রমেল পড়ে আছে মর্গে
রমেল চাকমার মৃত্যুর সঠিক তদন্ত হোক। বিচার হোক। সর্বত্র হোক তীব্র প্রতিবাদ। কিন্তু এ ঘটনায় আবেগ বর্জিতভাবে আমাদের বোধহয় কয়েকটি পয়েন্ট মনে রাখা দরকার।

অভিযোগে প্রকাশ, নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনে নান্যাচর কলেজ ছাত্র রমেল চাকমা গত ১৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। এর আগে ৫ এপ্রিল রমেল চাকমাকে নিজ হেফাজতে নিয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনী।

এই দীর্ঘ সময়েও রমেল চাকমা নির্যাতনের অভিযোগ ও পরে তার মৃত্যুর কারণ মূল ধারার মিডিয়াতে প্রকাশ পায়নি। তবে দু-একটি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক অনলাইন ও ফেসবুকে বিষয়টি সীমিত পরিসরে আলোচনা তুলেছে।

সাথীর সঙ্গে দ্বিমত
মিডিয়ার খবরে রমেল চাকমা নেই কেন, এর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী, স্নেহাশীষ মুক্তাশ্রী চাকমা সাথী ফেসবুক নোটে দুটি পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন, এক. পাহাড়ের সাংবাদিকরা হয়তো নিরাপত্তা জনিত কারণে খবরটি করেননি, দুই. অথবা তারা সংবাদটি ঢাকা অফিসে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু অফিস এটিকে সংবাদ হিসেবে গুরুত্ব দেয়নি।

সাথী বেশ কিছুদিন মূল ধারার মিডিয়াতে পার্বত্য সংবাদসহ আদিবাসী বিষয়ক সংবাদ করেছেন।এখনো আদিবাসী বিষয়ক সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সঙ্গে জড়িত। তার সঙ্গে বিনীতভাবে দ্বিমত করেই বলছি, ওই দুটি ঘটনার কোনটিই হয়তো সঠিক নয়।

নিজেও বহু বছর থেকে পাহাড়ে, বনে, বাদাড়ে ঘুরে পার্বত্য সংবাদ করে চলেছি। তাই পর্যবেক্ষণ থেকে বলছি, পাহাড়ের সাংবাদিকরা সব সময়েই ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকতা করেন।

তাহলে রমেলের প্রশ্নে তারা পিছু হটবেন কেন? আর মিডিয়ায় “যথাযথভাবে উপস্থাপিত” হলে, একজন কলেজ ছাত্রের নির্যাতন ও মৃত্যুর খবর প্রকাশ না হওয়ার কারণ নেই।

বরং রমেল সংবাদ মূল ধারার মিডিয়ায় না আসার সম্ভাব্য জোরালো কারণ এই যে, এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত অভিযুক্ত নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। ঘটনার সঙ্গে পুলিশ জড়িত থাকলেও প্রায়শই তারা এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে চান না। অর্থাৎ “যথাযথভাবে উপস্থাপিত” না হওয়ায় রমেল সংবাদ মূল ধারার মিডিয়ায় একপেশে অভিযোগের ভিত্তিতে খবরটি হয়তো আসেনি।

নিজে টিভির সাংবাদিক বলে জানি, টেলিভিশনে এ ধরণের সংবাদ করা আরো কঠিন। অভিযোগকারী (নিহতর পরিবার), পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী, সম্ভব হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অন দা রেকর্ড বক্তব্য ছাড়া টিভিতে এমন সংবাদ করা যায় না। আর সব মিডিয়ার মধ্যে টিভিই সবচেয়ে শক্তিশালী মিডিয়া।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, বছর ছয়েক আগে বেগমগঞ্জে পুলিশ গণপিটুনি দিয়ে এক কিশোরকে মেরে ফেলতে উৎসাহিত করেছিল।বাজারের ভেতর শত শত উন্মত্ত জনতা কিশোরটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। পুরো ঘটনাটি মোবাইলে ভিডিও করে রেখেছিলেন এক ব্যক্তি।

পরে এই ভিডিও ক্লিপিং এর সূত্রে পুলিশের বক্তব্যসহ বিস্তারিত খবর প্রচার করে সময় টিভি। সেখান থেকে আবার প্রথমালোসহ শীর্ষ সংবাদপত্রগুলো এই খবরটি পরদিন প্রচার করে। অর্থাৎ লাইভ ভিডিও ক্লিপিংই এ ক্ষেত্রে ঘটনার প্রমান। …

কল্পনা চাকমা থেকে সোহাগী জাহান
সাথীর নোটে কল্পনা চাকমার কথা এসেছে। সোহাগী জাহান তনুর কথা আসেনি। কল্পনা অপহরণ ও তনু হত্যার নেপথ্যে নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত বলে জোর অভিযোগ।

রাঙামাটিতে হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী কল্পনা চাকমাকে নিরাপত্তা বাহিনী ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অপহরণ করার পর পরই কিন্তু সংবাদটি সেভাবে মিডিয়ায় প্রকাশ হয়নি। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পাহাড়ি গণপরিষদ পাহাড়ে হরতাল, অবরোধসহ টানা আন্দোলন করলে, সেষব রাজপথের সংবাদ প্রকাশের সূত্রে কল্পনা চাকমা অপহরণের খবর প্রকাশ পায়। পরে ঢাকা থেকে আমি, প্রিসিলা রাজ, মূর্শেদ আলী খান, শাহিন আখতার, সাগর সারোয়ার, মনির হোসেন লিটনসহ আরো কয়েকজন সরেজমিন অনুসন্ধান করার পর মিডিয়ায় খুব বড় করে কল্পনা চাকমা অপহরণের খবর প্রকাশ পায়।

এরপর কল্পনা চাকমা পরিনত হন আন্তর্জাতিক সংবাদে। বলা ভাল, কল্পনা চাকমাই এখন পার্বত্য মানবাধিকার পরিস্থিতির অপর নাম। কিন্তু এতো বছরেও এ অপহরণের বিচার হয়নি।

আর গত বছর ২০ এপ্রিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ ময়নামতি সেনা নিবাসের ভেতর রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তনুর সহপাঠিরা লাগাতার আন্দোলন গড়ে তুললে সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ঢাকাসহ সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অভিভাবক, শিক্ষক, জনতাও যোগ দেন এই আন্দোলনে। এমন আন্দোলন কখনো দেখেনি বাংলাদেশ।

এরপরের ঘটনা কমবেশী সকলেরই জানা, আন্দোলনের সূত্রেই পুলিশ নড়েচড়ে বসে। দুইবার ময়না তদন্ত হয় তনুর মরদেহের। মানবাধিকার কমিশন তদন্ত করে জানায়, সেনা নিবাসের ভেতর হত্যাকাণ্ড ঘটলেও হত্যার বেশকিছু আলামত নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। তারপর পুলিশ জেরার মুখোমুখি করা হয় নিরাপত্তা বাহিনীর দুজন সদস্যসহ বেশকিছু বেসামরিক ব্যক্তিকে। এরপর যখারীতি “জোর পুলিশী তদন্ত চলিতেছে”, তনু হত্যারও বিচার হয়নি।

কল্পনা ও তনুর ঘটনাই প্রমান করে, হত্যা-অপহরণের মতো গুরুতর অপরাধের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত বলে অভিযোগ উঠলে তার সুবিচার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সারা বাংলাদেশের চিৎকারেও শাসকগোষ্ঠীর টনক নড়ে না।

হোক কলরব
রমেল হত্যার বিচারের দাবিতে পিসিপি খাগড়াছড়িতে মিছিল করেছে বলে অনলাইন মিডিয়ায় দেখেছি। আসলে আরো জোর প্রতিবাদ ছাড়া মিডিয়ার তথা পুরো বাংলাদেশের নজর কাড়া মুশকিল। আমরা এমন একটি দেশে বাস করছি, এখনে সুবিচার চাইতে গেলে অনুনয় করতে হয়, ধর্ণা দিতে হয়। এটিই নির্মম বাস্তবতা। এর বিকল্প পথই হচ্ছে প্রতিবাদ। আন্দোলনের চাপে সরকার বাহাদুর যদি নড়েচড়ে বসেন!

আর কে না জানে, মিডিয়া কিছু “হোলি কাউ” বা ধর্মের ষাঁড় তৈরি করেছে। এর মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনী ও আদালত হচ্ছে শীর্ষে।

রমেল চাকমার মৃত্যুর খবর প্রধান সারির মিডিয়ায় এলো না কেন, সে বিষয়ে পাহাড়ের সাংবাদিকরা কি বলেন, তা-ও জানতে চাই, বিতর্ক হোক। হোক কলরব।

বটম পয়েন্টে:
ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা/ রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা!

দেখুন: “নান্যাচরে সেনাবাহিনীর নির্যাতনে গুরুতর আহত এইচএসসি পরীক্ষার্থী রমেল চাকমার মৃত্যু!”
http://www.dailycht.com/news/details/bangladesh/37220

‘সেনাবাহিনী কিছু লাকড়ি আর তেল দিয়ে দাহ করেছে, পরিবারের কাউকে ডাকেনি’
http://www.bbc.com/bengali/news-39685049