বাংলা ভাষার একটা জনপ্রিয় বাগধারা আছে “ণত্ব ষত্ব জ্ঞান নাই” যার বাচিক অর্থ হলো যার কাণ্ডজ্ঞান নাই আর ব্যবহারিক অর্থ হলো বাংলা ব্যাকরণের একটি বিশেষ নিয়ম যার মাধ্যমে আমরা যেন বানানের সময়ে কোথায় স, শ, ষ হবে এবং কোথায় ণ, ন হবে সেই পার্থক্য বুঝতে ও লিখতে পারি। বাংলা ব্যাকরণে ণত্ব ষত্ব নিয়ে একটা আলাদা চ্যাপটার আছে। আপনারা ইচ্ছে করলেই যেকোন ব্যাকরণ বই থেকে পড়ে নিতে পারেন।

তবে সাধারণ কয়েকটা বিষয় মনে রাখলেই আপনি এই অক্ষরগুলোর সঠিক ব্যবহার এবং শুদ্ধ বানান লিখতে পারবেন। খুব সংক্ষেপে ণত্ব বিধান নিয়ে বলি- মনে করেন ট বর্গীয় বর্গীয় ধ্বনির আগে তৎসম শব্দে সব সময় মূর্ধণ্য ‘ণ’ যুক্ত হয়। যেমনঃ কণ্ঠ, ঘণ্টা, লণ্ঠন, লুণ্ঠন ইত্যাদি।

আবার ঋ, র, ষ ধ্বনির পরে ‘ণ’ হয়। যেমনঃ ঋণ, তৃণ, বর্ণ, বর্ণনা, কারণ, মরণ, ব্যাকরণ, ভীষণ, ভাষণ, উষ্ণ ইত্যাদি।

ঋ, র, ষ – এর পরে স্বরধ্বনি, ষ, য়, ব,হ, ং এবং ক – বর্গীয় ও প – বর্গীয় ধ্বনি তার পরবর্তী ‘ন’ মুর্ধন্য ‘ণ’ হয়। যেমনঃ কৃপন, (ঋ- কারের পরে প্, তারপর ণ), হরিণ (র এর পরে ই, তারপরে ণ), অর্পণ (র্+প্+অ+ণ্), লক্ষণ (ক্+ষ্+অ+ণ্)। এরূপ – রুক্মিণী, ব্রাক্ষণ ইত্যাদি।

কিছু শব্দে স্বভাবতই মূর্ধন্য ণ হয় (ণ নিয়ে সুন্দর একটা কবিতা আছে। আগ্রহীগণ পড়ে নিতে পারেন) এবং সকল বিদেশি শব্দে দন্ত্য ন হবে।

এরপর আসি ষত্ব বিধান নিয়ে কিছু কথা বলতে। খাঁটি বাংলা, তদ্ভব এবং বিদেশি শব্দে সাধারণত মূর্ধন্য ষ এর ব্যবহার নেই। আসলে সব “স” ধ্বনি “স” হলেও লিখিত চেহারা “স” নাও হতে পারে। বিদেশি শব্দে সবসময় স হবে। যেমন হাসিনা একটা বিদেশি শব্দ যার উচ্চারণ হবে “হাছিনা”। (অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের লোকদের কথা আলাদা, উনারা ছ বলতে পারেন না। ছফাকে উনারা মনে হয় “সফা” বলবেন।

সংক্ষেপে বলতে গেলেঃ অ, আ ভিন্ন অন্য স্বরধ্বনি এবং ক ও র- এর পরে প্রত্যায়ের স ষ হয়। যেমন-ভবিষ্যৎ (ভ্+অ+ব্+ই+ )এখানে ব-এর পরে ই-এর ব্যবধান), মুমূর্ষু, চক্ষুষ্মান, চিকীর্ষা ইত্যাদি।

ই-কারান্ত এবং উ-কারান্ত উপসর্গের পর কতগুলো ধাতুতে ‘ষ’ হ্য। যেমন – অভিষেক=অভিষেক, সুসুপ্ত= সুষুপ্ত ইত্যাদি।

ঋ’ এবং ঋ কারের পর ‘ষ’ হয়। যেমনঃ ঋষি, কৃষক,উৎকৃষ্ট, দৃষ্টি, সৃষ্টি ইত্যাদি।

তৎসম শব্দে ‘র’ – এর পর ‘ষ’ হয়।যেমনঃ বর্ষা, ঘর্ষণ, বর্ষণ।

র – ধ্বনির পর যদি অ, আ ভিন্ন অন্য স্বরধ্বনি থাকে তবে তার পর ‘ষ’ হয়। যেমনঃ পরিষ্কার।

ট – বর্গীয় ধ্বনির সঙ্গে ‘ ষ’ যুক্ত হয়। যেমনঃ কষ্ট, স্পষ্ট, নষ্ট, ভ্রষ্ট ইত্যাদি।

ইদানীং কিছু লোক করছেন, খেয়েছেন শব্দকে “করেসেন, খেয়েসেন” লিখে নিজেদের এক্সট্রা কুল ডুড প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এদের দেখলে মনে হয় ওদের বাসায় গিয়ে বিনা পয়সায় বাংলা ব্যাকরণ শিখিয়ে দিয়ে আসি।

ণত্ব ষত্বের মত আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে “র, ড় এবং ঢ়” এর মধ্যে পার্থক্য যা অনেকেই বুঝতে পারে না। এগুলো হলো বাংলা বর্ণমালার তাড়নজাত ধ্বনি। মনে করেন, কাপড় পরা আর বই পড়া। পরিধান অর্থে পরা এবং পতন বা পঠন অর্থে পড়া। অর্থাৎ সে বই পড়ে (পঠন অর্থে) অথবা সে গাছ থেকে পড়ে গেল (পতন অর্থে)। সে শাড়ি পরে ( পরিধান অর্থে)। তাহলে এখন যারা কাপড় পড়ে তোরা বইখাতা দিয়ে কী করে? আমার বুদ্ধিতে কুলায় না।

বাংলাভাষায় কথা বলতে পারা একটা বিরাট সৌভাগ্য কারণ এই ভাষার বর্ণমালা দিয়ে আপনি যেকোন ভাষার শব্দ উচ্চারণ করতে পারবেন। যেমন আরবি বর্ণমালায় বর্গীর “জ” নাই তারফলে তারা “দ” দিয়ে জ এর অভাব পুরোন করে। যেমন এখন মানুষ রমজানকে “রামাদান করে ফেলেছে শুধু জ বর্ণের অভাবে। বা হিন্দিতে “ড়” বর্ণ নেই বলে হিন্দিভাষী মানুষ “ড” দিয়ে ড় এর কাজ চালায়। তার ফলে “বলে চুড়িয়া” গানের লাইনকে তাদের লিখতে হয় “বলে চুডিয়া”! কী হাস্যকর!!

অনেকে ড় উচ্চারণ করতে পারে না। তাদের জন্য একটা টেকনিক শিখিয়ে দিই। ড় দিয়ে লেখা শব্দকে “ড” দিয়ে উচ্চারণ করবেন। দেখবেন কিছুদিনের মধ্যেই আপনার উচ্চারণের উন্নতি হচ্ছে। যেমনঃ গড়ের মাঠে গরুর গাড়ি গড়গড়িয়ে যায় এই বাক্যকে আপনি বলবেন, “গডের মাঠে গরুর গাডি, গডগডিয়ে যায়।”
ফেবু শিক্ষিতদের কারণে আরেকটা চূড়ান্ত মাত্রার ফাতরামি শুরু হইছে। কিছু মুরুকখো সোদা উত্তরাকে লেখে “উওরা” মাত্রকে লেখে “মাএ”। এদেরকে গালি দেয়ার ভাষা জানা নাই। এদের কল্যাণে ছাত্রলীগ হয়ে গেছে “ছাএলীগ”। মনে হয় শালার পুতেদের ণত্ব ষত্ব জ্ঞান নাই।

হুমায়ুন আজাদ স্যার বানান একটা প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “শুদ্ধ বানান শেখার ভাল উপায় হলো শুদ্ধ বানানটা শিখে নেয়া”। সত্যিই আপনি যদি কোন শব্দ লেখার সময় অক্ষরগুলোর চেহারার দিকে তাকান তাহলে সেই শব্দের বানান ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। আমি বাংলাভাষার পণ্ডিত না, এই ভাষায় দক্ষতাও মাতৃভাষা হিসেবে যতটুকু মানুষের থাকে আর কি সেই লেভেলের। তবে বাংলাভাষার প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। সেই শ্রদ্ধার জায়গা থেকে বলতে ইচ্ছে করে, করছেনকে “করসেন” উত্তরাকে “উওরা” ছাত্রলীগকে “ছাএলীগ” লেখা কদর্যতা। যারা এসব করে তাদের বাংলাভাষার উপর বিন্দুমাত্র ভালবাসা নেই।

সবাইকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা। সবাই যেন নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে এই প্রত্যাশা।