তার বিকাশ স্বাভাবিক হবে না, বন্ধ্যাত্বও দেখাদিতে পারে। তবে এই যৌন মিলনের মাধ্যমে নতুন একটি প্রজাতি সৃষ্টির প্রক্রিয়াও শুরু হতে পারে। দুই প্রজাতির সকল সংকরই যদি বন্ধ্যা হয় বা মারা যায় তাহলে তাদের মধ্যে আর কখনই জিন বিনিময় সম্ভব হবে না। আধুনিক যুগে তাই জীববিজ্ঞানীদের কাছে পুরনো প্রশ্নই নতুন রূপে দেখা দিয়েছে। আগে প্রশ্ন ছিল, প্রাকৃতিক নির্বাচন নতুন প্রজাতির উৎপত্তিতে ভূমিকা রাখে কি-না। আর বর্তমান প্রশ্ন হচ্ছে, প্রাকৃতিক নির্বাচন পুনর্জননের বিভাজন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে কি-না।
বিংশ শতকের অধিকাংশ সময় জুড়েই বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তরে না বলেছেন। তারা এর কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের বদলে দৈব বিচ্যুতিকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। কিন্তু সম্প্রতি হওয়া একটি গবেষণা আমাদের বলছে, প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে দৈব জিনতাত্ত্বিক বিচ্যুতি নামে যে প্রকল্প উপস্থাপন করা হয়েছিল তা সম্ভবত ভুল। প্রজাতির উৎপত্তির ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচনই মুখ্য ভূমিকা রাখে।
একটু আগে মাংকিফ্লাওয়ারের প্রজাতি নিয়ে কথা বলা হয়েছে। তাদের বিবর্তনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেই দৈব বিচ্যুতির বদলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাব প্রকট হয়ে উঠে। এক প্রজাতির পরাগরেণু বাহক যেহেতু প্রায় কখনই অন্য প্রজাতির পরাগরেণু বহন করে না, সেহেতু দুটি প্রজাতিকে পুনর্জননের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ পৃথক বলে ধরে নেয়া যায়। দক্ষিণ আমেরিকার একই অঞ্চলে এই দুই প্রজাতির ফুল জন্মাতে পারে। কিন্তু যে ভ্রমর M. lewisii ফুল থেকে পরাগরেণু বয়ে নিয়ে যায় সে কখনই M. cardinalis এর কাছে যায় না। আবার যে হামিংবার্ড M. cardinalis এর ফুল থেকে পরাগরেণু নিয়ে যায় সে কখনই M. lewisii এর কাছে যায় না। তাই এক প্রজাতির পরাগরেণু কখনই অন্য প্রজাতির ফুলে যেতে পারে না। এমনকি Schemske ও তার সহকর্মীরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন, দুই প্রজাতির মধ্যে জিন বিনিময় বন্ধের পেছনে ৯৮% অবদানই এই ভিন্ন পরাগরেণু বাহকদের। তাই এক্ষেত্রে সন্দেহের কোন অবকাশই থাকে না যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন ভিন্ন প্রজাতি দুটোকে ভিন্ন ভিন্ন পরাগরেণু বাহকের কাছে আকৃষ্ট করে তুলছে এবং এভাবে তাদের অভিযোজনে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। পুনর্জননের এই বিভাজনও প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে হয়েছে।
প্রজাতি পৃথিকীকরণে প্রাকৃতিক নির্বাচনই যে মুখ্য ভূমিকা রাখে তার আরেকটি প্রমাণ এসেছে একেবারে অদ্ভুত একটি উৎস থেকে। গত কয়েক দশকে জিনবিজ্ঞানীরা কয়েকটি সংকর প্রজাতিতে বন্ধ্যাত্ব ও বিকলাঙ্গতার জন্য দায়ী জিনগুলো সনাক্ত করেছেন। তারা মূলত ড্রসোফিলা গণের অন্তর্ভুক্ত ফলের মাছি নিয়ে গবেষণা করেছেন। সনাক্তকৃত জিনগুলো আবার বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে। যেমন: কেউ উৎসেচকের মর্মোদ্ধার করে, কেউ গাঠনিক প্রোটিন সংশ্লেষে সাহায্য করে, কেউ বা আবার ডিএনএ-র সাথে সংযুক্ত প্রোটিন সংশ্লেষণ করে।
এই জিনগুলো নিয়ে গবেষণা করে দুটি আশ্চর্যজনক তথ্য পাওয়া গেছে। প্রথমত, সংকর প্রজাকিগুলোর বংশধরদের মাঝে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী জিনগুলো খুব কম সময়ে অনেক পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এবং দ্বিতীয়ত, তাদের এই দ্রুত পরিবর্তনের জন্য প্রাকৃতিক নির্বাচন দায়ী। পপুলেশন জিনবিজ্ঞানীদের গবেষণায় এই তথ্যগুলো বেরিয়ে এসেছে।
মাংকিফ্লাওয়ার এবং সংকর প্রজাতির বংশবিস্তার নিয়ে যে গবেষণাগুলো করা হচ্ছে তার ফলাফল প্রাকৃতিক নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ভবিষ্যথে নতুন প্রজাতির উৎপত্তিতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাব আরও স্পষ্ট হবে, কারণ এ বিষয়খ পরীক্ষার ক্ষেত্রে দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান কালের জীববিজ্ঞানীরা তো একরকম মেনেই নিয়েছেন যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন একই প্রজাতির মধ্যে বিভিন্ন পরিবর্তন আনয়নের পাশাপাশি নতুন প্রজাতির উৎপত্তিতেই মুখ্য ভূমিকা রাখে। কিছু অকর্মা লোক প্রাকৃতিক নির্বাচনকে যতই অমূলক ও ভূয়া বলুক না কেন, তারা নিজেরাই এটা অস্বীকার করতে পারবে না যে, গত কয়েক দশক ধরে বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
বিবর্তনের প্রত্যক্ষ কিছু প্রমাণ ১. অস্ট্রেলিয়ার বুনো খরগোশ – ইউরোপ থেকে এদেরকে অস্ট্রেলিয়াতে আনা হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার উষ্ণ পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে এদের দেহের আকার, কানের আকার এবং ওজন পরিবর্তিত হয়েছে।
|
চমৎকার অনুবাদ হয়েছে। এক এক করে সায়েন্টিফিক আমেরিকানের বিবর্তন সংখ্যাটার সবগুলোই অনুবাদ করে ফেলুন।