অনুবাদ: বিকাশ মজুমদার
সম্প্রতি কানাডার টরোন্টো বা ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার অথবা আফগানিস্তানের কাবুল থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের ওরল্যান্ড পর্যন্ত ইসলামিক স্টেটের সমর্থকেরা কোথাও একাকী তাদের সন্ত্রাসী হামলা কার্যক্রম পরিচালনা করছে না। আর অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া সন্ত্রাসীগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোন সহজ উপায় বা উত্তর কোনটাই কোন দেশের নিরাপত্তাবাহিনীর কাছে নেই।
একের পর সন্ত্রাসী হামলায় কেঁপে ওঠা বিশ্ব আজ আবার জেগে উঠছে নতুন হামলার সংবাদে। এবারের হামলা হয়েছে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরে যেখানে একজনমাত্র সন্ত্রাসী আরিয়ানা কনসার্ট হলের লবিতে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যা করে কমপক্ষে ২২ জন নিরপরাধ মানুষ। এবং বরাবরের মত বোমা হামলা এবং মানুষ হত্যার দায় স্বীকার করেছে তথা কথিত ইসলামের খেলাফত ইসলামিক স্টেট। বিশ্বজুড়ে ইসলামিক স্টেটের ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী হামলা ‘একাকী নেকড়ের সন্ত্রাসবাদ’ এ পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের ওরল্যান্ডে নৈশক্লাবের হামলায় নিহত হন ৪৯ জন থেকে শুরু করে প্যারিস শহরের উপকণ্ঠে একজন পুলিশ অফিসার এবং তার জীবনসঙ্গীর খুন হয়ে যাওয়া অথবা বার্লিনের ক্রিসমাস উৎসবের আগে ছুটির দিনের কেনাকাটায় হামলায় একজনমাত্র সন্ত্রাসীর আঘাতে ঘটে গেছে সমূহ বিপর্যয়। মনে হচ্ছে যাবতীয় সন্ত্রাসী হামলার মূলপরিকল্পনাকারী বহুদূরের বিলাসী স্থানে নিরাপদে অবস্থান করছে।
আমাদের এই সময়ে হোয়াইট হাউসে বসে যুক্তরাষ্ট্র সরকার নিবিড় পর্যবেক্ষণে ইসলামিক স্টেটের হামলার পরিকল্পনা চিহ্নিত করে নস্যাৎ করতে ব্যস্ত। সিরিয়ার কোন নিরাপদ গোপন স্থানে শারীরিকভাবে অক্ষত থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত এবং পরিচালিত ইসলামিক স্টেট তার সমস্ত সম্পদ, সামর্থ্য দিয়ে বিশ্বের যেকোন স্থানে জিহাদি হামলার ষড়যন্ত্র সমন্বয় করছে। অনলাইনের মাধ্যমে আকৃষ্ট করে বিশ্বের যেকোন প্রান্তে হামলা চালানোর সামর্থ্য ইসলামিক স্টেটকে দিয়েছে অনন্য ক্ষমতা এবং একই সাথে অন্যদের জন্য মাথা ব্যথার কারণ। অনলাইনের মাধ্যমেই ইসলামিক স্টেট দেশের সীমানা তছনছ করে দিচ্ছে। আমেরিকান বা ইউরোপের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে উদ্বাস্তু স্রোতের মাধ্যমে নয় বরং সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে বর্তমান সংখ্যাযুগের বিটস এবং বাইটসের মাধ্যমে।
অনলাইন এখন উদার পশ্চিমা বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য মাথা ব্যথার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথাকথিত একাকী হামলাকারী হয়ত সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্লেগের মত মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া ইসলামিক স্টেট বা অন্যকোন সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর নিয়োগ প্রক্রিয়া বা প্রচারণা ভিডিওচিত্র অথবা হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেইনের কারণে আকৃষ্ট হয়েছে। কিন্তু তারা যখন হামলা করতে গেছে তখন নিজেদের ইচ্ছাতেই গেছে। তখন কোন সন্ত্রাসী জঙ্গী সংগঠনের কোন নেতা তাকে সরাসরি নেতৃত্ব দেয় নি বা তার সাথে কেউ যোগাযোগও করেনি। তারা হয়ত কোন সন্ত্রাসী হামলার আহ্বানে সাড়া দিতেও পারে। যেমন; বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত ইসলামিক স্টেটের মুখপাত্র আবু মুহাম্মদ আল-আদনানি সবাইকে আহ্বান করে “রমজান মাসে প্রতিটি অবিশ্বাসী কাফেরদের উপর হামলা করে দুর্দশা সৃষ্টি করার তাগিদ দেয়।” কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের মত করে হামলার লক্ষ্য নির্ধারণ করে, বেছে নেয় পছন্দের অস্ত্র, ঠিক করে আক্রমণ করার সঠিক সময় এবং গণমাধ্যমকে নিজেদের ইচ্ছাতেই হামলার আদ্যপান্ত জানায় এবং দায় স্বীকার করে।
এইরকম আক্রমণ প্রক্রিয়া কি নতুন? হ্যাঁ নতুন তো কিছুটা বটেই। কিন্তু একইরকমভাবে বেশিরভাগ মানুষ চিন্তা করে না। ইসলামিক স্টেটই প্রথম একাকী নেকড়ের সন্ত্রাসবাদের ধারণা প্রচলন করে নি। হয়ত শুরু হয়েছিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে। আশার কথা হচ্ছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমই হয়ত অদ্ভুত এই ‘একাকী নেকড়ে সন্ত্রাসবাদ’ ধারণার সমাপ্তি ঘটবে।
বিশ্বের যেকোন স্থানের সন্ত্রাসী হামলার দায় স্বীকারের কারণ বুঝতে হলে বুঝতে হবে ইসলামিক স্টেট কীভাবে জিহাদি জঙ্গী সদস্য সংগ্রহ করে, তাদেরকে উগ্রবাদী করে তোলে এবং আমাদের তথ্য প্রযুক্তির ডিজিটাল যুগে তাদের গতিশীলতা টিকিয়ে রাখে। বুঝতে হবে কেন কিছু নির্দিষ্ট মানুষকেই উদ্দেশ্য করে প্রপাগান্ডা মেসেজ দেয়া হয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে সম্ভবত, ইসলামিক স্টেট সম্ভাব্য সদস্যকে অভয় দেয় এই বলে যে, তুমি একা নও। জিহাদের উদ্দেশ্যে হাতে মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র তুলে নিয়ে তারা বসে যায় ট্রাকের চালকের আসনে আর কোন উৎসব মুখরিত জনসমাবেশে মানুষের উপর চালিয়ে দেয় ট্রাক, কোন জনাকীর্ণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভিতরে চলে যায় প্রেসার কুকারের মধ্যে বোমা ভরে এবং তারা বৃহত্তর জঙ্গী গোষ্ঠীর সাথে একাত্ম হয়ে যায়। প্রতিটি জিহাদি হামলার সাথে সাথেই তারা পরিণত হয় ইতিহাসের অংশে, পত্রিকার পাতার শিরোনামে, তারা পরিণত হয় নিজেদের সামর্থ্যের থেকে বড় অংশের অংশীদার। যদিও তারা মূলত একা।
সব জঙ্গীই তার জঙ্গীগোষ্ঠীর এক একজন প্রচারক। ইসলামিক স্টেটের যখনই কেউ মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় তখন দেখা যায় সে ইসলামিক স্টেটের প্রচারণা করছে। প্রকৃতপক্ষে আমেরিকান জনগণ প্রথমবারের মত ইসলামিক স্টেটের ভয়াবহ নৃশংসতা দেখতে পায় ২০১৪ সালের আগস্টে প্রকাশিত একটা ভিডিও চিত্রে। সেখানে দেখা যাচ্ছে একজন ইসলামিক স্টেটের জঙ্গী জিহাদি খুনি ধারালো ছুরি দিয়ে আমেরিকান একজন জিম্মির কী অবলীলায় গলা কেটে ফেলছে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভিডিও প্রদর্শনীর মাধ্যমে ইসলামিক স্টেট সবার নজর কাড়ে। নৃশংসতার চর্চা এবং প্রদর্শনীই হলো ইসলামিক স্টেটের জঙ্গী জিহাদি সংগ্রহের মূল পরিকল্পনা এবং চালিকা শক্তি। এই পরিকল্পনার ভিন্ন দিকও আছে; সেটা হলো কোন গোষ্ঠীর প্রতি কেউকে মোহাবিষ্ট করে ফেলা। ইসলামিক স্টেট হলিউডি সিনেমার মত ঝকঝকে ছবি এবং নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে মানুষকে জবাই করার ভয়ানক ভিডিও প্রকাশ করে। জঙ্গী গোষ্ঠীটি মনে করে মানুষ হত্যার ভিডিওর সাথে বর্বরতা মিশালে তাদের মনোবল আরও বাড়বে। ইসলামিক স্টেটের কিছু অংশ স্থানীয়। পক্ষান্তরে সিরিয়ার কিছু শহরে বাস যুদ্ধ করে বিদেশী যোদ্ধা এবং তারা এখানে ভালো বাড়ি, নতুন নতুন নারী আর বিলাসী জীবনের স্বাদ পেয়েছে। সর্বোপরি জঙ্গীরা বৈশ্বিক জিহাদী গোষ্ঠীর অংশ হয়ে যায়। অর্থাৎ, কেউ যদি ইসলামিক স্টেটের খেলাফত গ্রহণ করে তবে সে বিশ্বের যেকোন প্রান্তে থেকেই ইসলামিক স্টেটের নাম ব্যবহার করতে পারবে এবং সে তৎক্ষণাৎ পেয়ে যাবে তার চারপাশে সমমনা জিহাদি ভাই, বোন আর স্থান পেয়ে যাবে ইতিহাসে।
ইসলামিক স্টেটের মোবাইল, ভিডিও বার্তা নিয়ে পর্যালোচনা করা খুব জরুরী। আমাদেরকে বুঝতে হবে ইসলামিক স্টেট তাদের ‘ভার্চুয়াল খেলাফত’ প্রচারের জন্য কেমন কৌশল বাস্তবায়ন করছে। লন্ডনের কিংস কলেজের সন্ত্রাসবাদ এবং উগ্রতা বিষয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী চার্লি উইন্টারের গবেষণা অভিসন্দর্ভ ছিল ‘ওয়ার স্টাডিজ’। তিনি চিহ্নিত করেছেন ছয়টি প্রলোভন দেখিয়ে সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলো তাদের কর্মী যোগাড় করে; সেগুলো হচ্ছে— নৃশংসতা, দয়া, ইসলাম তথা নিজেকে অত্যাচারিত এবং নিপীড়িত মনে করা, যুদ্ধ, একত্মতা এবং বেহেশত বা কল্পিত সব পেয়েছি রাজ্য। উইন্টার মনে করেন, পঞ্চম কারণ যথা ‘একত্মতা’ হলো সবচেয়ে শক্তিশালী পন্থা যা দিয়ে সর্বাধিক নতুন জিহাদিকে জঙ্গীদলে ভেড়ানো সম্ভব। বিশেষকরে পশ্চিমাদেশের যুবকেরা এই কারণেই আকৃষ্ট হচ্ছে। ইসলামিক স্টেটের নিয়মিত প্রকাশনা ‘দাবিকে’ প্রকাশিত ভিডিওচিত্র এবং ছবিতে ‘ইসতিরাহাত আল-মুজাহিদিন’ দেখানো হচ্ছে জিহাদিরা চা পান করছে আর সবাই মিলে গান গেয়ে অবসর যাপন করছে। এই প্রচারণা ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে খেলাফতের সদস্যদের ভ্রাতৃত্ববোধের ধারণা প্রকাশিত হয়েছে।
যারা একাকীত্বে ভোগে বা যাদের জিহাদ করার কোন সুযোগ নেই বা যারা প্রচলিত রাজনীতিতে দ্বিমত পোষণ করে বা যারা সমাজের চারিদিকের অসংগতিতে ভুগে ক্লান্ত তাদের জন্য ইসলামিক স্টেট নিয়ে এসেছে ভ্রাতৃত্ববোধ। তাদেরকে আর একাকী থাকতে হবে না। সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মী এবং থেরাপিস্ট শেন কাভানাউফ এবং মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের পর্যবেক্ষণকারী গিলাদ শিলোয়াক আমেরিকার গণমাধ্যম এবং প্রযুক্তি কোম্পানী ‘ভোকেটিভ’ কে জানায় ‘একাকী নেকড়ে’ সন্ত্রাসীদের জন্য নিবেদিত একটা ইসলামিক স্টেটমুখী একটা টেলিগ্রাম চ্যানেল আছে। একাকী নেকড়ের জন্য তারা ছোট পুস্তিকা বের করেছে। টেলিগ্রাম চ্যানেলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ইসলামিক স্টেট তার সদস্য জিহাদীদের জন্য বোমা বানানোর পদ্ধতির কায়দা কানুন সরবরাহ করে। ইসলামিক স্টেট বিশ্বজুড়ে শত শত হাজার হাজার সমর্থক এবং কর্মীদের নিয়ে গঠন করেছে ভার্চুয়াল জিহাদি গোষ্ঠী। এই ধরণের বৃহৎ জনগোষ্ঠী ভার্চুয়াল পেরিয়ে বাস্তবজগতে কীভাবে একটা সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা সাজাতে পারে সেটা জঙ্গীবাদে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক রুক্মিণী কালিমাচি নিউ ইয়র্ক টাইমসের ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ইসলামিক স্টেট নিয়ে একটা পডকাস্ট বানিয়ে নিপুণভাবে দেখিয়ে দেন। ইসলামিক স্টেটের উপর নির্মিত পোডকাস্টে দেখানো হয় ইসলামিক স্টেট মোটেও কোন ‘একাকী নেকড়ে’ বা বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন নয় বরং দূর দূরান্ত অবস্থানে থেকেও তারা সন্ত্রাসী হামলার ছক আঁকতে পারে। কালিমাচি নির্মিত তথ্যচিত্রের সাথে আমরা কিছু তথ্য যুক্ত করতে পারি। কিছুক্ষেত্রে একাকী নেকড়ে প্রকৃতপক্ষেই উর্ধতন জিহাদি নেতার কাছ থেকে সাংকেতিক ভাষায় কোন বিশেষ দিকনির্দেশনা পায়। এমনকি যে জিহাদি এরকম কোন নির্দেশনা পায় না সেও কিন্তু একাকী নয়, তারা নিজেরাও নিজেদেরকে একাকী মনে করে না।
অবশ্যই ইসলামিক স্টেট প্রত্যাশা করে একাকীত্বের অনুভূতি কাটিয়ে উঠে তার বাছাইকৃত কর্মীদের থেকে আরও বেশি বেশি অংশগ্রহণ। ইসলামিক স্টেট চায় সদস্যরা বিশেষ উপায়ে ত্রাস সৃষ্টি করে তাদের কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রা এগিয়ে নিয়ে যাক। এবং সেখান থেকেই ইসলামিক স্টেট নতুন কোন জনাকীর্ণ স্থানে যথা নিয়মে সন্ত্রাসী হামলার প্রস্তুতি নেয়। সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞগণ বহু আগে থেকেই কোন সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সরাসরি নির্দেশনায় হামলা বা অতি সম্প্রতি সাংকেতিক বার্তায় পাঠানো গোপন যোগাযোগের মাধ্যমে হামলা এবং কোন জিহাদির স্বপ্রণোদিত হামলার মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন। যেকোন সন্ত্রাসী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ দীর্ঘমেয়াদে যারা হামলায় অংশগ্রহণ করবে তাদেরকে বিশেষ কৌশলগত নির্দেশনা দিয়ে থাকে এবং সেসব নির্দেশ সাধারণত অপরিবর্তিত থাকে। কিন্তু যারা একাকী হামলায় অংশ নেয় তাদের উপর সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর নেতবৃন্দের কোন নির্দেশনা থাকে না।
কিন্তু ইসলামিক স্টেট সুনির্দিষ্ট করে ফেলেছে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তাদের কোন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে কীন নির্দেশনা দিতে হবে আর কতজন জঙ্গী প্রয়োজন হবে। তাদের নিয়মিত প্রকাশনা ‘রুমিয়াহ’ এবং অনিয়মিত প্রকাশনা ‘দাবিক’ ম্যাগাজিনে হামলার সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্ত নির্ধারণ করেছে। যেমন দাবিকের এক সংখ্যায় থ্যাংকস গিভিং ডে উৎসবের জন্য জনাকীর্ণ শপিংমল ম্যাসি’স এ হামলা চালানোর অঙ্গীকার করে, সহজেই বহনযোগ্য আগ্নেয়াস্ত্র এবং সহজে পাওয়া যায় এমন বিস্ফোরক ও দাহ্যদ্রব্য দিয়ে বাসায় বানানো বোমা ব্যবহার করতে বলে। কিন্তু একই সাথে ইসলামিক স্টেট তার নির্বাচিত জিহাদীদেরকে অতর্কিতে চোরাগোপ্তা উচ্চাভিলাষী হামলার পরামর্শ দেয়। তারা যেখানে আছে, হাতের কাছে যা আছে সেটাকেই সম্বল করে হামলা চালানোকে উৎসাহিত করে।
যেকোন নির্দেশনাই হোক না কেন বাস্তবায়নের জন্য ইসলামিক স্টেটের অনুগামী সমর্থক প্রয়োজন। কানাডার ওরল্যান্ডোর পালস নাইটক্লাবে হামলা চালানো ওমর মতিনকে হয়ত একজন আদর্শ জিহাদি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে কারণ নাইটক্লাবটিতে হামলা চালানোর জন্য কোন সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর কাছ থেকে নির্দেশনা লাগেনি। আজকে পর্যন্ত চলমান তদন্তে মতিন সম্পর্কে এমন কোন তথ্যই পাওয়া যায় না যা দিয়ে বোঝা সম্ভব যে, মতিন কোন সন্ত্রাস প্রবণ দেশে ঘুরতে গেছে বা কারো কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছে অথবা ইসলামিক স্টেটের উর্ধতন নেতার কাছে থেকে সে ব্যক্তিগত নির্দেশ পেয়েছে অথবা সে ১১ সেপ্টেম্বর হামলার সাথে একত্মতা বোধ করে। কিন্তু সন্ত্রাসী হামলার জন্য মতিনের কোন নির্দেশনার দরকার ছিল? যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, মতিন ইন্টারনেটে বিভিন্ন জিহাদী সংগঠনের উগ্রপন্থী প্রচার এবং তথ্য দ্বারা স্বপ্রনোদিত হয়ে হামলা চালিয়ে থাকতে পারে। শেষ পর্যন্ত, এটাই প্রমাণিত হয়, মতিনের শুধু এতটুকু নির্দেশনা দরকার ছিল যার মাধ্যমে সে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করতে পারে, কি উপায়ে হামলা করবে সেটা নির্ধারণ করতে পারে এবং অপেক্ষা করতে পারে একটা রাতে নাইটক্লাবে উৎসবমুখর পরিবেশে ঠাণ্ডা মাথায় ৪৯ জন নিরপরাধ মানুষকে খুন করতে পারে।
ইসলামিক স্টেটের মত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত হামলা হবে চারিদিকে অনেক পরিব্যাপ্ত এবং সংগঠিত এবং কখনোই হামলার সময় কোন অসামঞ্জস্যতা থাকবে না। মতিনের মত কেউকে সন্ত্রাসবাদে দীক্ষিত করতে যেটা দরকার সেটা হলো খুঁজে বের করতে হবে এই বিপুলা বিশ্বে বিপুল আয়োজনে মতিন নিজের মানসিক এবং সামাজিকভাবে একাকী বোধ করে কিনা। যদি একাকী না হয় না তাকে সামাজিকভাবে তার দুর্বলতম স্থানে আঘাত করতে হবে। সম্ভাব্য জিহাদিকে তার সামাজিক অবস্থান বুঝিয়ে বলতে পারলে বাস্তবে স্পষ্টতই হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হবে।
আমরা প্রায়ই শুনে থাকি ‘আপনঘরে বেড়ে ওঠা উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী’ যার মানে প্রাথমিকভাবে মনে হয় যেসব সন্ত্রাসীরা দেশের ভিতরে সন্ত্রাসী হামলা ঘটানোর আগে বিদেশী জঙ্গীগোষ্ঠীর কাছে প্রশিক্ষণ নিতে কখনো দেশের বাইরে যায় নি। কিন্তু আজকের দিনের এই ডিজিটাল দুনিয়ায় নিজের আপনঘরে বেড়ে ওঠা বলে সত্যিই কি কিছু আছে? রাকা এবং সিরিয়া হলো ইসলামিক স্টেটের বাজার। তারা রাকা এবং সিরিয়ার যুদ্ধাবস্থা সরাসরি কম্পিউটার আইফোনের মাধ্যমে অনলাইনে ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশে ঢাকার হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে বর্বর হামলা অথবা ফ্রান্সে নিস শহরের রাস্তায় সন্ত্রাসী হামলার দৃশ্য তারা পোস্ট দিয়ে দিচ্ছে ফেসবুক পেইজে, টুইটারে ফলে সমগ্র পৃথিবীবাসির মানুষ ইসলামিক স্টেটের কার্যক্রম দেখতে পাচ্ছে। মতিনের সবাই আপন ঘরের সন্ত্রাসী হিসেবে বেড়ে ওঠে না। কিন্তু তারা মনে করে তারা যেন বেড়ে উঠেছে রাকায় এবং তারা কানাডার ওরল্যান্ডো, সান বারনার্দিনো, বা ক্যাফোর্নিয়ার অথবা যে যেখানে আছে সেখানেই তাদের ভুল বাড়িতে থেকে সঠিক পরিচয়ের জন্য যুদ্ধে লিপ্ত।
ইসলামিক স্টেট প্রকৃতপক্ষেই ক্রমাগত এবং সুনির্দিষ্ট হুমকি। যে অবিশ্বাস্য গতি আর নিয়মকরে সন্ত্রাসীরা হামলা চালাচ্ছে তাতে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই নতুন হামলা এখন স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতেও এর থেকে আশু মুক্তির সম্ভাবনা নেই। অন্যান্য সন্ত্রাসীগোষ্ঠীদের সীমাহীন ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাকে ইতিপূর্বে পরাভূত করা গেছে এবং দূরদেশে গিয়ে হামলা পরিচালনা করার মত আগের সেই ক্ষমতা আর তাদের নেই। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য যে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান অঞ্চলে আল-কায়েদার এখন মুমূর্ষু অবস্থা। তারপর, ওবামা প্রশাসনের সতর্ক জিহাদি সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের কৌশলের গ্রহণের কারণে ইসলামিক স্টেট মসুল, ইরাক, সিরিয়া এবং লিবিয়ায় তাদের নিরাপদ আশ্রয়গুলোতে ক্রমেই দিশেহারা এবং কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল। সন্ত্রাসবিরোধী যৌথ সাঁড়াশি অভিযানে ইসলামিক স্টেট তাদের দখলকৃত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ইরাক এবং সিরিয়াতে শক্ত অবস্থান হারাচ্ছিল। একই সাথে তারা হারাচ্ছিল তাদের অধিকৃত ভূমি যেখান থেকে তারা ভার্চুয়াল প্রচারণা চালাতো।
ইতিমধ্যে আল-কায়েদা ইয়েমেন এবং সিরিয়াতে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামিক স্টেটের মত সমাজের একাকী বিষাদ্গ্রস্থ মানুষদের আকৃষ্ট করতে আধুনিক যোগাযোগমাধ্যম তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে। তাদেরকে আন্তরিক সামাজিক সম্পর্কের প্রলোভন দিচ্ছে। সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর নিজস্ব কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের লক্ষ্যে তাদেরকে অনুপ্রেরণা দেয় এবং তাদের মাঝে জিহাদের আগুন জ্বেলে দেয় যাতে হামলায় ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। যোগাযোগের আধুনিক প্রযুক্তি এখানে তাদের জন্য যথেচ্ছ। এবং ভবিষ্যতে যোগাগোগের ভিন্ন কোন রুপ দেখা দেবে তা এখনো আমরা জানি না। ইসলামিক স্টেটের আজকের সঙ্গকটময় হুমকি চিহ্নিত করে মোকাবিলা করা যায় তার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সেই সাথে অদূর ভবিষ্যতে যেসব জিহাদি জঙ্গীদলের প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে সেগুলো আগে থেকেই বুঝতে হবে এবং সমাধানের পথ বের করতে হবে। সরকারের সামনে এখন যৌথ হুমকি মোকাবিলা করে আমাদেরকে নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করা প্রধান দায়িত্ব এবং যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে জঙ্গীরা জিহাদি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে সেসব কোম্পানিকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো একত্রিত হলে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপেক্ষা বেশি কার্যকরি ফল পাওয়া যাবে। ইসলামিক স্টেট জিহাদিদের মনে যে মিথ্যা আন্তরিকতা, পরকালের লোভ এবং মালিকানার জন্ম দিয়ে ভয়ানক জঙ্গীবাদের চাষ করে সেটাকেই ধ্বংস করতে হবে।
যারা নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করতে গিয়ে অন্যের দেশের আলো বাতাস খেয়ে তাদেরকেই হত্যার টার্গেট করে সেই সকল বেয়াদবদের ঐ সকল দেশ থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে সৌদি আরব পাঠিয়ে দেয়া হোক। আমরা দেখতে চাই ইসলাম অন্ত প্রাণ সৌদি তাদের ভরণপোষণ ও নাগরিকত্বের দায়িত্ব নেয় কিনা।
অনেক পরিশ্রম লেখা এবং রেফারেন্স হিসেবে লন্ডনের কিংস কলেজের সন্ত্রাসবাদ এবং উগ্রতা বিষয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী চার্লি উইন্টারের গবেষণা অভিসন্দর্ভ ‘ওয়ার স্টাডিজ’ এর কথা উল্লেখ করেছেন। শিক্ষার্থী চার্লি বলেছেন ছয়টি প্রলোভন দেখিয়ে সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলো তাদের কর্মী যোগাড় করে; বাংলাদেশের বিভিন্ন সন্ত্রাসীদের পারিবারিক পটভূমি বিশ্লেষণ করে মনে হয়েছে অর্থের লোভও আরেকটি কারণ।