লিখেছেনঃ ফারদিন বিন আব্দুল্লাহ

বাংলাদেশ, যা তার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং ঐতিহাসিক সমৃদ্ধির জন্য বিখ্যাত, সেখানে নানা রকম আদিবাসী সম্প্রদায় রয়েছে, এবং তারা শতাব্দী ধরে এই ভূমিতে বসবাস করে আসছে। তাদের উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক অবদান সত্ত্বেও, আদিবাসী জনগণ তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে অব্যাহত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।

আদিবাসী, যাদেরকে প্রায়শই “মূল জনগোষ্ঠী” (aboriginal) বা “প্রথম জনগণ” ( first peoples) বা “আদি নিবাসী” (native) বলা হয়, এরা এমন জাতিগত গোষ্ঠী যারা নিজেদেরকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের আদি বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত করে।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ১% নিয়ে গঠিত আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীয় পরিচয়, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ঐতিহ্য ধারণ করে। বাংলাদেশের ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, আদিবাসী জনসংখ্যা প্রায় ১,৬৫০,১৫৯ । চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল ব্যতীত বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, সিলেটসহ সমতল ভূমিতেও চাকমা, মার্মা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল এবং ম্রো সম্প্রদায়ের মতো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আদিবাসী গোষ্ঠী রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে পৃথক সম্প্রদায় হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। যদিও ২০১১ সালে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী বাঙালি জনগণ ছাড়াও অনন্য জাতিগত পরিচয় সহ উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ব্যক্তিদের স্বীকৃতি দেয়। তবে, এই সংশোধনীটি কেবল উপজাতি জনগণের সাংস্কৃতিক দিক নিয়ে আলোচনা করে, তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে জমি অধিকারের মতো ক্ষেত্রে নীরবতা রক্ষা করে।

উপরন্তু এই অনুচ্ছেদ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সীমিত সংখ্যক জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশের সংবিধান আদিবাসী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি জানালেও, তাদের অধিকারকে সার্বিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং রক্ষা করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলি অব্যাহত রয়েছে। ২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীতে অনন্য জাতিগোষ্ঠীয় পরিচয় সহ ব্যক্তিদের স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে অগ্রগতি চিহ্নিত হয়, তবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং জমি অধিকারের বিষয়গুলিতে ফাঁক রয়ে গেছে। এছাড়াও, সংবিধানিক বিধানগুলি বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতার অভাব অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করে চলেছে।

বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য জমি অধিকার একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল সমস্যা। এঁরা কয়েক প্রজন্ম ধরে তাদের পূর্বপুরুষদের জমিতে বসবাস করে আসছেন, কিন্তু তাদের জমি সংক্রান্ত অধিকার প্রায়শই বিতর্কিত বা অস্বীকৃত হয়ে থাকে। এই সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠেছে ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা জমি দখলের কারণে।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP) এর বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, জমিহীনতা এবং জমি হস্তান্তর আদিবাসী সম্প্রদায়কে অন্যদের তুলনায় বেশি প্রভাবিত করে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলে প্রায় ২০% আদিবাসী পরিবারের কোনো জমি নেই। অনেককেই তাদের ঐতিহ্যবাহী এলাকাগুলিতে প্রবেশাধিকার ও ঐ জমি ধরে রাখার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার মাত্র ২% হলেও আদিবাসী জনগোষ্ঠীই দেশের ভূমিহীন জনগোষ্ঠীর ৪০% এরও বেশি।

বাংলাদেশের সংবিধান সকল নাগরিকসহ আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য সম্পত্তি অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিলেও তারা তাদের সম্পত্তির অধিকার থেকে অনেকসময় বঞ্চিত।

১৯৯৭ সালের চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল শান্তি চুক্তি সহ অন্যান্য প্রচেষ্টাগুলি জমি বিবাদের সমাধানের লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলি অব্যাহত রয়েছে। দাবি করা অগ্রগতি এবং বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে । এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। জমিসংক্রান্ত বিবাদ মীমাংসা, আমলাতান্ত্রিক বাধাগুলি দূরীকরণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় আদিবাসী প্রতিনিধিদের অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আদিবাসী অধিকারের কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপ।

অন্যান্য দেশের সাথে তুলনায় আদিবাসী বা উপজাতি সম্প্রদায়ের অধিকার স্বীকৃতি সম্পর্কে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের সংবিধান শিডিউলড উপজাতি ও জাতিগুলিকে স্বীকৃতি দেয় এবং তাদের উন্নয়ন ও প্রতিনিধিত্বের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রদান করে, যা বাংলাদেশের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে অনুপস্থিতি। উপরন্তু ভারতীয় প্রশাসন তাদের কৃষ্টি সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিশেষ বিধিমালা প্রণয়ন করে উপজাতি ও আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করতে অবদান রাখছে।

পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বিভিন্ন আদিবাসী জাতীয় পরিচয়কে স্বীকৃতি দেয় এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও ইতিবাচক ব্যবস্থার বিধান অন্তর্ভুক্ত করে। বলিভিয়ার সংবিধানও আত্মনির্ধারণ এবং স্বায়ত্তশাসনসহ আদিবাসী অধিকার স্বীকৃতির জন্য বিখ্যাত।

নাগরিক সমাজ এবং এনজিওরা সচেতনতা অভিযান, লবিং এবং সরকারি সংস্থার সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে আদিবাসী অধিকারের পক্ষে সমর্থন এগিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তাদের তৃণমূল পর্যায়ে উদ্যোগগুলি আদিবাসী সম্প্রদায়কে রক্ষায় এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের স্বীকৃতিতে আরও জোর দেয়। এই সংগঠনগুলি আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সহযোগিতা সহজ করে, যাতে জাতীয় প্রচেষ্টাগুলিকে জাতিসংঘের আদিবাসী জনগণের অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা (UNDRIP) সহ বৈশ্বিক মানের সাথে সামঞ্জস্য করা যায়।

বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতির সুযোগ রয়েছে। সংবিধানের ২৩এ ধারার আওতাকে স্পষ্টভাবে “আদিবাসী” জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য এর বিধি-নিষেধাবলী পরিষ্কার করা উচিত। কেবল সাংস্কৃতিক দিকগুলি নয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারও এই স্বীকৃতিতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

একই সাথে, আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। যাতে তারা সংবিধানিক বিধানের অধীনে তাদের অধিকার কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

বিশেষ করে চট্টগ্রামসহ পাহাড়ি অঞ্চলে জমি বিরোধের দ্রুত সমাধানের জন্য জরুরী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং জমি কমিশনের ক্ষমতা জোরদার করা জরুরী। এতে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করে জমি বিরোধের সমাধান প্রক্রিয়া সহজতর হবে।

উন্নত নীতিমালা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থা এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মধ্যে আরও বেশি সহযোগিতা জরুরী।

আদিবাসী অধিকার রক্ষায় সামাজিক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকৃতি এবং সমর্থন দেওয়া প্রয়োজন। এই সংগঠনগুলিকে অর্থসাহায্য ও কার্যকর সম্পৃক্ততার জন্য প্রয়োজনীয় প্ল্যাটফর্ম সরবরাহ করা উচিত।

বাংলাদেশে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, বৈচিত্র্য এবং সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে আদিবাসী অধিকার সমুন্নত রাখা অপরিহার্য। তুলনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক কাঠামো লাভ করে বাংলাদেশ আদিবাসী অধিকার স্বীকৃতি এবং রক্ষায় তার প্রতিশ্রুতি জোরদার করতে পারে। সরকার, সচেতন নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনের মধ্যে সহযোগিতা বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা এবং আদিবাসী সম্প্রদায় সহ সকল নাগরিকের সমৃদ্ধি ও কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবাই মিলে আমরা আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সম-অধিকার নিশ্চিত করা এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে পারি যেখানে আদিবাসী জনগণের অধিকার সমুন্নত এবং রক্ষা করা হয়।

-ফারদিন বিন আব্দুল্লাহ
শিক্ষার্থী, এলএলএম, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়