লিখেছেনঃ মোস্তফা সারওয়ার
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার পড়াশোনার সময়টা ছিল বাংলার ইতিহাসের অন্যতম ঘটনাবহুল ক্রান্তিকাল। আমাদের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৯৭১ সালে। কিন্তু তা পিছিয়ে গেল প্রায় দুই বছর। ১৯৬৯ সালের স্বায়ত্তশাসন ভিত্তিক এগারো দফার গণঅভ্যুত্থান, ছদ্মবেশি সামরিক একনায়ক আইয়ুবের এক দশকের স্বৈরশাসনের অবসানে সামরিক বাহিনী প্রধান ইয়াহিয়ার ক্ষমতা দখল, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, সংযুক্ত পাকিস্তানের একমাত্র জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নিরঙ্কুশ বিজয়, এবং ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ; একের পর এক ঘটেছিল যুগান্তকারী ঘটনা। গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অবিস্মরণীয়। বস্তুতপক্ষে এসব আন্দোলনের পুরোধা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসব যুগান্তকারী ঘটনাগুলোর মাঝখানেই পদার্থবিজ্ঞান অনার্স ও অন্যান্য সাবসিডিয়ারি বিষয়ে আমাদের পড়াশোনা চলছিল। শিক্ষক হিসেবে পেলাম বিশ্বমানের প্রথিতযশা পদার্থ বিজ্ঞানী ইন্নাস আলী, মতিন চৌধুরী, বেলায়েত হোসেন, সুলতান আহমেদ, হারুনর রশিদ, মুহাম্মদ রফিকুল্লাহ, হীরনময় সেন গুপ্ত, কাইয়ুম সরকার, মোহতাশেম হোসেন, সামসুল ইসলাম, কামরুন নাহার, অজয় রায়, মাজহারুল ইসলাম, ললিত মোহন নাথ, শমশের আলী, ওয়াজেদ মিয়া, এ কে এম সিদ্দিক, এবং দিলারা বেগমকে।
মেন্টর হিসেবে পেয়েছিলাম অধ্যাপক মোহাম্মদ ইমরানকে। আমাদের সৌভাগ্য গণিতের অধ্যাপক হিসেবে পেয়েছিলাম এ এন এম শহীদুল্লাহ, সিরাজুল হক মিয়া এবং আবদুর রহমান স্যারকে। পরিসংখ্যানের অধ্যাপক মাহবুবুদ্দিন, আসকার ইবনে সাইয়েক, গোলাম মোস্তফা এবং এ এন এম মনিরুজ্জামান ছিলেন শিক্ষক হিসেবে তুলনাবিহীন। আমাদের পথিকৃৎ ছিলেম পদার্থ বিজ্ঞানের অন্যতম জ্যোতিষ্ক এককালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলো দ্বারা তৈরি, তার গুরুত্বপূর্ণ অংশের নামকরণ করা হয়েছে “বোজন”—সত্যেন বোসের নামে। বোস-আইনস্টাইন থিওরি ও কনডেনসেটের উপর গবেষণাকারীদের গত কয়েক বছরে দুইবার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি-কণা ‘ঈশ্বর কণা’-র নাম হোল হিগস-বোজন। সত্যেন্দ্রনাথ বোস শুধু বিজ্ঞানী হিসেবেই বরেণ্য নন, কবি ও সংগীত শিল্পী হিসেবেও সমাদৃত।
আমাদের পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে গিয়ে পুঁথিগত বিদ্যার বাইরেও আমরা জড়িয়ে পড়তাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। আমাদের অবসরে বিহার ছিল সংগীত, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি এবং সমসাময়িক বিষয়ে। পুঁজিবাদী দৈত্যের এক বিশাল যন্ত্রের হৃদয়হীন স্ক্রু অথবা নাট না বানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন পরিবেশ ছিল হৃদয়বৃত্তির মাধুরী মিশিয়ে জীবিকার দক্ষ কারিগর এবং সমাজ ও প্রকৃতির হিতৈষী হিসেবে ছাত্রদের গড়ে তোলা। (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিচারণ: ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’, মোস্তফা সারওয়ার | 13 JUL , 2021)
আমাদের ক্লাসে ছিল তারেক শামছ্। কিংবদন্তী ছাত্র। আমি নিজে যশোর বোর্ডে মাধ্যমিকে বিজ্ঞানে দ্বিতীয় ও উচ্চ মাধ্যমিকে সব বিভাগে প্রথম স্থান পেয়েছিলাম। আমি দিব্যি করে বলতে পারি, তারেকের মত মেধাবীর জন্ম কদাচিৎ ঘটে। রোবটিক্সে আমেরিকায় নাম করেছিল। কয়েক বছর আগে তারেক আমাদের গৌণ পৃথিবীর হলাহল ছেড়ে চলে গেছে নক্ষত্রের সীমাহীন ব্রহ্মাণ্ডে। আমাদের ক্লাসে পেয়েছিলাম আরও এক অসাধারণ বিদুষী সহপাঠী, কালি নারায়ণ স্কলার মাহফুজুর রহমান, যার গণিতের রাজ্যে ছিল অনিরুদ্ধ বিহার। আমেরিকায় বহুজাতিক কর্পোরেশনে উঁচু পদে মনোয়ার, মাহফুজ, সালেহ, শফিক খান, মসরুর আলী খান, শফিক আহমেদ, মাসুমা; অধ্যাপনায় জাহাঙ্গীর, রেজাউল, রিজওয়ানুল, নোমান; আমি কখনও অধ্যাপক, কখনও উপাচার্য, কখনও উপ-উপাচার্য, কখনও ডিন এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় আজীবনের জন্য নিয়োগ প্রাপ্ত রিজিওনাল ট্রানজিট অথরিটির কমিশনার। ইংল্যান্ডে মিনু ও জাকিয়া সফলতার সাক্ষর রেখেছে। আন্তর্জাতিক সংগঠনে ইফতি ও বাসারাত খুব ভালো করেছে। ইতালির রোমে বাসারাত, হিরণ্ময় স্যারের তত্ত্বাবধানে আমার থিসিস পার্টনার, অধিষ্ঠিত হয়েছে ওয়ার্ল্ড ফুড অরগাইনাজেশন এর অতি উর্ধ্বতন পদে। আমাদের ক্লাসের যারা বাংলাদেশে থেকে গেছে, তারা বিভিন্ন বিষয়ে রেখেছে সাফল্যের বিজয় ডঙ্কা। অধ্যাপনা ও পদার্থবিজ্ঞান গবেষণায় রাব্বানী, শামিমা, নাসিমা, কাদের, সাহিদা, সলিমুল্লাহ, ও মহিঊদ্দিন। আমলা হিসেবে দিদার, মাসুদ, কায়সার, লতিফা, আনোয়ার, এজাজ; ব্যবসায় নিদারুণ সফলতার উচ্চাসনে শহীদুল্লাহ খান, সাজু, লতিফ, নাজমুল, সাইফুল গনি, মতিন; সাংবাদিকতায় ফজল সিদ্দিকী, মাহফুজুল্লাহ; ফটো সাংবাদিকতায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিজয়ী যীশু। শামিমা অধ্যাপনা ও গবেষণার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটর, হলের প্রভোস্ট, ও বোস সেন্টারের ডিরেক্টর। নারী শিক্ষায় রেখেছে প্রশংসনীয় অবদান। বাংলাদেশে চিকিৎসা পদার্থবিজ্ঞানের জনক বন্ধু সিদ্দিকে রাব্বানী বিজ্ঞানের সাধনাকে রূপান্তরিত করেছে বিশ্বব্যাপী আর্ত মানবতার সেবায়।
গণঅভ্যুত্থানের সময় আমাদের সহপাঠী আরেক মেধাবী ছাত্র বেলাল এহসান বাকী লাল রঙের দ্বিতল বাসে আগুন ধরিয়েছিল এমন করে যেন যাত্রী ও চালকের নিরাপত্তা বজায় থাকে। প্রসঙ্গত, উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০০৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আমাদের মেজ ছেলে আরাশের একটি ফোন কল এলো। সে তখন শিখছিল পূঁজি বাজারের অপশন মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতি। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, আমি ‘বেলাল’ নামের কাউকে চিনি কিনা। কেননা ওর মনে হচ্ছিল বেলাল আমার সমকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র। ওর জিজ্ঞাসার মুল কারণ হল. সেদিন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আরাশের অর্থনীতির অধ্যাপক ক্লাস লেকচারে উল্লেখ করেছিল সম্প্রতি প্রকাশিত বেলালের বই Quantum Finance: Path Integrals and Hamiltonians for Options and Interest Rates।
বইটি পদার্থবিজ্ঞান ও অর্থনীতির অপূর্ব মিশ্রণ। ১৯৯২ সালে আমি অধ্যাপনা করতাম আইভি লীগের অন্তর্ভুক্ত ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায়। বেলাল ছিল প্রিন্সটনে। কাছে ছিলাম বলে তখন কয়েকবার যাওয়া-আসা হয়েছে। ছুটিতে একই সময়ে এসেছিলাম বলে দুই বছর সান্ধ্য-ভোজনে মিলিত হয়েছিলাম ড. মঈন খানের ঢাকার বাসায়। সব মিলিয়ে কম দেখা হয়েছে। কিন্তু বেলালের অদ্ভুত রূপান্তরের ক্রান্তিকালগুলো লক্ষ্য করেছি। সময়ের বিচিত্র ভাঁজে ভাঁজে কখনও নিজ হাতের রগ কেটে রক্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ জবরদস্ত হিপ্পি, কখনও বিপ্লবী, কখনও হরে কৃষ্ণ মহা ঋষি, কখনও ইসলামী অর্থনীতিবিদ। সর্বোপরি এক মহান চিন্তাবিদ, অধ্যাপক ও পদার্থবিজ্ঞানী। কোয়ান্টাম তরঙ্গের মত নিয়ত পরিবর্তনশীল জ্ঞানের অরণ্যে এক দক্ষ শিকারি। লক্ষ্য হল কখনও হরিণ, কখনও কোয়েল, কখনও ব্যাঘ্র।
পদার্থবিজ্ঞানে আমার ক্লাসমেট মেধাবী ছাত্র ঢাকা বোর্ডে মাধ্যমিকে প্রথম স্থান অধিকারী শহিদুল্লাহ খান বাদল আরবান গেরিলাদের ত্রিপুরার অনুশীলন কেন্দ্র পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। তার নজরদারীতে নগরকেন্দ্রিক (urban) গেরিলা যুদ্ধে কমিউনিস্ট রেভল্যুশনারী-সিআর (communist revolutionary-CR) রেখেছে স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সম্মুখ যুদ্ধে এককালের মিতভাষী সহপাঠী মাহমুদুল মাসুদের বীরত্বের গাঁথা- মুজিবনগর ঘরানার নেতৃত্বে, স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। কারও অবদান অনুল্লেখিত থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।
পাঠ্যক্রম সহযোগী বিজ্ঞান মেলায় রাব্বানীর ছিল জয়জয়কার। বিজ্ঞান অনুষদ পাঠাগারের সামনে তার তৈরি রিমোট কন্ট্রোল মিনিয়েচার জাহাজটি এখনও আমার চোখে ভাসছে। প্রায় চুয়াল্লিশ বছর আগে টেকলজির গৌণ পৃথিবীতে ও ঢাকার বাজারে সরঞ্জামের দীনতার প্রেক্ষিতে বন্ধু রাব্বানীর ভেলকি-হীন ম্যাজিক দেখে দর্শকের চোখে বিস্ময়ের ঝিলিক ছিল দৃষ্টি নন্দন। আমার স্মৃতির মানসে এখনও সমুজ্জ্বল ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে পূর্ব বাংলার ইতিহাসের প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনীভিত্তিক আমার দুই বছর জুনিয়র জাফর ইকবালের নাটক ‘কপোট্রনিক সুখ দুঃখ’। আমি ছিলাম বিভাগীয় বিতর্ক ক্লাবের সভাপতি। যেখানে বিতর্ক হত সেই রুমের পিছনের গ্যালারীতে আমি বসতাম। সামনে চোখে পড়ত আমার জুনিয়র খোন্দকার মোত্তালিব, সাজ্জাদ, সোবহান, এদের হাতে শোভা পাচ্ছে জ্যঁ পল সার্ত্রে ও আলবে ক্যামুর বই। আমি বিস্মিত হইনি যখন দেখলাম ১৯৭৫ সালে সব্যসাচী মানব ও নিদারুণ মেধাবী আমার এক বছরের জুনিয়র ফজলে সোবহানের পরিচালনায় দেখানো হল ‘এবং ইন্দ্রজিত’। নাটকটি ছিল পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত নাট্যকার বাদল সরকারের লেখা। ‘ইন্দ্রজিত’ চরিত্রে অভিনয় করে জাফর ইকবাল। আর মানসী চরিত্রে জাহা আফরোজ ফ্লোরা। প্রথমে এটি দেখানো হয় টিএসসি অডিটোরিয়ামে। পরে রোকেয়া হলের অডিটোরিয়ামে। এবং সেখানে পর্দা উঠতেই সামনে প্রায় তিন শরও বেশি মেয়েদের দেখে জাফর ইকবালের মুখ থেকে প্রথমে কথাই বের হচ্ছিল না! ‘এবং ইন্দ্রজিত’ নাটকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল – লাইফ ইজ আ সার্কেল। এমন থিম নিয়ে কাজ সে সময় এটাই ছিল প্রথম। এটাই ছিল পূর্ব বাংলার ইতিহাসে বাদল সরকারের লেখা নাটকের প্রথম সার্থক মঞ্চায়ন। জ্যঁ পল সার্ত্রে, আলবে ক্যামু ও বাদল সরকার ছিলেন সাহিত্য ও দর্শন শাস্ত্রের অস্তিত্ববাদী ঘরানার বুদ্ধিজীবী। ফজলে সোবহানের পর বাদল সরকারের আবাহনে নাটক রচনা করেছে নিদারুণ সাফল্যজনকভাবে আমার সাথে ডাকসুর প্রথম পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাপী ১৯৭২ সালের নির্বাচনে একই প্যানেলের প্রার্থী এবং মহসিন হলের প্রতিবেশী সেলিম আল দীন।
আলাউদ্দিন আল আজাদ ও আলী যাকের এর মঞ্চায়িত একই ধাঁচের নাটকের জনপ্রিয়তা ছিল তুলনা-বিহীন। গ্রিক ট্রাজেডিয়ান হোমার লিখতেন কেলিওপি নামে গ্রিক দেবীর আবাহনে। এক সময় আমার মনে হত, সেলিম আল দীন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, ও আলী যাকের মগ্ন রয়েছেন আধুনিক বাংলা নাটকের তূর্য-বাদক বাদল সরকারের আবাহনে। ফজলে সোবহানের পরিচালনায় ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক কার্জন হল অডিটোরিয়ামে পরিবেশন করা হয় এরও এক বছর আগে ১৯৭৪ সালে। সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রে ফজলে সোবহান ও মীরজাফরের চরিত্রে অভিনয় করেছিল করেছিল ইয়ামিন। নকশি কাঁথার মাঠ (১৯৭৬) দেখানো হয় কার্জন হল অডিটোরিয়ামে। কবি জসীম উদ্দিন এর বিখ্যাত সৃষ্টিকে স্টেজ নাট্যরূপ দিয়েছিল ফজলে সোবহান নিজে। সে অভিনয় করেছিল রোক্সানা বামনীর বিপরীতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি নিজেও বক্তৃতা, বিতর্ক, টেলিভিশন কুইজ, ও প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছি। দৈনিক সংবাদ, দৈনিক বাংলা, দৈনিক বাংলার বাণী, দৈনিক গণবাংলা, দৈনিক সমাজ, ও দৈনিক গণকন্ঠ আমার কবিতা ছাপিয়েছে। ১৯৭২ সালের প্রথমার্ধে দৈনিক গণবাংলা প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপিয়েছিল আঠেরো দিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের উপর আমার লেখা ‘অপারেশন সেক্টর নম্বর নয়’। টেলিভিশনের জন্য গান লেখা, টেলিভিশনে বিজ্ঞান শিক্ষার আসরের উপস্থাপনা, রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নেওয়া ইত্যাদি পাঠ্যক্রম বহির্ভূত অনেক বিষয়ে রেখেছি আমার ছাপ। ষাটের দশকের অন্তিম শেষার্ধে সবেধন নীলমণি ঢাকার একমাত্র বেতার কেন্দ্র রেডিও পাকিস্তান-ঢাকা আয়োজন করেছিল পাকিস্তানের তৃতীয় পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনার ঊপর এক আলোচনা অনুষ্ঠান। অংশ নেওয়ার নিমন্ত্রণ আমি হৃষ্টচিত্তে লুফে নিলাম। ‘পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস’ এর প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধগুলো পড়ে বেছে নিলাম না-বোধক মন্তব্যগুলো। প্রথম দিনের রিহারসেল আলোচনায় এলেন অন্য চারজন অংশগ্রহণকারী। তারা হলেন- ড. কুদরতে খোদা, ড. সাইদ সাজ্জাদ হোসেন, ড. কে টি হোসেন, এবং সম্পাদক মজিবর রহমান। বিজ্ঞান ও কারিগরি খাতকে আমি তীব্র সমালোচনা করেছিলাম। ড. কে টি হোসেন আমার মন্তব্যের যথার্থতা সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। আমার সযত্নে কপি করা তথ্যনির্দেশগুলো নিবেদন করলাম। ড. কুদরতে খোদা আমাকে সমর্থন করেছিলেন। তিনি তুলে ধরলেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি তৃতীয় পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনার নিদারুণ বৈষম্য। ড. কুদরতে খোদা এই আলোচনায় আর এলেন না। ড. সাইদ সাজ্জাদ হোসেন আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যানের অফিসে। আমাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি ডিকশনারি ও অগদেন ন্যাশের একটি কবিতার বই। তিনি আমাকে দেখালেন একটি লেখা; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার ওপর একটি প্রবন্ধ। আমি তার সাথে তর্ক করেছি। আমি দেখলাম কোথায় যেন একটা মিল হচ্ছে না। বাইরে থেকে আমাদের যে ধারণা তার থেকে এক ভিন্নতর মায়াশীল ড. সাইদ সাজ্জাদ হোসেনের পরিচয় পেলাম সেই দিন।
সবেধন নীলমণি পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র দূরদর্শন কেন্দ্র ঢাকা টেলিভিশনের ডিআইটির স্টুডিওতে দুইটি সম্পূরক অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং হয়েছিল ১৯৬৯ সালের জুন মাসের শেষের দিকে। ভারত উপমহাদেশের অন্যতম নামজাদা সংগীত শিল্পী ফেরদৌসী রহমানের সঞ্চালনে ‘A Peep into the Realm of Melody’ ও ইংরেজি সংবাদ পাঠক আলম রশিদের সঞ্চালনে ‘Reflections of Television on Young People’। প্রযোজনায় ছিলেন খালিদা ফাহমী ও মুস্তফা মনোয়ার। গোটা পাকিস্তান থেকে একক মনোনয়ন পেয়ে ১৯৬৯ সালের দশ হতে পনেরই জুলাই জার্মানির মিউনিখ শহরে অনুষ্ঠিত এবং ব্যাভেরিয়ান রেডিও Bayerische rundfunk আয়োজিত Prix Jeunesse Colloquy উৎসবের কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এ দুইটি সম্পূরক প্রোগ্রাম। এটাই ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি-প্রাপ্ত টেলিভিশন প্রোগ্রাম। পূর্ব বাংলার আব্দুল্লাহ শিবলী ও পশ্চিম পাকিস্তানের আসমা ইয়াসমিনের মিউনিক যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। এ দুইটি সম্পূরক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলাম আমি- মোস্তফা সারওয়ার, শহীদুল্লাহ খান বাদল, নায়লা জামান, আবদুল্লাহ শিবলী, মুস্তাক আহমেদ, লুবনা মরিয়ম, রানা ও হায়দার।
আমাদের রিহার্সেল হয়েছিল অনেকদিন ধরে মে মাস থেকে জুন পর্যন্ত। আমার মনে পড়ে, প্রথম দিন রিহার্সেলের পর দুই বোন নায়লা ও লুবনা তাদের হালকা ধূসর রঙের ফোক্সওয়াগন ভ্যানে আমাদের রাইড দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। অনিন্দ্য লাবণ্যময়ী, নিদারুণ গুণবতী, মেধাবী, সাংস্কৃতিক জগতের উদীয়মান নক্ষত্রের দয়ার্দ্র কৃপাকে না বলার ধৃষ্টতা আমাদের মত পথচারীদের ছিল না! রিহারর্সেলের প্রারম্ভে পরিচয় পর্বে আমার মনে হয়েছিল বাদল ও নায়লার সেটাই ছিল প্রথম পরিচয়। আমার জানা নেই সেদিন প্রেমের দেবতা কিউপিড তীর ধনুক নিয়ে ডিআইটির স্টুডিওতে অদৃশ্যতার অবগুণ্ঠন পড়ে বেছে নিয়েছিল বাদল ও নায়লাকে। আমার দিব্য দৃষ্টি নেই। তাই আমার চোখে পড়েনি। আজ পাঁচ যুগ পরে আট হাজার মাইল দূর থেকে দেখছি বাদল ও নায়লা অলংকৃত করছে বাংলাদেশের সফল দম্পতিদের অভিসার সাম্রাজ্যে কতিপয় ভাগ্যবানের ঈস্পিত আসন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আর্টস সেকশনে ১৩ই জুলাই ছাপানো আমার প্রবন্ধে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘটনাবলীর কিছুটা ছোঁয়া রয়েছে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিচারণ: “কফি হাউসের সেই আড্ডাটা”, মোস্তফা সারওয়ার, 13 JUL , 2021)।
আরও কিছু নতুন বিষয় আজ উল্লেখ করব। ১৯৬৯ সালে আন্তর্জাতিক লায়ন্স ক্লাবের উদ্যোগে এবং সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। বিষয় ছিল ‘সঞ্চয়’। ড. এম এন হুদা ছাত্র শিক্ষা কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে আমাকে প্রথম পুরস্কার হিসেবে গোল্ড মেডেল দিয়েছিলেন। এর কয়েকদিন পর নীলক্ষেতের ফুটপাতে দেখা হল তখনকার কিংবদন্তীর ছাত্র এবং ভবিষ্যতের নামজাদা অর্থনীতিবিদ আমার দুই বছর সিনিয়র ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সাথে। আমার সালামের উত্তর দিলেন। তারপর তিনি দাঁড়ালেন, যেটা কদাচিৎ ঘটেছে। তিনি ছিলেন কম কথার মানুষ। আমার সাথে তার দেখা হয়েছিল দু-একবার আজিমপুরের জিয়াউল হক সাহেবের বাসায় যেখানে আমি ও তার ইঞ্জিনিয়ার বড় ভাই কিছু দিন রুমমেইট ছিলাম রাজনৈতিক আন্দোলনের বিক্ষুব্ধ সময়ে। অভিবাদনে সীমাবদ্ধ থাকত আমাদের আলাপ। আমার জানা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের রীতির ছন্দপতনে বিস্মিত হলাম। পরিমিত ভাষায় তিনি আমাকে অভিনন্দন জানালেন ও আমার ‘সঞ্চয়’ প্রবন্ধের প্রশংসা করলেন। আমি ধন্য হয়েছিলাম।
ড. মঈন খানের উদ্যোগে কার্জন হল মিলনায়তনের সামনের সবুজ চত্বরে উচ্ছ্বল যৌবনা এক মহীরুহের আঁধো ছায়ায় ১৯৭৭ সালের নববর্ষের সকাল বেলা আমরা কতিপয় সংস্কৃতি ও সাহিত্য সেবী এক কবিতাপাঠের আসরের আয়োজন করেছিলাম। আসরে সভাপতি ছিলেন ড. হারুন অর রশীদ এবং বিশেষ বক্তা ড. অজয় রায়। আমি সঞ্চালনার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রেস রিলিজ অনুযায়ী প্রধান দৈনিক পত্রিকাগুলো পরদিন প্রকাশ করেছিল পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক মোস্তফা সারওয়ারের নাম উল্লেখ করা বিজ্ঞপ্তিটি। খবরের মূল আকর্ষণ ছিল লাল লংকা ও কাঁচা আমের সহযোগে নববর্ষের সকালে কার্জন হল চত্বরে কবিতা পাঠের আসর। আসরটির অন্যতম সংগঠক ছিল ফজলে সোবহান। স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে অনেক পরিশ্রম করেছে ফ্লোরা, ইয়ামিন, রেজিনা, কামাল, বাবলী, জলি, জাফর, শফিক এবং আরও অনেকে। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রদের সাথে কবিতা আবৃত্তিতে যোগ দিয়েছিল নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, রফিক আজাদ সহ নামজাদা কবিরা। আমাদের প্রত্যাশার কল্পলোক ভেদ করে শ্রোতাদের স্থান অলংকৃত করেছিলেন শামসুর রাহমান, ওবায়েদুল্লাহ খান, আশরাফ সিদ্দিকী, প্রমুখ। আমার আমন্ত্রণে প্রধান অতিথি ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। আমি, সোবহান, ও আরও অনেকে পিএইচডি সহ উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছেড়েছিলাম ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি। দুঃখজনক, এই আসরটির অপমৃত্যু ঘটল একবছর পূর্ণ হওয়ার আগেই।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ছাত্রছাত্রীরা অধ্যয়ন, সংস্কৃতি সেবা (যেমন কবিতা, সংগীত, নাটক) ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অর্থাৎ পাঠ্যক্রম,পাঠ্যক্রম-সহযোগী, এবং পাঠ্যক্রম-বহির্ভূত কাজ নিয়ে শুধু ব্যস্ত ছিল ভাবলে ভুল হবে। ভেবে দেখুন, আমরা এই বিভাগে পা ফেলেছি গড়পড়তা সতের বছরের যুবক-যুবতী। কবিগুরুর চিত্রকল্পে ‘ঘন গৌরবে নব যৌবনা বরষা’। জৈবিক প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও, আমরা কি আমাদের মাথার বিচিত্র আবেগের নিউরন আর রক্তের অন্তর্গত ফসফরাসের অমোঘ প্রবাহকে ভুলে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের ব্রম্মচারীব্রতে আজন্ম দীক্ষা নিয়েছিলাম? মোটেই নয়। অবশ্য অর্ধ-শতাব্দী আগে সেকালের সামাজিক অনুশাসন ও মূল্যবোধের প্রাচীর আমাদের আবেগ, অনুভূতি, ও হৃদয়বৃত্তিকে করেছিল শৃঙ্খলিত ও সংযত।
আমার মনে আছে, আমাদের প্রথম বছর বাৎসরিক বনভোজনের কথা। কাক-ডাকা ভোরে মহসিন হল থেকে রিক্সা নিয়ে হাজির হলাম কার্জন হল চত্বরে। বাসগুলো মৃদু নিঃশ্বাসে অপেক্ষমাণ। গন্তব্য জয়দেবপুরের শাল সেগুনের এক মোহনীয় অরণ্যে। অনেক রাত জেগে বিদ্যাদেবীর আরাধনা করেছি। চোখে তখনও তন্দ্রার ছোঁয়া লেপটে আছে। চোখ রগড়ে হঠাৎ দেখলাম সৌন্দর্যের স্বর্গীয় প্লাবন। লর্ড বায়রনের কয়েকটি পঙক্তির অনিরুদ্ধ প্রবাহ এসে টোকা দিল আমার নিউরনে-
She walks in beauty, like the night
Of cloudless climes and starry skies;
And all that’s best of dark and bright
Meet in her aspect and her eyes;
Thus mellowed to that tender light
Which heaven to gaudy day denies.
আমার ভুল হতে পারে, স্মৃতিচারণে যতটা মনে পড়ে আমাদের ক্লাসে ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল বিশের কাছাকাছি। সবাই ছিল আমার চোখে লাবণ্যময়ী। আচারে, আচরণে, চেহারায় তুলনা-বিহীন। সকলেই মেধাবী। লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত। মেকআপ পড়ত না। ওই অপ্রত্যাশিত মুগ্ধ প্রভাতে দেখলাম সবাই সেজেছে। আমি সে সময় সাহিত্য ও শিল্পের নন্দন তত্ত্বের ওপর পড়াশোনা শুরু করেছি। সেই স্তম্ভিত প্রভাতে মাধুরীর সর্বগ্রাসী সুনামির প্রায় মুখোমুখি হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, ‘sublime’ সৌন্দর্যের শঙ্কাময় প্লাবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেই জার্মান দার্শনিক আরথার শোপেনহাওয়ার (Arthur Schopenhauer) এর সূক্ষ্ম পরামর্শে।
এরপর আমার ভালবাসার বিহার হল ভাবনার অনিরুদ্ধ পৃথিবীতে। কার্জন হলের কাল্পনিক প্রেমিকাদের নিয়ে লিখেছিলাম অনেক কবিতা। সেকালের লেখকদের প্রার্থিত দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতার সম্পাদক সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি আহসান হাবীব আমার অনেক কবিতা ছাপিয়েছিলেন। তরুণ যুবকের কল্পনার বিশ্বে প্লেটোনিক ভালবাসার দীর্ঘ গ্রীবা এসে কার্জন হলের শূন্য স্তব্ধ সিঁড়িতে হত অন্তরঙ্গ সঙ্গী
ভাবছি,
একদিন নির্লিপ্ত সন্ধ্যায়
নারী-নক্ষত্রের ভিড়ে শ্যামলীর ক্লান্ত চোখে
মেরুর স্তব্ধতা খুঁজে পাবো;
নিস্তব্ধতার একগুচ্ছ বসন্তমালতী
যাকে আমি চিরদিন ভালোবাসি
একরাশ কান্নায় বলে যাবে:
‘পৃথিবীর সব কিছু চেনালোক, শৈবাল, নিরুপমা পাপড়িরা
বিস্মৃতির মমি দিয়ে ঢেকে গ্যাছে চঞ্চল মেয়েটিকে’
তবু আমি ভুলি নাই-এও এক অন্তরঙ্গ বিস্ময়;
(লেখক: মোস্তফা সারওয়ার; কবিতার নাম: অন্য এক শব্দমালা; দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতা, ২৭ শে অগাস্ট, ১৯৭২ সাল; এবং কবিতার বই: অনুলিপিঃ অন্তরঙ্গ মুহূর্তে, পৃষ্ঠা ৩৮)
কার্জন হলের ক্লাস রুমে, করিডোরে, অফিস ঘরে, সামনের বিস্তৃত সবুজের সমারোহে চলত পদার্থবিজ্ঞানের সাধনা। নামজাদা অধ্যাপকদের গবেষণায় প্রকাশ পেত নব জ্ঞানের ফল্গুধারা। অনুগামী জ্ঞান পূজারী প্রাপ্ত বয়স্ক যুবক যুবতিরা মুক্তমনে গ্রহণ করেছে বিজ্ঞানের অপার সম্ভার। মহান দার্শনিক প্লেটো (Plato) এর রচিত সিম্পোজিয়াম (Symposium) বইয়ে ভালবাসার সবচেয়ে শুদ্ধতম সক্রেটিসের (Socrates) সংজ্ঞা তখন আমি হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করেছি। সিম্পোজিয়াম এর অন্য বক্তা অ্যারিস্টোফেনিস (Aristophanes) এর কৌতুক অথবা অ্যালসেবায়েডিস (Alcibiades) এর জৈবিক প্রবণতাকে প্লেটোনিক ভালবাসা থেকে নির্বাসিত করেছি। প্লেটোনিক ভালবাসায় দেহ বিচ্ছিন্ন শুধু মনের আবাসন। কল্পনার শুদ্ধ পৃথিবীতে গভীর অবগাহন। যে পৃথিবীতে শুধু বিদ্যমান রূপসীর মন-
ম্লান জোছনায়
আমি চেয়ে দেখি-দীর্ঘ অনুচ্ছেদ
অদ্ভুত প্রবাল দ্বীপের মতো ভেসে ওঠে
কার্জন হলের প্রশস্ত করিডোর; – ঐখানে মৃদু পায়ে
হেঁটে গেছে অনুরাধা সেই রূপসীর মন;
…
দখিনের ঐ চিলতে পথে দাঁড়িয়ে থাকি
অন্ধকারে মনে হয় কার আঁচলের মৃদু মর্মর
(লেখক: মোস্তফা সারওয়ার; কবিতার নাম: ম্লান জোছনায়; দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতা, ২৭ শে অগাস্ট, ১৯৭২ সাল; এবং কবিতার বই: অনুলিপিঃ অন্তরঙ্গ মুহূর্তে, পৃষ্ঠা ৩৬)
কার্জন হল থেকে ক্লাস শেষে ফিরে যেতাম মহসিন হলে-
অনেক শিউলি যেন পড়ে আছে এই পথে নিঃশব্দে বিজনে
বৃটিশ কাউন্সিল ঘিরে পড়ে আছে অনেক জারুল ফুল।
(লেখক: মোস্তফা সারওয়ার; কবিতার নাম: সিগনাল টাওয়ার; কবিতার বই: অনুলিপিঃ অন্তরঙ্গ মুহূর্তে, পৃষ্ঠা ৪৫)
কল্পনায় ভেসে আসত এক কাল্পনিক মানবী। যার পৃথিবীটা ছেয়ে আছে হয়ত বা প্রেম, সুখ অথবা বিষণ্ণতা।
ঘরকন্না সেরে আজ রূপসার জলে চেয়ে থাকো।
কার ছায়া দেখ?
প্রেম? সুখ? বিষণ্ণতা;
অথবা হেলিওপোর্টের মতো বিস্তৃত বুকে ধরে আছো
সন্ধ্যার বিষণ্ণ আঁধার?
(লেখক: মোস্তফা সারওয়ার; কবিতার নাম: সিগনাল টাওয়ার; কবিতার বই: অনুলিপিঃ অন্তরঙ্গ মুহূর্তে, পৃষ্ঠা ৪৫)
পাঠক, কাল্পনিক ভালবাসার দুঃখের বোঝা কাঁধে নিয়েই শুধু আমার বিচরণ কার্জন হলের আনাচে কানাচে, তা কিন্তু নয়। বান্ধবীদের নিয়ে কার্জন হলে অথবা লাইব্রেরীর আশে পাশে গন্ধরাজ, কামিনী, বেলি, শেফালী অথবা টগরের ঝোপের কাছে আমরা আলোচনা করেছি শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত এমনকি সংস্কারের লৌহ কপাট। আমি ছিলাম ব্যতিক্রমী। প্রথাগত অন্ধ সংস্কার সম্ভবত আমিই ভেঙ্গেছিলাম সর্বাগ্রে। জারুল, কৃষ্ণচূড়া, অশ্বত্থ, রাধাচূড়া নীরবে সাক্ষী হয়ে রইলো। আমাদের বড় ছেলে তুরহানের হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে সভাপতির ভাষণ এখনও আমায় দোলা দেয়। সদ্য উত্তীর্ণ ছাত্র ছাত্রীদের তিনি বলেছিলেন, “তোমরা অন্ধ সংস্কার ভাঙ্গবে”। সেটা ছিল ২০০৫ সাল। এরও চার দশক আগে শুনেছি দেয়াল ভাঙ্গার শব্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে।
আমাদের একটু জুনিয়র এক অনিন্দ্য সুন্দরী এলো পদার্থবিজ্ঞানে। রূপে, গুণে, আচরণে মনে হল স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে এক লাবণ্যময়ী অপ্সরী। মনে হল গ্রিকদের প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী আফ্রোদিতি এবং গ্রিক ঈশ্বরের নয়টি কন্যা (Muse যারা সঙ্গীত, শিল্পকলা, সাহিত্য ইত্যাদির দেবী) তাদের ভাণ্ডার রিক্ত করে ঢেলে দিয়েছে ওই লাবণ্যময়ীকে। সাথে এসেছিল এক বছর পর অপরূপ সৌন্দর্য আর গুণে প্লাবিত ছোট বোন অন্য বিভাগে। সাধু সাবধান! মনে হয়েছিল কার্জন হলের সন্ন্যাস হয়ত ভেঙ্গে যাবে। দেখেছি, প্লেটোনিক ভালবাসার দেয়াল টপকাতে গিয়ে তরুণ যুবকদের বাসনার অপমৃত্যু। আজও তাদের ব্যথিত চিত্তের দীর্ঘশ্বাস মাঝে মাঝে অশরীরী উপচ্ছায়া হয়ে কার্জন হলের প্রশস্ত করিডোরে গেয়ে যায় মেহেদী হাসানের জৈনপুরী ঘরানায় রাগ দরবারীতে গাওয়া এবং উর্দু কবি পারভিন শাকিরের লেখা গজল “কু বা কু ফ্যাল গায়ী বাত…”।
[
এমেরিটাস অধ্যাপক এবং সাবেক উপ-উপাচার্য- ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিয়েন্স, ডিন এবং সাবেক উপাচার্য-ডেলগাডো কমিউনিটি কলেজ, কমিশনার-রিজিওনাল ট্রানজিট অথরিটি, বিজ্ঞানী এবং কবি। ]
Mostofa Sarwar, PhD, MS, MSc
Dean of Science and Mathematics Division
Former Vice Chancellor and Provost
Delgado Community College
City Park Campus – Building: 2 Room: 131E
615 City Park Avenue
New Orleans, LA 70119
(504) 671-6480
msarwa@dcc.edu
Leave A Comment