লিখেছেন: শান্তনু ওঝা
সমরবাবুর পনেরাে বছরের মেয়ে দেবলীনা, অল্পতেই রেগে যায়, চিৎকার করে। মায়ের সাথে ঝগড়া করে, সারাক্ষণ বান্ধবীদের সঙ্গে কি যে অতাে গল্প, বােঝালে কর্ণপাতই করে না। সমরবাবু মেয়েকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছেন। ভাবছেন একজন মনােচিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলবেন। অমলবাবুর সতেরাে বছরের ছেলেটিও কেমন বদলে যাচ্ছে। সারাদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা, পড়াশােনা করে কখন? সারাদিন কর্মক্ষেত্রে পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরে ছেলের নামে অভিযােগ শুনতে আর ভালাে লাগে না। একদিন তাে হেলমেট ছাড়া বাইক নিয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরিয়ে গেলাে। সেদিন অমলবাবু ছেলেকে খুব বকলেন, বােঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ছেলের মুখ দেখে তাে মনে হলাে না ছেলে তাঁর কথায় কোনাে গুরুত্ব দিচ্ছে। অমলবাবু কি যে করবেন !
এগুলাে কোনাে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রত্যেকের জীবনেই এই ‘সান্ধ্যকালের’আবির্ভাব হয়, বাল্য আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে, WHO -এর হিসাব অনুসারে মােটামুটি ১০-১৯ বৎসরের মধ্যে। একে বলে বয়ঃসন্ধিকাল। ইংরাজিতে কৈশােরের কোনাে যথাযথ প্রতিশব্দ না থাকায়, এই সময়কালকে বাংলায় কৈশােরকালও বলা যায়। এই সময়ে নানাপ্রকার শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। বয়ঃসন্ধিকাল একটি ঝােড়াে, উথালপাথাল সময়কাল। এই সময়ে কিশাের কিশােরীদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র দেখা যায়, সামাজিক সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পায়, নিজেদের পরিণত বয়স্কদের সমকক্ষ ভাবতে শুরু করে অর্থাৎ স্বাধীনভাবে পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে অভিযােজিত হওয়ার চেষ্টা করে যা পরিণত বয়স্কদের কাছে বা অভিভাবকদের কাছে সন্তানদের অকালপক্কতা বলে মনে হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্ত হরমােনকেই এই বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তনের জন্য দায়ী করা হতাে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানীরা , এই সময়ে সংঘটিত মস্তিষ্কের নানা প্রকার গাঠনিক পরিবর্তনকেই এর জন্য দায়ী করেন। কোনাে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বা পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয়সাধনের জন্য এই বয়স্কদের মস্তিষ্কের ক্রিয়া অনেকটা আমাদের ড্রয়িংরুমের টেলিভিশন সেটটার মতাে যার স্পীকার, ডিভিডি প্লেয়ার সবই আছে কিন্তু তাদের মধ্যে সঠিক সংযােগ নেই, তার উপরে আবার টিভির রিমােট কনট্রোলটিও ঠিকমতাে কাজ করছে না। আমাদের মস্তিষ্কের রিমােট কনট্রোল হলাে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (Prefrontal Cortex), গুরুমস্তিষ্কের অগ্রখণ্ডে অবস্থিত। এই অংশটি আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে, কোনাে কাজের| পরিণতি সম্পর্কে আন্দাজ করতে বা অন্য ব্যক্তিদের বুঝতে সাহায্য করে। প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সংযুক্ত হয় স্নায়ুকোশের স্নায়ুসন্নিধি বা সাইন্যাপস দ্বারা। অনেকটা টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য যন্ত্রপাতির ইলেকট্রিক তারের মতাে। f-MRI (Functional Magnetic resonance imaging) -এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, কৈশােরে সাইন্যাপস গঠনের হার বৃদ্ধি পায় অর্থাৎ স্নায়ুকোশগুলি দ্রুত পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। অতিরিক্ত স্নায়ুকোশীয় সংযােগ আবার বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যেমন বাড়ির অপ্রয়ােজনীয় তড়িৎ সংযােগ সুবিধার চেয়ে ক্ষতিই করে বেশি, দুর্ঘটনার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়। মস্তিষ্ক ঠিক একইভাবে কাজ করে । মস্তিষ্ক তার অপ্রয়ােজনীয় স্নায়ুকোষগুলি ধ্বংস করতে শুরু করে, একে বলে সাইন্যাপটিক প্রুনিং (Synaptic Pruning), একই সঙ্গে প্রয়ােজনীয় স্নায়ুসন্নিধিগুলির বন্ধন আরাে দৃঢ় হয় । স্নায়ুকোশের বড় প্রবর্ধক, অ্যাক্সনের বাইরে রক্ষণাত্মক মায়েলিন সীথ গঠিত হয়, ফলে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সমন্বয়ের গতি বৃদ্ধি পায়। এইসব ঘটনা মস্তিষ্কের পিছনের অংশ থেকে সামনের দিকে অর্থাৎ প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের দিকে ঘটতে থাকে এবং ২০ বৎসরের মাঝামাঝিতে গিয়ে সম্পূর্ণ হয়। ফলে কিশােরদের মস্তিষ্ক, বড়দের তুলনায় একটু অপরিণতই থাকে।
কৈশােরকালে আমরা যদি লেখাপড়া বা অন্য কোন গঠনমূলক কাজে নিযুক্ত থাকি তাহলে সেইসব কাজের জন্য প্রয়ােজনীয় সাইন্যাপসের সংখ্যা বাড়বে এবং ঐ সাইন্যাপসগুলি সুগঠিত ও সুদৃঢ় হবে, কিন্তু যদি কমপিউটার গেম খেলা বা টেলিভিশন দেখা প্রভৃতি অপ্রয়ােজনীয় কাজে মস্তিষ্ককে ব্যস্ত রাখি তাহলে সেইসব অপ্রয়ােজনীয় স্নায়ুসংযােগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। অ্যামীগডালা (Amygdala), মস্তিষ্কের অন্যতম আবেগনিয়ন্ত্রক, কৈশােরে কিছুটা অপরিণত থাকে অর্থাৎ মস্তিষ্কের যুক্তি ও বিচার কেন্দ্র, ফ্রন্টাল খণ্ডের সঙ্গে অ্যামীগডালার স্নায়ু সংযােগ তখনাে সম্পূর্ণরূপে গঠিত হয় না। তাই এই বয়সীরা যুক্তির তুলনায় আবেগের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়। অগ্রমস্তিষ্কের মিডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (Medial Prefrontal Cortex) এবং টেম্পােরাল খণ্ডের পস্টেরিয়র-সুপিরিয়র টেম্পােরাল সালকাস (Posterior-superior Temporal Sulcus) ও অ্যান্টেরিয়র টেম্পরাল কর্টেক্স (Anterior Temporal Cortex) এই তিনটি অংশকে একত্রে Social brain বা সামাজিক মস্তিষ্ক বলা হয়। কারণ মস্তিষ্কের এই অংশগুলি আমাদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন ধরনের মানুষদের চিনতে ও বুঝতে সাহায্য করে। বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, পরিণত বয়স্করা ও কিশাের-কিশােরীরা সামাজিক পরিস্থিতিতে মস্তিষ্কের ঐ তিনটি অংশকে ব্যবহার করলেও, তিনটি অংশের প্রাধান্য ও সক্রিয়তার মান উভয় ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়। দেখা গেছে পরিণত বয়স্করা সামাজিক কাজে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের তুলনায় টেম্পােরাল খণ্ডের অংশদুটিকে বেশি ব্যবহার করছে, কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালীন মস্তিষ্ক টেম্পােরাল খণ্ডের তুলনায় প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সকে অধিক ব্যবহার করে, যা সেইসময় তুলনামূলকভাবে অপরিণত থাকে। এই কারণেই কিশাের-কিশােরীদের সামাজিক প্রতিক্রিয়ায় কিছু ভিন্নতা বা তথাকথিত জটিলতা দেখা যায়।
তবে মস্তিষ্কের নিউক্লিয়াস অ্যাকুমবেনস্ (Nucleus Accumbens) নামক অংশটি, অনেক আগে, কৈশােরেই পরিণত হয়ে যায়। এই অংশটিকে মস্তিষ্কের Reward Center বা পুরস্কার কেন্দ্র বলে। কেউ প্রশংসা করলে বা কোনাে পুরস্কার পেলে আমাদের ভালাে লাগে বা গর্ব হয় এই অংশের সক্রিয়তার জন্য। এই সময় এই অংশ থেকে ডােপামিন নামক এক হরমােন নিঃসৃত হয় যা আমাদের এই সুখানুভূতির জন্ম দেয়। f-MRI পদ্ধতির মাধ্যমে এও জানা গেছে, কিশাের-কিশােরীদের মস্তিষ্কের এই অংশটি কেবলমাত্র বড় ও মাঝারি পুরস্কারেই উত্তেজিত হয়, ছােটো পুরস্কারকে আদৌ গুরুত্ব দেয় না। এই বড় পুরস্কার বা বেশি পুরস্কার বা বেশি প্রশংসার লােভেই এই বয়সী শিশুরা সামান্য প্ররােচনাতেই খুব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে, বন্ধুদের সঙ্গলাভের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। ডােপামিনের অতি সক্রিয়তার জন্য সৃষ্ট অলীক সুখানুভুতির জন্যই বােধ হয় এই বয়সীরা ড্রাগ, অ্যালকোহল প্রভৃতি নেশার সহজ শিকার হয়। এছাড়াও এই বয়সে কর্টিসল ও মেলাটোনিন হরমােনের ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটে, ফলে নিদ্ৰাচক্রেরও এক বিরাট পরিবর্তন সংঘটিত হয়। বড়দের যেখানে মেলাটোনিনের প্রভাবে রাত্রি দশটার মধ্যেই নিদ্রার উদ্রেক হয়, সেখানে কিশাের-কিশােরীদের ঘুম আসতে আসতে মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। দৈনন্দিন ঘুমের এই ঘাটতি তাদের খিটখিটে মেজাজ ও অসহিষ্ণুতার অন্যতম কারণ। আধুনিক গবেষকরা দেখেছেন এই বয়সে যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন না করলে সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia), অবসাদ প্রভৃতি মানসিক রােগের সূত্রপাত হয় এবং আত্মহত্যার প্রবণতাও বৃদ্ধি পায়। উপরের আলােচনা থেকে এটা স্পষ্ট বােঝা যাচ্ছে যে, সন্তানদের এই বিশেষ সংবেদনশীল সময়কালে অভিভাবকদের যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। অভিভাবকেরা সঠিক শিক্ষা, সুস্পষ্ট ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে দিয়ে সন্তানদের গঠনরত মস্তিষ্কের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারেন। পিতামাতা তাদের সন্তানদের নতুন কিছু শিখতে (বিদেশী ভাষা, অঙ্ক) বা বিভিন্ন প্রতিযােগিতামূলক খেলায় অংশগ্রহণে উৎসাহ দিতে পারেন। এই ধনাত্মক ক্রিয়া সেই একই ডােপামিনজনিত সুখানুভূতির জন্ম দেয় যা তারা কোনাে বাজে নেশা বা কোনাে অনৈতিক কাজ কিংবা অহেতুক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে পাওয়ার চেষ্টা করে।
সুতরাং এটা বােঝা গেল যে সমরবাবু বা অমলবাবুর উদ্বেগ বা আক্ষেপের কিছু সামাজিক ভিত্তি থাকলেও, এর জন্য আমরা আমাদের সন্তানদের পুরােপুরি দায়ী করতে পারি না, এই সন্ধিকাল, বাল্যাবস্থা থেকে যৌবনে প্রবেশের একটি স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক পথ। এই আলাে-আঁধারি, কুহক মায়াঘেরা গলিপথ থেকে হাত ধরে আমাদের সন্তানদের বাস্তবের রাজপথে নিয়ে আসার দায়িত্ব আমাদেরই।
“If we were all peers, our parents might tell us, it is perfectly normal to be green before you are golden” – Tom Althous.
খুবই সময়োপযোগী একটি লেখা । কেন বাচ্চাদের এই হটাৎ পরিবর্তন এর একটা চমৎকার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া গেল কিন্তু এর সমধান এতটা সহজ নয় । যেহেতু ব্যাপারটা প্রাকৃতিক কারণেই হচ্ছে সেহেতু এটা নিয়ন্ত্রণকরা যেন প্রকৃতি বিরুদ্ধ অনেক কঠিন।
আর আমি বর্তমানে এই সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি ।