আবু বকর আল-বাগদাদী পরিষ্কার করে বলেছে আইসিস খুব দ্রুত আন্তর্জাতিক রণকৌশল প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। আলজেরিয়া এবং সুদান হতে পারে যুদ্ধের পরবর্তী ময়দান।
Abu Bakr al-Baghdadi is pictured for the first time in five years, in a propaganda video. Photograph: AFP/Getty
খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণার চার বছর পরে সম্প্রতি এক প্রচারণা ভিডিওতে ইসলামিক স্টেটের নেতা আবু বকর আল-বাগদাদীকে আবার দেখা গেছে। এবারের ভিডিও-চিত্রে বাগদাদী লোকটি কোন খলিফা হিসেবে মসজিদের মেহরাবে দাঁড়িয়ে ধর্মীয় বয়ান করছে না বরং সে এখন ফেরারি আসামী যার জন্য তল্লাশি চলছে। ধারাভাষ্যকার অতি দ্রুত মনে করার চেষ্টা করছে আল-কায়েদার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা আবু মুসাব আল-জারকাবি মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে কীভাবে উপস্থিত হয়েছিল। আমাদের জ্ঞানত জারকাবির শেষ ছবিতে দেখা যায়, জারকাবি জানালাবিহীন প্রায় অন্ধকার নিয়ন আলোর এক ঘরের মেঝেতে কুশন বিছিয়ে বসে আছে, তার হাতে ধরা একটা আগ্নেয়াস্ত্র। কিন্তু বাগদাদীর ভিডিও অনেক পরিশীলিত এমনকি ভিডিওতে শব্দের কোন বাড়াবাড়ি নাই, কেউকে আকৃষ্ট করার জন্য উচ্চকিত বয়ান নাই।
বাগদাদী নিরাপত্তায় ঘেরা ছোট্ট একটা রুমে থাকে, তার চারপাশ অনুগত সমর্থকের নিরাপত্তার চাদরে মোড়া যদিও সবার আনুগত্য সে নিশ্চিত হতে পারেনি। বাগদাদী যেন নৃশংস পরিবেশে একাকী কোন প্রাণীর মত দৌড়চ্ছে, সব সময় আতংকের মধ্যে তার বসবাস, এই বুঝি দলের মধ্যেই কোন জুডাস তাকে ধরিয়ে দিয়ে আমেরিকার ঘোষিত তার মাথার দাম ২৫ মিলিয়ন ডলার বা ১৯ মিলিয়ন পাউন্ড বাগিয়ে নিলো। নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সে প্রচুর সময়, সামর্থ্য এবং অর্থ ব্যয় করেছে। এই ভিডিওতে যদিও বাগদাদী এবং তার সঙ্গীদের পরিচয় এবং অবস্থান সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না কিন্তু তবুও তাকে নতুন ভিডিও প্রচার করার ঝুঁকি নিতে হয়েছে।
যেকোনো মূল্যেই হোক তার জঙ্গিদলকে সচল রাখতেই হবে। সব জঙ্গি নিয়ে একবারে লক্ষ্যবস্তুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার রণকৌশলের কারণে আইসিস জিহাদি আন্দোলন থেকে কিছুটা ছিটকে পড়েছে ফলে ধ্বসে গেছে তার প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত খেলাফত এবং বাগদাদী এখন নিজেও তার সমর্থকদের তোপের মুখে। এই ভিডিও চিত্রে বাগদাদী ধর্মের তাত্ত্বিক আলোচনায়, এবং সাংর্ঘষিক তর্ক বিতর্কে জড়িত হয় নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইসিসের ক্ষয়িষ্ণুতা নিয়েও বাগদাদী কোন মন্তব্য করেনি।
যদি প্রথম ভিডিও-চিত্রে বাগদাদী নিজেকে সারা জাহানের মুসলিম উম্মাহর কাছে সবচেয়ে শক্তিমান ইসলামী বয়ানকারী হিসেবে চিত্রিত করে, তবে দ্বিতীয় ভিডিওতে সে সরাসরি প্রমাণের থেকেও বেশি কিছু যেন সে নিজেই একজন আইসিসের জিম্মি। তারপরেও এতকিছু ছাড়িয়ে এই ভিডিও চিত্রটি অনেক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও কিছু মানুষ বিশেষত রাশিয়ান অপপ্রচারের বিভ্রান্ত হয়ে মনে করে বাগদাদী নিহত হয়েছে। এই ভিডিও দুষ্প্রাপ্যতার জন্য অমূল্য এবং আমাদেরকে কিছু যোগসূত্র দিয়ে যায়। গতমাসের শ্রীলংকায় জঙ্গি হামলার পরে আইসিস এই হামলার দায় স্বীকার করেছে যদিও আইসিসের জিহাদি দল এই হামলা পরিচালনা করে নাই কিন্তু যারা করেছে আইসিসের নামের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে এই কাজ করেছে যাদের সাথে আইসিসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তেমন কোন যোগাযোগ নাই। গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ধারণা করা হচ্ছে হয়ত এপ্রিলের ১০ থেকে ১৯ তারিখের মধ্যে বাগদাদীর এই ভিডিও-চিত্রটি ধারণ করা হয়েছে। সে কি জানত অথবা ধারণা করেছিল তার জঙ্গি দল সিরিয়া ইরাকের এরিয়া পেরিয়ে ২১ এপ্রিল শ্রীলংকাতে এত বড় ভয়ানক জঙ্গি হামলা চালাতে সক্ষম হবে? বাগদাদীর ভিডিও চিত্র ধারণ করার পরে একটা অংশে অডিও জুড়ে দেয়া হয় যেখানে শ্রীলংকার কথা উল্লেখ আছে।
এথেকেই প্রমাণিত হয় আপাতত আইসিস নামের জঙ্গি সংগঠনটি বড় ধরণের হামলার পরিকল্পনা এবং পরিচালনা করার সামর্থ্য হারিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এমন হামলা পরিচালনার জন্য অন্যকে অনুপ্রাণিত করা, জঙ্গিদেরকে দিক নির্দেশনা দেয়া, অর্থ সংস্থান এবং প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করতে এখনো যথেষ্ট পারঙ্গম। সর্বোপরি জঙ্গি দল হিসেবে আইসিসের এখনো রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি পতনের পরেও যার বিন্দুমাত্র কমতি হয়নি। ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ সম্প্রতি ধারণা করেছে যে গত বছরের ব্রিটেনের ৮০ শতাংশ সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করেছে কোন একজন ব্যক্তি নিজে যার সাথে সিরিয়া বা ইরাকের আইসিস কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সরাসরি কোন যোগাযোগ ছিল না।
কূটাভাসের চমৎকার বৈপরীত্য এই যে, আইসিস বিশ্বব্যাপী যতটা পরিচিত পেয়েছে খেলাফতের পতন ঘটলেও তার পরিচিতি বা ব্র্যান্ডিয়ের কোন ক্ষতি হয়নি। আইসিস একটা অঞ্চলের কর্তৃত্ব হারিয়েছে কিন্তু এখন এই বিষ বৃক্ষ বিশ্বের বাকি অংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। ভিডিওটিতে বাগদাদী সন্ত্রাসবাদের আন্তর্জাতিক বৈশিষ্ট্যের উপর জোর দিয়েছে, সে দেখায় খেলাফতের পতনের সময় কত বিদেশি যোদ্ধা নিহত হয়েছে। যুদ্ধে শুধু যে জয়লাভ করলেই চূড়ান্ত অর্জন হয়ে যায় তা নয়। শেষ ভিডিওতে বাগদাদী আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়, “আল্লাহ আমাদেরকে জিহাদ করতে নির্দেশ দিয়েছেন বিজয়ের জন্য নয়।” খেলাফতের পতনের ফলে পশ্চিমা বিশ্ব পরিষ্কারভাবে সুনির্দিষ্ট একটা খণ্ডযুদ্ধে জিতে গেছে। কিন্তু আমরা বৃহত্তর যুদ্ধে এখনো জিততে পারিনি।
আইসিস এখনো মানুষের অন্তরে বেঁচে আছে। মশুল এবং রাকাতে যে আইসিস ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রচারণা ভিডিওতে বলা হচ্ছে ফিনিক্স পাখির মত ধ্বংসস্তূপ থেকে তারা আবার জেগে উঠছে। বিশ্বব্যাপী আইসিসের কার্যক্রম পরিচালনার অংশ হিসেবে ‘আল-শামের প্রতিশোধ’ নিতে বিভিন্ন প্রদেশে তারা কাজ করে যাচ্ছে। ফলে বাড়ছে মানুষের জীবনের অপচয়। সাম্প্রতিক সময়ে আরব বিশ্বে প্রতিরোধের ঢেউ উঠেছে, ঢেউয়ের আঘাতে পতন ঘটেছে আলজেরিয়া এবং সুদানের একনায়কতন্ত্রের। ক্ষমতার শুন্যতায় এই দুটি দেশই হতে পারে আইসিসের নতুন ভবিষ্যৎ গন্তব্য। আইসিসের উত্থান শুরু হয় ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পুর এবং ২০১১ সালে আরব বসন্তে তার নবজাগরণ। বাগদাদী সাম্প্রতিক সময়ের জনপ্রিয় আন্দোলনগুলোর সাথে একমত নয়। জিহাদি আন্দোলনগুলো নিশ্চিত বিপ্লবের ফসল ছিনতাই করে নিজেদের ঘরে তুলেছে যেটা ২০১১ সালে ঘটেছিল।
বিশ্বের সকল মুসলিমদের জন্য সব সম্ভবের যে স্বপ্নের বাসভূমির উপর আইসিসের জন্ম হয়েছিল সেটা এখন অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ভোগ পড়েছে সিরিয়া আর ইরাকের সাধারণ মানুষের কপালে ঠিক তাদের উপর যারা এই সর্বগ্রাসী পরিকল্পনার শিকার। আইসিস সব জানত। সেজন্যই বাগদাদী নতুন ভিডিওতে সমর্থকদেরকে লুকিয়ে থেকে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। আইসিসের পতন ঘটলেও খেলাফতের জন্য জঙ্গিদলটির আরও দীর্ঘদিন টিকে থাকা দরকার। আমাদেরকে অবশ্যই জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে। সিনাই থেকে সোমালিয়া, মালি থেকে ফিলিপাইন সব দেশের পরবর্তী প্রজন্ম আইসিসের অতীত উগ্রবাদের লাঠি লজেন্স নাও চুষতে পারে কিন্তু জিহাদ শেষ করো তাদেরকে আইসিসের ফাঁদে ফেলে।
ISIS আর পরবর্তী টার্গেট সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়া। আফ্রিকা ও দক্ষিণ ছাড়া খেলাফতের আপাদত কোন জায়গা নাই।।